ডুমুরের ফুল ৩৯.
শাম্মী চায়ের কাপ জাদিদের সামনে ধরে রেখে জিজ্ঞেস করল
– চা খাবে?
জাদিদ অন্যমনস্ক থাকায় শাম্মী কী বলছে শুনতে পারেনি।
জাদিদ কোনো উত্তর দিচ্ছেনা বুঝতে পেরে শাম্মী আবার বলল
– জাদিদ তোমার কী হয়েছে বলোতো? সেই কোন সময় থেকে মুড অফ করে বসে আছো। কারণটাও বলছো না আর কিছু খাচ্ছোও না। শাহীনের সাথেও বাজে বিহেভ করেছো। জাদিদ!
শাম্মী জাদিদের কোনো ভাবান্তর না দেখে দুষ্টু বুদ্ধি আটলো৷
শাম্মী জাদিদের কপালে চুমু দিয়ে প্রায় দৌঁড়ে পালালো।
জাদিদ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে বসে রইলো।
রেহান ফ্রেশ হয়ে রিসোর্টের রুম থেকে বের হলো। শাহীন কুমিরের মতো ঘুমাচ্ছে। ঘুমানোর আগে তার অনেক মন খারাপ ছিলো। জাদিদ তার সাথে বাজে বিহেভ করেছে। এতোটা বাজে বিহেভ কখনোই করেনা সে। রেহান অবশ্য তেমন কিছুই বলেনি। আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সে বিমোহিত। ডিএসলার ক্যামেরা নিয়ে সে সাজেকের লুই সুই গ্রামে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলো।
মিম্মা আর হেমলতার দুপুরের খাবারের জন্য দেরি হয়ে গেছে। সবাই আগে আগে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজ নিজ প্ল্যান অনুযায়ী বের হয়ে পড়েছে। হেমলতার মন তখনও খারাপ। মিম্মা এটা সেটা বলে চেষ্টা করছে মন ভালো করার জন্য। দুপুরের খাবার মেন্যুতে সাদা ভাত, আলু ভর্তা, কচি বাঁশের কোরল, মুরগির মাংস আর পাতলা ডাল। মিম্মা নাক ডুবিয়ে খেলো। হেমলতা ভাত নাড়াচাড়া করেই উঠে গেলো।
রিসোর্টে ফিরে মিম্মা তার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। হেমলতা এপাশ ওপাশ করতে করতে বিছানা থেকে উঠে রুম থেকে বের হয়ে পড়লো।
হঠাৎ করে মনের অস্থিরতা বেড়ে গেছে। কমছেই না। মন বলছে জাদিদ আশেপাশেই কিন্তু জাদিদের এখানে আসার কথা না। জাদিদ ব্যস্ত তার নতুন জীবনে। যে জীবন পাওয়ার আশায় তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল জাদিদ।
সেদিনের সন্ধ্যায় জাদিদ তাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে জাদিদের কান্না থামিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে হেমলতা বাসায় ফিরে আসে। তারপর থেকে জাদিদ হুটহাট তাকে ফোন দিয়ে দেখা করার জন্য নিয়ে আসতো। হেমলতা মিথ্যা কথা বলে বাসা থেকে বের হতো।
জাদিদ ঢাকায় চলে যাবার বেশ কিছু দিন পরে নানী তাকে ডেকে নিয়ে গেলো তার রুমে৷ হেমলতার বাবাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন৷
মিসেস জয়নাব রূঢ় স্বরেই বললেন
– ছেলেটা কে?
হেমলতা ভয়ে কাঁপছিল। টেনে টেনে বলল
– কো….ন ছেলে নান…নী?
– যেই ছেলের সাথে তোমাকে যেখানে সেখানে অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখা যায়?
– তোমার ভুল হচ্ছে নানী।
মিসেস জয়নাব ঝাড়ি দিয়ে বললেন
– একদম মিথ্যা বলবিনা৷ মেরে এখানেই পুতে রাখবো৷ আমি নিজ চোখে দেখেছি ঝাকড়া চুলের ছেলের সাথে তোকে।
হেমলতা ভয়ে তরতর করে ঘামতে শুরু করেছে।
মনোজ মিসেস জয়নাবের কথায় হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
– আম্মা, হয়েছে কী? আমাকে বলবেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
– মনোজ তোমার মেয়ে এক বখাটে ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়।
হেমলতা ভয়ে ভয়ে বলল
– নানী ও মোটেও বখাটে ছেলে না।
জয়নাব হুঙ্কার ছেড়ে বললেন
– তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। আমি বেশ আগেই তোমাকে ওই ছেলের সাথে দেখেছি। ওরকম বখাটে ছেলের হাতে আমি আমার নাত্নী দিবোনা।
মনোজকে উদ্দেশ্য করে বললেন
– তোমার কথা মতো দিছিলাম ওকে কোচিং-এ। কী লাভ হলো? উল্টো সে মাখামাখি করে বেড়ায় বখাটে ছেলের সাথে। আমি সুপাত্র খুঁজে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। তার পরশুদিন আসবেন। একবারে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে যাবেন। এরকম বাজে মেয়ের জন্য আমি অনুষ্ঠান করতে পারবোনা।
হেমলতা তখন কিছুই বলতে পারেনি। রাতে জাদিদকে সব জানানোর পরে। জাদিদ ঢাকা থেকে চলে এলো। মিসেস জয়নাবের পা পর্যন্ত ধরে অনুরোধ করেছিল জাদিদ৷ কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি৷ হেম বিয়ের দিন সকালে পালিয়ে জাদিদের বাসায় উঠে এসছিল। কিন্তু জাদিদ বাসায় ছিলো না। জাদিদের দাদী সরাসরি জানিয়ে দিলেন
– জাদিদ ঢাকায় চলে গেছে।
হেম জাদিদের নতুন মায়ের মোবাইল দিয়ে জাদিদের নাম্বারে ফোন করলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ। হেম জাদিদের বেডরুমে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে বারবার জাদিদের নাম্বারে ফোন করতে লাগল কিন্তু ফোন সুইচড অফ। জাদিদের নতুন মায়ের কাছে মোবাইল ফিরিয়ে দিয়ে হেমলতা তার বাসায় ফিরে গেলো। সন্ধ্যায় হেমলতার বিয়ে হয়ে গেলো মনিরের সাথে। মিম্মা বসার রুমের এক কোণায় বসে চুপচাপ হেমের সাইন করা দেখছিল। তার কিছুই করার মতো ছিলো না। মনোজ আর জয়নাব ওকে সকাল থেকে নজরদারি করে রেখেছিল যেন কোনোভাবেই হেমকে হেল্প করতে না পারে।
হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে হেম একটা হোটেলের সামনে এসে দাড়ালো। সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো হেম। চোখ দুটি বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বাম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে নিচ্ছে বারবার। এভাবে জাদিদের সাথে তার দেখা হবে ভাবতেই পারেনি। ঝাকড়া চুলের মোটা চশমা পরা ধবধবে ফর্সা চেলেটা ঠিক আগের মতোই আছে। শুধু ঠোঁট জোড়ায় কালো রঙের ছাপ লেগে গেছে। স্মোক করার ফলাফল।
জাদিদ হেমের কাছাকাছি এসে নিরলস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল
– কেমন আছো?
হেম বলল
– ভালো। তুমি কেমন আছো?
– এইতো আছি। তোমার হাজবেন্ড কই?
হেমের উত্তরের অপেক্ষা না করেই জাদিদ বলল
– রুমে বুঝি?
হেম ঘাড় নাড়লো।
জাদিদ আর কিছুই বলল না। পাশ কাটিয়ে চলে এলো রুমে। মিম্মাকে দেখার পর থেকে অসহ্য লাগছিলো সবকিছু। রুমে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলো জাদিদ। অনেক সময় যাবত এই কান্নাটাই আটকে রেখেছিল সে। হেমের চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। শরীরেও এসেছে। একজন বিবাহিত মেয়ের যেমন পরিবর্তন আসার কথা ঠিক তেমনই।
অতীত যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন মানুষের কিছু করার থাকেনা চোখের নোনাপানি আটকে রাখার চেষ্টা ছাড়া।
চলবে…..
~ Maria Kabir