“ভালোবাসার প্রান্ত”(পর্ব-২০)
পনেরো মিনিট ধরে বারান্দায় হাটছি আর ভোর হবার প্রহর গুনছি। ব্যাথা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। কী তুচ্ছ মানুষের জীবন! আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি অথচ কাল কোথায় থাকবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আজ আমার পাগলটা শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে কাল এই সময়ে আমিহীন সে কেমন পাগলামি করবে তা আল্লাহই জানেন। আমিই বা তাকে ছেড়ে কেমন করে থাকবো? মরণের পরের জগৎটা কেমন হয়? সেখানে গিয়ে কী আমার এই ভালোবাসা মাখা মধুর স্মৃতিগুলো মনে থাকবে? আমি চাইলেই কী আমার টুনটু পাখিকে দেখতে পাবো? চাইলেই কী সীমান্তর স্বপ্নে এসে রোজ তাকে ছুঁয়ে দিতে পারবো?
আর ভাবতে পারছি না, আমার বুকটা চেপে আসছে।
__এতরাতে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন সোনাবউ?
সীমান্তর কথায় চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালাম। সে উৎকন্ঠা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নির্বাক থাকলেও আমার পেটব্যাথা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে যা আমার চোখেমুখে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ফেলেছে অলরেডি। আমি কিছু বলার আগেই সে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে বলল-
__তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন? তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? কী হয়েছে বলো? চুপ করে কেন আছো?
তার অসহায় চাহনি আর অস্থিরতা আমার গলার স্বর আটকে দিলো। কেমন করে বলবো যে, আমার ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে? শুনেই তো সে ভয় পেয়ে যাবে। কিন্তু বলতে তো হবেই। তবুও আমি বলতে পারছি না।
সে আরও অস্থির হয়ে বলল-
__চুপ করে আছো কেন? বলো কী হয়েছে? আমার টেনশন হচ্ছে অস্থির লাগছে সোনাবউ। প্লিজ চুপ করে থেকো না!
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/
আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
__আমার পেটব্যাথা করছে সাহেব।
সে ভীত চোখে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল-
__কিহ? এতক্ষণ আমাকে ডাকোনি কেন? কখন থেকে ব্যাথা শুরু হয়েছে?
আমার এতটাই হাসফাঁস লাগছে যে, না দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি, না কথা বলতে পারছি। এতক্ষণ অবশ্য এতটা খারাপ লাগেনি। স্বামী বড্ড বিস্ময়কর জিনিস, এতটাই ভরসার স্থান এটা যে, তার সামনে পৃথিবীর সব স্ত্রী যেন অবলীলায় আহ্লাদে রোগী হয়ে যায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। তার আদরেই যেন আমি স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে গেলাম মুহূর্তের মধ্যেই। এজন্যই আমি বারবার বলি, “তুমি আমার সুখের চেয়েও বড় অসুখ রাজাসাহেব।”
হঠাৎ মনে হলো, যেসব স্ত্রীরা স্বামী সোহাগী নয় তারা এই ব্যাথামাখা সুখের স্বাদ থেকে চির বঞ্চিত। তারা কখনও হয়ত জানেই না যে, সুখের চেয়েও বড় অসুখের সুখটা আসলে কেমন হয়।
সীমান্ত আমাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সবাইকে খবর দিলো। নাটোরেও খবর পাঠানো হয়েছে। তারা আসছে। বাড়িতে এক রকম হৈচৈ শুরু হয়ে গিয়েছে। সবাই কেমন অস্থির চোখমুখ নিয়ে ছুটাছুটি করছে। মামনি আমাকে ভরসা দিয়ে চলেছেন। আর সীমান্ত একদম নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। যেখানে যা ফোন করার সব বাবা আর নানান করছেন। সীমান্তর যে মাথা কাজ করছে না তা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। আমি তার হাত ধরে বললাম-
__একটুও টেনশন করো না। আমি ঠিক ফিরে আসবো। স্বর্গের মতো আমার এই ঘর ছেড়ে আমি কোথায় যাব বলো তো?
সীমান্ত কিচ্ছু বলল না। শুধু টপটপ করে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি ম্লান হেসে বললাম-
__এই পাগল ছেলে, তুমি না ডাক্তার! ডাক্তার কখনও এত ভীতু হয়?
এবারও সে কিচ্ছু বলল না। কিন্তু তার টুনা মন যেন বলে উঠলো, “ডাক্তারদেরও একটা দূর্বল স্থান থাকে। সেই স্থানে আঘাত লাগার ভয়ে তারাও আতঙ্কিত থাকে। এসব তুমি বুঝবে না সোনাবউ।”
আমি তার টুনা মনের সব কথা কী করে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। মানুষটা বাহিরে যতটা কাতর হয়ে আছে তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভেতর ভেতর কাতর হয়ে আছে। তাকে সান্ত্বনা দেবার যুক্তিযুক্ত ভাষা আপাতত আমার কাছে নেই। ব্যাথায় আমার সবকিছুই এলোমেলো লাগছে।
মুহূর্তের মধ্যেই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। অলরেডি কল করে ওটি রেডি করতে বলা হয়েছে। আমাকে এখন ওটিতে ঢুকানো হবে। এরপর কথা বলার আর সুযোগ নেই। সীমান্তর অস্থিরতা কেউ থামাতে পারছে না। বাবা মামনি নানান নানুন বড় আব্বু বড় আম্মু আপি কেউই যেন তাকে সামলে উঠতে পারছে না। জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক এবং করুণ মুহূর্তে আছি আমি। নিজের জীবনের আশঙ্কার চেয়ে স্বামীর এই করুণ অসহায় পরিস্থিতি আমাকে চুরমার করে ফেলছে। আমি খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক করে তাকে আমার কাছে ডাকলাম। আমার ডাক্তার স্বামী রাজ্যের ভয় আতঙ্ক সব চোখেমুখে মেখে নিয়েছে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। সে আমার দিকে ঠিকমতো তাকিয়ে থাকতেই পারছে না। চোখের জল মুছতে মুছতেই যেন সে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে আমি যেন গভীর ভাবে উপলব্ধি করছি, আমি যদি সত্যিই ফিরে না আসি? আমার ভেতরটা মুচড়ে উঠলেও আমি তা ভেতরেই রাখলাম। ব্যাথায় আমার চোখমুখের অবস্থাও ভালো না। সে একটা হাত দিয়ে আমার ডান হাতটা ধরলো। আরেকটা হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে চলেছে। আমি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললাম-
__একদম শান্ত হয়ে যাও। আমার কিচ্ছু হবে না পাগল ছেলে।
যদি ফিরতে না পারি সেক্ষেত্রে যে তাকে কিছু উপদেশ দিয়ে যাব সেই সাহসও নেই আমার।
সে কাঁন্নায় ভেঙে পড়ে কোনো কথাই বলতে পারলো না। আমি তার চোখ মুখ নাক ঠোঁট হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিয়ে বললাম-
__আমি যাচ্ছি সাহেব।
সে চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল-
__যাচ্ছি মানে? কতদিন না বলেছি, যাচ্ছি বলবে না? বলো, আসি।
আমি নির্বাক তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল-
__আমাকে ছুঁয়ে কথা দাও তুমি ফিরে আসবে! তুমি কিন্তু শপথ করেছিলে যে, আমরা সহমরণে যাব। এখন কথা দাও!
বাড়ির সবাই নিশ্চুপ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে লজ্জা পাবার অবকাশ নেই আমার। সত্যিই ফিরতে পারবো কী না জানি না তবে এখন আমাকে যে কথা দিতেই হবে। বললাম-
__কথা দিচ্ছি ফিরে আসবো তোমার বুকে। আর শোনো!
কথাটা বলেই আমি থেমে গেলাম। সেও থমকে গিয়ে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। আমি রাজ্যের মায়া মমতা ঢেলে বললাম-
__আমি তোমায় ভালোবাসি সাহেব।
আমার কথা শুনে সে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁন্না জুড়ে দিলো। মামনি সীমান্তকে জড়িয়ে ধরে বলল-
__বাবুসোনা সে ঠিক ফিরে আসবে, তুই এমন করে ভেঙে পড়লে ওর প্রেসার ঠিক থাকবে না। একটু শান্ত হ!
সীমান্ত কাঁন্না জড়ানো সুরে বলল-
__মামনি আমি নিজেকে বিগত নয় মাসে বুঝিয়েই উঠতে পারিনি। সে কেন এমন একটা ভয়ানক পরিস্থিতিতে আমাকে ফেলল? আমি কত অনুরোধ করেছি তাকে, বেবি কন্সিভে তার জীবনে ঝুঁকি আছে। সে শুনলোই না। মা হবার বাসনা আজ আমাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে দেখো! ওর কিছু হলে আমার এই দূর্বল হৃদপিন্ড তা নিতে পারবে বলো? নিষ্ঠুর মেয়েটা আমাকেও শেষ করে দিলো।
⭐
ওটি রেডি। প্রেফেসর ম্যাম আমার ওটি করবেন। সাথে তানিও আছে। সীমান্তও থাকতে চাইছে কিন্তু বাবা মামনি রাজী নন। রোজ অসংখ্য অপারেশন করা সার্জারী বিভাগের ডাক্তার নিজের স্ত্রীর অপারেশন করতে তার হাত শুধু নয় তার হৃদপিন্ডও কাঁপছে। সে সবার কথা অমান্য করে ওটির ভেতরে ঢুকে আমার হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে বারবার বলছে-
__ভয় নেই সোনাবউ, তোমার কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো!
আশঙ্কা আকাঙ্ক্ষা আর আনন্দের ত্রিমুখী সংঘর্ষে সে একদম ক্ষতবিক্ষত। বৈশাখের ঝড়ো হাওয়ার মতোই ছিন্নভিন্ন তার ভেতর বাহির। আমার ভয় আমি মরে যাব এটা নিয়ে নয়। আমার ভয় আমার মন্দ কিছু হয়ে গেলে এই মানুষটা একদম মেন্টালি পাগল হয়ে যাবে। কে সামলাবে তাকে? অথবা এরচেয়েও ভয়ানক কিছু ঘটতে পারে যা আমি ভাবতেই পারছি না। আমার চোখ তুলা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে, কিছুই দেখতে না পেলেও সবই শুনতে পাচ্ছি। আমি টের পারচ্ছি সে অবিরাম চোখ মুছে চলেছে।
সে ম্যামকে বললেন-
__আমার সন্তানকে আমিই প্রথম স্পর্শ করবো ম্যাম। এটা আমার রিকুয়েস্ট।
সীমান্ত আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সরে গেল। কিছুক্ষণ পর বাচ্চার আওয়াজ কানে এলো। একজন নার্স বললেন-
__স্যার বেবির শরীর থেকে রক্ত মুছে দিই। রক্ত তো আপনার শার্টে লেগে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে।
সীমান্ত কাঁন্না জড়ানো স্বরে বলল-
__এটা আমার সন্তান, সে সৃষ্টি হয়েছেই তো আমার রক্ত থেকে। তার শরীরের এই রক্ত আমার একটা শার্টে শুধু নয় শত শত শার্টে লাগলেও ক্ষতি নেই। এটা আমার সন্তান, আমার ছেলে, আমার প্রান্ত।
আমার চোখ থেকে তুলা সরিয়ে দিয়ে সীমান্ত আমার কাছে দাঁড়িয়ে বলল-
__আমার ছেলে, আমার প্রান্তকে দেখো সোনাবউ, অবিকল আমার মতো দেখতে হয়েছে।
সদ্য হওয়া সব বাচ্চাদের চেহারা একই রকমের লাগে। জানি না সে কোথায় নিজের সাথে মিল পেল! আমার ছেলেটা কেমন শান্ত হয়ে বাবার বুকে মিশে আছে। আমি হাসলাম। আমার ভেতরটা প্রাণ খুলে হাসছে। আমি আমার স্বামীকে বাবা বানাতে পেরেছি। এই বংশে একটা প্রদীপ জ্বালাতে পেরেছি। আমার জীবনের প্রথম ইচ্ছে ছিল সীমান্তকে নিজের করে পাওয়া। আর দ্বিতীয় ইচ্ছেটা আজ পূর্ণ হলো। হঠাৎ শরীরটা যেন শীতল শক্ত হয়ে আসছে। দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আমি নিষ্পলক দেখছি সীমান্ত প্রান্তকে কোলে নিয়ে চোখভরা জল নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে আমার ঝাঁপসা দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে গেল। আমি আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার ছেলের কাঁন্নার আওয়াজের সাথে শুনতে পেলাম সীমান্তর ভীত স্বরের একটা ডাক “সোনাবউ।”
তবে কী আমি আমার কথা রাখতে পারবো না? কী হবে আমার সীমান্তর? কেমন করে সে নিজেকে সামলে নেবে? পৃথিবীর সব রঙ, সব শব্দ নিমেষেই থেমে গেল। আমি শেষ প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ আমার স্বামীর জীবনের জন্য আমাকে আয়ু দান করুন!
পরের পর্ব আসছে…
বিঃদ্রঃ গল্পের কাহিনী এবং চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে গল্প কখনোই মিলবে না। জীবন কখনও গল্পের মতো সাজানো গোছানো হয় না। গল্পটা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য লেখা হয়েছে তাই বিতর্কিত মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।
Written by- Sazia Afrin Sapna
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
▶ লেখকদের জন্য পুরষ্কার-৪০০৳ থেকে ৫০০৳ মূল্যের একটি বই
▶ পাঠকদের জন্য পুরস্কার -২০০৳ থেকে ৩০০৳ মূল্যের একটি বই
আমাদের গল্পপোকা ফেসবুক গ্রুপের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/