ওবাইদুলের পকেটে কুড়ি টাকা টিপস ঢুকিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এলাম। শ্যামলী যেতে হবে। কুঁড়ি টাকা বাস ভাড়া কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভরপেট খাওয়ার পরে পকেটের অবশিষ্ট কুড়ি টাকা এখন ওবাইদুলের পকেটে। আমার পকেটে রেস্টুরেন্ট থেকে আনা একটা টুথপিক ছাড়া অন্য কিছু নেই।
.
“ভাই ভাড়াডা দেন….”
বাসের সুপারভাইজার ভাড়া চাইতে এসেছে। লোকটার কথার সুর শুনে মনে হলো দেশের বাড়ি বরিশাল। আমি একটু অন্যদিকে চোখমুখ ঘুরিয়ে আবার তার দিকে ফিরলাম। লোকটার আঙুলের ফাঁকে পাঁচশ, একশ, দুইশো, দশ, বিশসহ সবরকম টাকার নোট। আমি তার দিকে যথা সম্ভব খুশী হবার ভঙ্গিমা করে বললাম- “আপনার বাড়ি বরিশাল না?” লোকটা আমার দিকে একটু আড় চোখে তাকালো, আমিও চোখ উল্টে নিজেকে দেখতে চেষ্টা করলাম, এক্সপ্রেশন ঠিক আছে কিনা!
সুপারভাইজার বললো “হ মোগো বাড়ি রহমতপুর। আমনে জানলেন কেমনে?” লোকটা বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান লোকদের সহজে অনেক কিছু বোঝানো যায়।
“আপনার মনে আছে? সেবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মিছিলে আপনি শ্লোগান দিয়েছিলেন।”
“কিযে কন দাদো, হেইয়া মনে থাকবে না! হাকিম্মার লইগ্যা কত কষ্ট করলাম। কিন্তু জিতাইতে পারলাম না।” খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন সুপারভাইজার। আমিও ছেড়ে দিব না। আরও আলাপ বাড়ালাম। “কয় ছেলে-মেয়ে, কে কোন ক্লাসে পড়ে, বাড়িতে কবে গিয়েছিলেন……”আমি একটার পর একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম সে উত্তর দিলো। ওইযে লোকটা বুদ্ধিমান, বুদ্ধিমান লোকেরা সবকিছু জানে। আপনি তাদের যা জিজ্ঞেস করবেন সাথে সাথেই উত্তর পাবেন, তবে উত্তর ভুল হলে সেটা তার দোষ না!
গল্প যখন খুব জমে উঠেছে আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম যান ভাড়া কেটে আসেন। আপনার সাথে আরো অনেক কথা বাকি। তিনি খুশী মনে ফটাফট ভাড়া কেটে আসলেন। কিন্তু গাড়ি ততক্ষণে শ্যামলী। আমি তার কাছথেকে ফোন নাম্বার নিয়ে নিলাম বাকি কথা কোনো একদিন বলার জন্য। বাস থেকে নেমে মনো পড়লো লোকটাকে ভাড়া দেয়া হয়নি!!
.
শ্যামলী সিনেমার টিকেট কাউন্টারের সামনে একটা মেয়ে দাড়িয়ে, ওর নাম জান্নাত। বাইশ বছর বয়স, উচ্চতা পাঁচফুট চার ইঞ্চি, ওজন-৫৫ কেজি। আমার সাথে দেখা করতেই এখানে এসেছে। আজ আমাদের প্রথম দেখা। আমি দূর থেকেই মেয়েটাকে দেখছি। কাছে গেলে মোহ ছুটে যায়। দূর থেকে অনেক সুন্দর লাগছে ওকে। মেয়েটার চোখে চশমার আকৃতি দেখে বোঝা যাচ্ছে চশমা ছাড়া বিশেষ ভালো দেখতে পায় না।
.
আমাদের তিনটায় এখানে আসার কথা ছিল। আমি তিনটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই এসেছি। মেয়েটা কখন এসেছে আমি জানি না। এখন যদিও চারটা বাজে গত একঘন্টা পাঁচ মিনিট মেয়েটা ঠায় দাড়িয়ে আছে। বার কয়েক মোবাইলটা হাতে নিয়েছিল, আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যাগে রেখে দিয়েছে। সিনেমা হলে শো আধা ঘন্টা শেষ হয়ে গেছে। আমিও মেয়েটাকে দেখে ফেলেছি এক ঘন্টা পাঁচ মিনিট। এবার সামনে যাওয়া যাক।
.
এতটা দেরী করাতে যে কোনো মানুষেরই খুব রাগ করার কথা ছিলো। কিন্তু জান্নাতের মধ্যে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না। এরকম মেয়েরা খুব ভয়ংকর রকমের হয়। এদের এক্সপ্রেশন থাকে একরকম আর মনোভাব আরেক রকম। জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
.
আমি কৌতূহল ধরে রাখতে পারলাম না। জান্নাতকে জিজ্ঞেস করলাম “তুমি কি দূরে কম দেখো?”
“আমি কিছুই দেখি না!” জান্নাতের কথাটা কেমন যেন ধারালো মনে হলো।কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। আজকে আমাদের সিনেমা দেখা হবে না। দুজন বেরিয়ে হাটতে লাগলাম। শিশুমেলা হয়ে, শেকৃবি,সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, পার হয়ে সংসদ ভবনের কাছে চলে এসেছি, এতক্ষণে জান্নাতের সাথে কোনো কথা হয়নি। কয়েকবার পিছিয়ে পড়ছিলো ও। আমি হাত ধরে সামনে আনতে চেয়েছিলাম, ওর জন্য খানিক পেছনে এসে এগিয়ে এনেছি কিন্তু হাতটা ধরা হয়নি।।
.
আকাশে মেঘ ডেকে উঠলো। অন্ধকার বাড়ছে, আমি আর জান্নাত আসাদগেট পার হয়ে খেজুরবাগান, বৃষ্টি নামলো, ঝুম বৃষ্টি… জান্নাত আমার খুব কাছে এসে হাটছে। আমার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে কারো স্পর্শ পেলাম!
“একটু ধরবে?” আমি ওর দিকে ফিরে তাকালাম, ওর চোখে চশমা নেই। ও আবারো বললো- “আমি বহুদিন এই কাঁচের দেয়ালটা ছাড়া হাটি না, তুমি আমাকে নিয়ে একটু পথ চলবে?”
জান্নাতের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে সেদিন ভিজতে ভিজতে গোটা শহর হেটেছি।
.
“উফফ কি জ্বর বাধিয়েছিস? কোথায় গেলি আর এমন জ্বর নিয়ে ফিরে এলি বলতো?” আমার রুমমেটের সন্দিহান জিজ্ঞাসা। ওর চোখের মধ্যে কেমন যেন অবাক একটা অনুভূতি দেখতে পেলাম। কাউকে এতটা অবাক হতে দেখলে ভালোই লাগে। আমি বললাম “থার্মোমিটারটা নিয়ে আয় দেখি কত জ্বর..”
রুমমেট জ্বর মেপে বললো “১০৪ ডিগ্রী।”
আমি কাথা মুড়ি দিতে দিতে বললাম “এটা জ্বর না! ১০৪ ডিগ্রী ভালোবাসা।। ” রুমমেটের অবাক হওয়ার মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। এতটা অবাক হলে মানুষের মুখে সৌন্দর্য্য থাকে না। আমি কাথাটা পুরো মুড়ি দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম!!
©Md. Aminul Islam