আম্মা, গান গায় কে?
– তোর বাপের কাজ। কোথা থেকে ভাইয়ের ছেলে যোগাড় করে আনসে। সে নাকি এখন থেকে এই বাসায় থাকবে। তা থাকবে ভালো কথা, ছাদে দুই রুম আছে। ঐখানে থাকুক। না এনে উঠাইসে গেস্টরুমে। এখন আবার ছেলেরে ভুজং দিয়া গান শুরু করসে। যত্তসব। আমার হইসে যত জ্বালা। একজন বুড়া বয়সে গানের আসর খোঁজে, একজন বিবাহ করবেনা বলে পণ করসে। ঐদিকে রহিমার মা রোজ সকালে উঠে দাঁতে ব্যথা, মাথায় ব্যথা বলে রান্নাঘরের কাজ বন্ধ করে রাখে।
আম্মা, পৃথিবীর তাবৎ সমস্যার সাথে কেন আমার বিবাহ এনে জুড়ে দিতে হবে সেটা কি জানতে পারি? আচ্ছা না থাক সেটা জানতে চাইলে আবারও নতুন ইতিহাস তৈরী করবা। তারচেয়ে যে যার মত থাকি তাই ভালো।
– তোমার কাছে যেটা ভালো সেটা যে আমাদের কাছেও ভালো হতে হবে এমন কথা কোথাও লেখা আছে?
আম্মা, ছোটবেলায় কড়া পাহারায় রাখসো যেন প্রেম করতে না পারি। আহা কত ইচ্ছা ছিল! পাহারা দিয়ে জীবন অতিষ্ঠ করে দিসো আর এখন পারলে রিকশাওয়ালার গলায় ঝুলায়া দিতেসো। তোমাদের ভাবগতিক বুঝিনা। শোন আমাকে এই বছরটা দাও। এরমধ্যে আমার রিসার্চের কাজটা শেষ হয়ে যাবে। তারপর যারে বলবা তাকে তিন কবুল বলে বিবাহ করে ফেলবো।
– হ্যা তোকে বিয়ে করার জন্য তো সারা বাংলাদেশ হা করে আছে।
সারা বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছো কেন? যে বিয়ে করবে সে তো বাংলাদেশের বাইরের কেউও হতে পারে।
– খবরদার রিসার্চের ওখান থেকে যদি কোন সাদা চামড়া ধরে নিয়ে আসিস তো তোর একদিন কি আমার একদিন। তোরে আমি জীবনেও বিদেশ যেতে দেবোনা।
তোমারে নিয়া বড় জ্বালা গো আম্মা। আমি যাই। রাতে দেখা হবে।
‘আমি একটু মহাখালীর দিকে যাবো। আপনার সাথে বের হলে আপত্তি আছে?’
হঠাৎ করে ভেসে আসা নতুন গলার শব্দে একটু চমকে উঠে তিতলী।
– আমি যাবো বংশাল। বংশাল কোথায় চেনেন?
জ্বি পুরান ঢাকার দিকে।
– যে পুরান ঢাকা চেনে, সে পুরো ঢাকা শহর চেনে। বাসা থেকে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে চলে যান সোজা মহাখালী।
চাচা বলছিলো, আপনার অফিস মহাখালীতে। তাই ভাবলাম একসাথে যাওয়া যায় কি না। আপনার আপত্তি থাকলে থাক। আমি আসলে বংশালের নাম জেনেছি গুগল থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নিশ্চয়ই একসাথে নামা যায়?
– তা অবশ্য যায়। আপনি বংশাল চেনেন গুগল দিয়ে, কোন দেশে থাকেন?
আমি খুব ছোটবেলায় নিউজিল্যান্ড চলে যাই বাবা মার সাথে। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া। ওখানকার একটা রিসার্চ প্রজেক্টের আন্ডারে দেশে এসেছি চার সপ্তাহের জন্য।
– তো এতো ভালো বাংলা বলা বা গান গাওয়া কিভাবে রপ্ত করেছেন?
আমার মা রবীন্দ্রসংগীতের ভীষণ ভক্ত। মায়ের কাছেই শেখা মূলত। বাসায় বাংলা বলা বাধ্যতামূলক ছিল ছোটবেলা থেকেই।
– ইন্টারেস্টিং। চলুন আপনাকে মহাখালী নামিয়ে দেই।
কিন্তু আপনিতো বংশাল যাবেন বললেন।
– আপনাকে কাটাতে চাইছিলাম।
কিন্তু কেন?
– বিয়ে করেছেন?
না। কিন্তু এমন প্রশ্নের কারণ?
– আমার বাসায় কয়দিন পরপর মা বাবা উৎপাত এনে হাজির করে। আমার বিয়ের চিন্তায় তাদের রাতের ঘুম হারাম। আমাকে বিয়ে দিতে না পেরে তারা এখন যাকে পায় তারই বিয়ে দিয়ে দেয়। আপনি যদি এলিজিবল ব্যাচেলর হয়ে থাকেন আর আমার মায়ের আশেপাশে কয়েক সপ্তাহ থাকেন আমি নিশ্চিত কাউকে খুঁজে পেতে আপনাকেও বিয়ে দিয়ে দেবে।
দারুন মজারতো?
– কোনটা মজার? বিয়ে দিয়ে দেয়াটা না আমার মা?
দুটোই।
কথাবার্তা আর আলাপে জানা হয়ে যায় আকাশের রিসার্চের অফিসও একই জায়গায় শুধু ফ্লোর আলাদা। রোজদিন একসাথে আসা যাওয়া, কাজশেষে একটু বাইরে কোথাও বসে চা খাওয়া, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আড্ডা দিয়ে আকাশের সাথে খুব ভালো সময় কাটে তিতলীর। মা বাবা আর কাজের বাইরে কারো সাথে মন খুলে কথা বলার সুযোগ যেন তিতলী পায় দীর্ঘদিন পরে। আর তাই সপ্তাহ চারেক পেরিয়ে যখন আকাশের যাবার সময় হয়ে যায় তিতলীর কেন যে অকারণ মন খারাপ লাগে তা যেন সে কিছুতেই ভেবে পায়না। থেকে থেকে শুধু মনে হয় কি হয় আকাশ আরো কয়েকটা দিন থেকে গেলে? যখন তখন বললেই গান গেয়ে ওঠা, কারণে অকারণে হো হো করে হেসে ওঠা, অথবা নিজেকে খুব বাঙ্গালী প্রমান করতে খেতে বসে আমি খুব ঝাল খেতে পারি বলে কাঁচামরিচে কামড় দিয়ে হাপুস নয়নে নাকের পানি চোখের পানি এক করে কাঁদা এই সবগুলো ব্যাপার অনেকগুলো দিন বড় নাড়াবে বুঝি তিতলীর হৃদয়। বুকের খুব ভেতরে নয়তো কাঁপছে কেন?
রোজ রাতে আনমনে গিটারে সুর তুলে গান গাওয়া নাকি আকাশের স্বভাব। আজ রাতে কেন তিতলীর পছন্দের গানটাই তাকে বেছে বেছে বাজাতে হবে? রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে গেস্টরুমের বারান্দা থেকে ভেসে আসছে আকাশের গলা, ‘ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।’
কেঁদে ফেলার ভয়ে পরদিন কোনরকমে আকাশকে বিদায় দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় তিতলী। যদিও অফিস থেকে তার ছুটি নেয়া ছিল। আকাশকে বলেছিল পর্যন্ত ও নামিয়ে দিয়ে আসবে। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মনে হয় যেন পুরো বাড়ি শব্দহীন। জীবনের অনেকগুলো বছর পর তিতলীর মনে হয় একজন সঙ্গী থাকা বোধহয় খারাপ কিছুনা। আকাশ পৌঁছে দায়সারাভাবে শুধু জানায় পৌঁছেছে। ব্যস অতটুকুই। আর কোন খোঁজ মেসেজ মেইল কিছুই আসেনা পুরো একমাস।
রোজদিন মেসেঞ্জারে সবুজ আলোতে একটিভ থাকা আকাশের আইডির দিকে তাকিয়ে তিতলী ভাবে তবে কি সে একাই এই বয়সে এসে হুড়মুড়িয়ে প্রেমে পরে গেলো কারো? আকাশ শুধুই বন্ধু ভেবেছে? আচ্ছা বন্ধু ভেবে হলেওতো একবার নক দিতে পারে। তার মানে তিতলী ছিল শুধুই তার সময় কাটানোর একজন মানুষ?
দরজায় টোকা পরতেই ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে বসে তিতলী।
– বাবা, এসো। মা ও দেখছি সাথে আছে। মায়ের মুখে কুলুপ দেয়া। কি ব্যাপার?
আকাশের বাবা ফোন করেছিলেন আজ।
– হুম, তো?
আকাশ তোকে বিয়ে করতে চায়।
মাথায় বাজ পরলেও বোধহয় এতো অবাক হতোনা তিতলী। খুশীতে বুঝি কেঁদেই দিতো।
তোর মা রাজী না। তোকে বিদেশ যেতে দেবেনা। তবে তুই রাজী থাকলে হয়তো ভেবে দেখবে আর কি।
মনে মনে কত কথা যে বলে ফেলে তিতলী মা কে। বিয়ে বিয়ে করে কান ঝালাপালা করে দিলে এখন যেই বিয়ে করতে আমিও রাজী তখন তোমার সমস্যা ছেলে কেন বিদেশী। মুখে অবশ্য বলে অন্য কথা।
– তাহলে আর কি বিয়ে বাদ।
তোর জন্য আমি অনেক ভালো দেশী পাত্র এনে দেব। আমাদের একটা মেয়ে। নয়তো বিয়েই দেবোনা। আমার কাছেই থাকবে। (তিতলীর মা)
আবারও মনে মনেই জবাব দেয় তিতলী। আম্মা তোমার পছন্দ করা ছেলে কি আমাকে রোজ রাতে গান শোনাবে? আমি যখনই বলবো চলে ঘুরে আসি। গুড আইডিয়া বলে লাফিয়ে উঠবে? গাড়ি পেতে দেরী হলে মোড়ের টংয়ের দোকানে পা ঝুলিয়ে চা খেতে রাজী হবে? কিংবা ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে অনেকটা পথ? মজা করে কি বলবে তোমার চোখে কাজল লেপ্টে হুতুম প্যাঁচার মত দেখা যাচ্ছে?
ভাগ্যিস মানুষ অন্যের মনের কথা পড়তে পারেনা। নয়তো বড় লজ্জার ব্যাপার হতো।
– তবে বিয়ে বিয়ে করে আর আমার মাথা খেয়োনা। এখন যাওতো আমার ঘুম পাচ্ছে।
মা বাবা বেরিয়ে যেতেই টুং করে মোবাইলে একটা শব্দ হয় তিতলীর। কার যে এতো সময় রাত বিরেতে মেসেজ পাঠানোর ভেবে বিরক্তিতেই মোবাইলটা হাতে নেয় সে।
– কেউ কি জেগে আছে?
আকাশের মেসেজ। মা তো রাজী হবেনা। এই বাড়িতে যে মায়ের কথাই শেষ কথা। খামোখা কষ্ট বাড়িয়ে কি লাভ ভেবে মেসেজটা দেখেও চুপ করে থাকে তিতলী।
কিন্তু ঐ যে বলেনা অবাধ্য মনের কারণে মানুষ কখনো কখনো শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রন হারায়। তিতলীর বুঝি তেমন কিছুই হলো। আর তাই না চাইতেও বুঝি লেখা হয়ে যায় মোবাইলের স্ক্রিনে।
এতোদিন পর?
– একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি?
উত্তরটা এই মূহুর্তে দিতে চাচ্ছিনা।
– চাচা চাচী তোমাকে কিছু বলেছে?
কি ব্যাপারে?
– তোমার আমার মানে আমাদের ব্যাপারে?
কি বলবে?
– এবার বুঝেছো কেন যোগাযোগ করিনি? যেভাবে পণ করেছো বিয়ে করবেনা, ফিরিয়ে দাও যদি সে ভয়ে যোগাযোগ করিনি। আসার আগে তো একটু ভালভাবে বিদায় পর্যন্ত দাওনি। আসার আগের দিন রাতে তোমার পছন্দের গান গাইলাম তাও একবার কথা বলতে এলে না রুমে।
এখন রাজী হয়েছি কে বললো?
– কেউ বলেনি। মনে হলো যদি মত পাল্টে থাকো। থাক তবে। আরেকটু সময় দেই। যদি আমার কপাল ফেরে।
একটা গান শোনাও। অনেকদিন তোমার গান শুনিনা।
– কি গান শুনতে চাও? আজ না হয় তুমি গান শোনাও।
তোমার ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো,
আমার ভালোলাগা ভালবাসা
তোমায় দেবো আরও।
– শুনিনিতো এই গান।
লিংক দিচ্ছি। শিখে নিও। আর শোন, আমি আজীবন শ্রোতা হয়েই থাকতে চাই। রোজ রাতে শোনাবে তো গান?
– আমাদের জীবন নাটকের নাম কি হবে? হ্যাপীলি এভার আফটার?
উ হু। অবশেষে কন্যা বিবাহে রাজী হইলো।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস