#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৪
২৪.
শুভ্র প্রভাত! ঘড়িতে আট’টা বেজে সাতান্ন মিনিট। পাখির কিচিরমিচির। কুয়াশা আচ্ছন্ন পিচ্ছিল রাস্তা ভেদ করে শুভ্র বাইক নিয়ে শা করে দৌড় দিলো। এইযে একটি সুন্দর সকাল অথচ কত অসুন্দর! এই শুভ্র প্রভাত শুভ্রর বুকের নীল ব্যথা। নীল ব্যথার অধিকারিণী একজন সুন্দর রমণী। এ জীবনে কত রমণী এলো গেলো। কতজন’কে প্রত্যাখ্যান করলো শুভ্র অথচ বেছে বেছে গিয়ে আসক্ত হলো তার উপর যার উপর সবাই আসক্ত। আচ্ছা পৃথিবীতে এতো সুন্দরী থাকতে কেনো সবাই শুভ’র বুকের সেই নীল ব্যথার প্রতি পাগল? ওরা কি জানে না শুভ্র’র নীল ব্যথা যে ‘তরু’। শুভ্র কেনো সবার থেকে গোপন করলো? তার নীল ব্যথা যে বুকে ঘাঁটি গেড়ে নিচ্ছে। তাকে রেখে অন্য পুরুষে মত্ত হয়ে অন্য পুরুষের জন্য রাত-বিরেতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সুদূর চলে যাচ্ছে। কি ভেবেছে শুভ্র টের পায় না? শুভ্র পিছু না গেলে ওতো সুন্দর করে নীল ব্যথা পৌছাতে পারতো? শুভ্রর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুখের ধোঁয়া মিশে গেলো প্রকৃতিতে। ফাঁকা রাস্তায় শুভ্র জোরে বললো,
‘নীল ব্যথা, তবুও তুমি ভালো থাকো! আর শুভ্র’র বুকের বাম পাশের যন্ত্রটার নীল ব্যথা হয়ে থাকো।’
শুভ্রর বুকটা ভারী হয়ে উঠলো। চোখ কি খানিক ঝাপসা হলো? নাহ! শুভ্রদের চোখ ঝাপসা হয় না। ওদের দীর্ঘশ্বাসগুলো কান্না। মায়ের কোলে মাথা পেতে করা হাহাকার গুলো ওদের কান্না। এইতো সেদিনকার কথা বাবা সাফ মুখের উপর জানিয়ে দিলেন,
‘এসব চাইল্ডিশ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। তোমার জন্য নিশ্চয়ই আমি পরিবার ভাঙবো না। তাছাড়া ইম্পোর্টেন্ড বিষয় তরু তোমাকে ভাই ছাড়া অন্যকিছু হিসেবে পছন্দ করে না। তোমার একতরফা জেদে আমি আমার পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ করবো না।’
শুভ্রর মাথায় কথাগুলো যেনো বলের মতো বারি খেলো। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ্রর মা স্বামীকে বুঝাতে গিয়ে ধমক খেয়ে ফিরে আসলেন। পরিবার’টাকে তো তিনিও খুব ভালোবাসেন। ধ্রুবর মায়ের সাথে তার মিলে না একথা সত্যি। তাদের মাঝে অকারণে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। কিন্তু ধ্রুব কে তিনি নিজের পেটের ছেলে বৈ অন্যকিছু কক্ষনো মনে করেননি। তার এক ছেলের মনকে ভেঙে দিয়ে আরেক ছেলের বউ করে তরুকে কীভাবে আনবেন? বাড়ির সেই অসুস্থ পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন? তারপর কেউ কারোর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে? তাই তিনি কোলে রাখা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘বাবা, জীবনটা ছোট। একজীবনে মানুষ সব পায় না। আমি তোমাকে আমার দু’হাত ভর্তি করে তোমার জীবনের সব অপূর্ণতায় পূর্ণ করতে চেয়েছিলাম। ভাগ্যের পরিহাসে আজ তোমরা দুই ভাই একই মেয়ে তাও নিজের চাচাতো বোন নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছো। একতরফা…
মাকে মাঝপথে থামিয়ে শুভ্র তাচ্ছিল্য গলায় বললো,
‘প্রতিযোগিতা তো জন্ম থেকে, মা। নামে প্রতিযোগিতা। কাজে প্রতিযোগিতা। সবটা শুরু করে এখন এসে সান্ত্বনা দিচ্ছো? ক্যারি অন।’
শুভ্রর মা ছেলের তাচ্ছিল্যময় হাসি দেখলেন না। কিন্তু বুঝতে পারলেন। তার চোখ’টা ভরে উঠলো। এ দেশে কি আর কোনো তরু নেই আমার ছেলেটার জন্য? শুভ্র বোধহয় মায়ের ব্যথা বুঝতে পারলো। মায়ের হাত টেনে উল্টোপাশে চুমু দিয়ে বললো,
‘সরি মা।’ শুভ্রর মা তখন মৃদু আওয়াজে কেঁদে উঠলেন। শুভ্র বললো,
‘তরুরা শুভ্রদের প্রেমে পরলো না কেনো, মা? আমি এ ব্যথা কত জনম সইবো?’
শুভ্র ভ্রু কুচকে বাইক চালিয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। অফিসে যেতে মন টানছে না। শহর ঘুরবে আজ। ধ্রুবকে সাথে আনার দরকার ছিলো। দুই রিজেক্টেড মাল একসাথে বিরহ উদযাপন করতে পারতো। কি লাভ নিজেদের এড়িয়ে চলে? পাখি যে অন্যের বাসা পছন্দ করে।
তরুর সাথে ধ্রুবর মা খারাপ আচরণ করায় ধ্রুব যেদিন ঘরের জিনিসপত্র ভাঙলো সেদিন দাদুভাই সব নিরবে দর্শন করে গেলেন। একটা টু শব্দ অব্ধি না করে নিজের ঘরে দোর দিলেন। তিনি কি করবেন? তিনি তো কোনোদিন আশংকা করেননি তার বাড়ির ভেতরের এই অবস্থা। কোনদিকে যাবেন তিনি? কার পক্ষ নিবেন? তিনজনই যে তার রত্ন! কলিজা ছেড়া মানিক!
ধ্রুবর হাত কেটে বিচ্ছিরি অবস্থা হলো। রাতে শুভ্রর বাবা এসে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললো,
‘বাবার সাথে কথা বলবে। মনে রেখো, বাবাদের দোষ থাকে না। যত দামী খেলনাই হোক সন্তান চাইলে বাবারা রক্ত বেঁচে তা কিনে নিয়ে আসতে চায়। বাবা হলে পরে বুঝবে।’
তারপর শুভ্র স্নেহার কাছে শুনলো ধ্রুবর বাবার সাথে ধ্রুবর কি নিয়ে যেনো তুমুল ঝগড়া। বাবার সাথে ধ্রুবর ঝগড়া করার জেদ গিয়ে মেঝো কাকী তরুর উপর তুললো। শুভ্রকে আর বলে দিতে হয়নি কি নিয়ে এতো কোন্দল। সে রাতে ধ্রুবর ব্যান্ডেজ বাধা হাত দেখে চু চু করে বলেছিলো,
‘আহারে ধ্রুব! তুই যদি না জন্মাতি।’
ধ্রুব চোরা গলায় বলেছিলো, ‘তাতে তোর কিছু বিশেষ লাভ হতো না।’
শুভ্র বড় করে মুখবন্দি বায়ু বাতাসে ছেড়ে দিলো। হালকা আওয়াজে বললো,
‘ইশশ… যদি তরুই না জন্মাতো। কত সুন্দর হতো সব! তরু তুই কেনো জন্মালি?’
শুভ্র জোরে গাড়ি টানলো। এতো জোরে যে যেকোনো সময় দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বাতাসের তীব্রতা শরীরে কাটার মতো হুল ফুটালো। তবু হুশ নেই। বরং চিৎকার করে বললো,
‘ও প্রকৃতি শুনে রাখো,
অপ্রকাশিত শুভ্র’রা বিক্রি করে অব্যক্ত প্রেম, প্রতীক্ষা। কেবল কিনে আনে শুধু এক বুক হতাশা, উপেক্ষা।’
শূন্য রাস্তায় শুভ্রর কথা প্রতিধ্বনি হয়ে বারবার এসে কানে লাগলো। শুভ্র চমকে উঠলো। হাত কেঁপে উঠলো। বাইক নিয়ে উল্টে পরলো রাস্তায়।
২৫.
বছরের এক তারিখ পরলো। চারিদিকে কী রঙিন রঙিন সজ্জা!কত আমেজ! রাস্তাজুড়ে আলপনা। তরুর মনেও রং লেগেছিলো কেননা আজ শুদ্ধর সাথে দেখা হবে। তরু মন ভরে সাজলো। একটা ল্যাভেন্ডার কালারের শাড়ি পরলো। রমনায় শুদ্ধর জন্য অপেক্ষা করলো বিকেল পর্যন্ত। কিন্তু শুদ্ধ এলো না! ভিড়ের মাঝে একলা তরু এককোণে এক জায়গায় বসে সারাদিন অপেক্ষা করলো অথচ শুদ্ধ এলো না। এভাবে ধোকা দিলো তরুকে? তরুর চোখ ছাপিয়ে জল এলো। পড়ন্ত বিকেলেই ফিরে এলো।
ফিরে এসেই দেখলো ড্রইংরুমে শুভ্র বসা। প্লাস্টার করা পা টা ছোট টেবিলের উপর রাখা। বড় জেঠু শুভ্র ভাইকে চেকাপ করছেন। শুভ্র ভাই বাইক এক্সিডেন্ট করার পর থেকে বড় জেঠু নিজের কাজে বাড়ি থেকে কম বেরোন। তিনি মনে করেন তার কঠোরতায় শুভ্রর এই অবস্থা। এ বাড়ির ছেলে মেয়েগুলো বড় আদরে মানুষ। বেশি আদরে মানুষ বলেই হয়তো সবার জীবনে এতো কষ্ট! তরুকে দেখে ওর বড় জেঠু বললেন,
‘কিরে মা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো কিছু বলবি?’
তরু জেঠুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কেনো জানি না বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের সামনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। তরু মন খুলে সবার সাথে কথা বলতে পারে না। কিন্তু কারোর কোনো আদরে কমতি নেই। কেউ তাকে ব্লেইম করছে না। কেউ বলছে না, ‘আমার ছেলের জীবন’টা নষ্ট করে দিয়েছিস তুই।’ অথচ তরু জানে আদতে শুধু তাদের ছেলেদের নয় এই গোটা পরিবারটাকে নষ্ট করে ফেলেছে তরু। তাই তো যে বাবা তরুর একমাত্র টিম মেম্বার সেই বাবা তরুর সাথে খুব একটা কথা বলেন না। নাম ধরে ডাকেন না। বাড়ি ফিরে তরুর সারাদিনের অভিযোগ গুলো শুনতে তরুর ঘরে আসেন না। তরু জেঠুর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় মিনমিন করে বললো,
‘আ’ম সরি, বড় জেঠু। আই লাভ ইউ।’
জেঠু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। এমন না একথা তরু আজ প্রথম বলেছে। তবুও তরু দৌড়ে চলে আসার সময় স্পষ্ট দেখতে পেলো জেঠুর চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। তরু কাঁদতে কাঁদতে বলে চললো, ‘সব আমার দোষ। সব।’
সত্যি কি তরুর দোষ? নাকি শুভ্রর? নাকি ধ্রুবর? নাকি ভালোবাসার?
চলবে