#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১২
২০.
আমি কেনো ঘর ছেড়ে বের হচ্ছি না তা নিয়ে দুদিন বাড়িতে অনেক জল্পনা-কল্পনা চললো। ছোট জেঠি ভেবে বসলেন তার ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে আমি ঘরে দোর দিয়েছি কিংবা ট্যুরে গিয়ে কারোর সাথে আমার অনেক বড় ঝামেলা লেগেছে, গোপনে প্রেম করে প্রেমিকের কাছে প্রতারিত হয়েছি বলেও কেউ কেউ ধারণা করছে এর সাথে মূল বিষয় বস্তুই ছিলো চিলেকোঠার ছেলেটা বিনা নোটিশে চলে গেলো কেনো?
বাড়ির সবাই কতভাবে চেষ্টা করলো আমার মন ভালো করার, আমাকে হাসানোর। ছোট জেঠী আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। সেদিনের তার ব্যবহারের জন্য কত করে সরি বললেন। স্নেহা স্কুল থেকে আসার পথে ১৫ টাকা দিয়ে আমার জন্য গোলাপ কিনে নিয়ে এলো। এসে খাপটে আমায় জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। ফিসফিস করে বললো,
‘আমি কিন্তু সব বুঝি, তরুপু। তুমি শুদ্ধ ভাইয়ের জন্য কাঁদো তাই না? আমারও কান্না পায়।’
আমি স্নেহাকে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। চোখ মুছে উঠতেই এরমাঝে দরাজ গলায় হুঙ্কার দিয়ে প্রবেশ করলেন শুভ্র ভাই,
‘কিরে তোকে নাকি কে কালোজাদু করেছে? ঘুরে টুরে এসে ঘরে দোর দিয়ে পেত্নীদের সাথে বসবাস করিস। খাস টাসও না। ভূত-পেত্নী কি খাওয়ায় তোকে? দেখা তো আমাকে। দেখি গরু থেকে তোর পেত্নীতে প্রমোশন টা কীভাবে হলো।’
আমি মুচকি হাসলাম। ফাইযলামো করতে ইচ্ছে করলো না। কথার উত্তর দিতেও ইচ্ছে করলো না। শুভ্র ভাই আবার বললেন,
‘কিরে খুব ভাব বেড়েছে? কথার উত্তরও দিচ্ছিস না, গরু?’
আমি এবার একটু বেজার হলাম। শুভ্র ভাই আমাকে ব্যাঙ্গ করে তরু থেকে গরু ডাকেন। তার ভাষ্যমতে আমি নিতান্তই গরু জাতের সাথে আমার নামটাও গরু। চরিত্রের সাথে নামের পার্ফেক্ট কম্বিনেশন। আমার মুখ ফুলানোর মাঝে এবার এলেন ধ্রুব ভাই,
‘কিরে তোকে না কবে থেকে আমার জন্য একটা পাত্রী খুঁজতে বলছি? বিয়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি মারা যাচ্ছি আর তুই দরজা-জানালা লাগিয়ে নাকি সুই*সাইডের প্ল্যান করছিস?’
ডাহা মিথ্যা কথা! এরা প্ল্যান করেই এসেছে আমাকে উল্টাপাল্টা কথা বলে জ্বালাবে। আমি ত্যাড়া স্বরে বললাম,
‘তোমাদের কাজ নেই? বাড়িতে কি করছো?’
শুভ্র ভাই আয়েশ করে উত্তর দিলেন, ‘আরে বাড়িতে একটা পেত্নীর আমদানি হয়েছে তিনদিন আগে। ব্যস্ততায় দেখতে আসতে না পেরে অবশেষে আজ ছুটিই নিয়ে ফেললাম।’
ধ্রুব ভাই উত্তর দিলেন, ‘আর আমি তো সিউর ছিলাম আজ তুই সুই*সাইড মাস্ট করবি। তার জন্য সরঞ্জাম আনতে হবে না?’
‘আমার সুই*সাইডের জন্য তুমি সরঞ্জাম আনবে বলে আজ ছুটি নিয়ে নিলে?’
ধ্রুব ভাই হেসে মাথা নাড়ালেন। বস্তুত তিনি হাসেন না। আমি অপলক দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে রাঙানোর জন্য এমন করছেন তারা। কিন্তু আমি রাগছি না। শুভ্র ভাই বললেন,
‘চল তোর দুঃখ তে আমরা একটু দুঃখিত হই।’
ধ্রুব ভাই শুভ্র ভাইয়ের কাধে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে বলেন,
‘কিন্তু দুঃখিত কীভাবে হওয়া যায় রে? একটা কেক কেটে সেলিব্রেশন করে ফেলি?’
স্নেহা বললো, ‘গুড আইডিয়া ভাইয়া সাথে একটু ডেকোরেশন।’
শুভ্র ভাই এক গাল হেসে বললেন, ‘তাই? নে হাই ফাইভ।’
স্নেহা শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই দুজনের সাথেই হাই ফাইভ করলো। আমি তাদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। আমার মন ভালো রাখার জন্য সবার কত প্রচেষ্টা! আমার এতো বড় বাড়ি ভর্তি মানুষ। তবুও আমি শূন্য ওই একজনের জন্য। আমার মানুষগুলোর আমার মুখে হাসি ফুটাবার কত প্রয়াস! অথচ আমি একজনের ঠোঁটে নিজের জন্য হাসি দেখতে মরিয়া। আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি শুদ্ধকে দেখি না তিনদিন! কোনো কিছুতেই মন থেকে তাকে এক সেকেন্ডের জন্য সরাতে পারছি না।
২১.
বিকেলে আমি ছাদে এলাম। মুক্ত বাতাসে ডানা দুটো মেলে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। এরপর একদৃষ্টিতে চিলেকোঠার ঘরের দরজার দিকে চেয়ে রইলাম। চেয়ে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে আমার বোধ হলো,
‘আরে আমি তো অন্য তরু হয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে তো চুটকিতে সমাধান আছে। এভাবে ঘরে দোর দিয়ে থাকলে আমি শুদ্ধকে খুঁজে পাবো কোথায়? উনি তো একটু ওরকমই। আমার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাব।’
আমি শক্ত হয়ে দাড়ালাম। নাহ! মেজাজটা ফুরফুরে করতে হবে। উনাকে বের করা একটা ব্যাপার? আমার বা হাতের তুড়ির কাজ। এখন মাসের শেষের দিক। নতুন বাসায় নিশ্চয় উঠতে পারেনি। তাহলে? কোথায়? তার বাড়িতে? ওও হ্যাঁ। আরে? এটা আমার মাথায় আগে কেনো খেলেনি? ওতো জিনিসপত্র নিয়ে তো সে আর বন্ধুর বাড়ি কিংবা যেখানে সেখানে উঠতে পারবে না। হাহাহা… শুদ্ধ আই এম কামিং বেইবি। বলেই আমি দৌড়ে চলে গেলাম দাদুর ঘরে।
দাদু এসময় ঘরে থাকে না। তিনি মসজিদে গিয়ে আসর, মাগরিব একসাথে পড়ে আসেন। তবুও আমি লোকচক্ষুর আড়ালে সতর্কতার সহিত ঘরে ঢুকলাম। দাদুর সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কালো ডায়েরি বের করে তা থেকে মেলে ধরলাম। শুদ্ধর আগেও আমাদের চিলেকোঠার ঘরে আরো ব্যাক্তি ছিলেন। দাদু সবার বাড়ির ঠিকানা, নাম্বার রেখে দিতেন। আমি শুদ্ধর ঠিকানা জানি না। ডায়েরি থেকেই দেখে নিলাম। নাম্বার’টা ফোনে টুকে নিলাম। এরপর দৌড়ে আবার ছাদে এলাম। ব্যস্ত কাঁপা হাতে নাম্বারটায় ফোন লাগালাম।
ফোন ধরলেন একজন পুরুষ। নরম সুরে বললেন,
‘কে?’
আমি সালাম দিয়ে বললাম, ‘আমি তরু। শুদ্ধ স্যারের অফিসের কর্মচারী। শুদ্ধ স্যার আছে আংকেল?’
‘হ। ডাইকে দিমু?’
‘না না আংকেল। ডাকতে হবে না। রাখি আংকেল। ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
তরু আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। ধ্রুব ছাদের দরজা থেকে সব দেখলো, শুনলো। এরপর অপলক তরুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে রইলো। তারা সারা বাড়ির মানুষ তিনদিনে যা করতে পারেনি এক ব্যক্তির শুধুমাত্র নামটুকু এক সেকেন্ডে তা করে ফেললো। কি আশ্চর্য এই ধরণীর নিয়মকান্ড! ধ্রুব হা করে নিঃশ্বাস নিলো। মুখ উপরে তুলে চেয়ে রইলো। বুক চিরে বেরিয়ে এলো ‘তরু, কেনো আমায় ভালোবাসলি না?’ এরপর বিরবির করে বললো সন্তর্পণে,
‘যে তোমার অপেক্ষায় তাকে তুমি ফিরে দেখো না অথচ তুমি যার উপেক্ষায় তার প্রতি তুমি অবুঝ মৃতপ্রায়, অপরাজিতা।’
ধ্রুব চলে গেলো। জানতে পারলো না তরু তাকে দেখে নিয়েছে। তার ওই দীর্ঘশ্বাস, ওই চোখ লুকানোর প্রচেষ্টা তরু দেখেছে। ওই ফিসফিসানি স্বর তরু সব স্পষ্ট শুনেছে। তরু অবুঝ নয়। তার আশেপাশের আবহাওয়া সে বুঝে। শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাইয়ের সাথে বাড়ির ভেতরে কি সমস্যা চলছে কেউ না বললেও সে বুঝতে পারে। সে তো মেয়ে! এতো কাছে থেকেও বুঝবে না? তরু বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালো। নিচু স্বরে বললো,
‘ও আকাশ, আমায় ক্ষমা করো। আমি ওদের ভালোবাসতে পারিনি।’
বলতে বলতে তরুর গলাটা ধরে এলো। চোখটা ছলছল করে উঠলো। এতো সুন্দর, পবিত্র, বিশুদ্ধ ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারার মধ্যেও যে অশান্তি, অপ্রাপ্তি।
২২.
শুদ্ধ ভ্রু কুচকে বসে আছে। সে নিশ্চিত তরু একটা অঘটন ঘটাবে। সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়ার একটুপর শুদ্ধর বাবা ওকে ডেকে বললো,
‘তরু নাম কইরে একটা মাইয়া ফুন দিছিলো।’
শুদ্ধ চমকে উঠলো। না! তরু ফোন দিয়েছিলো সেজন্য নয়। বাবার মুখে তরু নামটা শুনে। শুদ্ধ আচ করতে পেরেছিলো তরু কিছু একটা করবে। এতো ভদ্র মেয়ে সে নয়। তাই তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তরুর মতো মেয়ে তিনদিন ধৈর্য্য ধরে ছিলো এই অনেক। শুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে তরুর অঘটনের অপেক্ষা করতে লাগলো।
চলবে