হেমন্তের নীড় পর্ব-০৯

0
7

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৯
১৪.
স্নেহার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা চারজন বাইরে খেতে এসেছি। স্নেহা গিফটের জন্য আমার কান দুটো ঝালাপালা করে দিলেও আমি নিরুত্তর মুখে মেন্যুতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। যদিও চোখ বুলিয়ে লাভ নেই। দেখা গেলো আমি খেতে চাইছি আম আমাকে জোর করে খাওয়ানো হবে জাম। এই জোরাজুরির যাতাকলে পিষ্ট হতে হতে আমি ক্লান্ত। এহেন পরাধীনতা আমি ঘৃণা করি।

ধ্রুব ভাই বসেছেন আমার পাশে। শুভ্রভাই আমার মুখোমুখি। দুজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যে ক্ষণে ক্ষণে উল্টেপাল্টে আমার মুখের উপর স্থির হচ্ছে তা আমি মাথা নিচু করেও বলতে পারি। কিন্তু আমি পণ করেছি কোনোমতেই নিজপছন্দে খাবার অর্ডার দিতে চেয়ে আজ আর অসম্মানিত হবো না। এমনিতেও আমার মন’টা পরে আছে চিলেকোঠার ঘরে। শুদ্ধকে একবার চোখের দেখাও দেখিনি। তারউপর এদের চাহনি আমাকে বিরক্ত করে তুলছে। যেকোনো মূহুর্তে আমি ব্যাগপত্র কাধে তুলে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে পারি। তারপর যা হবে তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নই বলেই আমি উঠে চলে যেতে পারছি না। অবশ্য প্রস্তুত থাকলে আমি তো আসতামই না। শুভ্র ভাই কেশে জিজ্ঞেস করলেন,

‘অর্ডার দিচ্ছিস না কেনো?’

‘খিদে নেই।’

শুভ্র ভাই আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। ধ্রুব ভাই নিশ্চুপ ফোনের দিকে চেয়ে আছে। তার ব্যাপারটাই হচ্ছে এমন, আমার উত্তরই তার উত্তর। আমি নিশ্চিত এই মূহুর্তে আমি যা খেতে চাইতাম সে একটু ভঙ্গি করে মেন্যু উল্টেপাল্টে দেখে আয়েশি ভঙ্গিমায় সেটাই অর্ডার দিতে বলতেন। কিন্তু বাধ সাধতো শুভ্র ভাই। ওই যে সবার উপর নিজের খবরদারি করার অভ্যাস। সবার মতামত উপেক্ষা করে সে নিজ মন মতো অর্ডার করবে। আমার কেমন অসহ্য লাগছে। শরীর চিড়বিড় করে উঠছে। অযথা আমার এই রাগের কারণ আমি বুঝতে পারছি না। শেষে কুলাতে না পেরে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

‘খাবার পার্সেল করে নিয়ে চলো। বাসায় গিয়ে খাবো।’

শুভ্র ভাই সেকেন্ড কয়েক আমার দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকলেন। আমি ধরেই নিলাম একটা রাম ধমক খেতে চলেছি এবং হলোও তাই। ধমকে উঠলেন তিনি,

‘পার্সেলই করার হলে এখানে এলাম কেনো?’

ধমকের পৃষ্ঠে আমি আর টু শব্দ করলাম না। চোখ খিচে বন্ধ করে রইলাম। ধ্রুব ভাই তখনো ফোনে চোখ গুজে রয়েছে। শুভ্র ভাই ওয়েটার ডেকে খাবার গুলো পার্সেল করে দিতে বললেন এরপর জায়গা থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে বললেন,

‘এদিকে আয়।’

আমি চমকে উঠলাম। হাত ধরায় অস্বস্তি হলো। এই অস্বস্তির সূত্রপাত শুদ্ধ আমার জীবনে আসার পর। শুভ্র ভাই আলতো হাতে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ধ্রুব ভাই এতোক্ষণে ফোন থেকে চোখ সরিয়েছেন।

‘তিনবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নে তো।’

‘কেনো?’

‘এমনি। আমার মনে হচ্ছে তোর ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করছে না যেকোনো সময় মরে টরে যেতে পারিস তুই। নে নে শ্বাস নে।’

শুভ্র ভাইয়ের কথা আমার মানতে ইচ্ছে করলো না। তখন পড়ন্ত বিকেল পেরিয়েছে। সন্ধ্যা ছুই ছুই! আমি আকাশের দিকে তাকালাম। মিনিট কতক নিশ্চুপ মুহূর্ত গড়িয়ে যাওয়ার পর বিমর্ষ কণ্ঠে বললাম,

‘দেখো! কেমন করে মেঘগুলো চলে যায় প্রকাশ্যে তবু সবার বেখেয়ালে।’

শুভ্র ভাই মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। আমি পেছনে ঘুরে কাচ গলিয়ে দেখলাম ধ্রুব ভাই স্নেহার সাথে কথা বলছে এরপর আবার শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। পরপর দুবার দুজনের মুখচ্ছবি, গাম্ভীর্যতা পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হলো আদতে এরা একসাথে বড় হয়েছে, সমবয়সী, যা করে সব একসাথে কিন্তু কোথায় যেনো সম্পর্কের টান পরেছে। কোথায় গিয়ে যেনো শান্ত দ্বন্ধ! ওদের মধ্যে সব মিল কিন্তু খুব অমিল!

আমার ভাবনার মাঝে পার্সেল নিয়ে স্নেহা ধ্রুব ভাই বাইরে বেরিয়ে এলেন। ওদের দুজনের মুখের দিকে আমাকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব ভাই চোখ নাচালেন। সবসময়ের মতো গম্ভীর মুখে প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘কি হয়েছে তোর?’

‘কিছু না।’

আমাদের যাওয়ার মাঝেই বাধা হয়ে শুভ্র শুভ্র বলে চিৎকার করে দৌড়ে এলেন এক ঝাঁক রমনী। শুভ্র ভাই হেসে হেসে রমনীদের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। বললেন,

‘কিরে মাছের বাজার! এখনো একসাথেই ঘুরিস তোরা?’

কথাবার্তায় বুঝলাম তারা খুব ভালো বন্ধু। খুব সম্ভবত তারা তাদের মোমেন্ট ক্যাপচারড করতে বেরিয়েছেন। পাঁচজনের গায়ে একই শাড়ি, একই গয়না, একই সাজ। পেছনে একজন ফটোগ্রাফার গোছের লোক। কথা বলার এক পর্যায়ে রমনীগণ হেসে কুটি কুটি হয়ে শুভ্র ভাই কে ইশারায় কি যেনো বললো। শুভ্র ভাই শুধু মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসলেন। আমার তখন বিরক্তি তুঙ্গে। রমনীগণ আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হতাশ শ্বাস ফেললেন। তাদের এই শ্বাস ফেলে দেখে ধ্রুব ভাইয়ের ভ্রু জোড়াও কুচকে গেলো। আমি তাদের এই হাসিহাসি মুখভঙ্গি থেকে বিশ্রী মুখভঙ্গি হয়ে যাওয়ার কারণ ঠাওর করতে পারলাম না।

বিদায় নিয়ে চলে আসার বেলায় ধ্রুব স্পষ্ট শুনতে পেলো তাদের ফিসফিসানি স্বর,

‘শুভ্রদের ভালোবাসাও উপেক্ষা করা যায়? ও মেয়ে না কংক্রিট?’

১৫.

এখন ডিসেম্বর মাস! শুদ্ধকে দেখার ছুতোয় পড়ন্ত বিকেলে ভারী কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে ফুল গাছ দেখার অযুহাতে ছাদে এসে আমি ভয়াবহ ছ্যাকা খেলাম। শুদ্ধ নেই। তবে ছ্যাকাটি আর ছ্যাকা রইলো না। মিনিট বিশেক পরেই ঘটলো শুদ্ধর আগমন। আমি তার ঘরের সামনে পথ আগলে দাড়ালাম। বুকের মাঝে হাত দুটো ভাঁজ করে গম্ভীর ভান করে বললাম,

‘কোথায় গিয়েছিলেন?’

ভাবটা এই যেনো আমি তার বউ। এই ভেবেই আমার মন রাঙা হলো। শুদ্ধ তার সকল গন্ডি পেরিয়ে আমাকে অবাকতার সাগরে ফেলে মুচকি হাসলেন। বললেন,

‘ছাদের বেঞ্চেতে বসো, তরু। আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসি।’

আশ্চর্যের চরম শিখরে পৌঁছে গেলাম এই মূহুর্তে আমি। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে রইলো। সে চা বানিয়ে নিয়ে এসে আপনাআপনি বললো,

‘বাসা খুঁজতে গিয়েছিলাম।’

এই তবে তার ভালো ব্যবহারের কারন! আমি স্তব্ধ নয়নে বললাম,

‘আপনি এখনো ওখানটায় পরে আছেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি ভুলে গেছেন।’

‘ভুলে যাওয়ার জন্য তো তোমার দাদুকে বলিনি আমি।’

এই পর্যায়ে আমার চোখ ছাপিয়ে জল এলো। ধরা গলায় বললাম,

‘বাসা পেয়েছেন?’

তিনি মিনিট দুয়েক আমার টলমলে চোখের দিকে চেয়ে কি জেনো খুঁজলেন। এরপর ধীরগতিতে মাথা নাড়িয়ে বললেন,

‘না।’

আমার চোখের জল চোখেতেই গায়েব হলো। আমি ভেবে ফেললাম, সে এক পাও নড়তে পারবে না। তার যাওয়া আমি অবশ্যই ঠেকাবো। আমি তাকে এ পর্যন্ত একবারো জিজ্ঞেস করিনি কেনো তিনি চলে যেতে চান। কারণ উত্তরটা আমার জানা। সে নিশ্চয়ই উত্তর দিবে ‘তোমার জন্য’। আমি পা দুলিয়ে দুলিয়ে বললাম,

‘চা’য়ের টেস্ট ভালো। ধ্রুব ভাইয়াও ভালো চা বানাতে পারে। শুভ্র ভাইয়া আবার ওতো ভালো পারে না।’

বললাম ঠিক টেস্ট ভালো কিন্তু আদতে আমি চা মোটেও পছন্দ করি না। তারউপর সেটা যদি হয় রং চা..! শুদ্ধ মুখে কুলুপ এটে শূন্যে দৃষ্টি রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আমি কি বলবো কি বলবো খুঁজে না পেয়ে শুভ্রভাই, ধ্রুব ভাইয়ের গল্প টেনে বসলাম আচম্বিতে।

‘জানেন, ওরা সবসময় একসাথে চলে, উঠে, বসে, খায়, একসাথে সব করে। কিন্তু… এতো কাছে থেকেও ওরা যেনো যোজন যোজন দূরের। ওদের মধ্যকার আচরণ ঠান্ডা। ওদের এরকম অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ আমি বুঝতে পারি না। নাকি পিঠাপিঠি ভাইদের সম্পর্ক এরকমই থাকে?’

শুদ্ধ কোনো উত্তর দিলো না। একটা চাপা শ্বাস বাতাসে মেলে ধরে পকেটে হাত গুজলো। তরুকে বলতে ইচ্ছে করলো না, ‘ওদের সম্পর্কের এই দূরত্বের কারণ একমাত্র তুমি, তরু।’

শুদ্ধর থেকে উত্তর না পেয়ে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। কেমন বিমর্ষ! কি এতো ভাবে সারাদিন? তারপর হুট করে প্রশ্ন করে বসলাম,

‘আপনার সেলারি কত?’

বাস্তবিক যে কাউকে হুট করে বেতন জিজ্ঞেস করলে সে অপ্রস্তুত হয়। কিন্তু শুদ্ধ অপ্রস্তুত হলো না বরং আয়েস করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা’টা দেয়ালের উপর রেখে বললো,

‘৩০ হাজার টাকা।’

‘ওওও…।’

‘হুম। এই স্যালারিতে তোমার ফ্যামিলি আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে না, তরু। বৃথা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা উচিত তোমার।’

‘আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আপনি আমাকে নিবেন কিনা সেটা বলুন। আমার এই স্যালারিতে দিব্যি জীবন কেটে যাবে।’

বলতে বলতেই আমি তার আর আমার চায়ের কাপ উলোটপালোট করলাম। শুদ্ধ কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপটা আবার উলটে নিজের কাপ নিয়ে এক চুমুকে চা শেষ করলেন। আমি আশ্চর্য হলাম। মনে মনে গালিও দিলাম কিন্তু লজ্জা বোধ করলাম না। কারণ তার বেলায় আমি মহা নির্লজ্জ! অতঃপর তিনি আমাকে অতীব গভীর কণ্ঠে শুধালেন,

‘চুমুকে চুমুকে বিষ পাণ করার এতো প্রচেষ্টা কেনো তোমার?’

আমি মুচকি হাসলাম। উঁচু স্বরে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলাম,

‘কারণ আমার বেহায়া হৃদয় খারাপ প্রেমিকের বিষপান নামক অমৃতসুধা পানে চরম তৃষ্ণার্ত!’

‘মেয়ে, আমার কাছে এলে পরে অযত্নলব্ধ হয়ে রবে।’

‘প্রিয় যত্নের পুরুষের কাছে অযত্নের পাত্রী হতে আমি সহস্রবার রাজি।’

‘মনে রেখো, আমি তোমার বাবার চোখে চিলেকোঠার সেই বেয়ারা ছেলে।’

‘তাতে কি? আমার চোখে তো ‘স্বপ্নের পুরুষ!’

শুদ্ধ আর কোনো টু শব্দ না করে চলে গেলেন। চারিদিকে তখন সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব। আমি ক্ষণে ক্ষণে নিঃশব্দে হেসে উঠছি। বহুদিন! বহুদিন পর মনে হচ্ছে আমরা বৈঠকে বসেছিলাম। যে বৈঠক শুদ্ধর প্রতিকূলে আর আমার অনুকূলে। আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম। নাহ! এই লোকটা কি কোনোদিনও আমার প্রেমে পরবে না?
আমি এই এখনকার সময়টাতে এসেও বুঝতে পারিনা তবে ওকথা তিনি আমাকে কেনো বলেছিলেন? কেনো বলেছিলেন আমি তার কাছে হেমন্তের মতো প্রিয়? সেই বাক্য বলার পরেই না আমার কিশোরী মন তার প্রতি ডুবে মরলো? দোষ কি তার নয়? আগ কি সে বাড়ায়নি? এখন কী সুন্দর আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে সম্পূর্ণ’টা এড়িয়ে চলে যান! অসভ্য লোক!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে