হেমন্তের নীড় পর্ব-০২

0
9

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০২.
৩.
আমার এক আশ্চর্য সমস্যা রয়েছে। বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকলেই আমার চাপা ব্যাথা করে। বর্তমানে আমার ভীষণ চাপা ব্যাথা করছে। কারন বিগত বারো ঘন্টা আমি কারোর সাথে কথা বলিনি। এরমধ্যে অবশ্য নয় ঘন্টা ঘুমিয়েছি। এখন চুপচাপ বসে বসে মুখের এক্সারসাইজ করছি। এই যে বাড়িতে একজন জলজ্যান্ত পরির মতো মেয়ে না খেয়ে, মন খারাপ করে কারোর সাথে কথা না বলার অনশন করেছে এতে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ তার সাথে আগ বাড়িয়ে এসে কথা বলছে না। একটু আহ্লাদ দিয়ে তোষামোদ করছে না। খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে না। ব্যাপারটা নিয়ে খুবই ব্যথিত আমি। আমার জন্মদাত্রী অবশ্য একবার এসে আমাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে গেলেন তবে বিশেষ পাত্তা দিলেন না। এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছি কখন বাবা বাড়ি আসে। তবে আমার ভাবনার মাঝেই বাবার বদলে এলেন শুদ্ধ। তিনি এসে ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়া আমার দাদুভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘আসসালামু আলাইকুম, দাদুভাই। কেমন আছেন?’

আমি চোখ টিভির দিকে রেখে কান সজাগ করে রইলাম। উফফ.. শুদ্ধ’কে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। পাঠকরা ভাবতে পারেন এ আমার কিশোরী মনের আবেগ অথবা উঠতি যুবতী একচ্ছত্র ভালোলাগা। তবে তাদের বোঝার সুবিধার্থে আমি বলে দিতে চাই যে কিশোরী বয়স এবং উঠতি যুবতী বয়স দুটোই আমি পেরিয়ে এসেছি। এ আমার প্রেম! ভালোবাসা!

আমার দাদুভাই যে শুদ্ধ’কে একদম পছন্দ করেন না সেটা তিনি তার চেহারার অভিব্যাক্তিতেই বুঝিয়ে দেন। তিনি সালামের উত্তর নিলেন মনে মনে বিরবির করে। কিন্তু উত্তর নেওয়া উচিত ছিলো জোরে শব্দ করে। আমি শিখিয়ে দিলাম না। নেহাত আমার থেকে তার জ্ঞান-বুদ্ধি কিছু কম নয়। আর তাছাড়া আমার কারোর সাথে কথা না বলার অনশন চলছে। শুদ্ধ বললেন,

”আমি এ মাসের ডিসেম্বরে বাসা’টা ছেড়ে দিচ্ছি, দাদুভাই।’

আমি চোখ বড় বড় তাকালাম। সটান সোফা থেকে যন্ত্রমানবের ন্যায় দাঁড়িয়ে পরে মুখ ফসকে বলে ফেললাম,

‘কিহ? আপনি না কাল বললেন জানুয়ারিতে ছাড়বেন?’

শুদ্ধ উদ্দেশ্যহীন তাকালো। যেন আমার অবাকতা তাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করেনি এমন ন্যায় মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কেমন আছো, তরু?’

আমি উত্তর দিলাম না। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে তার অভিনয় দেখে গেলাম,

‘কাল তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো? কি জানি মনে করতে পারছি না। জানুয়ারিতে ছাড়বো বলেছিলাম? তাহলে বোধহয় ভুল বলেছি।’

আমি অবাকতার শীর্ষে চলে গেলাম। কি বলছে এই লোক? আমার সাথে দেখা হয়েছে কি না সেটাও তার মনে নেই। নাকের পাটাতন ফুলিয়ে বললাম,

‘কেনো? আপনি কি ডিমেনশিয়ার রোগী?’

এরমাঝে ধ্রুব ভাই এসে গম্ভীর স্বরে ডাকলেন,

‘তরু, এদিকে আয়। জেঠু ডাকছে।’

বলে ধ্রুব ভাই নিজেই এসে খপ করে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। আমি কিচ্ছু বললাম না। অন্যসময় হলে এইমুহূর্তে আমি নিশ্চিত বিরক্ত হয়ে বলে উঠতাম, ‘আমার সময় হলে যাবো। একদম জোর-জবরদস্তি করবে না।’ কিন্তু এখন এইক্ষণে এসে আমার আর সেই কথাটুকু বলতে ইচ্ছে করলো না। অপমানের জ্বালা চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরলো। যার জন্য আমি পুরো পৃথিবী ছাড়তে প্রস্তুত সে আমাকে কেয়ারই করে না। আমাকে সে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করে না। আমার চোখ ছাপিয়ে জল এলো। শুদ্ধ তা দেখলোও। কিন্তু তার চোখে আমি কোনো অনুতাপ, কিংবা মায়া দেখলাম না। সেসব তো দূর করুণার ছায়াটুকু পর্যন্ত ছিলো না।

দাদুভাই বললেন,

‘সকালের নাস্তা করে যেয়ো, শুদ্ধ। পরোটা আর আলু ভাজি। তুমি চাইলে একটা ডিম পোজ করে দিতে বলি?’

দাদাভাই যে শুদ্ধর এককথায় রাজি হয়েছেন তা আর ভেঙে ভেঙে হলফ করে বলতে হবে না। তার চোখে মুখের ঝিলিকেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি শুদ্ধর এই ডিসিশনে অতিমাত্রায় খুশি। শুদ্ধ মাথা দুলিয়ে হেসে তার ঝাঁকড়া চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো,

‘আমার সব জায়গায় খেতে বসে পরার অভ্যাস নেই।’

শুদ্ধর কথাটা শোনা গেলো, আমার অন্যের ঘরে নোটিশ বহীন যখন তখন খেয়ে বেড়ানোর অভ্যাস নেই। সে অতি ভদ্র ভাষায় বলেছে বলেই ভদ্র লোকগণ প্রথম দেখায় এই ত্যাড়া লোককে খুবই ভদ্র বলে দাবি করবেন। তবে মুরব্বিরা সাধারণত এই ধরনের কাট কাট কথাবার্তা বলা ছেলে পেলেদের পছন্দ করেন না। যথারীতি দাদুভাইয়ের কাছেও শুদ্ধ বড়োই অপছন্দনীয়। তার কাছে শুদ্ধ’কে খুবই ঠান্ডা মাথার বেয়াদব কিছিমের লোক এবং অত্যাধিক ধূর্ত বলে মনে হয়। এ ধরনের ধূর্ত ছেলেরা সাধারণত সংসার পাতে বোকা কিছিমের মেয়েদের সাথে। ধূর্ততার সাথে না পেরে বোকার অভিমান জমতে জমতে একসময় তলানি পরে আর উপরটুকু থাকে পরিষ্কার, পাতলা, ট্যালটেলে। সেই পাতলা তরলটুকুর নাম সম্পর্ক।

আমাকে যে ইনটেনশনালি শুদ্ধর সামনে থেকে সরিয়ে আনা হলো তা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। এ অবশ্য নতুন নয়। দাদুভাইয়ের মতো শুভ্রভাই এবং ধ্রুবভাইও শুদ্ধ’কে পছন্দ করেন না। আরো বেশি পছন্দ করে না আমাকে শুদ্ধর আশেপাশে দেখা। কোনো এক দৈবিক কারনে আমার বাবাও শুদ্ধকে পছন্দ করে না। আমার এখন শোকের প্রতীক কালো পোশাক পরে রাজকীয় গম্ভীর ভঙ্গিতে বলতে ইচ্ছে করছে,
‘আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসে না, তবুও সে আমায় ভালোবাসলো না। ‘

এবং এরসাথে আমার মন চাইছে শুদ্ধও নাটকীয় ভঙ্গিতে তা স্বীকার করে বলুক, ‘তরু ছাড়া এই এক জনমে আমাকে আর কেউ ভালোবাসেনি। আমার এ জীবন তরুর তরে সমর্পিত।’

০৪.
শুদ্ধ এ বাড়িতে আছেন আড়াই বছর ধরে। প্রথম দিকে তার ব্যবহার আমার মোটেও পছন্দ ছিলো না। আমি তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। এক, দুই মাস একটু পুরাতন হতেই দেখা গেলো তার সাথে সাক্ষাৎ হলেই ‘খুকি খুকি’ করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছেন। উঠতি বয়সের মেয়েরা নিজেদের বড় ভাবতে পছন্দ করে। কাজেই আমিও তার এই খুকি ডাক কোনোমতেই গ্রহণ করতে পারলাম না। সাত-আট মাস পর্যন্ত তাকে দেখলেই বিরক্তিতে আমার নাকের পাটাতন ফুলে উঠতো। তারপর কোন জেনো এক অজানা লগ্নে তার সাথে আমার ভাব বিনিময় হলো। আমি জানতে পারলাম লোকটা ভারী চমৎকার। তার ভাবনা গুলো ভীষণ সুন্দর। সে আমার সাথে পরামর্শর আয়োজন করতো,

‘তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে, খুঁকি?’

বলে রাখা ভালো আমি তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। আমি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম,

‘তরু বলুন। নাহলে উঠে চলে যাবো।’

তিনি গ্রাহ্যই করলেন না। বললেন,

‘বলোতো খুকি, সাতকাহন কার উপন্যাস?’

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লাম কিন্তু তার খুকি ডাক ছাড়াতে পারলাম না। তবু আগ্রহ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম,

‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।’

তিনি অকপটে ঘোষণা জানালেন ‘আমি একজন বিশিষ্ট লেভেলের মাথামোটা। আমাকে ইন্টার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে থালাবাসন মাজতে বসিয়ে দেওয়া উচিত। আমার মস্তিষ্ক পুরোদস্তুর অপরিপক্ক। মুরগির গু দিয়ে ভরপুর। সুতরাং, আমার জন্য খুকি নামটাই পার্ফেক্ট।’

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,

‘কে লিখেছে?’

‘সমরেশ মজুমদার।’

আমি মুখ টানা মেরে বললান, ‘আমি জানি সমরেশ মজুমদার। দেখলাম আপনি জানেন কিনা!’

শুদ্ধ আমার কথা বিশ্বাস করলেন। কারণ আমি টুকটাক বই পড়ি। এবং মাঝেমধ্যেই ইচ্ছাকৃত উল্টাপাল্টা লেখকের নাম বলি।

‘তোমার মতে কোন লেখক আন্ডাররেটেড? আর কোন লেখক ওভাররেটেড?’

‘সমসাময়িক?’

‘যেকোনো।’

‘আমার জ্ঞান খুবই অল্প। তাই লেখক জাজ করা আমার একদমই উচিত হবে না। তবে আমার অপছন্দের লেখক …. ।’

আমি নিচু আওয়াজে বললাম নামটি, পাছে যদি আবার পাঠকগণ তাদের প্রিয় লেখকের হয়ে আমাকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে আসে? শুদ্ধকে প্রশ্ন করলাম,

‘আপনার অপছন্দের লেখক কে, শুদ্ধ ভাই?’

বলে রাখা ভালো সেসময় আমি তাকে ‘ভাই’ বলেই সম্বোধন করতাম। আমার প্রশ্ন শুনে উনি উত্তর করলেন,

‘আমি নিজেই।’

‘কেনো আপনি কি লেখালেখি করেন?’

‘লিখি না বলেই তো আমি নিজেই নিজের অপছন্দের লেখক। কত লেখার ট্রাই করেছি তোমার বয়সী থাকতে।’

উনার কথা শুনে আমরা একসাথে অল্প বিস্তর হাসলাম। আহা! সে কি মধুর সময়। যদি আগে জানতাম তার প্রেমে এভাবে পা পিছলে পরবো আমি!তবে কক্ষনো তার সাথে বৈঠকে বসতাম না। সেই স্মৃতি গুলো আজ এই সময়টায় এসে খুব পীড়াদায়ক। আমি বলেছিলাম সেদিন গর্বে বুক ফুলিয়ে,

‘আমিও লেখার চেষ্টা করবো।’

‘লেখা এতো সহজ নয়। আগে এইচএসসি শেষ করো, খুকি।’

উনার বিদ্রুপ শুনে আমি মুখ ভার করলাম। উনি কি বোঝাতে চাইছেন, আমি গর্দভ স্টুডেন্ট বলে কি ইন্টার পাশও করতে পারবো না? আশ্চর্য! আমি এতোটাও গবেট নই। আমি গাল ফুলিয়ে জবাব দিলাম,

‘পাশ করার মতো ব্রেইন আছে আমার। হুহ!’

শুদ্ধ আমার কথায় অযথাই বিকট হাসিতে ফেটে পরে বললেন,

‘খুকি, তোমাকে মুখ ভার করলে তো খুব সুন্দর দেখায়।’

তার প্রতি লাইনে খুকি খুকি যেনো আমাকে বুঝিয়ে দেয় আমি কতটা গরু জাতের। আমার মুখ আরো ভার হয়ে আসতো। সত্যি বলতে আমি আগে কিছুটা বলদ জাতেরই ছিলাম। বর্তমানে নিজের কাছে নিজেকে বড় জাহির করার জন্য বুদ্ধিমতী বলে দাবি করলেও আমি আসলে সেই বলদ-ই রয়ে গেছি। নচেৎ ওমন নস্যাৎ লোকের পেছনে কে ঘুরে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে