হেমন্তের নীড় পর্ব-০১

0
10

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০১

১.
‘এই মূহুর্তে ঠোঁটের আলকাতরা গুলো মুছবি। চোখের উপর কি সঙ দিয়েছিস? তুলে ফেল এক্ষুণি। শাড়ি পড়েছিস কোন সাহসে?’

‘আশ্চর্য! আমার কি একটু শাড়ি পড়ার সাধীনতাও নেই?’

‘তোকে মার্জিত পোশাক পরে যেতে বলেছিলাম।’

‘শাড়ি অবশ্যই একটি মার্জিত পোশাক।’

‘তর্ক করছিস কোন সাহসে? কথা কানে যায় না? শাড়ি পরে রংঢং করবি তারপর ছেলেরা দেখে পছন্দ করবে। পেছন পেছন ঘুরবে এসব খুব এঞ্জয়েবল লাগে?’

শুভ্র ভাইয়ের কথায় কান’টা আমার ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। চু শব্দ করে চলে আসতেই সামনে এসে দাড়ালেন আরেক দানব। ধ্রুব ভাই! তিনি আরো দ্বিগুন গরম মেজাজে গলা চড়িয়ে বললেন,

‘আজকের অনুষ্ঠানে একটা ছেলে তোর ছবি তুলেছে তুই আবার হাসিমুখে পোজ দিয়েছিস? যার তার ফোনে ছবি রাখার এতো শখ?’

‘ও আমার থেকে ছোটো।’

‘তো?’

‘এবার কিন্তু অসহ্য লাগছে আমার!’

‘থাপ্পড় খাবি, বেয়াদব?’

আমার রাগের উপর এদের ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে আমার রাগের পারদ চিড়বিড় করে বাড়লো। বিগত দুই ঘন্টা থেকে ঘুরেফিরে তারা দুজন একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্নভাবে মশলা মাখিয়ে আমাকে ঝাড়ির উপরে রেখেছে। নেহাৎ আমি ভদ্র মেয়ে। তাই ভদ্রতার খাতিরে কোনো প্রত্যুত্তর করছি না। এক কান দিয়ে ডুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এদের যন্ত্রণায় যেকোনো সময় ঠুসঠাস করে মাথা’টা ফেটে যেতে পারে। তাই চেঁচিয়ে ডেকে উঠলাম,

‘দাদুভাই, দাদু…ভাই।’

দাদাভাই এলেন লাঠিতে ভর করে ঠুকঠুক আওয়াজ করতে করতে। এসেই তিনি বিরক্ত হয়ে আরো এক কাঠি উপরে গরম মেজাজ দেখিয়ে বললেন,

‘এতো বড় মেয়ে ষাড়ের গলায় চিল্লাচ্ছিস কেনো? এলাকার লোক সব সজাগ হয়ে যাবে।’

অতঃপর আমি বুঝে ফেললাম এ বাড়িতে আদতে আমার বিন্দুমাত্র দাম নেই। এদের অত্যাচারে একদিন ঠিক ঠিক আমাকে বনবাসে চলে যেতে হবে। দীর্ঘ এক আর্তনাদের নিঃশ্বাস নিজের বুকের ভেতর চেপে বললাম,

‘অবশ্যই চেঁচাবো। এরা কি আমাকে জোকার পেয়েছে? দুইজন একসাথে শুরু করে দিয়েছে এই রাত বিরেতে। মায়ের বকা, তোমার বকা, এদের দুজনের বকা। আমি এইটুকুন একটা মাসুম বাচ্চা! এতো বকাবকি হজম করতে পারি?’

শুভ্র ভাই বোধ হয় তার ধৈর্য্য আর ধরে রাখতে পারলেন না। চোখের সাদা অংশ লাল করে বললেন,

‘মারবো টেনে এক চর। তোমাকে ভালো কিছুই বলা যাবে না? কিছুই শেখানো যাবে না? তুমি একাই একশ? যা করতে চাও তা করতে দিলেই খুব খুশি, না?’

আমার মুখ’টা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। শুভ্র ভাই দাদুভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এবার বললেন,

‘দাদুভাই, আপনি কি জানেন? আপনার এই নাতনি বাড়ির বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই হয়ে যায় জন্মের বেহায়া। ছেলেদের সাথে মুখে মধু নিয়ে হেসে হেসে কথা না বললে তো তার পেটের ভাত’ই হজম হয় না। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেউ বিয়েবাড়ির সাজ দিয়ে যায়? গাঁইয়া কোথাকার!’

গাঁইয়া! বেহায়া! আমাকে এইভাবে অপমান? আজ যদি দাদাভাই এর বিচার না করেন তবে আমি বিষ খাবো। কিন্তু আমার এই পণ বহাল রাখা তো দূরের কথা আমি মুখ দিয়ে উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারলাম না কারণ দেখা গেলো আমার মুখ থেকে বের হওয়ার আগেই আমার দুই হারামি ভাই এবং দাদাভাই তিনজন তিন কৌটা নেংটি ইঁদুর মারার বিষ এনে দিয়েছেন। আমার ইঁদুরের বিষ খেয়ে মরার ইচ্ছা আপাতত নেই। সুতরাং আমি চুপ থাকলাম এবং আমার এই সরলতার সুযোগ নিয়ে ওইদিকে আরেক টেপ রেকর্ডার বাজলো। ধ্রুব ভাই বললেন,

‘শুধু কি তাই? চেনা নেই জানা নেই অচেনা কোন বখাটে ছেলেপেলেদের ফোনে ছবি তুলেছে আপনার নাতনি। ভাবুন কতটা গোঁয়ার!’

ইয়া মাবুদ! আমাকে গোঁয়ার ডেকেছে? আমি তোমার কাছে বিচার দিলাম। তুমি এর বিচার করো। আমি দাঁতে দাঁত পিষে মেঝের দিক তাকিয়ে রইলাম আলাভোলা মুখ করে। ধ্রুব ভাইকে আমার কুত্তা দৌড়ানি খাওয়াতে ইচ্ছে করলো কিন্তু এবারও আমার ইচ্ছেগুলো মাটিচাপা দিয়ে আমি আব্বুর আসার অপেক্ষা করলাম। কারন এই ইহজগৎ এ ওই এক বাপ ছাড়া আমার পাশে দাঁড়ানোর আর কেহই নেই। আমার টিম মেম্বার এবং শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে শুধুমাত্র, কেবলই, একমাত্র আমার বাবা। দাদুভাই রায় দিলেন,

‘এটা খুব বাজে কাজ হয়েছে। এই জঘন্য অপরাধের জন্য আমি তরু’র কাল দুপুর পর্যন্ত খাবার বন্ধ করলাম। তরু খেতে পারবে কাল রাত ৯ টা বেজে ১ মিনিটে।’

শুভ্র ভাই এবং ধ্রুব ভাই এই রায়ে একদমই খুশি হলেন না এবং তা তাদের চোখ দেখেই বোঝা গেলো। তারা খুশি হতেন যদি আমাকে দুই মাস ঘরবন্দীর রায় দেওয়া হতো। আমি রাগে দুঃখে বাংলার চলচ্চিত্রের শাবানার মতো দুই হাত দুই কানে দিয়ে বলে উঠলাম, ‘নায়ায়ায়ায়া….।’ কিন্তু আমার না বোধহয় কারোর কানে ঢুকলো না। যে যার মতো চলে গেলো। আমি সিনেমার মধ্যে মশলা এড করার জন্য স্লো মোশনে দৌড়ে আমার ঘরের দিকে রৌনা হলাম। আর মনের মুখে বলে গেলাম,

‘অসম্ভব! আমি খাদ্য প্রেমী মানুষ। একদিন না খেয়ে থাকলে আমি তো মরেই যাবো। নিকুচি করেছে ওদের ঘোষণার। ওদের ঘোষণা আমি থোরাই কেয়ার করি? এদের যন্ত্রণায় আমার জীবন’টা একদম শ্যাষ!’

২.

শুভ্র এবং ধ্রুব ভাই আমার দুই জেঠার ছেলে। হুমায়ুন আহমেদ এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় উভয়ের দুটি বিখ্যাত চরিত্র আমার ঘরেই অবস্থান করে। যদিও বিখ্যাত চরিত্রদের সাথে আমাদের ঘরে অবস্থানরত দুই চরিত্রের কোনোদিক থেকেই কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার সরল, হাবা, স্লো মেশিনের অধিকারী মস্তিষ্কের ভাবনার অনুপাতে, কোনো এক অতিব গোপন কারণে আমার দুই জেঠির মাঝে বিশেষ নিশ্চুপ দ্বন্ধ অর্থাৎ জেদাজেদি চলে। বিষয়টা অতিব গোপন না আবার প্রকাশ্যও না। জায়ে জায়ে খোঁচা মারা, ঠেস দেওয়া, জেদাজেদি চলবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের এই শীতল, অকথ্য, চোখেচোখে শান্ত যুদ্ধ আমার নিরেট মস্তিষ্ক বোধ হয় এতকাল হালকার উপর ঝাপসা একটু বুঝতে পেরেছে কিন্তু এই বুদ্ধিহীন মস্তিষ্ক তার কারণ উদঘাটন করতে পারছে না। কারণ একইসাথে আমার মায়ের সাথে তাদের দুজনের সম্পর্ক পাল্লাপাল্লি পর্যায়ে অতিব সুন্দর এবং নম্র। ধ্রুব এবং শুভ্র এই দুটি বিখ্যাত নাম হওয়ার পেছনের কারণও বুঝি তাদের ওই নিরব দ্বন্ধ। এও বহু ঘাটাঘাটি এবং বহুল গবেষণার পরে নিজের সকল অকর্মণ্যতার বুদ্ধি ঢেলে একটু একটু আন্দাজ করেছে আমার মান্দাতার আমলের, দ্যা গ্রেট স্লো মস্তিষ্ক।

এই মূহুর্তে আমি স্লো মোশনে দৌড়ে আমার ঘরে গেলাম না। অটোমেটিক ভাবে পা দুটো পথ পাল্টে চলে এলো চিলেকোঠার ঘরে। আমি দরজায় হালকা টোকা দিলাম। সেটা আমার নিজের কানেই তেমন শোনা গেলো বলে মনে হলো না। অথচ ভেতর থেকে গম্ভীর গলার পুরুষ’টির স্বর ভেসে এলো,

‘কিছু বলবে?’

‘জি।’

‘বলো।’

‘এতো অভদ্র কেনো আপনি? ভেতরে আসতে না বলেন, এটলিস্ট দরজা তো খুলে কথা বলতে পারেন।’

তিনি দরজা খুললেন না। অবশ্য এটা আজ নতুন নয়। এক বছর থেকে হয়ে আসছে। ভেতর থেকে তিনি বললেন,

‘অভদ্র মানুষকে দরজা খুলতে বললে অভদ্র কাজ করে ফেলতে পারে। তখন?’

আমি মাথা নিচু করে বিরবির করে বললাম,

‘হক না! পারলে বিয়ে করে নিন। মুখ দিয়ে তিনবার কবুল আর হাত দিয়ে একটা সই করে দিলে কার কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?’

তিনি বোধহয় শুনলেন। নাহলে ভেতর থেকে এই উত্তর কি করে এলো? কিন্তু শুনলেন কীভাবে? হাতির কান নাকি?

‘পাগলামো না করে যাও এখান থেকে। তোমার জন্য আমি ঘর ছাড়া হই তা নিশ্চয়ই চাও না?’

আমি কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। মিনিট কয়েক নিরব গড়ার পর আমার গলা কেমন ধরে এলো।

‘একটু খুলুন না। কথা দিচ্ছি এক নজর দেখেই দৌড় দিবো আর একটা কথাও বলবো না।’

পাষানের মন গললো না। তিনি দরজা খুললেন না মিনিট দশেক গড়িয়ে গেলেও আমি দীর্ঘশ্বাস বুকে বোঝাই করে চলে আসতেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো৷ অতঃপর আমার অতি কাঙ্ক্ষিত পুরুষ’টি বের হয়ে এসে আমার চক্ষুদ্বয় শীতল করলেন। আমি মুগ্ধতায় খেই হারালাম। পাঁচদিন পর তার মুখটা দেখে আমার মনে হলো আদতে এই আশ্চর্য সুন্দর বদনখানি আমি পাঁচযুগ পর দেখলাম। আমার ঠোঁটে তখন বিশ্বজয়ের হাসি অথচ তিনি বললেন,

‘তোমার দাদুভাইকে বলো জানুয়ারিতে আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। চোখ যেনো কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। চোয়াল আমার ঝুলে গেলো। এহেন সব অবাকতার সাথে নিজেকে নিজেই শুধালাম,

‘মানে? আজকে অক্টোবরের ২০ তারিখ। নভেম্বর, ডিসেম্বর। দুই মাস? আমি কি কানে ভুল শুনলাম?’

আমার প্রিয় পুরুষটি বললেন,

‘নহে বালিকা! যা শুনিয়াছো ঠিকই শুনিয়াছো। তোমার অত্যাচার তো আর কুলানো যাচ্ছে না।’

আদতে তিনি এমন কিছুই বলেননি। সবই আমার কল্পনা। তিনি আমার কথার কোনো ধারই ধারেন নি। আমার চোখে পানি এলো না। কারন আমি জানি তার যাওয়া আমি অবশ্যই ঠেকাতে পারবো। কিন্তু আমার শখের পুরুষের শখের নারীটি কেনো আমি নই? এই ভেবে আমার বুক ক্রমশ ভারী হচ্ছে। আমি বুক ভরা মন খারাপ নিয়ে কেমন নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করেছিলাম সেদিন,

‘আচ্ছা, আমাকে আপনার দেখতে ইচ্ছে হয় না? আমি কি যথেষ্ট সুন্দরী নই?’

আমার শখের পুরুষ আচমকা তখন আমার দিকে ঝুঁকে এলো। তার পোড়া কালচে খয়েরি ঠোঁট এবং আমার মোলায়েম নুড লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটের পার্থক্য কেবল তখন তিন ইঞ্জির। আমার পড়নে তখনো শাড়ি এবং তার গায়ে স্বভাবতো-ই নতুন জামাইয়ের মতো সাদা লুঙ্গি আর সাদা সেন্টো গেঞ্জি। আশেপাশে বাতাসের হই হুল্লোড়। রাস্তার হলদে নিয়ন বাতির আলো এসে তার উপর পরতেই তাকে দেখাচ্ছে বিয়ের বরের মতো। মনে হচ্ছে আজ তার গায়ে হলুদ। গলায় একটা গামছা আর গালে একটু হলুদের ছোঁয়া থাকলেই একদম পারফেক্ট হতো। অল্প বয়স্ক ছেলেদের লুঙ্গি পড়লে আমার কাছে বিদঘুটে লাগে। তবে আমার শখের পুরুষটিকে লাগে স্নিগ্ধ। আমি তার দিকে তাকিয়েই থাকি। ওই তামাটে বর্ণ, কালি পড়া গভীর দুটি নয়ন, সিল্কী এলোমেলো চুল, গোলগাল মুখ, এক গোছা দাড়ি। কি দেখে যে এতো পাগল হলাম আমি নিজেই জানি না। তবুও পাগল হলাম। অজান্তেই! আমি তখনও তাকে পর্যবেক্ষণ করছি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আর তিনি কন্ঠ খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে আমাকে বলছেন,

‘ওভাবে চেয়ে দেখো না অঙ্গনা, তুমি ছারখার হবে!’

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে