হৃদয়ের_আয়না পার্ট_১
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস
“আপনি আজও দেরি করে বাসায় এসেছেন।
আপনার জন্য আমি রাতের খাবার নিয়ে কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি।”
“আপনাকে না আমি বলেছি, আমার জন্য শুধু শুধু খাবার নিয়ে বসে না থাকতে,,আমি রাতের খাবার বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।”
“আপনি এমন কেন?আপনি বুঝেননা কেন আপনার জন্য আমি রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করি।”
“না বুঝিনা, আর বুঝতেও চাই না।”
“কেন বুঝেন না,আপনি সব বুঝেন কিন্তু সবকিছু বুঝেও আপনি না বুঝার অভিনয় করেন। আপনি এমন কেন,, কতটা ভালবাসি আপনাকে,, আগে যে মেয়ে রাত জাগতে পারত না,,সে এখন আপনার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করে আপনার সাথে একসাথে খাবে বলে,আগে রান্না জানতাম না,ভেবেছিলাম রান্নাও শিখব না,কিন্তু যেদিন থেকে আপনার ভালবাসার পিঞ্জরে আটকে পড়ে গেছি সেদিন থেকে শাশুড়ি মার কাছ থেকে রান্না শিখেছি। আজকে আমাদের বিয়ের ১০মাস হতে চলল অথচ আপনার মনে আমি এতটুকু জায়গা বানিয়ে নিয়ে পারি নি।যদি বউকে ভালবাসতে না পারেন,, একজন স্বামীর কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করতে না পারেন তাহলে আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?”
“আমার মা বাবার জন্য।নাহলে আমি আপনাকে জীবনেও বিয়ে করতাম না।আমি আপনার কষ্ট বুঝি কিন্তু আপনি আমার থেকে যা আশা করেন তা আমি আপনাকে দিতে পারব না।মা বাবা আর ২মাস পর হজ্বে যাবেন তারপর নাহয় আমি আপনাকে এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে দিব।দয়া করে এই ২মাস আপনি আমার স্ত্রী হওয়ার অভিনয় করে যাবেন।”
“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন তা ক্লিয়ার করে বলুন,,”
“আপনাকে আমি ২মাস পর ডির্ভোস দিয়ে দিবো।”
“কি নিষ্ঠুর লোকটা,কি সুন্দর আর সহজ করে কথাটা বলে ফেলল।”
.
.
বৃষ্টি,,এই বৃষ্টি এখনো ঘুমাচ্ছ। কি হল শুনতে পাচ্ছ না,দূর,ঘুমাক যতখুশি আমার তাতে কি?বৃষ্টি ঘর থেকে তেমন বের হয় না তাই বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা আটকে দিয়েছি।সারাদিন অফিসের কাজ শেষ করে যখন বাসায় আসি তখন ও দেখি বৃ্ষ্টি একিভাবে শুয়ে আছে।বিষয়টা সুবিধের মনে হল না,,ওর কপালে হাত দিতে দেখি জ্বরে শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করে পানি এনে ওর কপালে কাপড়ের পট্টি দিয়েছি।সারারাত জ্বরে মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে,, জ্বরের ঘোরে অনেক কিছু বলেছে যা শুনে নিজেরও খুব কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু আমার কিছু করার নেই,,শেষ রাত্রে ওর শরীর থেকে জ্বর নামলো।
“এখন কেমন লাগছে,”
“ভালো,,”
“নিন আমি নিজ হাতে আপনাকে খাইয়ে দিচ্ছি,কিছু খেয়ে নিন ,তাহলে দেখবেন ভালো লাগবে,,”
“না আমি খাব না,,”
“কেন?,,,”
“কারণ আপনার কারণে আমার জ্বর হয়েছে এইজন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে?”
“আমার জন্য আপনার জ্বর হয়েছে!!?”
” হ্যা আপনার জন্য,কালকে রাতে আমি আপনার সাথে রাগ করে শাওয়ার নিয়েছি আর তাতে আমার এই অবস্থা,,”
“কেন এইসব পাগলামি করতে গেলেন,মানুষকে কষ্ট আর বিরক্ত করতে আপনার খুব ভালো লাগে তাই না?”(বকা দিয়ে)
….
“আচ্ছা প্লিজ আর কাঁদবেন না,”(শান্ত হয়ে)
“আপনি আমাকে বকা দিলেন কেন?অসুস্থ মানুষকে কেউ এভাবে বকা দেয়।”
“সরি ভুল হয়ে গেছে, প্লিজ ক্ষমা করে দেন।”
“হবে না,,আগে শাস্তি,,তারপর ক্ষমা,”
“ওকে,, বলেন কি শাস্তি দিবেন আপনি আমাকে,,”
“আপনি আমাকে দেখে সবসময় বিরক্ত হন সেটা আমি জানি।বিশ্বাস করুন আমার কিছু চায় না,শুধু আপনার মা, বাবা,আর আপনাকে নিয়ে আমি আমার বাকিদিনগুলো পাড় করে দিতে চাই।আপনাদের জন্য কাজ করতে আমার মোটেও কষ্ট হয় না,নিজের আপন মানুষ ভেবে আমি ভালবেসে এইকাজগুলো করি।আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা না দেন অন্তত আপনার সেবা করার জন্য আমি আপনার সাথে থাকতে চাই প্লিজ আমাকে ডির্ভোস দিয়ে কষ্ট দিবেন না যদি আমি কোনদিনও এই পরিবারের কোন উপকার করে থাকি তাহলে….আর কথা বলা বলতে পারছি না এরপর যা বলছি কান্নার কারণে তা অস্পষ্ট শুনা যাচ্ছে।”
“প্লিজ আপনি শান্ত হন,, আচ্ছা ঠিকাছে আপনাকে ডির্ভোস দেব না কিন্তু আমারও শর্ত আছে আপনি আমার কাছ থেকে কিছু আশা করবেন না তাহলে,,”
“মুখের কথা টেনে, ঠিকাছে আমার তাতে সমস্যা নাই,কিন্তু আমার যে কাজে আপনি বিরক্ত হন সেগুলো করে আপনাকে বিরক্ত করতে চাই,,কারণ আপনাকে বিরক্ত করতে আপনার ভালো লাগে প্লিজ আমার কোন কাজে বিরক্ত হয়ে আমাকে কখনো ভুলেও এই কথাটা বলবেন না যে,আপনাকে ডির্ভোস দিয়ে দিব।”
“কিছুক্ষণ ভেবে আচ্ছা,, নিন খাবার খান,,,”
“না এখনও খাবো না,,”
“কেন?আবার কি হয়েছে?”
“আপনাকে শাস্তি পেতে হবে? তারপর,”
“ও মা একটু আগে না শাস্তির কথা ঘোষণা করে দিলেন তাহলে,,”
“সেটাতো আমাকে বকা দিয়েছেন তাই বকার শাস্তি দিয়েছি এখন আমাকে খাওয়াতে চাইলে আমার আরেকটা শাস্তি মাথা পেতে নিতে হবে?”
“উফ, আচ্ছা বলেন”,,
“আপনি আমাকে আপনার স্ত্রী মনে না করতে পারেন কমপক্ষে আমাকে আপনার বন্ধু মনেতো করতে পারেন প্লিজ আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।”
“হুম বুঝলাম,কিন্তু এটা কোনরুপ শাস্তি হল, বুঝতে পারলাম না,,”
“আরে বন্ধু হলে আপনাকে জ্বালাবো সারাক্ষণ, বন্ধুরাতো তাই করে করে,তা নয় কি?”
“বাব্বাহ,, আমাকে জ্বালানোর ফন্দি,, এইসব হবে না,,কারো জ্বালাতন আমি সহ্য করতে পারবো না,,”
“তার মানে আপনি চান না আমি খায়,,”
“আচ্ছা, আচ্ছা ঠিকাছে,, আমাকে জ্বালায়েন,,যত খুশি জ্বালায়েন ঠিকাছে,,’প্লিজ খান এবার,,”
“তারমানে আমরা আজকে থেকে ফ্রেন্ডস।”
“হুম”
“আরে বসে আছেন কেন,,খাওয়াবেন না,, খিদা লাগছেতো,”
“হুম নেন ,”
“খেতে খেতে আচ্ছা আমরা ফ্রেন্ড থেকে বেস্টফ্রেন্ড হতে পারি না?”
“না,,”(কঠিন স্বরে)
“কেন?বেস্টফ্রেন্ড হতে সমস্যা কোথায়?”
“অনেক সমস্যা কারণ বেস্টফ্রেন্ডের জায়গা অনেক আগে অন্য একজন দখল করে নিয়েছে তাই, ওই জায়গার অধিকার শুধু ওরই অন্য কেউ এসে ওর সেই অধিকারে হাত বাড়াক তা আমি চাই না,সে যেই হোক না কেন,,বাকি খাবারটুকু নিজে খেয়ে নিয়ে টেবিল থেকে ঔষুধটা নিয়ে খেয়ে নিবেন।”
“আচ্ছা,,হঠাৎ করে উনি এত রেগে গেলেন কেন?”আমার এই কথায় রাগার কি আছে?মাঝে মাঝে উনি যে কোন কথায় রেগে উঠেন বুঝতে কষ্ট হয়,”
.
.
এরপরে ভালোই দিন কাটছিল আমাদের, এখন উনি আর রাত করে বাসায় আসেন না,একসাথে আমরা রাতের খাবার খাই,আগে উনি আমার হাতের রান্না খেতেন না,এখন খান,আমার সব কাজে আগে বিরক্ত প্রকাশ করতেন,কিন্তু এখন বিরক্ত হলেও আমার সেই শাস্তির কথা মনে করে বাইরে আর বিরক্তভাবটা প্রকাশ করেন না।ফ্রেন্ড হওয়াতে আমরা এখন অনেক কাছে চলে এসেছি,উনি এখন আমাকে আপনি না বলে তুমি বলে ডাকেন,কিন্তু ওনাকে আমি খুব সম্মান করি তাই আমি এখনো উনাকে আপনি বলে ডাকি,এখন উনি অনেক কথায় আমার সাথে শেয়ার করেন,আমরা একসাথে গল্প করি,খুনসুটি আর আমার জ্বালাতনতো সাথে আছেই।বেচারা মুখ বুঝে সব সহ্য করে।ফ্রেন্ড হওয়াতে আমরা অনেক কাছে চলে এসেছি সেটা সত্য শুধু দুঃখ একটাই আমি উনার ফ্রেন্ড ঠিকই কিন্তু বেস্টফ্রেন্ড হতে পারলাম না,ওই জায়গা অন্য আরেকজনের দখলে। কিন্তু সে কে?যার জন্য আকাশ আমাকে সে জায়গা থেকে বঞ্চিত করছে।যাইই হোক তারপরও আমি খুশি।
আজকে ১৩ ফ্রেবুয়ারী।আজকে রাত ১২:০০টায় ১৪ ই ফ্রেবুয়ারী আসবে,উনাকে আমি কত ভালবাসি আজকে তা উনার সামনে প্রকাশ করব।আমাদের বেডরুমটা ফুল দিয়ে আর চারপাশে মোমবাতি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছি।আলমারিতে অনেক শাড়ি আছে।একটা শাড়িও মন মতন হচ্ছে না,সব শাড়ি নামিয়ে ফেললাম, হঠাৎ একটা শাড়ি আমার চোখে পড়ল, আরে এই গোলাপি শাড়িটাতো আমার না,এটা কোথা থেকে আসল,,খুব সুন্দর শাড়িটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে, মনে হয় আকাশ আমার জন্য শাড়িটা এনে রেখে দিয়েছে, আমাকে শাড়িটা দিতে সম্ভবত ভুলে গেছে,এই শাড়িটা আজকে পড়ব।
“হ্যালো আকাশ,”
“হুম বৃষ্টি বল,”
“বলছি আজকে রাতে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় আসবেন,”
“কেন?”
“আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“দেখ আজকে মনে হয় বাসায় আসতে দেরি হবে,অফিসে অনেক কাজ,”
“প্লিজ তারপরও তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবেন আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব,”
“দেখি,”
.
.
রাত ১২:০০টা বেজে গেছে। কিন্তু উনি এখনো এলেন না,,মনটায় খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারো পায়ের জুতার আওয়াজ পেলাম,হ্যা এটা আকাশ,, এটা আকাশের পায়ের জুতার আওয়াজ।পিছনে ফিরে দেখি ওনি।
“ওনি রুমে এসে বললেন বৃষ্টি কি জন্য বাসায় তাড়াতাড়ি আসতে বলছ।আর কি সারপ্রাইজ রাখছ?”
“রুমটা আগে দেখেন”
উনি চোখ বুলিয়ে রুমটা দেখলেন,,তারপর রেগে উঠে বললেন,,
এই রুম এইভাবে সাজানোর মানেটা কি?আর তুমি how dare you এই শাড়িটা তুমি কেন পড়েছ,, এই শাড়িটা পড়ার অধিকার তোমাকে কে দিসে?এই কথাটা বলে উনি আমার গলা চেপে ধরলেন,,তুমি আমাকে এতদিন যা বলে এসেছ আমি তাই করে এসেছি কিচ্ছু বলে নি আমি,কিন্তু তুমি আজকে আমার সকল ধর্য্যের সকল সীমা পাড় করে ফেলেছ।এখনি শাড়িটা চেঞ্জ করে ফেলবে।আর যদি কোনদিন আমি তোমাকে এই শাড়িটা পরতে দেখি তাহলে সত্যি বলছি I will kill you.এই কথা বলে উনি চলে গেলেন। এত রেগে গেলেন কেন উনি?কি হয়েছে এই শাড়িটা পড়লে? বুঝতে পারছি না,খুব কান্না পাচ্ছে,উনি এমন কেন কেন বুঝেন না আমাকে?
.
.
উনি সারারাত বাইরে ছিলেন বাসায় এলেন না,
সারাটা রাত আমি কান্না করে পার করলাম,সকালে আমি রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখি ওনি স্টোররুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন,চোখ দুটি লাল হয়ে ফুলে আছে,, বুঝেছি উনিও রাতে অনেক কেঁদেছেন। যখনি উনার মন খারাপ থাকে তখনি উনি এই স্টোররুমে চলে আসেন,এই স্টোররুমে এমন কি আছে যেখানে উনি সময় পার করেন,,এখানে উনি যে সময় কাটান তার অর্ধেক সময়ও আমাকে দেন না।বিয়ের পর আমি যখন নতুন এই বাসায় আসি একবার শখ করে এই স্টোররুমটা খুলতে চেয়েছিলাম অনেক কষ্টে করে এর চাবি আকাশের কাছ থেকে লুকিয়ে এনে যেই দরজাটা খুলতে যাব দেখি আকাশ আমার হাত কেউ ধরে রেখেছে,সেদিন আমাকে অনেকগুলো বকা দিয়েছিল,আর এইও বলে দিয়েছিলো এই রুমের দরজা যাতে আমি ভুলেও না খুলি,,যদি খুলি তাহলে আমার অবস্থা খুব খারাপ হবে।সেদিনের পর থেকে আমি দরজার দিকে পা মাড়াই নি।কিন্তু এখন অবস্থা খুব জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে,,এই রুমের ভিতরে লুকিয়ে থাকা রহস্য আমাকে জানতে হবে।