#হৃদয়হীনা
Part–1
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
কলেজের ফাইনাল এক্সাম, কেমিস্ট্রি পরীক্ষার দিন, শায়েরীকে এক প্রকার বাধ্য হয়ে এক্সামে এটেন্ট না করে, বিয়ের পীঁড়িতে বসার জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সব ফ্রেন্ডরা যেখানে বিক্রিয়ার সমতা মিলাতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় শায়েরীকে সবাই মিলে বউ সাজানোতে ব্যস্ত!
বর্তমানে সে স্তব্ধ হয়ে পুতুলের মতো চুপচাপ কাঠ হয়ে আয়নার সামনে বসে আছে। চোখ বেয়ে বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে কিছু রঙিন স্বপ্নও ভেঙে যেতে দেখলো চোখের পর্দার সামনে। সদ্য তরুণীতে পা দেওয়া শায়েরীর অদৃশ্য ডানা দুটি যেন কেউ কেটে দিচ্ছে এমন পীড়াই বুকে এসে বিঁধছে। চাচী এসে জানালো ছেলেরা নাকি এক দেখাতেই আকদ করে ফিরে যাবে৷ ভাবা-ভাবি, দেখাদেখির কোন প্রয়োজন নেই তাদের।মেয়ে তাদের পছন্দ জন্যই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তাদের আসার কথা ছিল বিকেলের পর পর। সবকিছুই ঠিক ছিল। শায়েরীও এতো হৈচৈয়ের মধ্যে বই নিয়ে পড়া রিভিশনও দিয়েছিল কিন্তু লাভ কি হলো? ছেলের মা ফোন দিয়ে জানালো তারা দুপুরের মধ্যেই আসবে এবং দুপুরেই বিয়ে সম্পন্ন হবে৷ তার ছেলের নাকি বিকেলের পর কাজ আছে এজন্য সময়সূচি খানিকটা আগানো হলো। শায়েরীর বাবা চাইলেই পারতেন তাদের সমস্যার কথা জানাতে কিন্তু তিনি পাল্টা বললেন তাদের কোন সমস্যা নেই বরং যতোদ্রুত বিয়ে সম্পন্ন হবে সেটাই তাদের জন্য মঙ্গলজনক। এদিকে একটা বারও শায়েরীর মতামত নেওয়ার দরকার দেখলেন না তিনি৷ তারা নাকি গতকাল রাতেই সবটা জানিয়েছেন শায়েরীর বাবাকে কিন্তু এই খবর শায়েরীর কানে এসে পৌঁছালো সকাল বারোটার দিকে৷ কলেজের পরীক্ষা বেলা একটা থেকে শুরু। সে একঘন্টা আগেই রেডি হওয়ার জন্য ব্যস্ত হতেই তার চাচী বলে উঠে, কই যাবি তুই? এখন কোথাও যাওয়া নেই। ছেলেপক্ষ খানিকবাদেই এসে পড়বে৷
কথাটা তার কর্ণকুহর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ ছোট হয়ে গেল। বুক কেঁপে উঠে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। কলেজের এই এক্সাম না দিলে তাকে বোর্ড এক্সামে বসতেই দিবে না। রেজাল্ট ফেইল আসবে তার৷ তখন থেকেই হবু স্বামী নামক লোকটির প্রতি তার এক আকাশ সমান ঘৃণা ও অনাগ্রহের সৃষ্টি হলো। আনমনেই তাকে নিজের সবচেয়ে বড় দুশমন ভাবা শুরু করল সে।
সাজানো শেষ হওয়ার পর পরই চাচী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “মাশাল্লাহ আমাদের শায়েরী মনিকে কি যে সুন্দর লাগছে! দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন অচীন দেশের রাজকন্যা রাস্তা ভুল করে এখানে চলে এসেছে৷”
তার এক কাজিন ফোড়ন কেটে বলে উঠে, “দুলাভাই তো তোকে দেখে জ্ঞান হারাবে৷”
এই সিলি জোকেও সকলে ঘর কাপিয়ে হাসলো। শায়েরী ঘড়ির দিকে তাকায়। দুইটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। ক্ষণেই তার চোখে পানি এসে গেল। সে ডুকরে শব্দ করে কাঁদতে লাগলে তাকে ঘিরে অবস্থান করা ব্যক্তিরা তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগে। সবাই ভেবেই নেয় বিয়ে হচ্ছে জন্য কান্না করছে। বিয়ের দিন কনে কান্না না করলে মানায়ও না।চাচী তার মাথায় তার বুলিয়ে আদর করতে লাগলো। শায়েরীর সেই মুহূর্তে মন চাচ্ছিল, ছুটে পালিয়ে একটানে বিয়ের লাল শাড়ি ছুঁড়ে ফেলে, কলেজ ইউনিফর্মটা জড়িয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে।
কিন্তু মন চাইলেই কি সব ঘটে যায়? তাহলে হয়তোবা পৃথিবীটাতে “অসুখী” বলে কোন শব্দ থাকত না। সেও মনের কথা অনুযায়ী কাজ করতে পারল না। চুপচাপ বসেই রইল। এতোদিনে একবারও বাবার আদেশ অমান্য করেনি সে।আজকেও এর ব্যতিক্রম হলো না। চোখের পানি বলি দেওয়ার সাথে আকাশে উড়ার স্বপ্নটাও ধুলির ন্যায় মিলিয়ে গেল।
কেউ তার কষ্টটা বুঝতে পারছে না৷ কষ্ট যদি চোখে ধরা পড়ত তাহলে সবাই তার কষ্টের পরিমাণ দেখে হতভম্ব হয়ে যেত।
তখনই তার কানে এসে হূলের মতো “ছেলেদের গাড়ি চলে আসছে” শব্দটা বিঁধলো। মুহুর্তের মধ্যে তার রুমে জট পাকিয়ে থাকা দল হুড়মুড় করে রুম ত্যাগ করে। তাদের প্রস্থান করার সঙ্গে সঙ্গে রুমটা নিঃস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ালো এবং বারান্দার দিকে অগ্রসর হলো। বারান্দা থেকে নিচটা স্পষ্ট দেখা যায়। অবাধ্য চোখ নিচের দিকে গিয়ে আটকালো। তিনটে গাড়ি সত্যি এসে তার বাসার সামনে থেমেছে। দুইটি মাইক্রো আর মাঝে একটা প্রাইভেট কার। সাদা রঙের পারসোনাল কারটা ফুল দিয়ে সাজানো।নিশ্চয়ই বর সাহেব এই গাড়ি করে এসেছেন। শায়েরীর গা জ্বালা দিয়ে উঠলো। ভেতর থেকে রাগের দলা স্ফুরিত হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে গেস্টরা গাড়ি থেকে বের হতে লাগলো। কিন্তু সাদা গাড়িটা থেকে কেউই বের হচ্ছে না। তার মনে খটকা লাগে। সে ঝুঁকে এলো বারান্দার গ্রিল বরাবর। আসলেই কারটা থেমে আছে। ভেতর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। একে একে সবাই বের হলে, একেবারে শেষ সময়টায় সাদা গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে গেল।একটা সুবলিষ্ঠ, সুগঠিত পুরুষ অবয়ব চোখের সামনে হতেই শায়েরীর বুক ধুরুধুরু করে উঠানামা করতে শুরু করে।শ্বাস-প্রশ্নাস অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে লাগে৷ নিশ্চয়ই এটাই বর সাহেব! কারণ দুই মাইক্রো থেকেই সব যাত্রী নেমে পড়েছে এবং তাদের মধ্যে কেউই বর বেশে নেই। শেষ যাত্রী যে বর এতে তার দ্বীধা রইল না।
সে অপ্রতিভ হয়ে উঠে এবং চোখ বুজে বিড়বিড় করে বলে, এ আবার কেমন বর? নিজের বিয়েতে নিজেই ড্রাইভিং করে? অদ্ভুত!
ততোক্ষণে বাসার ভেতরে শোরগোল, হৈ-হুল্লোড় এসে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল বারান্দার গ্রিল থেকে।
বারান্দা থেকে রুমে প্রবেশ করতেই আহনাফ হাসান নামটা কানে আসলো। তার ভ্রু কুচকে যায়। এইরকম মুহূর্তে কে এই নাম উচ্চারণ করছে? আচ্ছা অনুষ্ঠানে কি আহনাফ হাসান এসেছে? এটা অসম্ভব! অবাস্তবও বটে।
শায়েরী একদন্ড ভাবলো।এমনও তো হতে পারে, ছেলের বন্ধু হয় আহনাফ । না এটা হতে পারে না। আহনাফের নিশ্চয়ই খেয়ে-পরে কাজ নেই যে তার বিয়ে খেতে আসবে৷ তাও আবার বাসায় হওয়া সাদামাটা বিয়েতে তো এমন মানুষ-জন আসবেই না৷ সে আগডুম-বাগডুম ভাবতে ভাবতেই চাচী আর তার কাজিন বাহিনী এসে তার কাছে এসে দাঁড়ালো। সবার মুখ হাসি-হাসি৷
চাচী বলে উঠে, ছেলেরা দেরি করতে চাচ্ছে না। কাজী ওদের সঙ্গেই এসেছে। বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেই খাওয়া-দাওয়া সারবে।
শায়েরী চুপসে গেল। তার মন চাচ্ছে বাবার পা ধরে কান্নাকাটি করে বলতে, আব্বু আমি বিয়ে করতে চাই না। আমি প্লেনে প্লেনে করে আকাশ ঘুরতে চাই৷ দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতে চাই। প্রকৃতি দেখতে চাই! রান্না-বান্না, চুলা সামলানোর কাজ আমি পারব না। পিঁয়াজ কাটলেই আমার চোখে পানি আসে। মশলার ঘ্রাণ নাকে এলেই বমি পায়, চোখ জ্বলে! কি করে সংসার করব আমি?
তার ছোটবোন শ্রুতির কথার আওয়াজ ধ্যানমগ্নতা কেটে যায়। শ্রুতি চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলে, “আপুই জানিস দুলাভাই কত্তো হ্যান্ডসাম! উনি অনেক স্টাইলিশ। সানগ্লাস পড়ে আসছে বিয়ে করতে।উফফ যা কুল না ব্যাপারটা!”
সে তার ছোটবোনের কথায় দারুণ বিরক্ত হলো।
তার বোন সবার সামনে অনর্গল বলে যেতে লাগলো, “আমাকে চকলেটও দিল। কত্তো ভালো উনি। ভাবা যায়?”
শায়েরীর একথা শুনে বোনের গালে চড় মারতে ইচ্ছা করছিল। একটা অচেনা লোক এসে চকলেট দিল আর ওমনি উনিও লোভী বাচ্চার মতো চকলেট নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। ছেঁচড়া কোথাকার। একটা চকলেট পেয়েই প্রশংসা বাণী ছুঁড়তে ব্যস্ত!
চাচী এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “চল মা দেরী করিস না। ছেলেপক্ষ তাড়া দিচ্ছে৷”
শায়েরী তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটা ধরলো। অস্বস্তি, চাপা বেদনা কাজ করছে তার মধ্যে। ভীষণ চিন্তিত সে।
তার বিয়ে উপলক্ষে বাসা সাজানো হয় নি। কাজেই ড্রয়িংরুমটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে কারো শুভ বিবাহ সম্পন্ন হবে। কোন সাজ-সরঞ্জাম নেই। কেবল বঁধু-ই হালকা সেজেছে।
ড্রয়িংরুমে পৌঁছেই চোখ গেল সোফার দিকে। কালো পাঞ্জাবি পড়া একটা ছেলে মাথা নিচু করে তার মুখ বরাবর বসে আছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সামান্য ঝুকলে হয়তো চেহারার গড়ন দেখা যাবে কিন্তু লজ্জায় শায়েরী সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তার বুকের সঙ্গে সানগ্লাস ঝুলিয়ে রাখা, সেদিকেই দৃষ্টি গেল তার। । তাকে দেখে শায়েরীর ভ্রু কুচকে গেল। বড় আজব তো লোকটা! বিয়ের দিন কেউ কালো পরে? দেখে মনে হচ্ছে ব্যাটা শোক মিলাদের অনুষ্ঠানে আসছে।
কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার হলো লোকটাকে দেখার পর পরই শায়েরীর মাথা ঘুরাতে লাগলো। এখনো চেহারা দেখেইনি। তার কেন যেন মনে হচ্ছে এটা কোন বুড়া লোক। চাচীর কথা কি তবে ঠিক?
এমনই মুহূর্তে খুব সুরেলা গলায় কেউ একজন বলল,এই যে আমাদের বউমা চলে এসেছে।
কথাটা কর্ণপাত হতেই তার গা বেয়ে হীম স্রোতপূর্ণ অনুভূতি বয়ে গেল। মাথা ঘুরানো বেড়ে গেল। কালো পাঞ্জাবি পড়া লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে সোজাসাপ্টা তার চোখে চোখ রাখলো। দুইজনের চোখাচোখি হতেই কালো পাঞ্জাবি পরিধানকারী স্মিত ভদ্রতাসূচক হাসি হাসল। কিন্তু শায়েরী হতভম্ব হয়ে গেল তাকে দেখে।চকিত হয়ে সামনের দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে দেখে। গলা শুকিয়ে আসলো। বিষ্ময়ে মূর্তি বনে গেল সে। দৃষ্টি তার অবিন্যস্ত। চোখের সামনে সে এটা কাকে দেখছে! ওমাগো! এই ছেলেটা টিভির ভিতরে অভিনয় করে না? আহনাফ হাসান তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! ভাবতেই তার মাথা চর্কির ন্যায় ঘুরতে লাগে। হাত ঘামে ভিজে উঠে। দু-দুটো শুকনো ঢোল গিলে ফেলে সে। এতোবড় সেলিব্রিটি তার বাসায় কী করছে? মাথা ফাঁকা হয়ে আসলো তার। মস্তিষ্কের প্রতিটা নার্ভ এতোই উত্তেজিত হয়ে উঠলো সে দাঁড়িয়ে থাকা দায় তার জন্য।
আহনাফ হাসান নামক নায়ক সাবেহ তাকে উদ্দেশ্য করে ঠোঁট নাড়ালো কিন্তু ঘাবড়ে যাওয়া, চমকে যাওয়া শায়েরীর কানে কিছুই এসে পৌঁছাতে পারলো না। এর আগেই সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে ধরলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি তার বলিষ্ঠ হাত দুটো দিয়ে বেশ শক্তপোক্ত ভাবে আকড়ে ধরে তাকে।
উপস্থিত সবাই থ বনে গেল। বিয়ের প্রধান আর্কষণ হলো বধু। তার এই দশা দেখে সকলের জন্যই গুঞ্জন উঠে যায়৷
গেস্টদের মধ্যে একজন বলে উঠে, মেয়ের আবার কী হলো?
আহনাফ হতভম্ব হয়ে যায়। এমন কিছু আশা করেনি সে মোটেও। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। তার এক বন্ধু এসে ফিচলে হেসে বলে, ভাবী তোরে দেইখাই ফিট খাইছে। এই মেয়ে তোর সঙ্গে সংসার করবে কেমনে? তুই চুমা দিলেও তো ভাবী সেন্সলেস হবে রে।
আহনাফ দুইহাতে তাকে আকড়ে ধরে বিরক্তি প্রকাশ করলো।
ততোক্ষণে অনেকেই শায়েরীর কাছে আসতে আরম্ভ করলো। হুট করে শায়েরী ঢুলে পড়ে আহনাফের বুকের মাঝে। সে তির্যক দৃষ্টি নিবন্ধ করে তার অজ্ঞান হওয়া বউয়ের দিকে।
ক্ষণেই আহনাফ চকিত উঠে এহেন কান্ডে। বিড়বিড় করে বলে, ওহ গড! শেষমেশ বিয়ে করতে এসে বৌ মারার কেসে ফাঁসবো কিনা? মিডিয়ার যে শ্রী! নিশ্চয়ই কালকে নিউজে আসবে, বাসর করার আগেই জ্ঞান হারালেন জনপ্রিয় অভিনেতা ও গায়ক আহনাফ হাসানের স্ত্রী। বিস্তারিত জানতে লিংকে ক্লিক করুন।
চলবে।