#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|১৬|
#শার্লিন_হাসান
নাজিয়ার সাথে কথা বলে ডকুমেন্টস নিয়ে নিবরাস বেড়িয়ে পড়ে। তবে তার হাতে নাজিয়ার আনা অনেকগুলো ফুল,চকলেট সাথে একটা পার্সেল। আনায়ার জন্য এনেছে নাজিয়া! নিবরাসের কাছে সেগুলো দিয়েছে। তাজা বেলী ফুলের দু’টো চুড়ি নিবরাস হাতে নেয়। দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে হাজারো বেলীর মাঝে দু’টো করে গোলাপ।
গাড়ীতে বসে গিফ্টগুলো সামনেই রাখে নিবরাস। শুধু হাতে বালা জোড়া। তার ইচ্ছে আনায়াকে নিজ হাতে পড়িয়ে দিবে। বালাজোড়া নিবরাস নাড়াচাড়া করছে তখন পরাগ বলে,
-ম্যাম তো রাগ করে আছে স্যার। রাগ ভাঙাবেন না?
-তুমি না বললে আমার মনেই ছিলো না। সন্ধ্যায় গার্ডেনের এককোণ সাজিয়ে রেখো। সাথে রাতের ডিনার,কেক,ড্রিং সব রেখো। আর হ্যাঁ কারেন্টের দিকে খেয়াল রেখো কেউ যাতে সুইচ অফ করে না দেয়।
-আচ্ছা আমি মেসেজ করে দিচ্ছি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতে।
-হুম দাও।
আনায়া মারিয়াকে বিদায় দিয়ে গাড়ীতে বসে পড়ে। তার মনে রাগ আছে প্রচুর তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিবরাসকে এবার কিছু বলবে না। চুপ থাকবে সেও দেখবে নিবরাস কতটুকু যায়! তার ইচ্ছে করছে তার বাবাকে কল দিয়ে সব অভিযোগ বলতে নিবরাসকে নিয়ো। এতো নেতা তার লাগবে না। আর না এসব শত্রু, চলার পথে পা ফেলতে এতো ভাবনা। নেতাকে পেয়ে লাভ কী? তাকে চায় একের পর একজন। পিছু পড়ে আছে! পিছু ছাড়ছে না।
-আমার কপালটাই এমন। আমার সবকিছুতেই অন্যদের ভাগ থাকবে। অন্যদের পছন্দ হবেই।
মির্জা বাড়ীতে আসতে দেখে একটু আগে নিবরাসরা এসেছে। তারিশাও আছে নিবরাসের সাথে। আনায়া ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে নিবরাসকে এভয়েড করে ভেতরে ঢুকে যায়। নিবরাস পরাগকে দিয়ে গিফ্টগুলো ভেতরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। শুধু বালা জোড়া নিজের হাতে রাখে। তখন তারিশা বলে ফেলে,
-বালাগুলো খুব সুন্দর তাও তাজা ফুলের। আমায় দাও না বালাগুলো। তুমি কী করবে এসব দিয়ে?
-তোমার বিয়ের জন্য এনেছি তারিশা। সেন্স বলতে কিছু তো নেই তোমার মাঝে আর না আছে লজ্জা। আমার বউ আছে তুমি ভুলে গেছো? সবসময় আমার পিছু লাগবে মা আমার বিরক্ত লাগে তোমাকে। আমি ম্যারিড আমার বউ আছে বুঝেছো?
-আনায়ার জন্য এনেছো আমি কী দোষ করলাম?
-আনায়ার তুমি কে? নিজের জায়হায় সীমাবদ্ধ থাকো বেহায়া মেয়ে। শুধু বাবার জন্য কিছু বলতে পারি না নাহলে তোমার মুখোশ টেনে ছিঁড়তে আমার সময় লাগবে না। একশুটে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবো। ডিজগাস্টিং।
নিবরাস চোখ-মুখ শক্ত করে ভেতরে চলে আসে। আর্জেন্ট কল আসাতে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ত্রস্ত পায়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। খাটের উপর গিফ্ট সাথে ফুলের তোড়াটা রাখা। আনায়া রুমে নেই হয়ত শাওয়ারে গেছে। নিবরাস সোফার উপর,পায়ের উপর পা তুলে বসে।
আনায়া শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে আসে। কোন কথা বলে না নিবরাসের সাথে। ব্যস্ত হাতে হেয়ার ড্রয়ার নিয়ে চুল শুকাতে থাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। তাঁদের রুমটা বিশাল। ঢুকার সময় ছোট্ট রুমের মতো যেটায় সোফা রাখা ভেতরে তাঁদের বেডরুম। সাথে এটাস্ট ওয়াশরুম আর একটা চেন্জিং রুম যেখানে কাবাড আর জামাকাপড় রাখা। তাদের বেডরুমে কাউচ,বেড,ড্রেসিং টেবিল সাথে বেডের দুই পাশে টেবিল।
আনায়া চুল শুকিয়ে তৈরি হয়ে বাইরের দিকে যায়। নিবরাসকে দেখেও না দেখার ভাণ করে। ড্রয়িং রুমে আসতে মরিয়ম নওয়াজ খাবার টেবিলে রাখছেন। আনায়া তাকে সাহায্য করার জন্য যায়। মরিয়ম নওয়াজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
-নিবরাস বাইরে থেকে এসেছে ওর জন্য শরবত নিয়ে যাও। আর বলো লান্স করতে আসার জন্য।
আনায়া শরবতের ট্রে টা নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। করিডোর দিয়ে হাঁট ছিলো তখন কোথা থেকে তারিশা তড়িঘড়ি আসে। অল্পের জন্য ধাক্কা লেগে শরবতের গ্লাস নিচে পড়েনি। আনায়া সেসব পাত্তা দেয়নি সোজা রুমে চলে যায়। নিবরাস সোফায় বসে,বসে কপাল স্লাইড করছে। আনায়া টেবিলের উপর ট্রে টা রেখে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে,
-লান্স করার জন্য আসতে বলা হয়েছে।
-শোনো!
-সময় নেই।
নিবরাস উঠে দরজা লক করে দেয়। আনায়া বেডরুমে চলে আসে। নিবরাস শরবতের গ্লাস হাতে ভেতরের দিকে আসে।
-গিফ্ট গুলো তোমার জন্য।
-লাগবে না।
– তুমি যদি ভেবে থাকো আমি এনেছি আমার দেওয়া গিফ্ট ভেবে প্রত্যাখ্যান করবে তাহলে ভুল।আমি আনিনি তোমার জন্য এসব একজন পাঠিয়েছে।
-কে?
-নাজিয়া!
আনায়া অবাক হয়। নাজিয়া কে নিবরাস চেনে? আর গিফ্টগুলো নিবরাসকে দিয়ে পাঠিয়েছে। আনায়ার ভাবনার মাঝে নিবরাস গ্লাসটা সাইড টেবিলে রেখে পাশ থেকে ফুলের বালা দু’টো নিয়ে আনায়ার হাতে পড়িয়ে দেয়। আনায়া নিবরাসের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।
-আপনি আসুন আমি গেলাম।
-এই তুমি রাগ করেছো?
-কই না তো!
-মিথ্যে বলবে না।
-আমার রাগের দাম আছে নাকী? আর যার কাছে আমার দাম নেই তার কাছে রাগ করা বোকামী ছাড়া আর কিছু না।
-আমি ওকে অপমান করেছি তো।
-আমি শুনতে চাইনি এসব ব্যপার। প্লিজ আপনি আপনার মতো থাকুন আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। যদি এটাও সম্ভব না হয় তাহলে বলুন আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিজের বাড়ী চলে যাচ্ছি।
-স্যরি।
আনায়া পাত্তা না দিয়ে বালা জোড়া খুলে খাটের উপর রাখে। দ্রুত প্রস্থান কর নেয়। নিবরাস পকেট থেকে ফোন বের করে খাটের উপর ছুঁড়ে মারে। তারিশাকে পারছে না বাড়ী থেকেই বের করে দিতে।
আবারো ফোন হাতে পরাগকে টেক্স দেয়,
-সুন্দর ভাবে ডেকোরেশন না করলে বুলেট কিন্তু মাথায় গেঁথে দেবো।
টেক্স পেয়ে পরাগ আর রিপ্লাই দেয় না। বুঝেছে নিবরাস রেগে আছে। হয়ত আনায়া তাকে কথা শুনিয়েছে।
পরাগের মতো ভালোই হয়েছে মাথা ফাটায়নি যে এটাই তাঁদের নেতার সাত কপালের ভাগ্য।
আনায়া চুপচাপ খাবার খেয়ে উঠে যায়। তারিশা সব বসেছে তার পেছন দিয়ে নিবরাস আসে। বাকীদেরও মোটামুটি খাওয়া শেষ।
তারিশা,নিবরাস একসাথে খাচ্ছে। তখন মরিয়ম নওয়াজ বলেন,
-তারিশার এতো লেট কেন?
-আসলে মামনি এসে শাওয়ার নিয়ে একটু রেস্ট নিয়েছি সেজন্য লেট হয়ে গেছে।
মরিয়ম নওয়াজ আর কিছু বলেন না। নিবরাস কোনরকম খেয়ে উঠে পড়ে। বারবার আনায়া যেখানে থাকার কথা সেখানে তারিশা চলে আসছে। নিবরাসের বিরক্ত লাগছে প্রচুর প্রকাশ করতে পারছে না।
ত্রস্ত পায়ে নিজের রুমে যায়। আনায়া কাউচের উপর বসে ফোন স্ক্রোল করছে। নিবরাস বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর,পর আনায়ার দিকে তাকাচ্ছে। আনায়া তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। নিবরাস নিরব থেকে আনায়াকে বলে,
-তোমার বোন গিফ্ট পাঠালো দেখলে না?
আনায়া জবাব দেয়না। নিবরাস ব্যর্থ হয়ে আবারো বলে,
-খাটে এসে বসো না?
আনায়া ফিরেও তাকায়নি নিবরাসের দিকে। সে তার মতো ফোনে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর উঠে কুশন এনে কাউচে গা এলিয়ে দেয় আনায়া। নিবরাস খাটের উপর শুয়ে,শুয়ে আনায়ার কান্ড দেখছে। মনে,মনে নিজেকে বকা দিচ্ছে। আর কখনো তারিশাকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। তারিশা কে তাকে নিবরাস চিনে না। আনায়া তাকে টর্চার করছে। জনগনের নেতা বউয়ের কাছে পাত্তা পাচ্ছে না।
*****
নাজিয়া পাঁচটার দিকে বাড়ী ফিরে। তার স্কুল থেকে কিছুটা দূরে একটা ক্যাফ ছিলো। সেখানে নিবরাসের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো নাজিয়া। গিফ্টগুলো আগে কিনে রেখেছে শুধু আসার সময় ফুলগুলো নিয়েছে। কী জানি আনায়া গিফ্টগুলো একসেপ্ট করেছে কীনা। ফুল দেখলে কেউ রাগ,অভিমান করতে পারে না আর না ফুল ফেলে দিতে পারে। ফুল মানে শুভ্র, শুদ্ধ।
তড়িঘড়ি শাওয়ার নিয়ে খাবার খেয়ে নেয় নাজিয়া। সাড়ে পাঁচটায় তার প্রাইভেট আছে টিচার আসবে। নিজেকে তৈরী করে স্টাডি রুমে চলে যায়। তার টিচার চলে এসেছে অলরেডি। বাড়ীতে তেমন কেউ নেই বললে চলে। তার মা জব করে অফিসে। আজকে হয়ত মিটিংয়ে আটকা পড়েছে সাথে তার বাবা,বড়বাবা ও। তার জেম্মা আড়ংয়ের জন্য বের হবে একটু পর। নাজিয়ার প্রাইভেট শেষ হলে দু’জন যাবে। তার ভাই জাফিন একটা আন্টির বাসায় নাজিয়ার আম্মুর পরিচিত। সে আসার সময় জাফিনকে নিয়ে আসবে।
সুহাসিনী রেডি হয়ে অপেক্ষা করে নাজিয়ার। আজকে নাজিয়াকে নিয়ে টুকটাক শপিং করবে। নাজিয়ার কী লাগবে না লাগবে আজকে কিনবে সাথে নিজের জন্যও। তাশরিফ খানের এটিএম কার্ড রেখে দিয়েছিলেন সকালে।
নাজিয়া সহ সুহাসিনী আড়ংয়ে আসে। নাজিয়ার ফোন ব্যতীত অন্য যা পছন্দ তাই নিতে পারবে। ফোনটা তার মায়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে চালাতে পারে না। তবে তার নিজের টাকায় কেনা ফোন আছে যেটা লুকিয়ে চালায় সে। তার রুমে তেমন কেউ আসে না। আর সে সারাদিন স্কুলে,পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকে। সামনে তার এক্সাম বেশীদিন নেই আর তিনমাস পর ফেব্রুয়ারিতে এক্সাম। আগামী মাসে হোস্টেলে উঠে যাবে ভালো গাইডলাইনের জন্য। এই একসপ্তাহের মতো আছে বাড়ীতে।
সুহাসিনী নাজিয়ার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিজের জন্যও শপিং করে টুকটাক। নাজিয়া সহ তাঁদের পরিবারের চারজনের জন্য মেচিং পান্জাবি নেয় সুহাসিনী। তাদের দুই জা এর জন্য মেচিং শাড়ী। তবে নাজিয়া তাদের সাথে মেচিং করেনি। সে তার পছন্দের টপস,জিন্স,জামা নেয়। সুহাসিনী অনেক বলেও নেওয়াতে পারেনি। নাজিয়ার মতিগতি বুঝতে পারে না সুহাসিনী। সীতারা আহমেদকে বললে তার এক ধমকে সব ঠিক হয়ে যাবে। সেজন্য নাজিয়ার জন্য মেচিং করে নিয়ে নেয় সে।
তাঁদের শপিং শেষ হতে আইসক্রিমের দোকানে ঢুকে দু’জন। নাজিয়া আইসক্রিম খাচ্ছে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কয়েক টেবিল পর চোখ যায় তার। জায়ান কারোর সাথে হেঁসে, হেঁসে আইসক্রিম খাচ্ছে আর কথা বলছে। সুহাসিনী দেখেনি সে তাঁদের উল্টোমুখী হয়ে বসেছে। নাজিয়া আফসোস করছে ফোন থাকলে কয়েকটা পিক তুলে রাখা যেতো।
তখন সুহাসিনীকে বলে,
-জায়ান ভাইয়া অফিসে তো?
-আজকে মিটিং আছে ওদের।
-আম্মুর ও?
-হুম।
-বড় বাবা আর বাবা ওরা মেবি কাজে আটকা পড়েছে ওদের মিটিং নেই।
-না ওদের কোম্পানিতে আজকে মিটিং নেই।
-হুম!
নাজিয়া ভাবছে জায়ান এখানে তো সীতারা আহমেদ কোথায়? নিশ্চয়ই ওদের গোপন বিজন্যাসের মিটিংয়ে আটকা পড়েছে। নিবরাস ভুল কিছু বলেনি! সীতারা আহমেদ জায়ানের সাথে মানুষ। যে সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখে। নাজিয়া সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে আফসোসের স্বরে বলে,
-ইশ মায়ের মেয়ে হয়েও মায়ের মতো হতে পারলাম না।
-হয়ে যাও বারণ করলো কে? ট্যালেন্টেড!
-এমন ট্যালেন্ট আমার দরকার নেই।
-এক্টা কথা আছে কী নাজিয়া জানো? হুজুরের সন্তান জালিম হয় আবার জালিমের সন্তান হুজুর হয়।
-তুমি ইনডিরেক্টলি আমার মাকে জালিম বললা নাকী?
-আরে না! ও তো খুব ভালো। ওকে এসব বলার সাধ্য আছে নালী আমার ?
-কারোর সাধ্য নেই তাকে কিছু বলার তাই না?
#চলবে
#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|১৭|
#শার্লিন_হাসান
(প্রাপ্ত বয়স্ক মনস্কদের জন্য উন্মুক্ত)
সুহাসিনী সহ নাজিয়া বাড়ীতে আসার পেছন দিয়ে সীতারা আহমেদ,তিয়াশ খান চলে এসেছে। জাফিন ও তাদের সাথে আছে। বন্যা তাঁদেরকে ঠান্ডা শরবত দেয়। শরবত পান করে তারা সবাই উপরে চলে যায়। লিভিং রুমটা একদম ফাঁকা সবাই নিজ,নিজ রুমে। বন্যা কিচেনে থালা ধুয়ে রাখছে। আচমকা কোমড়ে কারোর স্পর্শ পেতে চমকে যায়। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে সে হাত আরো বেশী শক্ত করে তার কোমড় আকড়ে ধরে নিকের সাথে মিশিয়ে নেয়। বন্যা পারফিউমের স্মেল শুকে বুঝতে পেরেছে এটা জায়ান আর স্পর্শটা ও তার কাছে অতি পরিচিত।
-জায়ান স্যার আ আপ..নি?
-হুম সুন্দরী আমি। সেদিন তো নাজিয়াকে পাঠালে আমি রেডি ছিলাম অথচ তুমি আসলে না।
বন্যা জায়ানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা লাগায়। কোন ভাবে সফল হয় না। না পেরে দরজার দিকে মুখ করে বন্যা। সামনে নাজিয়াকে ফোন হাতে দেখতে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। জায়ান সামনে তাকায়নি তবে বন্যার গাড়ে নিজের থোতমা দিয়ে রেখেছে। তখন নাজিয়া গলা খাকাড়ি দিতে জায়ান চিটকে দূরে সরে যায়। নাজিয়াকে দেখে বলে,
-তুমি কখন আসলে পাখি?
-এদিক দিয়ে বেচিংয়ে যাচ্ছিলাম বাট তোমাকে দেখলাম ওইখানে…
-হ্যাঁ,হ্যাঁ আমি ত.. তো ওই যে ”
আশেপাশে তাকায় জায়ান। ফ্রিজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিতে এসেছি।
-ওহ আচ্ছা তা পানির বোতল কোথায় তোমার?
-বন্যা দিবে। বন্যা আমি সোফায় বসলাম বোতল নিয়ে আসো।
জায়ান তড়িঘড়ি প্রস্থান করে। নাজিয়া বন্যার দিকে তাকায়। বন্যা তাকে দেখে মাথা নিচু করে নেয়।
-তুমি চাকরীটা ছেড়ে দাও আপাতত।
-কিন্তু আমার মা তো অসুস্থ প্রতিমাসে তার ঔষধের জন্য অনেক টাকার দরকার। চাকরীটা ছেড়ে দিলে না খেয়ে মরতে হবে।
-সেই ব্যবস্থা আমি করে দেবো তোমায়। আমার বাবার এটিএম কার্ড যখন খুশি তখন আমি নিতে পারি। তোমার স্যালারীর ফিফটি পার্সেন্ট আমি দেবো আর ফিফটি পার্সেন্ট আমার জিজু দিবে।
-জিজু…
-ডোন্ট ওয়ান্না টক বন্যা আন্টি। আমি গেলাম!
নাজিয়া চলে আসে রুমে। ফোনটা বের করে ভিডিওটা দেখে নাজিয়া। সে তো অপেক্ষায় ছিলো কখন জায়ান আসবে! বন্যাকে কিচেনে একা পেলে জায়ান ছাড়তো না এরকম কিছু মাথায় এসেছিলো নাজিয়ার। এরকম একটা প্রমাণ কতদিন ধরে চেয়েছিলো। ফাইনালী ডান! ভিডিওটা নিবরাসের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেয় নাজিয়া।
******
সন্ধ্যায় নাস্তা করে আনায়া খাটে বসে আছে। নিবরাস রুমেই পায়চারি করছে আর কলে কথা বলছে। আনায়া তার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। কিছুক্ষণ পর নিবরাস ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে আনায়ার সামনে এসে বসে। আনায়া ফোনে ধ্যাণ দিতে নিবরাস ফোন তার থেকে কেড়ে নেয়।
-ফোনটা দিবেন নাকী আমি চলে যাবো বাড়ী থেকে?
-প্লিজ তুমি কথাটা তো শোনো?
-একটা কথাও বলবেন না আপনি। আপনাকে দেখলেই আমার রাগ উঠে খু’ন করতে মন চায় আপনাকে।
-স্যরি তো!
-সরুন আমার সামনে আসবেন না দয়া করে। এরকম আলগা দরদ আমার দরকার নেই।
-আনায়া শোনো না?
আনায়া চোখ গরম করে তাকায়। নিবরাস সেসবে ভ্রুক্ষেপ না করে উঠে দাঁড়ায়। কাউচের উপরে রাখা শপিং ব্যাগটা এনে আনায়ার দিকে দেয়।
-গার্ডেনে এসো একটু পর!
-ঠেকা পরেনি আমার।
-শপিং ব্যাগটা তো খুলে দেখো?
-প্রয়োজন মনে করি না।
নিবরাস ব্যর্থ চোখে তাকায়। আনায়া এতো গাড় ত্যাড়া। মনে হচ্ছে তারই কিছু করতে হবে। নিবরাস সোজা দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসে।
-আমার কথা না শুনলে আমিও রাগ করবো।
-করুন তাতে আমার কী? আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য তারিশা আছে না?
-আবারো তাকে আনছো আমাদের মাঝে।
-আমি আনিনি আপনি এনেছেন। আচ্ছা এটা বলুন আমি আগে নাকী তারিশা আগে?
-অফকোর্স তুমি।
-তাহলে আমায় ড্রপ করে দিয়ে আসতে সমস্যা! তারিশাকে নিয়ে তো সুন্দর ভাবেই ঘুরে আসলেন। এতে বুঝা যাচ্ছে আপনার কাছে আমি কতটা ইমফরটেন্ট।
-তোমার ভার্সিটি উল্টো দিকে আর ওরটা আমার যাওয়ার পথেই।
-তো বারণ করতেন? বলতেন আপনার তাড়া আছে নিতে পারবেন না।
-ও সীটে বসে গেছে আমার কোলে না।
-আপনার সাথে নিবেন কেন?
-আর কখনো নেবো না স্যরি।
আনায়া কথা বাড়ায়না। চুপচাপ বসে থাকে নিনরাস তার মুখোমুখি বসে বলে,
-শাড়ীটা পড়ে রেডি হয়ে নিও।
-পারবো না।
-আরেকবার বলো?
আনায়া তাকায়। নিবরাস কঠোর চাহনি দিয়েছে। আমতাআমতা করে বলে,
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-একটু তো সন্মান দাও আমায়। এভাবে তুচ্ছ করো কেন?
-সন্মান! দেওয়ার সময় ঠিকই দেবো। এখন যান আমার মাথা গরম করবেন না প্লিজ।
নিবরাস উঠে চলে যায়। আনায়া থামাতে গিয়েও থামায়নি। আজকের গিফ্ট গুলো এখনো দেখা হয়নি। নিনরাস যেতে শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে একটা শাড়ী সাথে কিছু জুয়েলারি বের করে আনায়া। নিবরাসের আনা পার্সেলটা আনবক্সিং করে। সেখানেও শাড়ী,জুয়েলারি,গাজরা সহ সুন্দর একটা কম্বো ছিলো। আরেকটা পার্সেলে অনেকগুলো চকলেট। ছোট্ট একটা চিরকুট পায় আনায়া। তাতে লিখা,
-জানি না আমায় দেখে তোমার কেমন ফিল হয় বা কেমন চোখে দেখো আমায়। বাট বিলিভ মি তোমার চেহারার দিকে ফাস্ট টাইম তাকিয়ে আমি মায়ায় পড়ে গেছি। ভাবি, এই সুন্দর মেয়েটি আমার বোন! দেখতে ঠিক আমার মতো আমার টুইন বললে ভুল হবে না। ছোট্ট মেয়েটার পক্ষ থেকে তোমার জন্য সামান্য কিছু।
আনায়া হাসে। শাড়ীটায় হাত ভুলায়। যত্ন সহকারে চিরকুট সহ কাবাডে ঢুকিয়ে রাখে।
অতঃপর শাড়ী নিয়ে রেডি হতে চলে যায়। আনায়া শাড়ীটা পড়ে সাথের জুয়েলারি গুলোও পড়ে নেয়। তেমন একটা সাজেনি তবে কম ও সাজেনি। আজকে বেশ সাজতে মন চাইছে তবে সিম্পলের মাঝে কিছুটা গর্জিয়াস। আয়নায় নিজেকে দেখে আনায়া। ভাবছে নিবরাস অজ্ঞান না হলেই হলো।
দশটা বাজতে বাকীরা ডিনার করে নেয়। নিবরাস জানায় তারা বাইরে ডিনার করবে। এছাড়া পরাগ আগে বলেছে মরিয়ম নওয়াজকে তাদের ডেকোরেশন সাথে নিবরাসরা গার্ডেনে ডিনার করবে। সবকিছু সাজিয়ে পরাগ ও ডিনার করে নেয়। তবে মেইন সুইচ তাকে পাহাড়া দিতে হবে। কখন আবার তারিশা অফ করে দেয় ঠিক নেই।
তারিশা খেতে বসে বারবার আনায়ার খোঁজ করেছে সাথে তাঁদের রাতের ডিনার নিয়ে একশ একটা প্রশ্ন করেছে। পরাগ পারে না ধমকি একটা দিয়ে বসিয়ে দেয়।
তাদের খাওয়া শেষ হতে যে যার রুমে চলে যায়। নিবরাস আনায়াকে মেসেজ দিতে সে রুম থেকে বের হয়। করিডোর পেড়িয়ে সিঁড়ির কাছে যেতে হবে। করিডোরে থাকা অবস্থায় তারিশার সাথে দেখা হয়। আনায়াকে দেখে বলে,
-শাড়ীটা সুন্দর তবে তোমায় মানাচ্ছে না।
-শেয়ালের চোখে সবই সরিষা ফুল। এনি ওয়ে আমি কমপ্লিমেন্ট চাইনি তোমার থেকে। আমার ভদ্রলোক আমায় দেখে কমপ্লিমেন্ট দিবে। অবশ্য সবার চোখে ভালো কিছু মানান সই হয়না। নিজেকে যেমন ভাবে অন্যকেও ঠিক তেমনই ভাবে। আগে নিজেকে আয়নায় দেখো।
আনায়া মেজাজ গরম হয়ে যায়। আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে যায় সিঁড়ির দিকে। তারিশা যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। আনায়াকে আজকে সুন্দর লাগছে। তার শখের পুরুষ আনায়ার সাথে ডিনার করবে। কত সুন্দর একটা মোমেন্ট কাটাবে ভাবতে তারিশার গা জ্বলে যাচ্ছে।
আনায়া বাড়ী থেকে বেড়িয়ে ত্রস্ত পায়ে ডেকোরেশন করা জায়গা খুঁজতে লাগে। কিছুটা এগিয়ে আসতে লাইট অন হয়। আনায়া পুরো সারপ্রাইজড হয়ে যায়। সামনের জায়গাটা সুন্দর ভাবে ডেকোরেশন করা লাভ সেফের বেলুন আনায়ার বেবি পিংক কালারের শাড়ীর সাথে মেচিং করে হোয়াইট,পিংক বেলুন দিয়ে। মাঝখানের কয়েকটা বেলুন স্যরি লেখা। সাথে কয়েকটা স্যাড ইমুজি! বড় টেবিলজুড়ে ক্যান্ডেল লাইট কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো। মাঝখানে একটা কেক রাখা সেটাতেও স্যরি লিখা। সাথে কয়েক রকমের ড্রিং,খাবার ও আছে। আনায়া এসব দেখে আশেপাশে তাকায়। নিবরাসকে খুঁজছে।
তখন লাইট অফ হয়ে যায় আবার। মোমবাতির আলোয় চারপাশটা মৃদু আলোকিত হয়। আনায়া ছোট্ট করে ডাক দেয়,
-চাঁদাবাজ নেতা! ওহ্ স্যরি আমার লিডার কোথায় লুকিয়ে বসে আছেন?
নিবরাস ত্রস্ত পায়ে আসে তখন। লাইট অন হতে আনায়া নিবরাসকে দেখে। সে হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পরিধান করেছে। একটু গভীরভাবে খেয়াল করলো আনায়া। হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবিতে তাকে আজকে দারুণ লাগছে। আনায়া হাসে নিবরাসকে দেখে। তখন নিবরাস বলে,
-জান বলে ডাক দিতে পারতে তা না কীসব চাঁদাবাজ বলছো। বউ তুমি আসলেই পাষাণ।
-স্যরি মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে।
-এরপর থেকে আর বলবা না এসব। ভবিষ্যতে আমার বাচ্চাকাচ্চারা ও দেখবো তোমার থেকে শুনে আমায় চাঁদাবাজ বলছে।
-বলবে না।
-আচ্ছা চলো।
নিবরাস হাত বাড়িয়ে দিতে আনায়া তার হাতে নিজের হাত রাখে। দু’জনে চেয়ারে বসে। নিবরাস নিজে আনায়াকে খাবার বেড়ে দেয়। আনায়া চুপচাপ খেয়ে নেয়। দু’জনের খাওয়া দাওয়া শেষ হতে নিবরাস একটা বক্স এগিয়ে দেয় আনায়ার দিকে।
-শোনো রাগ করার জন্য একটা গিফ্ট আরেকটা তোমার বাসর রাতে তো কিছু দেইনি সেই গিফ্ট। অবশ্য বাসর করতে পারিনি গিফ্ট দিয়ে কী লাভ?
-বদলোক বাসর ছাড়া আর কোন কথা মুখে নেই।
-বউ প্লিজ বুঝো! আমাদের ও তো বেবি দরকার। চলো আজকে লং ড্রাইভে যাই। আমাদের বাংলোতে বাসরটা সেরে ফেলি।
-চুপ! রাগ ভাঙাতে এনেছেন নাকী বাসর করার প্রস্তাব দিতে? বদলোক একটা।
-দু’টোই।
-মুখটা বন্ধ রাখবেন?
-আচ্ছা রাখলাম।
আনায়া গিফ্টগুলো খুলে দেখে। একটা বক্সে গোল্ডের ব্রেসলেট সাথে দু’টো রিং রাখা। রাগ ভাঙানোর জন্য। আর বাসর রাতের লেইট গিফ্ট যেটা সেই বক্সে তডায়মন্ডের একটা নেকলেস সাথে গোল্ডের একটা চেইন রাখা।
আনায়া গিফ্টগুলো আবারো বক্সে ঢুকিয়ে টেবিলর এক কোণে রাখে। নিবরাস প্রশ্ন করে,
-গিফ্ট কম হয়েছে তাই না? আচ্ছা পরের বার বেশী করে দেবো। আমি শপিংমলে গেলে সব কিনে আনবো।
-আমি একবার ও বলেছি কিছু?
-না বলোনি তোমার মুখ দেখে বুঝলাম। শ্বশুর মশাই নিশ্চয়ই এর থেকে বেশী কিছু তোমায় দিয়েছে আমি কিছুই দিতে পারলাম না এখন অব্দি তোমায়।
-দিবেন কীভাবে? সারাদিন মেয়েদের চিপায় থাকেন।
-কই? আমি এখন আর কোন ইভেন্টে গেলে মেয়েদের সাথে পিক তুলি না।
-আগে তো তুলতেন?
-এরকম হ্যান্ডসাম,সিঙ্গেল নেতাকে যে কেউ চাইবে ইমপ্রেস করতে।
মুখ বাকায় আনায়া। নিবরাস হেঁসে বলে,
-আমার চাঁদের পূর্ণিমা।
-আর আমার অমাবস্যার চাঁদ।
নিবরাসের হাসি আপনার আপনি থেমে যায়।
-আমি তোমার থেকে বেশী ফর্সা বউ।
-তো কী? একদম ভাব নিবেন না বলে দিলাম।
আমার ‘হৃদয় কোঠায় চাঁদের পূর্ণিমা’ এসেছে। ভালোবেসে হৃদয় কোঠরে থাকবে তো?
-থাকবোনি।
-একটু সুন্দর ভাবে বলো না?
-ভালোবাসবো! আপনার হয়ে সবসময় থাকবো।
নিবরাস আনায়ার হাতের পিঠে চুমু খায়। কয়েকটা ফ্লাওয়ার আনায়াকে দেয়। অতঃপর তারা দু’জন কেক কাটে। আনায়া নিবরাসের দিকে তাকিয়ে হাসে।
নিবরাস আর সময় ব্যয় না করে আনায়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
-মহারানীর রাগ ভেঙেছে তো?
-না ভাঙেনি।
-চুমু খেলে ভাঙবে তাই না?
-আসলে এসব কিছুতে রাগ ভাঙবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার ঠোঁটে আমি অত্যাচার করতে পারবো।
-পাষাণ বউ।
আনায়া নিবরাসের গাড়ে কামড় বসিয়ে দেয়। নিবরাস কিছুটা ছিটকে সরে যায় আনায়ার থেকে। আনায়া নিবরাসের হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। পা উঁচু করে নিবরাসের অধরে,অধর মিলিয়ে নেয়।
আনায়ার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিবরাস গাড়ে হাত রাখে। কামড়টা জোরেই দিয়েছে আনায়া। নিবরাস অভিমানী স্বরে বলে,
-কামড় না দিলেও পারতা।
-বেশ করেছি।
নিবরাস হুট করে আনায়াকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে থাকে। আনায়া তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
-অসভ্য লোক নিচে নামা তো।
-বউ আজকে আর ছাড়ছি না কিন্তু। একবারে বাবুর পাপা হওয়ার মতো অসভ্যতামী করেই ছাড়বো।
#চলবে