#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|১৫|
#শার্লিন_হাসান
ও আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে নাজিয়া।
-ও তোমার সম্পর্কে সব জানে?
-শুধু আমার সম্পর্কে না। ক্লাবে যাওয়া আসা সেখানে একেকদিন একেক মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করা।
-তার নজরে তুমিও চলে আসলে। ব্যপার না ওর সম্পর্কে মোটামুটি আমি জানি ওর ভালো মানুষীর মুখোশটাও আমি জানি। শুধু জানতাম না ও এতোটা জঘন্য,ক্যারেক্টারলেস।
-আমি কী করবো?
-যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার থেকে ও তোমায় রুমে ডাকলে আমায় বলবে ঠিক আছে? ওর থেকে দূরে,দূরে থাকবে এটা আর কাউকে বলার দরকার নেই যেহেতু সবাই ব্যস্ত অফিস,মিটিং,কাজকর্ম নিয়ে।
-আচ্ছা বলবো না।
-হুম,বাকীটা আমি দেখবো। ওকে ওর যোগ্য শাস্তি পেতে হবে।
বন্যা বেড়িয়ে আসে রুম থেকে। নাজিয়া দরজা লাগিয়ে মেসেজ দেয় নিবরাসকে দেখা করার জন্য। নিবরাসের কথা মতোই সে মির্জা বাড়ীতে গিয়েছিলো আনায়ার সাথে দেখা করতে। তার আগে থেকে নিবরাসের সাথে পরিচয় ছিলো নাজিয়ার। তাঁদের স্কুলের ইভেন্টে চিপ গেস্ট হিসাবে এসেছিলো নিবরাস। সেখানে তাকে কিছুটা আইডিয়া দেয় জায়ান নিয়ে। আনায়ার সাথে দেখা করার পর নিবরাস তার স্কুলে এসেছিলো। নাজিয়াকে একটা এন্ড্রয়েড ফোন দেয় নিবরাস তাকে কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করে দিতে জায়ান সম্পর্কে। এছাড়া নাজিয়া নিজে কয়েকবার দেখেছিলো জায়ান লুকিয়ে রাতে বেড়ুতো বাড়ী থেকে। নাজিয়ার বেলকনি থেকে নজর দিলে দেখা যেতো। জায়ানের অসৎ পথে ব্যবসা আছে। নিবরাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে শামিম সরদারকে বসাতে পারলে জায়ান নিশ্চিত থাকতো কারণ দাপট,ক্ষমতা, আইন তার পকেটে থাকতো এখন তো চোরের মতো সব করতে হয়।
নিবরাসের ধারণা এসব ব্যপার সীতারা আহমেদ জানে। নাজিয়ার বিশ্বাস হয়না আবার হয়! তার মাও অফিসের কাজে বিজি থাকে। সত্যি-মিথ্যা কিছুটা ধোয়াশা সাদা কাপড়ে মোড়ানো। এই জীবনের রঙিন কৃত্রিম, অকৃত্রিম মঞ্চে সবাই ভালো। তবে মুখোশের আড়ালে সবারই ভয়ংকর রুপ লুকানো থাকে। কারোটা প্রকাশ পায় কারোটা পায় না।
নাজিয়া ভাবছে জায়ানের ভালো মানুষী নিয়ে। মুখোশের আড়ালে থাকা রুমটা যে কতটা ভয়ংকর তার। সীতারা আহমেদের সাথেও তেমন ভাব নেই আজকাল নাজিয়ার।
রাত কেটে সকাল হয়। নিবরাস নামাজ আদায় করে আনায়া সহ। আনায়া কিচেনে আসে সকালে নাস্তা রেডি করার কাজে হেল্প করবে।
তাঁদের বুয়া অলরেডি চা বানিয়ে বাকী সব ও করে রেখেছে। আনায়া আজকে রুটি বানাবে তার শখ হয়েছে সবাইকে রুটি বানিয়ে খাওয়াবে। পারে না তাও নিশ্চিত সাথে বুয়া আছে দেখিয়ে দিবে।
রুটি বানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয় আনায়া। গোল হয়না। কত চেষ্টা করেছে রুটি গোল করার একটা হয় বাকীগুলো মানচিত্র। আনায়ার বানানো রুটি গুলোই সেকে নেয় বুয়া।
নিরব মির্জা, রোহিত,পরাগ,নিবরাস,তারিশা,মিসবাহ,মাইশা,মরিয়ম নওয়াজ সবাই মিলে নাস্তা খেতে বসেছে। আনায়া সবাইকে সার্ভ করছে।
তারিশা রুটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আনায়া নিজেও নিবরাসের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। তখন তারিশা রুটির দিকে তাকিয়ে তচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
-রুটি গোল হয়নি খেয়ে মজা পাচ্ছি না।
তখন মাইশা বলে,
-প্রতিদিন তো গোল খাও একদিন বাঁকা খাও না?
তখন নিবরাস বলে,
-আচ্ছা তারিশা তুমি রুটি কীভাবে খাও?
-ছিঁড়ে খাই।
-ছিঁড়ে যেহেতু খাও এতে রুটি গোল, ত্যাড়া ব্যাকা হলেই কী? ছিঁড়েই তো খাও।
তারিশা চুপসে যায়। মিসবাহ শব্দ করে হেঁসে দেয়। বাকীরাও মিটমিট করে হাসছে। পরাগ ভাবছে তারিশার এতো মাথা ব্যথা কিসের? মেয়েটা বেশী বলে কবে হোস্টেলে যাবে সেই অপেক্ষায় আছে পরাগ।
আনায়া রেডি হয়ে নেয়। ভার্সিটি যাবে নিবরাসকে বলেছে দিয়ে আসতে। নিবরাসের কাজ আছে সে যেতে পারবে না এক কথায় বারণ করে দিয়েছে। আনায়াকে বলে দিয়েছে ড্রাইভার নিয়ে যেতে। আনায়া কিছু বলেনি!
রেডি হয়ে রুমের বাইরে আসতে দেখে তারিশাও রেডি হয়ে এসেছে। আনায়া ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-তুমি কোথায় যাচ্ছো?
-কলেজ যাবো ফ্রেন্ডরা আসবে সাথে কিছু কাজ আছে।
তখন নিবরাস আসে। পান্জাবির হাতা গোটাতে,গোটাতে। আনায়া, তারিশাকে দেখে থামে নিবরাস। আনায়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-ও কোথায় যাচ্ছে এখন?
নিবরাসকে দেখে তারিশা বলে,
-ভাইয়া তুমি বাজারের দিকে যাবে?
-হুম ওইদিক দিয়েই যাবো।
-আমায় কলেজে নামিয়ে দিও।
নিবরাস আনায়ার দিকে তাকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধকে মাথা নাড়ায়। আনায়া আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায়নি প্রস্থান করে সেখান থেকে। নিবরাস তারিশার কথা ফেলতে পারেনি কারণ তার যাওয়ার পথেই তারিশার কলেজ। আনায়ার ভার্সিটি উল্টো পথে সেখানে নিবরাস যাবে না।
নিবরাসের পেছনে তারিশা আসে। বাইরে আসতে দেখে আনায়া ড্রাইভারের সাথে কথা কাটাকাটি করছে কিছু নিয়ে। নিবরাস সেখানে গিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে,
-কী হয়েছে?
তখন ড্রাইভার মোতাহের হোসেন বলে,
-বউমনিকে বললাম গাড়ীতে উঠতে আমি নামিয়ে দিবো। শোনেনা উনি নাকী রিকশায় করে যাবে।
-তোমার কাছে টাকা আছে আনায়া?
-না থাকলে আপনি দিবেন নাকী? আর সেটা জেনে আপনার কোন কাজ নেই!
নিবরাস বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে কপাল স্লাইড করে মোতাহের হোসেনকে বলে,
-আনায়াকে নামিয়ে দিয়ে সেখানে অপেক্ষা করবেন। ওর ক্লাস শেষ হলে আবার নিয়ে আসবেন।
-ঠিক আছে কিন্তু বউমনি তো যেতে চায় না।
-আনায়া গাড়ীতে বসো যাও।
-প্রয়োজন নেই। বাবাকে বলে দিয়েছি গাড়ী পাঠিয়েছে।
-এতে বাবাকে ডাকার কী আছে? আমার কী গাড়ীর অভাব আছে?
-ঘুষের টাকার গাড়ীতে আমি যাই না।
আনায়া হেঁটে গেটের সামনে চলে যায়। তখন তারিশা বলে,
-এতো ঢং করার কী আছে? নিজের বাবার গাড়ীর গরম দেখায় নাকী টাকার গরম?
-আমার সাথে যেতে হলে মুখটা বন্ধ রাখবা নাহলে গু’লি মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো।
পরাগ গাড়ী নিয়ে নিবরাসের সামনে আসে। নিবরাস পরাগের সাথেই বসে। আনায়া পেছনে একা,একা বসে। নিবরাস জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। আজকে আনায়া তাকে কত প্রকার অপমান দিবে সেটা ভাবছে। একে তো একটু আগে ঘুষের টাকা নিয়ে বলেও দিলো। তার বউ তাকে চাঁদাবাজ, ঘুষখোর বলে অখ্যায়িত করে বাকীরা শোনলে কী করবে? ছিঃ! নিবরাস ছিঃ বউয়ের মুখ থেকে এখন অব্দি ঘুষ,চাঁদাবাজ শব্দ দূর করতে পারলি না? যাদের সামনে ভাব সাব নিয়ে চলাফেরা করিস তাঁদের সামনেই অপমান করে দিলো। সবাই ভাববে বউয়ের কাছে সব শেয়ার করিস, কোথায় ঘুষ নিস আর ঘুষের টাকায় কী, কী কেনা হয়। এই আনায়া এতো তেঁতো কেন?
নিবরাস ভেবে পায়না। তারিশাকে গন্তব্যে নামিয়ে দেয়।
তখন তারিশা বলে,
-তোমার ফিরতে কতক্ষণ লেট হবে?
-এই ঘন্টাখানেক।
-আমারও ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। গেটের সামনে এসে নক দিও আমি চলে আসবো।
তখন পরাগ বলে,
-এতো স্যারের পেছনে লেগে আছো কেন? গাড়ীর অভাব আছে নাকী?
-সেটা তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি আমি। নিবরাস ভাইয়া আমাকে নিয়ে যাইবা যাওয়ার সময়।
নিবরাস মাথা নাড়ায়। তারিশা হেসে ভেতরে যায়। পরাগ গাড়ী স্টার্ট দিতে,দিতে বলে,
-আনায়া ম্যাম দেখে কিছু বলেনি আমি ওনার জায়গায় হলে এই তারিশাকে কবে শিক্ষা দিয়ে দিতাম।
পরাগের কথায় নিবরাস বলে,
-পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ কে জানো?
-কে?
-যার লজ্জা নেই। এক্সামফল তারিশা! অপমান তাকে কম করা হয়নি এটা,ওটার মাধ্যমে। তাও সে বুঝে না। লজ্জা হয়না তার।
-তারিশা নামের মেয়েগুলো নিলজ্জ আর ছ্যাচড়া হয় মনে হয়।
-সেসব জানি না তবে এই তারিশা প্রচুর ছ্যাচড়া। সবকিছুতে বা হাত ঢুকানো তার অত্যাবর্শকীয় কাজ।
-যাওয়ার সময় একে আবার গাড়ীতে নিবেন স্যার?
-হুম নিবো।
-ম্যামের জায়গায় আমি হলে আপনাকেও টাইট দিয়ে দিতাম কবেই। তারিশাকে একটু বেশী প্রশ্রয় দেন আপনি।
মনে, মনে বলে পরাগ।
-তোমার ম্যাম ব্যর্থ।
-কেন?
-আমার পেছন থেকে তারিশাকে সরাতে পারেনি।
-সেটা আপনার ব্যর্থতা বউ থাকতেও অন্য নারীকে ছাটাই করতে পারেননি।
নিবরাস আর কথা বাড়ায়না।
ভার্সিটিতে এসে মারিয়াকে পায় আনায়া। অনেকদিন পর দেখা হয়েছে তাদের। ক্লাস দুইটা করে চলে আসে দু’জন মিলে গল্প করবে। আনায়া নিজের সুখ দুঃখ সাথে তারিশার ছ্যাচড়ামির কথা শেয়ার করে। মারিয়া সে মজা নিচ্ছে সাথে আনায়াকে ক্ষেপাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে স্বান্তনা দিয়েছে সাথে তারিশার গুষ্টি তুষ্টি ধুয়েমুছে দিয়েছে। নিবরাসের গুষ্টিও উদ্ধার করে দিয়েছে।
আনায়া ভাবছে বাড়ী গিয়ে কীভাবে নিনরাসের সাথে কথায় পেড়ে উঠা যাবে ঝগড়ায়। মারিয়ার থেকে আইডিয়া নিচ্ছে।
-এই বদলোক ঝগড়ুটে অনেক। মনে হয়না যুক্তি দিয়ে জিততে পারবো।
-বান্ধুবী তোর একে সোজা করতে একমাস লাগছে আমার একসপ্তাই যথেষ্টা ছিলো।
-যদি আমার কথা শোনতো তবে আমার একদিনই যথেষ্ট।
-প্রব্লেম কী তোর ভদ্রলোকের? বউ থাকতে আরেক মেয়ে নিয়ে পড়ে আছে।
-ও পড়ে নেই তারিশা নিজে ওর পেছনে পড়ে আছে। কী বলবো বোইন, একের পর এক শুধু আমার জামাই নিয়ে টানাটানি করছে।
-সে তো তোরই। যেই টানটানি করুক সে কিন্তু নিয়ম করে তোর ঠোঁটেই চুমু খায় অন্য মেয়ের ঠোঁটে না।
-যাহ্! তোর কাছে কিছু বলে শান্তি পাইনা কোন না কোন ভাবে লজ্জায় ফেলে না দিলে তোর হয়না।
-সত্যি বললাম তো।
-তোর সত্যি তোর কাছে রাখ। এমনিতেআ জকে আমার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
-দেএ আমি খবরটা জিজুকে দেই।
-না দরকার নেই।
-আরে দে না মজা হবে অনেক দেখি শা*লা কী রিয়েক্ট করে।
কথাটা বলে মারিয়া আনায়ার থেকে ফোন নিয়ে নিবরাসের নাম্বারটা খুঁজে। সহজে পেয়ে যায় নিবরাস দিয়ে সেভ করা। মারিয়া নাম্বারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-কী আনরোমান্টিক তুই। এই জেনারেশনে এতো, জান,বাবু,সোনা,কলিজা,কিডনি,লিভার, ফুসফুস থাকতে নাম দিয়ে সেভ করলি?
-ওর নাম্বার আমার ফোনে রেখেছি সেটাই ওর সাত কপালের ভাগ্য।
মারিয়া হাসে। নিবরাসের নাম্বারে কল দেয়। আনায়া চেয়ে আচে কল রিসিভ করে কীনা সেটা দেখবে। প্রথমবার কল যেতে কেটে দেয় নিবরাস। তাতে আনায়ার রাগ আরো ৪০০ ডিগ্রী বেড়ে যায়। দ্বিতীয়বার কল দিতে সে কেটে দেয়। তৃতীয় বার কল রিসিভ করে নিবরাস ঝাড়ি দেয়।
-কল কেটে দিচ্ছি বুঝতে পারছো ইমফরটেন্ট আছে তাও বারবার ডিস্টার্ব করো কেন?
-স্যরি জিজু বুঝতে পারিনি আসলে আমি আনায়া না ওর বেস্টফ্রেন্ড মারিয়া ।
-আনায়া কোথায়?
-রেগে বোম বসে আছে। আপনি বাড়ী গেলেই বেমটা ব্লাস্ট করবে আমি সাবধান করে দিচ্ছি।
-আপনার ফ্রেন্ড এক নাম্বারের গাড় ত্যাড়া। একটু বুঝিয়ে বলবেন ত্যাড়ামী কমাতে। আনায়ার সাথে আমার বাড়ীতে আসবেন দেখা হবে তখন কথাও হবে। এখন আমি ব্যস্ত আছি।
নিবরাস কল কেটে দেয়। আনায়া কথা বলছে না। মারিয়ার জায়গায় সে থাকলে নিশ্চিত ঝাড়িটা সেই খেতো। আজকে নিবরাস শুধু বাড়ী আসুক আনায়া বুঝাবে ঝাড়ি কত প্রকার ও কী,কী সাথে ঝাড়ি,হুমকি-ধমকি পানির সাথে গুলিয়ে খাওয়াবে।
#চলবে