হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা পর্ব-২৪+২৫

0
646

#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|২৪|
#শার্লিন_হাসান

তাহিয়া রিকশা থেকে এদিকওদিক তাকায়। তড়িঘড়ি মাস্কটা পড়ে নেয় সে। বাইরে বের হয়েছে অনেকদিন পরেই। কিন্তু মাস্ক পড়তে তার ভালো লাগে না। এই শহরের অলিগলিতে সে ঘুরে বেড়ায় এই শহরেই থাকে। অথচ তার একটা প্রিয় মানুষের সাথেও দেখা হয়না। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে থাকে সে। পান থেকে চুন খসলে নিবরাসের কাছে খবর পৌঁছে যাবে। আর নিবরাস ও তাকে শহর ছাড়া করবে।

হাজারো চিন্তা ভাবনা শেষ হলো যখন সে তার বাড়ীর সামনে পৌঁছায়। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে চলে যায়। বাড়ীটা পুরোনো বলা চলা। বাইরেটা দেওয়ালের রং পুরোনো হয়ে শেওলা পড়ে আছে। ভেতরে যেতে একজন মহিলা তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। মহিলাকে বৃদ্ধ বলা যাবেনা আবার বেশী শক্তপাক্তো ও বলা যাবে না। সোফায় বসে পানি পান করে তাহিয়া। তখন শিরিন বেগম বলেন,

-আর কতদিন পালিয়ে বেড়াবে?

-যতদিন না সে চায়। আমার বোন তো তাকে মে*রে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

-তোমার বোনের ভুল ধারনা ভেঙে দাও।

-হুম ভাঙবো। কিন্তু মিমি জানো কী? সে বিয়ে করে নিয়েছে আচ্ছা আমার কথা ও ভাবলো না একটিবার?

-সে তোমায় ভালোবাসে না।

-ইশশ! আমায় কেউ ভালোবাসে না।

-এসব বাদ দাও তাহিয়া। তোমার বাবা,বোন তো এখনো তোমায় মিস করে। এসব বাদ দিয়ে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াও। আর তোমার ফুফির আসল মুখোশটা সামনে আনো।

-আনবো খুব শীঘ্রই। এই মহিলা আমায় মেরে ফেলতে চাইলো। সেদিন নিবরাস গিয়েছিলো সেখানে। শামিম সরদারের বলা কথাগুলো রেকর্ড করে নিয়েছে আর থ্রেট দিয়েছে এটা পুলিশের কাছে দিয়ে তাঁদের সব কালো পথের ব্যবসা বন্ধ করে দিবে। তবে শর্ত দিয়েছে একটা এখানে যা হবে বাইরের কাক পক্ষী ও টের পাবেনা। আমার কী মনে হয় জানো? নিবরাস জানতো আমায় ওরা কিডন্যাপ করবে নাহলে এতো সুন্দর ভাবে অল্প সময়ে কেউ সবটা প্লান মাফিক করতে পারে?

থেমে,

সেদিন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নিবরাসের কথা অনুযায়ী আরেকটা মেয়েকে আনা হয়। সম্ভবত কোন হসপিটাল থেকে আনা হয়। মেয়েটার পরিচয় বা পরিবার কারোর খোঁজ ছিলো না। জানা নেই আমার তবে আমাকে বাঁচানোর জন্য মেয়েটার সাথে অন্যায় করা হয়। মেয়েটাকে চেয়ারে বসিয়ে তার মুখে এসিড ঢেলে তার মুখটা বিকৃতি করে দেওয়া হয়। নিবরাসের কাজ হতে সে আমায় নিয়ে বেড়িয়ে আসে সেদিন। আমাদের গাড়ী চলে আসে সেখান থেকে। জঙ্গল আবৃত পল্লীগ্রাম থেকে কোলাহলময় নগরীতে চলে আসা হয়। সেখানে কী হয়েছিলো জানা নেই। তবে তখন আমার মনে হয়েছিলো নিবরাস আমায় ভালোবাসে হয়ত! নাহলে আমার প্রাণ কেনো বাঁচাবে? আজোও বিশ্বাস করি সেটা। কিন্তু কয়েকদিন হলো বিশ্বাস আর মনটা ভেঙে গেছে যখন শুনেছি নিবরাস বিয়ে করেছে। আসলে সে আমার ভাগ্যে নেই তবে শখের পুরুষ সে। আছ এবং থাকবে শখের হয়ে। আচ্ছা মিমি তুমি বলো সে তো চাইতো আমি তাকে বিরক্ত না করি। আমি মরে গেলেও তার কিছু যায় আসে না বরং তার শান্তি! কিন্তু সে আমায় বাঁচালো সেদিন। এসিডে পুড়ে এই রুপটা বিভৎস হওয়া থেকে। তাইপেনের বিষাক্ত বিষের ছোঁয়া থেকে। ইশশ সেদিন আমার মুখ পুড়তো সেই সাথে আমার শরীরের প্রত্যেকটা অংশ নীলচে বর্ণ ধারণ করে সব খুঁয়ে, খুঁয়ে পড়তো। ভেবেছো কতটা ভয়ং*কর মৃ*ত্যু আমার জন্য লেখা ছিলো।

-এই নেতা কে আমি বুঝিনা মা। আসলে তার মাথায় কী ঘুরছে?

-জানা নেই!

দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় তাহিয়া। বছর খানেক হলো বাড়ীটাতে আসা! থাকা। নিবরাসই ম্যানেজ করে দিয়েছিলো। সেদিন রোহিতের সাথে একটা বাংলোতে পাঠানো হয় তাহিয়াকে। সেখানে কয়েকদিন সুরক্ষিত ভাবেই থাকে সে। তার মৃ*ত্যুর রপশ কাটতে এই বাড়ীতে চলে আসে।

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে তাহিয়া। নিবরাস মির্জা নামটা মনে পড়লে বুকটা কেঁপে উঠে। খুব বি*শ্রী ভাবে তাকে হারালাম। ইশ! আমি এই নগরীতে থাকবো কীভাবে তাকে ছাড়া?

****

বাড়ীটা ভালো করে দেখে রাখে নাজিয়া। রিকশা ঘুরিয়ে তাহিয়ার পিছু নেয় সে। তাহিয়া এই বাড়ীতে থাকে অথচ এতোদিন ভাবতো সে মারা গেছে। আর কত কিছু লুকানো আর প্রকাশিত হবে? আনায়া নিবরাসের কথা মনে আসতে নাজিয়া চলে যায় গন্তব্যের দিকে।

তার আসতে কিছুটা লেট হয়ে যায়।আনায়া নিবরাস এতোক্ষণ একটা ক্যাফেতে বসে ওয়েট করেছিলো তার জন্য।

নাজিয়া যেতে আনায়া তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে নেয়। নাজিয়াকে দেখে আনায়া মুচকি হাসে! মেয়েটা দেখতে আনায়ার কপি। চেহারায় এতো মিল! তার বোনটা অল্পবয়সী হলেও রুপে,গুণে,ম্যাচিউরিটিতে যেনো তাকে ছাড়িয়ে। নাজিয়া সামনের চেয়ারটায় বসতে আনায়া বলে,

-পাখি তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?

-তোমার মতো একটা নেতার বউ।

নাজিয়ার কথায় আনায়া,নিবরাস দু’জনে হেঁসে দেয়। নাজিয়া সিরিয়াস মুখ করে বলে,

-অ্যাম সিরিয়াস ভাইয়াকে বলো তার মতো একটা নেতা আমায় খুঁজে দিতে। তারপর তোমার মতো আমিও নিজের নামের সাথে নেতার বউ ট্যাগটা লাগাবো।

– মেয়ে তোমার লজ্জা হওয়া দরকার। বড় বোনের থেকে জামাই খুঁজছ?

-ধুর এসব লজ্জা টজ্জা আমার কমই।

-একদম আমার জামাইয়ের মতো।

-আমি নাজিয়ার মতো এতো বেশী ঠোঁটকাটা না বউ। আমি তো তোমার লাজুক স্বামী! তোমার অনুমতি ছাড়া তোমায় একটা চুমুও খাইনি।

-হ্যাঁ,হ্যাঁ সে তো দেখি আপনি কেমন লাজুক।

নিবরাসের দিকে তাকিয়ে নাজিয়া একটু শব্দ করেই হেঁসে দেয়। আনায়া নিবরাসকে ভেংচি কাটে। তখন নাজিয়া বলে,

-বিশ্বাস করা বড্ড দায়! তুমি ভাই নিবরাস মির্জা একনাম্বারের ঠোঁট কাটা তোমার মুখে লাজুক শব্দটা একদম শোভা পায়না।

-দুই বোন মিলে আমায় পচাচ্ছে। আমি একজন নেতা একটু তো সন্মান আর ভদ্র ভাবে কথা বলো আমার সাথে।

-আরে আমরা আমরাই তো।

ঠাস করে থাপ্পড় দিয়ে কথাটা বলে আনায়া। নিনরাস গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আনায়া কথার মাঝে খেয়াল করেনি চড়ের ব্যপারটা। কথা বলার সময় এমন হাত পা চলেই তার। তবে কয়েকমাস একটু বদ্রতার ট্যাগ বসাতে চেয়েছে কিন্তু তার মতো তার চঞ্চল বোনকে পেয়ে চঞ্চলতা জেনো বেড়ে গেছে। নিবরাস আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

-কথা বললে হাত পা নিজের কাছে গুটিয়ে রেখে কথা বলবে। হুটহাট পাশের জনকে থাপ্পড় দিয়ে কথা বলার ফিল নেওয়া কোন ধরনের ভদ্রতা?

-আমি আপনায় থাপ্পড় দিয়েছি?

-না আদর দিয়েছো।

-স্যরি! রিয়েলি স্যরি! আমি বুঝতে পারিনি। দেখি কোথায় থাপ্পড় দিয়েছিলাম?

-গালে!

-থাক বাড়ীতে গেলে গালটা দিও একটু মালিশ করে দেবো।

-লাগবে না।

তখন নাজিয়া বলে,

-একটা কথা ছিলো খুবই ইমফরটেন্ট।

-কী কথা?

নিবরাস বলে। তখন নাজিয়া বলে,

-তাহিয়া আপুকে দেখলাম।

-দেখে ফেলেছো? ওয়াও! ভাবতে পারিনি তুমি দেখে ফেলবে। যাই হোক কয়েকদিন গেলে আমিও বলতাম তোমায়।

-তাহিয়া বেঁচে আছে? একবছর আগে না শুনলাম ও মারা গেছে।

-মরেনি ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। তোমার মায়ের কুকীর্তি ফাঁস করার জন্য এমন কাউকে আমার চাই। সেজন্য ওকে বাঁচিয়ে নিয়েছি সেদিন। এছাড়া কোন ইচ্ছে ছিলো না। প্রচুর জ্বালিয়েছে আমায়।

-ও আমার কাজিন ভুলে গেলেন?

-তো কী? দেখো তোমার কাজিনের জন্য এই হ্যান্ডসাম নেতাকে হারাতে তুমি। ভাগ্যিস পটে যাইনি।

-এই শুনুন সবসময় নিজেকে এতো বড় ভাববেন না। যত্তসব!

তখন নাজিয়া বলে,
-আরে ভাই কথাটা তুললাম আমি। কাহিনীর সারাংশ বলবা তা না দু’জনে ঝগড়া করেই যাচ্ছে।

-আরে আয়াত তোমার কাজিন এটা ভার্সিটি লাইপ থেকে আমার পিছু পড়ে ছিলো। আঠার মতো! কোথাও শান্তি পেতাম না এটার জন্য। সব জায়গায় একে দেখা যেতো। কী জানি কীভাবে তোমাদের বিজন্যাসের বাইরের আরেকটা বিজন্যাসের কথা ও জানে। তোমার মাকে ফাঁসাতে চেয়েছে। জানি না কী শত্রুতা ওদের মাঝে। তোমার মা কোন ভাবে জানে আর ওকে রাস্তা থেকে সরানের জন্য সব পরিকল্পনা করে নেয়। আমি তার পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকে অবগত ছিলাম। তারপর আরকী! ওকে বাচিয়ে দেই সেদিন।

-এখন তো ওর বোন আপনায় ওর খু*নি ভেবে পেছনে পড়ে আছে। শুধু তাইনা শামিম সরদারের সাথে পরিকল্পনা করছে আপনায় মারার জন্য।

-করতে থাকুক! দেখি কবে আমায় মারে।

-আরে বাজে কথা ছাড়ুন না।
তেজ দেখিয়ে বলে আনায়া। নিবরাস আর এই নিয়ে কথা বাড়ায়নি। তারা তাঁদের মতো কথাবার্তা বলে কোল্ড ড্রিং খেয়ে উঠে। তেমন একটা ঘুরাঘুরি করেনি আর! নাজিয়াকে তার গিফ্ট গুলো আনায়া দিয়ে দেয়।

নাজিয়া গিফ্ট নিয়ে আনায়া, নিবরাসকে বিদায় জানিয়ে রওনা দেয় হোস্টেলের উদ্দেশ্য।

বাড়ীতে আসতে,আসতে বিকেল গড়ায়। আনায়া ব্যস্ত পায়ে উপরে উঠে। নিবরাস নিচে কথা বলছে রোহিত,সৌরভের সাথে।

তারিশা বেশ নজর রাখছে আনায়া,নিবরাসের উপর। কোন কথা না বলে সোজা নিবরাসের রুমে ঢুকে যায় সে। তারিশাকে দেখে আনায়া বলে,

– কারোর রুমে ঢুকতে হলে পারমিশন যে নিতে হয় সেই শিক্ষা মনে হয় এখনো পাওনি তুমি।

-পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। এই তুমি না আসলে তোমার জায়গায় আমিই থাকতাম।

-ব্রাহ্মণ্ হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন। বেশ ভালো তো! স্বপ্ন দেখা ভালো তবে সাধ্যের বাইরের কিছুকে নিয়ে নয়। এতে করে শুধু কষ্ট আর অপূর্ণতা পাওয়া যায় কখনো পূর্ণতার ছোঁয়া না।

-আজকাল বেশ বাইরে বের হও দেখছি। মির্জা বাড়ীর বউ এতো বাইরে কী?

-আমি তো আমার পার্টনারকে নিয়ে বের হই। আমায় প্রটেক্ট করার জন্য সে আছে। তুমিও আজকাল একা,একা বের হও দেখি। শুনেছি তুমি নাকী মির্জা বাড়ীর মেয়ে। আর আমি কোথায় যাবো না যাবো সেসব আমার হাজবেন্ড দেখবে বুঝবে। তোমার এসবে কাজ নেই।

-অবশ্যই কাজ আছে! অনেক কাজ আছে আমার।

-মনে হয় কারোর দু চার টাকার চাকরগিরি করো।

-মুখ সামলে!

-তুমি নিজের মুখ সামলাও! দিনদিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো। আমাদের পার্সোনাল মেটারে ঢুকো কেন?

-নিবরাস আমার হতো! শুধু তুমি তাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছো।

তখন আবার রুমে উপস্থিত হয় নিবরাস। তারিশার কথায় তার মেজাজ বিগড়ে যায়। মেয়েটার লাজ লজ্জা বলতে কিছু নেই। এসব বাড়াবাড়ির জন্য চ*ড় পর্যন্ত খেয়েছিলো একসময়। তখন আনায়া আসেনি নিবরাসের জীবনে। তাহিয়াকে সরানোর পর তারিশা জামেলা শুরু করে। ঘরে একজন বাইরে তো তাহিয়া ছিলোই। এখন বিয়ে করেও শান্তি নেই তার।

আনায়া রেগে তাকিয়ে আছে তারিশার দিকে। নিবরাস রুমে আসতে আনায়ার রাগ আরো বেড়ে যায়। তারিশা তাকে এতো কথা শোনাবে কেন? নিবরাস কিছু বলছে না কেন?

তখন নিবরাস তারিশাকে বলে,

-সমস্যা কী তোমার তারিশা?

-আমার সমস্যা এই আনায়া। তুমি জানো ভাইয়া আমি তোমাকে ভালোবাসী।

ঠাস করে চ*ড় পরে যায় গালে। নিবরাস রেগে চেঁচিয়ে বলে উঠে,

-দিনদিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো তুমি। আমি বলেছি আনায়ার থেকে দূরে থাকবে এমনকি আমার থেকেও। সমস্যা কী তোমার? বেশী সুখ কপালে সইছে না তাই না? তোমার মুখোশ টেনে ছিঁড়ে তোমায় বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে আমার দু’মিনিট ও সময় লাগবে না। সো বি কেয়ার ফুল। ওয়ার্নিং দিয়ে দিলাম। নেক্সট টাইম আমার রুমে আসবে না তো আমায় নিয়ে আনায়ার সাথে ঝগড়া করবে। গেট লস্ট! আর লজ্জা-শরম কিছু রেখো। ব্যক্তিত্ব তো নেই তারউপর যা তা অবস্থা! ছ্যচড়ার উপর কোন নোবেল থাকলে সেটা তোমাকেই আমি দিতাম।

#চলবে

#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|২৫|
#শার্লিন_হাসান

তারিশা রুম থেকে বের হতে দেখে মরিয়ম নওয়াজ দাঁড়িয়ে আছেন। তারিশার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছেন। তারিশা একটা ঢোক গিলে! আমতা আমতা করে বলে,

-তুমি এখানে মামনি?

-তুমি ওদের রুমে কী করো তারিশা?

-ওই এমনিতে এসেছিলাম আমি।

-আর মিথ্যে বলতে হবে না তোমার। আমি সব শুনেছি! বেয়াদব মেয়ে একটা। এই শিক্ষা দিয়েছি তোমায়? ওদের মাঝে বারনার ঢুকো কেন তুমি? আনায়া মির্জা বাড়ীর বউ এই কথাটা মাথায় রাখবে আর তুমি মেয়ে বিয়ে দিলে চলে যেতে হবে।

তারিশা কিছু বলছে না। মরিয়ম নওয়াজ হনহনিয়ে চলে আসেন সেখান থেকে। মূলত তাঁদের চিৎকার চেঁচামেচি তে এদিকটায় এসেছিলেন তিনি। তারিশার থেকে এসব একদম আশা করতে পারেনি তিনি।

আনায়া রেগে বসে আছে। নিবরাস আর কিছু বলেনি তাকে। কে জানে তার ত্যাড়া বউ আবার তার উপর রাগ ঝাড়ে কীনা। নিবরাস চুপচাপ শাওয়ারে ঢুকে যায়। আনায়া মেঝেতে তাকিয়ে আছে। পারছে না মুখের উপর সব বলে দিতে! কিন্তু বললে তারাই বিপদে পড়বে।

কী মনে হতে আনায়া সিদ্ধান্ত নেয় বাবার কাছে যাবে সে। সেখানে কয়েকমাস থাকবে। নিবরাস আসতে আনায়া বলে,

-আমি বাড়ী যাবো। কয়েকমাস সেখানেই থাকবো।

-তুমি কয়েকমাস বলতে কয়মাস বুঝাচ্ছো?

-এই দুই তিন মাস।

-তুমি কী করে ভাবলে এটা আনায়া? আমমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে রাতে ঘুমাবো?

-যখন আমি ছিলাম না তখন কীভাবে ঘুমিয়েছেন?

-তখন তো কাজ করেই রাত কভার করে দিতাম। এখন তো বউ আছে রোমান্স করে রাত কভার করা দরকার। তবুও হিমশিম খাচ্ছি।

-অস*ভ্য লোক মুখটা বন্ধ রাখবেন?

-আরে কী বলো তুমি? দুই তিন মাস। এক দুই দিন হলে একটা কথা ছিলো।

-এতো বউ পাগল হতে হবে না।

-আচ্ছা যাও।

-দুই তিন মাস কথাটা মাথায় রাখবেন।

-হ্যাঁ,হ্যাঁ থাকবে।
দেখে কী কপাল! বিয়ের চারমাস না যেতে বউ তিনমাসের জন্য বাপের বাড়ী চলে যাচ্ছে। বউ ছাড়া থাকতে হবে।

-বেশী প্যাকপ্যাক না করে নিজের কাজে মন দিন তো।

আনায়া নিজের ব্যাগ গুছানোর কাজে উদ্যত হয়। নিবরাস কাউচে বসে ফোন স্ক্রোল করছে।

সন্ধ্যায় সবাই লিভিং রুমে বসে কথা বলছে। নিরব মির্জা সহ! আনায়া তাঁদের জন্য চা বানিয়ে আনে।
টুকটাক কথা বার্তা হতে নিরব মির্জা তারিশাকে বলেন,

-তোমার তো ভার্সিটি ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। হোস্টেল যাইবা নাকী বাড়ীতে থাকবা?

-হ্যাঁ চলে যাবো দু একের ভেতর।

-মাইশা ও চলে যাবে শোনলাম। আনায়াও চলে যাবে বাড়ী তো ফাঁকা হয়ে যাবে।

নিরব মির্জা বলেন। কেউই আর তেমন কথা বাড়ায়নি।

পরের দিন সকালে আনায়া নাস্তা করে চলে আসে তাঁদের বাড়ীতে। জিয়াউর রহমান আনায়াকে দেখে বেশ খুশি। কতদিন পর বাড়ীতে এসেছে তার কন্যা। আনায়া নিজপর রুমে গিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। কতগুলো দিন হয়ে গেলো প্রিয় রুমটায় আসা হয়না। একসময় এই রুমটা ছাড়া ভালোই লাগতো না। শখের রুমের মায়াও ত্যাগ করে দিতে হয়। এই নারীর জীবনটা বুঝি ত্যাগে,ত্যাগেই কাটলো।

বেলকনিতে যেতে দেখলো তার টবের গাছগুলোও মৃত প্রায় অবস্থা। শখ করে বিশাল বেলকনির এক কোণায় পছন্দের কয়েকটা ফুল গাছ লাগিয়েছিলো আনায়া। এখন যত্ন ও নেওয়া হয়না আগের মতো।

পুরো বাড়ীতে পদচারণ করলো আনায়া। সোফায় বসে তার বাবার সাথে খোশগল্পে মেতে উঠে। অনেকদিন পর আনায়া এসেছে তার পছন্দের খাবার রান্না করতে বলা হয় কাজের বুয়াকে।

*******

রাতের দিকে আনায়া বই হাতে বেলকনিতে বসে পড়ছে। একাডেমিক বই না সে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন পড়ছে। বইটা তার ভীষণ প্রিয়! রাত প্রায় সাড়ে দশটা। বেলকনিতে বসে চাঁদ দেখছে সাথে বইও পড়ছে আনায়া। আজকের চাঁদটা আলো ছড়াচ্ছে বেশ। কিন্তু আনায়ার ব্যক্তিগত চাঁদ তার কাছে নেই।

আনাদের বাড়ীর গেট ছাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করে নিবরাস। অনেকটা চোরের মতো! তাঁদের গেটের দারোয়ান ঘুমিয়ে পড়েছিলো ভাগ্যিস! হয়ত কিছুক্ষণ পর জেগে যাবে। তাতে কী নিবরাস তো আজকের রাতটা এখানে থাকবে আবার ভোর হওয়ার সাথে,সাথে চলে যাবে। বউকে ছাড়া তার রুমে মন টিকে না। বিয়ের পর এই প্রথম নিবরাস শশুর বাড়ীতে পদচারণ করছে তাও চোরের মতো।

আনায়ার ফোনে মেসেজ দেয় নিবরাস। মেসেজের শব্দে ফোন হাতে নেয় আনায়া। মেসেজ দেখে নিচে তাকায়।নিবরাস তাকে হাত নাড়িয়ে হাই দিচ্ছে।

আনায়া রুম থেকে বেড়িয়ে মেইন গেটে আসে।নিবরাস তড়িঘড়ি ভেতরে ঢুকে পড়ে। লিভিং রুম জুড়ে অন্ধকার। লাইট অন করেনি আনায়া। নিবরাসকে আলতো হাতে ধাক্কা দিয়ে বলে,

-চোরের মতো আসলেন যে?

-তুমি কী চাচ্ছো আমি ডা*কাতের মতো আসি?

– আপনার মতলব টা কী? এই শশুর বাড়ীতে চুরি করতে আসলেন নাকী?

-না শশুরের থেকে চাঁদাবাজি করতে এসেছি। ভেবেছিলাম বাবুর পাপা হবো কিন্তু তুমি আমায় বাবুর পাপা বানানোর বদলে চো*র বানিয়ে দিচ্ছো।

-আরে…

নিবরাস আনায়ার মুখ চেপে ধরে তাকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। আনায়ার রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয় নিবরাস। আনায়া দাঁড়িয়ে আছে। নিবরাস সেসবে পাত্তা না দিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসে পড়ে।

-নতুন জামাই এসেছে তাকে আদর আপ্পায়ন করবে না?

-নতুন জামাই এভাবে চোরের মতো আসে না। বুঝলেন?

-তুমিও না বউ। আসো চুমু খাই তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

-অ’সভ্য লোক।

-এদিকে আসো আনায়া তোমার জন্য গিফ্ট এনেছি।

আনায়া খুশি হয়ে নিবরাসের সামনে গিয়ে বসে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-কী গিফ্ট? তাড়াতাড়ি দিন?

-ইশ কী শখ! টাকা নেই সেজন্য গিফ্ট আনিনি।

-লাগবে না গিফ্ট।

-চুমু লাগবে তাই না?

-আপনি আগে বলুন এভাবে আসলেন কেন? আমাকে বললেই তো হতো।

-ডিস্টার্ব করো কেন?

কথাটা বলে নিবরাস আনায়াকে কাছে টেনে নেয়। আনায়ার অধর জোড়ায় নিজের অধর মিশিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর নিবরাস আনায়ার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আনায়া রেগে তাকিয়ে আছে।

-আজব এতে রাগার কী আছে? জামাই মানুষ আমি একটু আধটু আদর তো লাগেই।

-রাগবো না? আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি সেটার কোন পাত্তাই দিচ্ছেন না।

-কী জেনো জিজ্ঞেস করছো?

-আমার মাথা!

-একটু সন্মান দাও আমায়। নেতা আমি।

-আমাকেও একটু সন্মান দিন নেতার বউ হই আমি।

আনায়ার কথায় নিবরাস হেঁসে দেয়। আনায়া নিবরাসকে টেনে বেলকনিতে নিয়ে যায়। আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,

-আজকের চাঁদটা বেশী সুন্দর তাইনা?

-উঁহু একদম সুন্দর না।

-কেন?

-আমার চাঁদের থেকে ওই আকাশের চাঁদ কিছুতেই সুন্দর হতে পারে না।

-আনায়া তোর জামাইটা কত রোমান্টিক দেখ।

-আনায়া কত ভাগ্য তোমার এমন একজনকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পেয়েছো।

দু’জনে কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলে রুমে চলে আসে। প্রতিদিনের মতো আনায়া নিবরাসের বুক দখল করে নেয়। গুটিশুটি মেরে নিবরাসের বুকে শুয়ে পড়ে আনায়া।

আহিয়ার মাথায় নতুন পরিকল্পনা ঘুরছে। কী ছাড়বে কী ধরবে বুঝতে পারছে না সে।
তাহিয়ার রুমে গিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে রাত বিরাতে। পুরো রুম এলোমেলো করে ফেলে। তেমন কিছু পাচ্ছে না সে। তবে ড্রয়ার খুলে ডায়েরির পাতার ভাজ থেকে একটা মেমোরি কার্ড পায়। আহিয়া ভাবছে হথথয়ত পুরোনো ছবি সংরক্ষণ করা আছে এতে। বেশী ইন্টারেস্ট আসেনি বিষয়টার প্রতি। তার মাথায় তো একটাই চিন্তা কবে নিবরাসকে মা*রতে পারবে। শামিম সরদার কিছুই করছে না সেজন্য আহিয়া বেশ বিরক্ত হয়। তার মনে হচ্ছে তাকে কোন পরিকল্পনা করতে হবে। নাহলে নিবরাসকে দমন করা সম্ভব না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে