#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|৭|
#শার্লিন_হাসান
আহিয়ার বাবা হসপিটালে ভর্তি আছে । নিবরাসের দলের কয়েকজন আসে হসপিটালে। তাঁদের একজনের হাতে ফুল৷ কেবিন নাম্বার জেনে তারা ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে আনিসুল হক অক্সিজেন মাস্ক লাগানো মুখে। তাদেরকে দেখে চিনতে ভুল হয়নি। নিবরাসের দলের একজন সৌরভ ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
-আনিসুল হক আমাদের নেতার পক্ষ থেকে আপনার জন্য। জানি বেশীদিন টিকবেন না! আমাদের নেতা আবার বেশ দয়ালু দেখুন আপনি তার শত্রু অথচ আপনার মৃত্যুর সময়টা যাতে ফুলের মতো সুন্দর হয় সেজন্য ফুল সাথে দো’আ পাঠিয়েছে।
সৌরভের কথায় আনিসুল হক অক্সিজেন মাস্ক খুলে বলে,
-অসুস্থ হয়েছি বলেই কী মরে যাবো? চিকিৎসার জন্য হসপিটালে এসেছি এই নয় যে আমার অবস্থা করুণ।
-চিকিৎসা না হলে তো আর বাঁচবেন না। নেতাকে বললে সেটাও ব্যবস্থা করে দিবে। আপনাকে উপরে পাঠানো তো সময়ের ব্যপার।
সৌরভের কথায় আনিসুল হক চুপসে যায়। তখন আহিয়া রুমে আসে। সৌরভকে দেখে বেঙ্গ করে বলে,
-কীরে নেতার চামচা ফুলটা কিনে আনার জন্য কত টাকা মারলি? নিশ্চয়ই কোন অসহায় লোকের পকেট থেকে চাঁদাবাজি করেছিস। ফুল না আনলেও হতো! লোকটার অন্তত একবেলার খাবার জুটতো।
-ফাল’তু কথা বাদ দে আহিয়া। নিবরাস ভক্তরা চাঁদাবাজি করে না। তবে শামিম সরদারের লোকজন আমাদের নাম করে চাঁদাবাজি করলেও করতে পারে।
-এসব দুই টাকা পাঁচ টাকা শামিম সরদার নেয়না ভিক্ষা করে। এসব তোরাই নিস!
-মনে হয় বাপের সাথে তোকে ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ইনজেকশন দিয়ে উপরে পাঠাতে হবে।
-একটা মে য়াদ উত্তীর্ণ ইনজেকশন দিয়ে আমায় মারা যাবে না। আমায় মারতে হলে দম লাগবে যেটা এখনো মুয়াম্মার নিবরাস মির্জার হয়ে উঠেনি।
-দেখা যাবে।
সৌরভ তার দলের লোকদের নিয়ে বেড়িয়ে আসে। আহিয়া তাঁদের যাওয়ার পাণে তাকায়। আনিসুল হকের কাছে এসে বসে।
-চিন্তা করো না বাবা। এঁদের একদিন সব শেষ হবে। এই নিবরাস মুখোশ পড়ে থাকে। এর মুখোশ একদিন আমি টেনে ছিঁড়ে দেবো।
-পারবি না মা। ওদের সাথে পারবি না। ভুল যে শুধু ওদের এমনটা তো নয়! আমাদেরও ও ভুল আছে।
-কোন ভুল নেই আমাদের। সব ভুল নিবরাসের।
*****
-স্যার ওই বুইড়া শালাকে হুমকি দিয়ে আসলাম। সাথে ওর সাহসী মাইয়ারে। একা পেলে একবার খেয়ে ছেড়ে দিমু।
পার্টি অফিসে এসে অতি আনন্দের সহিত কথাটা বলে সৌরভ। তাতেই ঠাস করে চড় বসে যায় তার গালে। নিবরাস হুংকার ছেড়ে বলে,
-ভাষার এই অবস্থা কেন তোর? ওই মেয়ের কোন ক্ষতি করবি না। শুধু ওই মেয়ে না আমার এলাকার কোন
মেয়ের যাতে কোন ক্ষতি না হয়। আর যদি কিছু হয় সবার আগে তোকে ধরবো আমি।
সৌরভ চুপসে যায়। এই নিবরাসকে মাঝেমাঝে বুঝতে পারে না কেউ। শত্রু ভয় পেলো এই কথা শোনে কোথায় খুশি হবে তা না ভাষা নিয়ে জ্ঞান দিয়ে দিলো।
মিটিং শেষে নিবরাস বেড়িয়ে যায় পার্টি অফিস থেকে। তখন মাইশা কল দিয়ে বলে মিসবাহকে নিয়ে চলে আসতে। স্কুলের সামনে আসতে দেখলো তারিশা মিসবাহ গেট দিয়ে বের হচ্ছে।
মিসবাহকে দেখে নিবরাস জিজ্ঞেস করে,
-গাড়ী নিয়ে এসেছে তোমার আন্টি?
-না আসেনি। তোমার গাড়ী দিয়ে যাবো আমরা দু’জন।
নিবরাস মাথা নাড়ায়। তারিশা মিসবাহকে নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসে। তারিশা সামনে বসেছে নিবরাসের সাথে। মিসনাহ একা,একা পেছনে। তার পেছন দিয়ে একটা গাড়ী আসছে।
কিছু মহিলা এসেছে মির্জা বাড়ীতে। অবশ্য সাহায্য চাইতে এসেছে। মরিয়ম নওয়াজ সাথে আনায়া ছিলো বাইরে মহিলাদের কাছে। তখন নেতার গাড়ী প্রবেশ করে গেট দিয়ে।
আনায়া সাথে মহিলারাও তাকায় গাড়ীর দিকে। নিবরাস গাড়ী থেকে নামতে তারিশা ও নামে। আনায়া নিবরাসের দিকে তাকিয়ে আছে৷ লোকটা এদিকে একবারের জন্য ও তাকাচ্ছে না। মিসবাহ তারিশাকে ভেতরে পাঠিয়ে এদিকটায় আসে। আনায়াকে দেখে বলে,
-বাইরে কী করছো? যাও ভেতরে চলে যাও।
আনায়া আর কথা বাড়ায়নি। পা ফেলে চলে আসে তবে তার হাটায় অনেকটা রাগ প্রকাশিত হয়। নিবরাস মহিলাদের সাথে কথা বলো সমস্যার কথা জানে। আপাতত বাজার করার জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে দেয় চারজন মহিলাকে। আগামী কালকে আসতে বলেছে। একটা ব্যবস্থা করে দিবে নিবরাস।
ভেতরে এসে আনায়া সোফায় বসে আছে। নিবরাস আসতে তাকে দেখেও না দেখার ভান করে আনায়া। নিবরাস আনায়ার সোজা সোফায় আয়েশ করে বসে৷ তখন তারিশা তারজন্য শরবত নিয়ে আসে। আনায়া সামনে বসে আছে তারিশা তার দিকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিবরাস নিবে নাকী নিবে না ভাবছে। তখন মরিয়ম নওয়াজ সেখানে উপস্থিত হোন।
-তারিশার থেকে গ্লাস টা নিচ্ছো না কেন নিবরাস?
আনায়া তাকায় তাঁদের দিকে। নিবরাস মাথা নাড়িয়ে শরবতটা পান করে। আমতাআমতা করে বলে,
-আনায়ার দায়িত্ব তারিশা পালন করছে। এদিকটা খেয়াল রাখা উচিত।
-তোমার বা*লের দায়িত্বর উপর তুমি নিজে খেয়াল রাখো। এসব দেখার টাইম নেই আনায়ার।
মনে,মনে কথাগুলো বলে আনায়া। প্রকাশ করার জো নেই যদি ধমক দিয়ে বসে নিবরাস।
আনায়া সেসবে আর কান দেয়নি উঠে সোজা রুমে চলে আসে। রুম জুড়ে পায়চারি করছে। নিবরাস কখন রুমে আসবে আর ঝাড়িটা দিবে আনায়া।
কলে কথা বলতে,বলতে রুমে প্রবেশ করে নিবরাস। আনায়া তাকে পাত্তা দিবে না জানে সেজন্য কলের ব্যস্ততা দেখাচ্ছে সে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আনায়া নিবরাসকে বলে,
-কলটা কাটুন।
নিবরাস ফোন পান্জাবির পকেটে নিয়ে নেয়। আনায়া তার কলার চেপে ধরে বলে,
-তারিশার সাথে খুব ঘুরাঘুরি হয়েছে বুঝি? তারিশার হাতের শরবত অমৃত তাই না?
-আরে এসব কিছু না। ও গাড়ী নিয়ে যায়নি সেজন্য আমার গাড়ীতে নিয়েছি।
কলার ছাড়িয়ে নিয়ে বলে নিবরাস।
-না ঠিক আছে। আমি কে? আমি কী হই? কেউ না কিছু না। তারিশা সব! যান,যান তাকে নিয়ে লং ড্রাইভে ও যান। আমি কিছু বলব না।
-রাগ করছো কেন? দেখো তোমার কত সাহস আমার কলার চেপে ধরেছো। অন্য কেউ হলে জেলে ঢুকিয়ে দিতাম।
-এই আপনি এসব জেল,ক্ষমতা নেতাগিরি অন্য কোথাও গিয়ে দেখিয়োন আর বলিয়েন বউয়ের কাছে না।
-ঠিক আছে।
আনায়া পুনরায় নিবরাসের কলার চেপে ধরে পা উঁচু করে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়।
-যদি আবার ধাক্কাটাক্কা লেগে তারিশার সাথে এসব হয়ে যায়। তার আগে আমি….
তাহলে চলো সবার আগে সংসারটা তোমায় নিয়েই শুরু করি। এতো ছটফট করছো আজকে সব থামিয়ে দেব।
আনায়া নিবরাসকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কথা না বাড়িয়ে বাইরে চলে আসে।
*****
নিধিকে বিদায় দিয়ে এদিকটা সামলে নেয় জায়ান। আত্মীয়স্বজন কিছুটা কমতে শুরু করে। তিয়াশ খান তার বড় ভাই তাশরিফ খানের রুমে গিয়েছে। জায়ান তখন নিজের রুমে এসে শামিম সরদারকে কল দেয়।
-ওই তিন কুকুরের হাত পা ভেঙে হসপিটালের কেবিনে শিফ্ট করিয়ে রাখবি। এসব আগাছা আার বাড়ীতে আনলি কোন সাহসে?
-আরে জায়ান ভাই থাম। ওঁদের আমি দেখে নেবো।
-তোর কথায় আমার বিশ্বাস নেই। ওদের হসপিটালে বসিয়ে পিক পাঠা। অবশ্যই হাতে পায়ে বেন্ডেজ থাকা চাই আমার।
জায়ান কল কেটে দেয়। সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়ে। চিন্তায় ঘাম ছুটে গেছে। গায়ের কালো পান্জাবিরটার দিকে একনজর দেয়। এই বুঝি তার বাবারা এসে বকা-ঝকা দিলো। নাজিয়াকে কিছু বলতে পারবে না সে। সফট হার্টে কঠিন কথা দিয়ে আঘাত করার সাধ্য জায়ানের নেই।
তিয়াশ খান,তাশরিফ খান জায়ানের রুমে প্রবেশ করে। তাশরিফ খান তো রেগে জায়ানকে বলে,
-এসব শামিমের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? ও ভালো না। এমপির পেছনে তো পড়েছে সাথে এলালার মেয়েদেরকেও উত্যক্ত করে।
-আসলে বাবা..!
-আর কখনো যাতে শামিম সরদারের সাথে তোমার উঠাবসা,চলাফেরার কথা আমি না শুনি।
তাশরিফ খান বেড়িয়ে যায়। তিয়াশ খান জায়ানকে বলে,
-এসব লোক বাড়ীর আশেপাশে ও যাতে না ঘেঁষে। নাজিয়া আমাদের পরিবারের সন্মান। বুঝলে?
মাথা নাড়ায় জায়ান। তিয়াশ খান প্রস্থান করতে শামিমের চৌদ্দ গুষ্টি বকাঝকা দিয়ে শুদ্ধো করে দেয় জায়ান। পারছে না নিজে গিয়ে গলা টিপে মেরে দিতে ছেলে তিনটাকে।
*****
সন্ধ্যায় মির্জা পরিবার ঠিক করছে কোথাও যাওয়ার জন্য। সবাই মিলে ঠিক করছে নিবরাসের নানুদের বাড়ী যাবে। তারপরে নিবরাস আর আনায়া অন্য কোথাও যাবে। আগামী কালকে তারা রওনা হবে রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। মরিয়ম নওয়াজ কল করে বলে দিয়েছেন তারা পুরোনো বাড়ীতে যাবে আগামীকাল সব জেনো ঠিকঠাক করে রাখে।
রাতের খাবার রেডি করে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছে আনায়া সাথে কাজের বুয়া একজন। তখন তারিশা আসে কিচেনে। রাতের মেনু দেখে বলে,
-এই কয়টায় হবে নাকী? আমি গরুর মাংশ রান্না করবো এখন।
-এখানে যথেষ্ট আইটেম আছে। আর একজন দু’টো বেশী নিবে না। সেখানে তিন রকমের মাছ,হাঁসের মাংশ,মুরগির মাংশ ও আছে। এখন রান্না করার দরকার নেই।
-নিবরাস ভাইয়া গরুর মাংশ বেশী পছন্দ করে৷ এখন হলে মন্দ হয়না।
কথাটা বলো তারিশা দেখে মাংশ নামায়। আজকে নতুন করে আনা হয়েছিলো বেশী বরফ হয়নি। কাজের বুয়া দু’জনকে বলে বাকী কাজ করে দিতে সে রান্না বসাবে। আনায়া কিচেন থেকে চলে আসে রুমে। নিবরাস তখন ল্যাপটপে কাজ করছিলো। সোজা রুমের দরজা লাগিয়ে দেয় আনায়া।
-এই শুনুন তারিশা নতুন করে আপনার জন্য রান্না করছে। ভুলেও ওই খাবারে নজর দিবেন না। যা আছে তার দিয়ে খেয়ে নিবেন। যতই প্রিয় খাবার হোক।
-আচ্ছা খাবো না।
-যদি খান তো আজকে সত্যি খবর আছে আপনার আমি বলে দিলাম।
-আরে খাবো না। যাও তারিশার থেকে কিছু শিখে নেও! দেখো ওর কিছু হইনা অথচ আমার জন্য রান্না করছে আর তুমি? একটা নিউজ নিয়ে এসেছো
-আচ্ছা আমিও ট্রাই করবো রান্না করার।
-তা পড়াশোনা নেই তোমার?
-আছে।
-সেগুলো কে করবে? পড়াশোনা ঠিকঠাক করছো না কেন?
-এই পড়াশোনা নিয়ে এতো বেশী সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই।
-আছে।আমার বউ শিক্ষিত হতে হবে নাহলে বাচ্চা মানুষ করাবো কীভাবে?
-আপনি আছেন না?
-আমি তো ব্যস্ত! তুমি মানুষ করাবা।
-গা’লি শিখানো ছাড়া আর কী শিখাবো?
– আমার বাচ্চাদের মানুষ করতে বলেছি গালি শিখাতে না।
– আগে বলুন বাচ্চা কই?
-আগে বলো তোমার পড়াশোনা কই? সার্টিফিকেট কই?
– চলুন আমার খিদে পেয়েছে।
নিবরাসকে নিয়ে নিচে আসে আনায়া। বাকীরাও এসেছে। নিবরাস আসতে সবাই খেতে বসে। তারিশা তার গরুর মাংশ এনে নিবরাসের সামনে রাখে। পাশে আনায়া বসা। হাত দিয়ে চিমটি কাটছে নিবরাসের হাতে যাতে মাংশ না নেয়।
-নিবরাস ভাইয়ার গরুর মাংশ পছন্দের আমার হাতের রান্না ও। খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে।
নিবরাস মনে,মনে নিজেকে গালি দেয়। কবে বলেছে তারিশার রান্না পছন্দের? মনে করার চেষ্টা করছে। এখন রুমে গেলে তার বউ আবার এটা নিয়ে রাগ করবে। তখন তারিশা উঠে নিবরাসের প্লেটে গরুর মাংশ ঢেলে দেয়। ততক্ষণে নিবরাস ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে। সামনে রোহিত, পরাগ বসা। নিবরাস তাদেরকে
উদ্দেশ্য করে বলে,
-ওই যে সামনে দু’জন বসে আছে ওদের দাও না? আমাকেই কী শুধু চোখে লাগে?
-দিচ্ছি।
তারিশা তাদেরকেও দেয়। নিবরাস খেটেখুটে না পেরে খাচ্ছে। আনায়া সবার আগে উঠে রুমে চলে যায়। নিবরাস খাওয়া শেষ করে কফির মগ নিয়ে রুমে চলে আসে।
#চলবে