হৃদয় কোঠায় চাঁদের পূর্ণিমা পর্ব-০৬

0
754

#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|৬|
#শার্লিন_হাসান

-কীভাবে চেনো?

-আসলে আমি খান বাড়ীর মেয়ে। তিয়াশ খান এর বড় মেয়ে উম্মে আয়াত নাজিয়া। আশা করি তুমি চিনবে আমায়।

আনায়ার তখন তার মায়ের কথা মনে পড়ে। তিয়াশ খান বর্তমানে তার মায়ের বর।
তখন আনায়া বলে,

-তোমার মা জানে তো এখানে এসেছো যে?

-না আম্মু কিছু জানে না।

-না বলে একা,একা আসাটা ঠিক হয়নি তোমার।

-আরে বাদ দাও; বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি।

আনায়া চুপসে যায়। মেয়েটা বেশ মিশুক! কিন্তু আনায়া মিশতে পারছে না। তারা তো বোন! বাবা ভিন্ন হলেও মা তো একজনই। আনায়াকে চুপ থাকতে দেখে নাজিয়া বলে,

-আমার তোমাকে দেখার শখ ছিলো। পূরণ করলাম। আর কিছু বলার নেই এখন আমি চলে যাব।

-সে কী! এখনই চলে যাবা?

তখন একজন সার্ভেন্ট নাস্তা নিয়ে আসে। নাজিয়া তখন বলে,

-ফিরতে,ফিরতে লেট হয়ে যাবে আবার। কিছু কেনাকাটা করতে হবে নাহলে কী জবাব দেবো? আমরা উঠি! আবার দেখা হবে আমাদের।

তখন মরিয়ম নওয়াজ বলেন,
-নাস্তা করে যাও।

-না করে এসেছি আন্টি।

কেউ আর কিছু বলেনা। নাজিয়া,নিধি বিদায় জানিয়ে বাইরে আসে। পেছনে আনায়াও আসে। তখন আবার নিবরাসের গাড়ী প্রবেশ করে গেট দিয়ে।

-আচ্ছা আমার ভার্সিটিতে এসো দেখা হবে তোমার সাথে।

আনায়া বলে। তখন নাজিয়া বলে,

-মেইন শহরেরটা?

-হুম।

-আচ্ছা বায়।

নিধি,নাজিয়া চলে আসে। আনায়া অন্যমনষ্ক হয়ে ভেতরের দিকে যায়। ভেতরে আসতে দেখলো নিবরাস চুপচাপ। হয়ত কিছু হয়েছে অফিসে। আনায়া সেসবে মন দিলো না। কিচেনে যেতে দেখলো তারিশা ট্রে তে গ্লাস রাখছে। বাইরে থেকে এসেছে নিবরাস তার জন্য ফ্রিজ থেকে জুশ নামিয়ে গ্লাসে নেয়।
আনায়া জিজ্ঞেস করে,

-কার জন্য নিচ্ছো?

-ভাইয়ার জন্য। বাইরে থেকে এসেছে তো।

আনায়া কিছু বলেনা। তারিশার পেছনে আসে।
নিবরাস জুশটা শেষ করে রোহীতকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আর কী,কী অপকর্মের কথা আমি জানি না? সব খুঁজে বের করে আমায় ডিটেইলস দিবা।

কথাটা বলে আর একমূহুর্ত দাঁড়ায়নি নিবরাস।

****

আড়ং থেকে তড়িঘড়ি দু’টো ড্রেস নিয়ে নাজিয়া,নিধি বাড়ীতে চলে আসে। তাদের কিছুটা লেট হয়ে যায়। সূতারা আহমেদ দু’জনকে বকাঝকা শুরু করে দেন। তখন নাজিয়া ফাস্টফুড খাওয়ার নাম দেয়। দোকানে লেট হয়েছে তাদের। এতে অবশ্য তেমন কিছুই বলেনি সীতারা আহমেদ।

শিকদার বাড়ী থেকে সব ঢালা পাঠিয়ে দিয়েছে। খান বাড়ী থেকে বিকেলে সব পাঠিয়ে দেবে। সেটার গোছগাছ হচ্ছে। বাড়ীতে বিয়ে অথচ নাজিয়ার সেসবে মন নেই। আনায়ার কথা ভাবছে সে। মায়ের মতোই সুন্দর হয়েছে। নাজিয়াও দেখতে সীতারা আহমেদের মতোই। আসার সময় নিধি বলেছে তাঁদের দুই বোনের চেহারায় নাকী অনেক মিল আছে।

বিকেলের দিকে প্রাইবেট আছে নাজিয়ার। সে রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়ে। বড়রা জায়ান সাথে তার কিছু কাজিন ফ্রেন্ডসরা যাবে শিকদার বাড়ীতে।

নাজিয়া এসবে নেই। সে নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। ফ্যামিলির তেমন কোন ইভেন্টে তেমন তদারকি করে না সে।

খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে নিবরাস। আনায়া সোফায় বসা। মৌনতা বজায় রেখে আনায়া প্রশ্ন করে,

-আপনি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?

-তেমন কিছু না অফিসে কর নিয়ে জামেলা হয়েছিলো সেটা মিটমাট করলাম।

-চলুন না কোথাও ট্যুরে যাই?

-এতো প্রেম নাই শরীরে তোমার মন চাইলে যাও। এদিকে কী হবে না হবে সেটা ভাবছি আমি।

-ওই রাজকে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন?

-তোমার মনে হয় আমি ভয় পাবো সামান্য বিষয় নিয়ে?

-ওটা সামান্য মনে হয়? আপনি কাউকে মেরে ফেলেছেন।

-তো?

-আপনি নাকী আবার এমপি।

-এই কথায়,কথায় এতো এমপি টেনে আনবা না।

-আগের বউকেও নিশ্চয়ই এজন্য মেরেছেন।

-তাকে আমি মারিনি দোষটা আমার গাড়েই পড়েছে।

-তার নাম কী ছিলো?

-বউ।

-মজা করছেন?

-আমি আগে কোন বিয়ে টিয়ে করিনি। এই তুমি আমার প্রথম বউ।

-প্রথম বউ কী হ্যাঁ? বলবেন একমাত্র বউ। আপনি আরো বিয়ে করতে চান?

-এই বউ ভালোবাসে না আরেকটা করতে হবে মনে হয়।

-আমি কিছু জানি না। আমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যান না? এইজন্যই এসব নেতাফেতাদের বিয়ে করতে নেই। বাড়ীতে বসে,বসে কান্না করো। এই সমস্যা ওই সমস্যা।

-আচ্ছা জায়গা সিলেক্ট করো। হানিমুনে যাবো।

কথাটা বলে নিবরাস উঠে যায়। তার কল এসেছে। আনায়া সেখানে বসে তাকিয়ে থাকে নিবরাসের যাওয়ার পাণে। ভেবেছিলো নাজিয়ার কথা বলবে নিবরাসকে। কিন্তু নিবরাস যা ব্যস্ত। মনে হয় না বলা হবে।

তখন আবার মিসবাহ আসে আনায়ার রুমে। তার পেছনে মাইশা আছে। কোন কিছু নিয়ে তাড়া করেছে মিসবাহকে।

মাইশা মিসবাহকে পুনরায় বলে,

-আজকে তোমার খবর আছে মিসবাহ। বেশী বেড়ে গেছো তুমি।

-কী হয়েছে আপু?

প্রশ্ন করে আনায়া। তখন মিসবাহ নিজেই বলে,

-আরে তারিশা আন্টি কান্না করছিলো তো আমি বলেছি আংকেলের অভাবে কান্না করো নাকী মামু তোমায় ছ্যাকা দিলো।

তারিশা আন্টি আবার আম্মুর কাছে আমার নামে কীসব জানি বানিয়ে বলেছে সেজন্য আম্মু আমার পেছনে পড়েছে। আগে তোমার বোনকে ঠিক করো। প্রেম করে কতগুলো।

মিসবাহর কথায় মাইশা এসে কানের নিচে ঠাস,ঠাস দু’টো থাপ্পড় মারে।

-বেয়াদব ছেলে। আজকে নিবরাস আসুক ওকে সহ মারবো। ওই তোমাকে প্রশ্রয় দিয়ে,দিয়ে মাথায় তুলেছে।

মাইশা বেড়িয়ে যায়। তখন আনায়া মিসবাহকে নিয়ে খাটের উপর চলে যায়। থাপ্পড় দেওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

-তোমার তারিশা আন্টি তোমার মামুকে পছন্দ করে?

-তুমি কাউকে বলো না। আমি শুনেছি দুইবার কাকে জেনো কলে বলতো এমপি সাহেব আমার স্বপ্নের পুরুষ। তাকে আমি পছন্দ করি।

আবার ওর বান্ধবী কাকে জেনো বলতো কিসের ভাই হ্যাঁ? জামাই বলবি নিবরাস আমার জামাই।

আনায়ার মনে মূহুর্তে হিংসারা দলা পাকায় তাও নিজের বরকে অন্য কেউ জামাই দাবি করছে সেই হিংসা। এখন আর বাবার বাড়ীতে গিয়েও থাকা যাবে না। নাহলে তারিশা তার বরটাকে কবে নিজের আঁচলে বেঁধে নেয়। কিন্তু নিবরাস এসব পাত্তা দেয় না। তাতে কিছুটা খুশি হয় আনায়া।

-বিয়েতে তারিশা আসেনি কেন?

-মামু বারণ করেছে।

-কেন বারণ করলো?

-তুমি জিজ্ঞেস করে নিও।

-আচ্ছা নেবো। চলো আমরা তোমার মামুকে রাজী করিয়ে কোথাও ঘুরতে যাই?

-চলো তুমি প্লেস সিলেক্ট করো।

-আগামী কালকে হসপিটালে ফুল একটা নিয়ে দিয়ে আসিস। বলসি এমপির তরফ থেকে শেষ বিদায়ে আপনার জন্য ফুলগুলো। ওপারে ভালো থাকবেন।

কথাটা বলতে,বলতে রুমে প্রবেশ করে নিবরাস। আনায়া,মিসবাহ তার দিকে তাকায়। নিবরাস বায় বলে কল কেটে দেয়। মিসবাহ কে জিজ্ঞেস করে,

-তারিশাকে কী বলেছো তুমি মিসবাহ?

-বলেছি আংকেলের অভাবে কান্না করছো নাকী আমার মামু তোমায় ছ্যাকা দিয়েছে।

মিসবাহর কথা শুনে নিবরাস আনায়ার দিকে তাকায়। রাগিনী রেগে তাকিয়ে আছে। এনার নিশ্চয়ই মিসবাহ যাবে আর ঠাস,ঠাস দরজা লাগিয়ে কথা সব জিজ্ঞেস করবে। তখন নিবরাস ধমক দিয়ে বলে,

-ছ্যাকা কী মিসবাহ? তুমি এতো পঁচা কথা বলো?

-তারিশা আন্টির থেকে শুনেছি। ওর বান্ধবীরা বলতো, নেতার বিয়ে হলে তো তুই ছ্যাকা খাবি। তো এখন তোমার বিয়ে হয়েছে সে ছ্যাকা খেয়েছে।

-ওসব কিছু না যাও মামু গিয়ে ঘুমাও। তারিশাকে আর উল্টাপাল্টা কিছু বলবা না।

-বউমনি আমি গেলাম।

মিসবাহ চলে যেতে আনায়া উঠে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। নিবরাস দেখেও না দেখার ভাণ করে তাকায়। কিন্তু তার দেখা না দেখায় কিছু যায় আসে না। আনায়া নিজে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।

-এই জন্যই বুঝি আমাকে বাবার বাড়ীতে অনেকদিন রাখতে চেয়েছিলেন। তখন তো তারিশার এক্সাম ও শেষ হয়ে গিয়েছে। এই আপনি আমায় বুঝ দিচ্ছেন? শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছেন?

-আরে এমন কিছু না। পাত্তা দেওয়ার হলে ওকেই আমি বিয়ে করতাম।

-কী বললেন আবার বলুন? আপনি না আজকে ওর দেওয়া জুশটা খেলেন?

-তুমি দাওনি ও দিয়েছে না তো আর করতে পারি না।

-আমাকে কেউ বলেছে কিছু? আপনি নিজেও তো বলতে পারতেন।

-না কিছু না। দেখো তোমার বরের জন্য কত মেয়ে পাগ’ল। তুমি ছাড়া।

-যদি জানতো আপনি একটা গুন্ডা তো কেউই পাগ’ল হতো না।

-আমি গুন্ডা দেখে তুমি আমায় অবমাননা করছো?

-না,না তা করবো কেন? আপনার জন্য কত মেয়েরা পাগল আমার সাধ্য আছে নাকী আপনার মতো এমপি,গুন্ডা,চাঁদাবাজ, দয়ালু ব্যক্তিকে অবমাননা করার?

-প্রশংসা করলা নাকী বদনাম?

-চুপ থাকুন। একদম তারিশার আশেপাশে ঘেঁষবেন না।

-আরে এসব ছাড়ো। পরিবারের সদস্য খাবার টেবিলেও সামনাসামনি বসা হয়ে যায়।

-তাকাবেন না একদম।

******

খান বাড়ীতে বিয়ের আমেজ। নিধিকে পার্লার থেকে সাজানো হয়েছে। শাহরিয়ার সায়ন্তিক শিকদারের সাথে কিছুক্ষণের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

বিয়েতে এসেছে শামিম সরদার সাথে তার দলের লোকজন। বেশ ভালোই কাটছে সময়। নাজিয়া সায়ন্তিকের পিকচার তোলার জন্য স্টেজের কাছে যায়। ভিড় ঠেলে কয়টা পিকচার তুলে সাইডে আসে। তখন পাশে থেকে একটা ছেলের কথা কানে আসে,

-মেয়েটার ফিগার কিন্তু জোশ মামা। হয়ত কোন রিলেটিভ যাওয়ার সময় খোঁজ করব একা রাতের জন্য হলে মন্দ হয় না।

নাজিয়া তাকায়। তার দিকেই তাকিয়ে আছে ছেলে তিনটে। এসে সোজা গালে চড় বসিয়ে দেয়। বাকী ছেলেদের দিকে রেগে তাকিয়ে বলে,

-তোদের মতো কুকুর দের ইনভাইট দিলো কোন কুকুর? নাকী বিনা ইনভিটেশনে চলে এসেছিস? আর আমি এই খান বাড়ীর মেয়ে ভালো করে চিনে রাখবি। মেয়েদের সন্মান কীভাবে করতে হয় সেটাও নিজের মা-বোন থাকলে তাঁদের থেকে শিখে নিস। নাও থাকতে পারে অবশ্য তোদের মতো কুকুরদের নিশ্চয়ই রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে।

কিছু লোক এদিকটায় চলে এসেছে। তিয়াশ খান, জায়ান খান এসেছে। ছেলে তিনটে জায়ানকে দেখে দমে যায়। তখন তিয়াশ খান বলে,

-নাজিয়া ওঁদের মারলে কেন?

-ওরা আমায় বাজে কথা বলেছে।

তখন সেখানের একটা ছেলে বলে,

-প্রমাণ কী আমরা যে বাজে কথা বলেছি তোমায়?

নাজিয়া তাকায় ছেলে তিনটার দিকে। নিজের ফোন থেকে ভিডিও টা সবার সামনে ধরে। অবশ্য তার ভিডিও অন করা ছিলো তখন। ভিডিও দেখার পর জায়ান রক্তচক্ষু করে ছেলে তিনটার দিকে তাকায়। কিছু বলতে যাবে ঠিক তখন কোথা থেকে শামিম সরদার এসে ছেলেদেরকে সোজা লা’থি মারে। তার দলের লোকদের চোখ দিয়ে ইশারা দিতে এদের তিনজনকে নিয়ে চলে যায়।

জায়ান নাজিয়াকে বলে,

-ওদের ভাইয়া দেখে নেবো চিনতে পারেনি তুমি যে এই বাড়ীর মেয়ে।

-এই বাড়ীর মেয়ে হিসাবে চিনলে বুঝি কিছু বলতো না?

-না।

-অন্য বাড়ীর মেয়ে ভেবে কেন বললো? আমাকে নাহয় ছেড়ে দিতো জায়ান খানের বোন বলে অন্য বাড়ীর মেয়েরা কী দোষ করলো? ওরা এমন কেন? মেয়েদের সন্মান দিতে পারে না। আসলে ছেলে জাতটাই খারাপ। এদের ইনভাইট দিয়ে আনো কেন ভাই?

জায়ান চুপ হয়ে যায়। এই মেয়ে শুরুতে জাত নিয়েই বলে দিলো। বড্ড বেশী পাকনা এটা। কথা একটা পেলে খোঁচাতে খোঁচাতে গভীর অব্দি চলে যায় । জায়ানের ভালো লাগে এর স্পষ্টভাবটা।

-আচ্ছা তুমি নিধির কাছে যাও আমি এদের শিক্ষা দেবো যাতে পরবর্তীতে অন্য কোন মেয়েদের অসন্মান না করে।

-তুমি নিজেও শিক্ষা গ্রহণ করে নিও কাকে ইনভাইট দিতে হয় আর কোথায় দিতে হয়। এসব কুকুরদের রাস্তা থেকে নিয়ে এসে নিজের স্ট্যটাস নিচে নামিয়ো না।

মাথা নাড়ায় জায়ান। নাজিয়া প্রস্থান করতে সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। মেয়েটা মুখের উপর বলে দেয়। তার নিজেরও ব্যপারটা লজ্জা লেগেছিলো যখন ভিডিওটা তার চাচ্চুর সামনে ধরে। সব গেলে তার বাবাও তাকে বকা দিবে এটা শিওর। পারছে না শামিম সরদারের খু’লিটাই উড়েয়ে দেয় জায়ান।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে