#হৃদয়_আকাশে_প্রেমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রাবণী_সারা
#পর্ব-৮
হৃদিতাকে বেলকনিতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিশান হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। হৃদিতাকে দেওয়া ১০ মিনিটের মধ্যে ছয় মিনিট পার হয়ে গিয়েছে। অথচ মেয়েটার কোনো হেলদোল নেই! সে কি ভাবছে নিশান তার সাথে মজা করছে। যদি তাই ভাবে তাহলে মেয়েটা বোকামি করছে। নিশান সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে হৃদিতা আজ দেখা না করলে ভেতরে গিয়ে হলেও দেখা করবে। নিশান আবার ম্যাসেজ দিলো হৃদিতাও চট করে ম্যাসেজটা দেখলো।
হৃদি অলরেডি ৭ মিনিট ওভার এখনো সময় আছে জলদি এসো।
হৃদিতা কি করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগে বাবা ফিরেছে ভাইয়াও বাড়িতে। ড্রইংরুম থেকে কথার আওয়াজ আসছে সবার। সাবার মধ্যে দিয়ে কি ভাবে বের হবে সে। আবার যদি লুকিয়ে বের হতে যায় তখন কেউ দেখে নিলে কি বলবে?
হৃদিতা নিশানের নাম্বারে কল দিলো। একবার রিং হতে নিশান রিসিভ করলো। হৃদিতা বললো,
এই বৃষ্টিতে ভিজে কেনো পাগলামো করছেন আপনি? জ্বর হবে তো। প্লিজ চলে যান আমি এখন পারবো না বের হতে।
নিশান মৃদু হাসলো মেয়েটা জ্বর আসার চিন্তাও করে ফেলেছে! হৃদিতা আবার বললো,
রাত বেশি হয়নি পরিচিত অনেকেই যাতায়াত করে রাস্তা দিয়ে কারো চোখে পড়লে তাদের মনে আমাদের নিয়ে নেতিবাচক চিন্তাটা বেশি আসবে। তাছাড়া বাবা মা ভাইয়া ভাবী সবাই ড্রইংরুমে আছে ওদেরকে কি বলে বের হবো আমি?
হৃদিতা কথা শেষ করে বড় শ্বাস ফেললো। নিশান হাসলো মেয়েটা টেনশনে নিজের খোলস থেকে বেড়িয়ে এসেছে যেনো। কম কথা বলা মেয়েটা একদমে কত কথা বলে ফেললো!
নিশান বললো,
তোমাকে সামনে থেকে না দেখে আমি যাচ্ছি না জ্বর হলে হোক প্রবলেম নেই। আর শোনো ভালোবাসলে মনে সাহস রাখতে হয়। একটু আধটু মিথ্যে বললেও হয়ত খুব বেশি ক্ষতি হবে না। বুঝেছো? এখন তাড়াতাড়ি এসো সময় পাঁচ মিনিট বাড়িয়ে দিলাম।
এত অধিকার দেখাচ্ছে কেনো উনি আর কেনোই বা মিথ্যে বলবো আমি! আগে তো ভেবেছিলাম উনি খুবই গম্ভীর ও সল্পভাষী মানুষ। কিন্তু এখন তো দেখছি নিশান মোটেও তেমন নয়। হৃদিতা মনে মনে এসব বললেও মুখে বললো,
শনুন আমি কাউকে ভালোটালো বাসি না আপনি চলে যান আমি নিচে আসবো না।
ঠিকআছে তোমাকে ভালোটালো বাসতে হবে না। ওটা না হয় আমি একাই বাসবো। ফোনে এত কথা না বলে সামনে এসোনা প্লিজ বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগছে তো আমার।
রাত ১০:২৩ বাজে। বৃষ্টি কমেছে কিছুক্ষণ হলো। শীতল মৃদু বাতাস বয়ে চলেছে ধরণীতে। হৃদিতাদের বাড়ির ছাদে পাশাপাশি দাড়িয়া আছে নিশান হৃদিতা। হৃদিতা নিশানকে কোনো ভাবেই ফেরাতে পারেনি। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে নিশানকে বলেছে রাস্তায় না দাড়িয়ে চুপিচুপি ছাদে আসতে। বিপত্তি বাধলো হৃদিতা বের হতে গিয়ে। বাবা ভাইয়া তখনো ড্রইংরুমে ছিলো। তোহা হৃদিতার অস্থিরতা লক্ষ করে জানতে চাইলে হৃদিতা তাকে বিশ্বাস করে সবটা বললো। তোহা হৃদিতাকে ভরসা দিলো সে এদের সামলে নিবে এবং কাউকে কিছু জানাবে না। তোহা রিয়াদকে রুমে ডাকলো ছেলে উঠে যেতে রেজাউল সাহেবও নিজের রুমে চলে গেলো। আর সেই সুযোগে হৃদিতা বেরিয়ে ছাদে এসেছে। সাথে করে একটা টাওয়েলও নিলো নিশানের মাথা মোছার জন্য।
হৃদি?
হৃদিতা কেপে উঠলো। এইমুহূর্তে নিশানের মুখে হৃদি ডাকটা অন্যরকম মাদকতা মেশানো ছিলো। ইশশ এত মায়া নিয়ে কেনো ডাকলো ছেলেটা! হৃদিতা মৃদু স্বরে বললো,
যদি কিছু বলার থাকে তাড়াতাড়ি বলে আপনি যান আমাকেও যেতে হবে।
নিশান হাসলো,হৃদিতা যে ভয়ে আছে বেশ বুঝতে পারছে। কথা বলতেও যে গলা কাপছে তার। নিশান কিছু না বলে হৃদিতার মুখোমুখি দাড়ালো। হৃদিতা না চাইতেও তাকালো নিশানের দিকে। ঠিক তখনি নিশান এক অকল্পনীয় কাজ করে বসলো।
নিশান এক হাটু ভেঙে হৃদিতার সামনে বসলো। ভেজা শার্টের বুক পকেট থেকে স্বর্ণের একটা ব্রেসলেট বের করে হৃদিতার সামনে এগিয়ে মোহনীয় কন্ঠে বললো,
হৃদি উইল ইউ ম্যারি মি??
হৃদিতা বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো নিশানের দিকে! মিনিটখানিক তাকিয়ে থেকে একপা পিছিয়ে উল্টো ঘুরে দাড়ালো। নিশান পূর্বের অবস্থানে বসে চাতক পাখির মত কেবল তাকিয়ে রইলো হৃদিতার দিকে। হৃদিতা ফিরিয়ে দেবে না তো?
হঠাৎ হৃদিতা ফিরে তাকালো। কিছুসময়ের জন্য মনের তিক্ত বিষাদগুলো ভুলে গেলো সে। তার ভেতরের সত্তা যেনো চিৎকার করে বলে উঠলো আর পিছিয়ে যাস না হৃদিতা নিজের মনের কথা শোন নিজের ভালোবাসাকে গ্রহণ কর।
হৃদিতা নিশানকে অবাক করে দিয়ে অধরে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। নিশান আর সময় নিলো না মুচকি হেসে ব্রেসলেটটা অতি যত্নে পড়িয়ে দিলো তার প্রণয়ীর হাতে। অতঃপর দুজনেই তৃপ্তির হাসি হাসলো।
.
শাহানা খান নিজের রুমে শুয়ে আছেন। বড় ছেলেটাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে তার। কেবলই মনে হচ্ছে আজকের এমন পরিস্থতির জন্য সে নিজে দায়ী। ছেলেটা তো রাইসাকে তখন বিয়ে করতে চায়নি। রিশান হুড়মুড়িয়ে মায়ের পাশে এসে বসে বললো,
মা হৃদি আপুকে কি সত্যি ভাইয়ার বউ করে আনবে?
শাহানা খান হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললেন,
আল্লাহ যদি তোর ভাইয়ার ভাগ্যে হৃদিতাকে লিখে রাখে তাহলো নিশ্চই ওকে বউ করে আনবো।
এরই মাঝে নিশান রুমে এলো হাসি মুখে রিশানের পাশেই বসলো। রিশানের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
অপেক্ষায় থাক অতি শীঘ্রই হৃদিকে তোর ভাবী রুপে এ বাড়িতে দেখবি।
শাহানা খান ছেলের হাসিটা দেখলো, আজকের হাসিটা মলিন নয় বরং প্রাপ্তির হাসি বলে মনে হচ্ছে। মায়ের তাকিয়ে থাকা দেখে নিশান বুঝতে পারলো মায়ের মনে কি চলছে। তাই সে নিজে থেকেই কাল রাতের ব্যাপারে মাকে সব বললো। ছেলের কথাগুলো শুনে শাহানা খান বললেন,
হৃদিতা তো রাজিই আছে। তাহলে দু একদিনের মধ্যে আমি আর তোর বাবা সম্মন্ধ নিয়ে যাব ও বাড়িতে?
এখন নয় কিছুদিন পরে যেও। হৃদি সময় চেয়েছে দেখি ও নিজের পরিবারকে কতটা ম্যানেজ করতে পারে।
.
হৃদিতা ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে দেখলো নিশান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। হৃদিতাকে দেখা মাত্র নিশান এগিয়ে এলো। হৃদিতার হঠাৎ লজ্জা লাগছে ভীষণ। দুদিন আগেও নিশানের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু এখন তো সেটাও পারবে না। কেনোনা নিশান তার অনুভূতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত।
নিশান সামনে দাড়াতে হৃদিতা বললো,
কিছু বলবেন?
নিশান নিঃশব্দে হাসলো। হৃদিতার কথা শুনে মনে হচ্ছে অপরিচিত কারো কাছে সে জানতে চাইলো কিছু বলবেন! নিশান বললো,
হ্যা বলবো তো অনেক কথা বলার আছে তেমাকে। এসো আমার সাথে।
কোথায় যাব?
আমি যেখানে নিয়ে যাব। আমার সাথে যেতে প্রবলেম আছে?
হৃদিতা হালকা হেসে বললো,
নাহ কোনো প্রবলেম নেই চলুন।
শহরের অফসাইডে কোলাহল মুক্ত নির্জন পরিবেশে এসে গাড়ি থামালো নিশান। নিশান নেমে হৃদিতাকেও ইশারা করলো নামতে। হৃদিতা নেমে জিজ্ঞেস করলো তারা কোথায় এসেছে। উত্তরে নিশান কিছু না বলে আলতো করে হৃদিতার হাত ধরে সামনে এগোলো। দেড় মিনিট হাটার পর ছোট একটা লেকের সামনে এসে দাড়ালো ওরা। লেকের টলটলে পানিতে জায়গায় জায়গায় ফুটে রয়েছে পদ্ম ফুল। গাছের ডাল পাতার ফাকা দিয়ে সূর্যের আলো পড়ায় থেকে থেকে পানি ঝিলমিল করে উঠছে। হৃদিতার মন যেনো আনন্দে নেচে উঠলো। এমন দৃশ্য যে সচরাচর দেখা যায় না। নিজের অজান্তেই নিশানের বাম হাত খামচে ধরে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো লেকের দিকে।
নিশানের নিজেকে ধন্য মনে হলো হৃদিতাকে খুশি করতে পেরে।
কেমন লাগছে জায়গাটা?
নিশান প্রশ্ন করতে হৃদিতা ঝটপট উত্তর দিলো,
অসাধারণ!
হুমম। চলো ঘাসের উপর বসি।
হৃদিতা এগোতে নিতে খেয়াল হলো তার হাতের বাধনে নিশানের হাত। সে চট করে হাত ছেড়ে সামনে এগিয়ে গেলো। নিশান সেখানে দাড়িয়ে শব্দ করে হাসলো। মেয়েটা বোধহয় লজ্জা পেয়েছে নিজের অজান্তে হাত ধরে।
দুজনে পাশাপাশি কিছুক্ষন নিরবে বসে রইলো। নিরবতা ভেঙে নিশান হৃদিতার হাতের দিকে চেয়ে বললো,
হৃদি ব্রেসলেট খুলে রেখেছো কেনো?
হৃদিতা আমতা আমতা করে বললো,
বাড়িতে কেউ জিজ্ঞেস করলে কি বলবো এজন্য…..
হৃদিতা কথা বলতে বলতে থেমে গেলো নিশানের দিকে তাকিয়ে। ইতোমধ্যে নিশানের ঠোঁটের হাসি উবে গিয়ে কেমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। হৃদিতা কারন বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো অতঃপর ব্যাগ থেকে ব্রেসলেটটা বের করে হাতে পড়ে নিলো। নিশানকে হাত দেখিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
পড়ে নিয়েছি ব্রেসলেট। এবার হাসুন।
হৃদিতার দিকে তাকিয়ে নিশান নিঃশব্দে হাসলো। মেয়েটা যে ক্রোমশ তাকে দূর্বল করে দিচ্ছে।
.
হৃদিতা বাড়িতে ফিরলো ৪:৪৩ এ। কলিংবেল বাজাতে হুমায়রা বেগম দরজা খুললেন। হৃদিতাকে দেখা মাত্র তিনি প্রশ্ন ছুড়লেন সে কোথায় ছিলো এতক্ষণ ভার্সিটি থেকে ফিরতে তো এত লেট হয়নি কখনো। হৃদিতা কোনো ভাবাভাবি ছাড়া উত্তর দিলো সে বান্ধবীর বাসায় নোট নিতে গিয়েছিলো। হুট করে মিথ্যে বলায় মনে মনে অনেকটাই অবাক হলো হৃদিতা। সে মিথ্যে বললো মায়ের কাছে! নিশানের বলা কথাটাই কি তবে সত্যি হলো ভালোবাসলে একটু আধটু মিথ্যে বলতে হয়! হুমায়রা বেগম তেমন কিছু না বলে বললেন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে। হৃদিতা মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে গেলো। রিয়াদ বাইরে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হতে হৃদিতার সামনে পড়লো। রিয়াদ জিজ্ঞেস করলো,
হৃদি আজ আসতে এত লেট হলো কেনো তোর?
রিয়াদ স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলেও হৃদি সেটা স্বাভাবিক ভাবে নিলো না। বলতে মন চাইলো,ভাইয়া আমি দেরি করে বাড়ি ফিরলে কেনো কৈফিয়ত দেবো আমি তো বড় হয়েছি তাইনা। তুমিও তো কত দেরি করে ফেরো কেউ তো তোমাকে বলে না কেনো দেরি হলো ফিরতে। হৃদিতা গভীর শ্বাস ফেললো মনের ভাবনাগুলো চাপা রেখে বললো,
বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম।
হৃদিতা এ কথা বলে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। রিয়াদ চেয়ে রইলো হৃদিতার যাওয়ার দিকে। বোনের কথা বলার ভঙ্গিটা আজ অন্য রকম লাগলো তার কাছে।
বোনের ব্যবহারে অবাক হচ্ছো তাইনা?
তোহা এ কথা বলে রিয়াদের পাশে এসে দাড়ালো। রিয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
সত্যিই অবাক হচ্ছি তোহা! হৃদি তো এভাবে আমার সাথে কথা বলে না!
এখনো বোনের অভিমান বুঝতে পারছো না তুমি?
রিয়াদ কোনো উত্তর দিলো না বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।
রাতে খাবার টেবিলে রিয়াদ খেয়াল করলো হৃদিতা তার সাথে আগের মত কথা বলছে না। এরকমটা বেশ কয়েকদিন ধরেই চোখে পড়ছে। তবে কি বোনের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে তার। আদরের বোনটা কি একটু বেশিই অভিমান করেছে তার পছন্দ মেনে নেয়নি বলে।
হুমায়রা বেগম ও রেজাউল সাহেব মেয়ের হাব ভাব দেখে বুঝে নিয়েছেন নিশানকে সে সত্যিই ভালোবাসে। তবে এর পেছনে তোহা রয়েছে সেই হুমায়রা বেগমকে বলেছে হৃদিতা নিশান দুজনই দুজনকে চায়। রেজাউল সাহেব খাওয়া শেষে সবাইকে রুমে যেতে বারণ করলেন। তারপর ছেলের কথা না ভেবে সারাসরি হৃদিতাকে বললেন,
হৃদি মা নিশানকে বলবি কাল ওর বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতে।
উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হয়ে তাকালের রেজাউল সাহেবের দিকে! সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে হৃদিতা বাবার বলা কথাগুলো এখনো কানে বাজছে যেনো। হৃদিতা রিয়াদের দিকে একবার তাকিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে নিচু স্বরে বললো,
কিন্তু ভাইয়া….
হৃদিতাকে থামিয়ে রিয়াদ সবাইকে আরো একটু অবাক করে দিয়ে বললো,
হৃদি বাবা যা বলেছে সেটাই কর নিশানকে বলে দে কাল আসতে।
#চলবে…….