#হৃদয়_আকাশে_প্রেমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রাবণী_সারা
#পর্ব-৭
নিশান নিজের রুমে পায়চারী করে চলেছে। হৃদিতা ও তার পরিবারকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সে। সেদিন হৃদিতাকে প্রপোজ করার পর হৃদিতা কিছু না বলে নিঃশব্দে জায়গা ত্যাগ করেছিলো। তারপর আর দেখা হয়নি হৃদিতার সাথে। ফোনও ধরছে না। নিশান একটু আগে মায়ের থেকে শুনেছে ছোট চাচ্চু ও কাকিমা আজ হৃদিতার বাবা মায়ের সাথে কথা বলেছে। তারা নাকি বলেছে সিদ্ধান্ত যাই হোক পরে জানাবে। এ কথা শুনার পর থেকে নিশানের টেনশন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।
হুমায়রা বেগম রেজাউল সাহেবের জন্য চা নিয়ে এলো রুমে। রেজাউল সাহেবের দৃষ্টি তখন ছাদের মেঝেতে। হুমায়রা বেগম চায়ের কাপ এগিয়ে নিজের উপস্থিত জানান দিলেন। রেজাউল সাহেব তাকালেন, চায়ের কাপ নিয়ে চমুক দিলেন দু তিনবার। ইশারায় স্ত্রীকে বললেন পাশে বসতে। হুমায়রা বেগম বসতে তিনি বললেন,
মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভেবেছো?
হুমায়রা বেগম ঝটপট উত্তর দিলেন,
আমি আর কি ভাববো তুমি যা বলবে সেটাই হবে।
হুমায়রা আমি হৃদির বাবা আর তুমি ওর মা। আমার মতো তোমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে।
হুমায়রা বেগম চুপ রইলেন কিছুসময়। অতঃপর বললেন,
তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে ভেবে চিন্তেই নেবে এটুকু ভরসা আছে আমার। তারপরও আমার মত যদি জানতে চাও আমি বলবো নিশান ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো। এখন অবদি ছেলেটার কোনো খারাপ দিক আমার চোখে পড়েনি। আগের বিয়েটা সম্পর্কে রিতার থেকে যতটা শুনেছি সে বিয়েটা নিশান মন থেকে করেনি। বাবা মায়ের কথা রাখতে করেছিলো। এবং সে বিয়েটা একমাসের মধ্যে ভেঙেও গিয়েছে। সংসার তো আর হয়ে ওঠেনি। তবে সবার আগে আমাদের হৃদির মতামত জানাটা অধিক প্রয়োজন।
হ্যা এটা ঠিক বলেছো। হৃদি কোথায় ওকে ডাকো।
হৃদিতা জানালার ধারে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষন্নমনে চুপচাপ বসে আছে। ভাবীর থেকে ফুপি ফুপা ও বাবাদের মাঝে কি কি কথা হয়েছে সবই শুনেছে। হয়ত রিয়াদ ভাবীকে বলেছে। নিশান কাল থেকে অনেকবার কল করেছে ম্যাসেজ দিয়েছে। হৃদিতা কল ধরেনি ম্যাসেজের রিপ্লেও দেয়নি। কি বা বলবে সে ফোন ধরে। নিশান যখন প্রপোজ করেছিলো হৃদিতা তখন কিছু বলতে পারেনি। মনের মধ্যে অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিলো সেসময়। নিশানের হঠাৎ প্রপোজ করা তাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিলো যেনো। হৃদিতার নিজের ভাগ্যের উপর বড্ড আফসোস হচ্ছে। শেষমেশ কিনা এমন একজনের প্রেমে পড়লো যাকে তার পরিবার মেনে নেবে না। হৃদিতার ইচ্ছে করছে সবাইকে গিয়ে বলতে, সে যদি পারে নিশান বিয়ে করেছিলো যেনেও ভালোবাসতে। তাহলে তারা কেনো পারবে না বিয়েতে রাজি হতে!
হুমায়রা বেগম হৃদিতার রুমে এসে দেখলো হৃদিতা জানালার ধারে ধ্যান ধরে বসে আছে। মেয়েকে তিনি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তার কেবলই মনে হলো মেয়েটার মন খারাপ কোনো কারনে। তিনি এগিয়ে এসে হৃদিতার কাধে হাত রাখলেন। হৃদিতা খানিক কেপে উঠে পাশ ফিরতে মাকে দেখলো।
হৃদি মা মন খারাপ তোর?
হৃদিতা জোরপূর্বক হেসে বললো,
কই না তো মা আমি ঠিকআছি। কিছু বলবে তুমি?
হুমম,তোর বাবা ডাকছে তোকে আমার সাথে আয়।
হৃদিতা মাথা নেড়ে মায়ের সাথে তাদের রুমে গেলো। বাবা কি বলবে তা হয়ত হৃদিতা বুঝতে পেরেছে।
.
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে রেজাউল সাহেব ও রিয়াদের মাঝে ছোটখাটো তর্কাতর্কি হয়ে গেলো। রিয়াদের বাবা মা নিশানের সাথে হৃদিতাকে বিয়ে দিতে রাজি থাকলেও রিয়াদ রাজি নয়। সে নিজের বোনকে একজন বিবাহিত ছেলের হাতে তুলে দিতে নারাজ। ভাই আর বাবার কথা কাটাকাটি দেখে রুপ ভয় পেয়ে তোহার ওড়নার আঁচল ধরে তার গা ঘেষে দাড়িয়ে রইলো। তোহা এ ব্যাপারে পুরোই নিশ্চুপ সে এ বাড়িতে নতুন এসেছে কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করছে। তবে এখন মনে হচ্ছে রিয়াদের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। হৃদিতা যে কাল রাতেই তাকে বলেছে নিশানকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। হুমায়রা বেগম ও বাবা ছেলের মাঝে টুকটাক কথা বলছেন। এসবের মাঝে হৃদিতা সেখানে বসে থাকতে পারলো না। মাথাটা ভাড়ী ভাড়ী লাগছে। চোখে ভীষণ জ্বালা করছে। কান্না যেনো দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে তার। নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। তার জন্যই তো বাবা ভাইয়া এমন কথা কাটাকাটি করছে। হৃদিতা উঠে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
হৃদিতাকে চলে যেতে দেখে রেজাউল সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,
খুব তো বলছিস এ বিয়েতে তোর মত নেই। কিন্তু তোর বোন তো রাজি আছে। হৃদির সাথে কাল রাতে আমার কথা হয়েছে ও বলেছে ওর কোনো আপত্তি নেই।
রিয়াদ চোখ বড় বড় করে তাকালো বাবার দিকে। বাবা এ কি বলছে হৃদির সম্মতি আছে এ বিয়েতে!
রিয়াদ কোনো কথা না বলে উঠে দাড়ালো তারপর হনহন করে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
.
হৃদিতা ভার্সিটি থেকে বের হতেই নিশানকে দেখতে পেলো। তাকে দেখেনি এমন ভান করে হৃদিতা উল্টো দিকে হাটতে লাগলো। নিশান ভ্রু কুঁচকালো হৃদিতার এমন কাজে। মেয়েটা কি তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে? নিশান বড় বড় পা ফেলে হৃদিতার পাশাপাশি হাটতে শুরু করলো। হৃদিতা সামনে নজর রেখে বললো,
আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাইছি না।
নিশান সামান্য হেসে বললো,
তোমাকে তো আমি কথা বলার জন্য জোর করিনি। আমি বলবো তুমি শুনবে।
আমি শুনতেও চাই না।
কেনো চাও না?
হৃদিতা এবার দাড়ালো নিশানের দিকে ফিরে বললো,
অযথা কথা বাড়াবেন না প্লিজ। যে সম্পর্কটা হবার নয় শুধু শুধু তার জের টেনে কথা বলে মায়া বাড়ানোর কি দরকার বলুন।
আচ্ছা! কথা বাড়ালে মায়া বাড়ে নাকি এটা তো জানতাম না!
হৃদিতা খেয়াল করলো সে সিরিয়াস ভাবে বললেও নিশান হয়ত সিরিয়াস ভাবে কানে তুলছে না। নিশানের ঠোঁটের কোনের বাকা হাসি সেটাই বুঝাচ্ছে। হৃদিতা এবার কঠিন গলায় বললো,
দেখুন আমি মজা করছি না আপনার সাথে। ব্যাপারটা সিরিয়াস। আমি আপনার সাথে আর কথা বলতে চাই না।
নিশান এবার আর হাসলো না সে সিরিয়াস ভাবেই বললো,
আমার ধারণা কি তবে ভুল ছিলো হৃদি। তুমি ভালোবাসো না আমাকে?
হৃদিতা ইতোমধ্যে এগিয়ে গিয়েছিলো সামনে। নিশানের কথা শুনে থমকে দাড়ালো। কি উত্তর দেবে সে নিশানকে,তাকে ভালোবাসে না! কিন্তু এটা যে সত্যি নয়। সত্যিটা হলো সে নিশানকে ভালোবাসে। হৃদিতা কি বলবে ভেবে পেলো না। নিশানকে উপেক্ষা করে সে রিকসা ডেকে উঠে পড়লো। নিশানের সামনে থাকলে যে নিজের ইমোশনকে আটকাতে পারবে না।
নিশান সেখানেই দাড়িয়ে রইলো। হৃদিতা কি সত্যিই ভালোবাসে না তাকে? হ্যা বা না কিছু না বলে এভাবে কেনো চলে গেলো? কাকিমা বললো হৃদিতার বাবা মায়ের সম্মতি আছে শুধু ওর ভাইয়া একটু বেকে বসেছে। হৃদিতা ওর ভাইয়ার জন্য নিজের অনুভূতিকে আড়াল করতে চাইছে? কিন্তু হৃদিতা যদি মন থেকে চায় তাহলে ওর ভাইয়া অবশ্যই মেনে নেবে।
নাহ এত সহজে হাল ছাড়লে হবে না। হৃদিতাকে বোঝাতে হবে। নয়ত নিশান হৃদিতাশীন কি করে বাচবে।
.
হৃদির যদি এ বিয়েতে আপত্তি না থাকে তাহলে তুমি আপত্তি করছো কেনো বলোতো?
তোহার কথা শুনে রিয়াদ গম্ভীর স্বরে বললো,
তাই বলে বিবাহিত ছেলের সাথে আমার বোনকে তুলে দেবো!
বিয়ে সে করেছিলো মেয়েটার সাথে সংসার তো করেনি তাইনা।
মেয়েটার চোখে নিশ্চই নিশানের কোনো খারাপ কিছু পড়েছিলো নয়ত একমাসের মধ্যে কেনো ডিভোর্স হবে।
রিয়াদ তুমি সবটা জেনেও না জানার ভান করছো! মেয়েটার অন্যত্র রিলেশন ছিলো তাইতো…..
থামো তোহা আমাকে এত বোঝাতে এসো না। আমি যথেষ্ট বুঝি।
তোহা মলিন হেসে বললো,
তাই নাকি? এজন্য বোন যাকে ভালোবাসে তাকে বোনের থেকে দূরে সরাতে চাইছো?
মানে!!
মানেটা এখনো বুঝতে পারোনি। হৃদি নিশানকে ভালোবাসে আর ভালোবাসে বলেই বাবার কাছে বলেছে তার এ বিয়েতে আপত্তি নেই।
রিয়াদ সেকেন্ড দুয়েক চুপ থেকে বললো,
হৃদি যেটাকে ভালোবাসা বলছে সেটা ভালোবাসা নয় আবেগ। আবেগ দিয়ে কখনো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। সময় যত গড়াবে আবেগও কেটে যাবে।
তোহা আর কোনো কথা খুজে পেলো না বলার। শুধু তাচ্ছিল্য হাসলো। সে কখনোই ভাবেনি রিয়াদ এমন বোধবুদ্ধিহীন কথা বলবে। বোনের ভালোর কথা ভেবে সে এসব করছে ঠিকই কিন্তু তার ফল কি ভালো হবে? হয়ত হবে না।
.
কেটে গিয়েছে কয়েকটা দিন। রেজাউল সাহেব তাদের গ্রামের বাড়ি থাকায় হৃদিতার বিয়ে নিয়ে বাড়িতে কোনো কথা হয়নি। সবকিছু আগের মত চললেও হৃদিতা আগের মত নেই। সে এমনিতেও খুব বেশি কথা বলতো না আর এখন আরো বলে না। প্রয়োজন ছাড়া মা ভাবীর সাথে কোনো কথা হয় না তার। শুধুমাত্র রুপের সাথেই সময় কাটায় সে। তার এ একাকিত্বের সঙ্গী একমাত্র রুপ। ভাইয়ার সাথে যে কথা বলে না তা না ভাইয়া কিছু বললে কেবল তারই উত্তর দেয়। হৃদিতা বাবা ও ভাইয়ার মতের বিরুদ্ধে আজ অবদি কিছু করেনি। তারা যা করবে সেটা হৃদিতার ভালোর জন্যই করবে এ বিশ্বাস সে সবসময় করে এসেছে। কারন বাবা তার মেয়েকে আর ভাই তার বোনকে যে ভীষণ ভালোবাসে। হৃদিতার এখন মনে হচ্ছে কেনো সবাই তাকে এত ভালোবেসেছে। বিশেষ করে ভাইয়া সেই তো আজ তাকে বুঝতে চাইছে না। তবে এত কিছুর পরও হৃদিতা ভাইয়ার মুখের উপর একটি কথাও বলেনি।
নিশান রোজ হৃদিতার ভার্সিটির সামনে অপেক্ষা করে কিন্তু হৃদিতার দেখা পায় না। আজও তার ব্যতিক্রম নয় তবে ফলাফল শুণ্য। হৃদিতা আজও আসেনি। মেয়েটা কি আজকাল ভার্সিটিতেও আসা বন্ধ করে দিলো! নিশান হতাশার নিশ্বাস ফেলে হৃদিতার নাম্বারে ডায়েল করলো বরাবরের মত রিং হয়ে কেটে গেলো। হৃদিতা ফোন ধরেনি। বিগত কয়েকদিন যাবত এমনটা হচ্ছে নিশান কল দিলে হৃদিতা রিসিভ করে না আবার কেটেও দেয় না। নিশানের রাগ হতে লাগলো। পেয়েছে টা মেয়েটা নিজেকে এভাবে কতদিন লুকিয়ে রাখবে। মানুষের ধৈর্য বলেও তো কিছু থাকে। হৃদিতার চোখে নিশান যা দেখেছে তা তো মিথ্যে নয় তবে কেনো ধরা দিচ্ছে না সে?
সন্ধে নেমেছে কিছুক্ষণ হলো। বাহিরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকে ঝলমল করে উঠছে চারিপাশ। অদূরে শোনা যাচ্ছে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। হৃদিতা নিরবে বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টির পানি যেমন প্রকৃতিতে শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার মনেও যদি এমন শীতলতা ছড়াতো। কতই না ভালো হতো। অন্তত একটু শান্তি মিলতো মনে।
হৃদিতার মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। সময় দেখার জন্য ফোন হাতে নিয়েই বেলকনিতে এসেছিলো সে। হৃদিতা ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো নিশান কল করেছে। ফোস করে শ্বাস ফেললো সে। নিশানের সাথে কথা না বলতে পেরে তার ও যে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ফোন ধরেই বা কি বলবে তাকে। পরপর চারবার রিং হয়ে কেটে গেলো। হৃদিতা রুমে এসে বেডে বসলো। সে গভীর ভাবে কিছু ভাবছে। খানিকক্ষণ পর ফোনে টুং করে শব্দ হলো। হৃদিতা ফোন হাতে নিলো হ্যা নিশান ম্যাসেজ করেছে। নিশানের দেওয়া প্রতিটি ম্যাসেজ সে পড়ে তবে রিপ্লে করে না। হৃদিতা ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো।
নিশান লিখেছে,হৃদি আমি তোমাদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি। তোমাকে ১০ মিনিট সময় দিলাম এর মধ্যে নিচে এসে দেখা করো। নয়ত আমি ভেতরে আসতে বাধ্য হবো।
হৃদিতা দ্রুত বেলকনিতে এলো। রাস্তার বিপরীতে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে একজনের অবয়ন দেখা যাচ্ছে। হৃদিতার বুঝতে বাকি রইলো না ওটাই নিশান। ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজে কি শুরু করেছে! এত পাগলামি করলে চলে!
#চলবে……