#হৃদয়_আকাশে_প্রেমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রাবণী_সারা
#পর্ব-৫
হৃদিতা আসার পর থেকে শাহানা খান লক্ষ্য করছেন নিশানকে। বাড়িতে সাধারণত কেউ এলে নিশান বাড়িতে থাকলে নিজের রুমেই সময় কাটায়। কিন্তু আজ সে হৃদিতারা আসার পরও ড্রইংরুমে বসে সকলের সাথে আড্ডা দিয়েছে। গম্ভীরতা কাটিয়ে মনখুলে কথা বলছে। এমনকি এখনও রুপের সাথে গল্পে মেতে আছে। তবে এর ফাকেও শাহানা খানের দৃষ্টিতে পড়েছে হৃদিতার দিকে ছেলের আড়চোখে তাকানো। হৃদিতা যখন কোনো কারনে হাসছে নিশান পলকহীন ভাবে তাকাচ্ছে হৃদিতার দিকে। শাহানা খান সরাসরি ছেলের চোখের দিকে তাকালো। নিশানের চোখে যে আজ অন্য কিছু দেখছেন তিনি। মায়ের দৃষ্টি হয়ত এমনই,সন্তানের ভালো খারাপ সব দিকই আগে চোখে পরে।
দুপুরে সকলে একসাথে খেতে বসেছে। শুধু রিশান নেই,ছেলেটা সেই যে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়েছে আর খোলে নি। শাহানা খান, নিশান, রিফা ডেকে কোনো সাড়া পায়নি। শেষে হৃদিতা গিয়ে ডাকায় রিশান দরজা খুলে খেতে এসেছে। খুব অভিমান হয়েছিলো যে তার। রিশানকে আর কেউ কিছু বললো না। ওর স্বভাব সম্পর্কে সকলেই কম বেশি অবগত,সে যতটা দুষ্টু ততটাই জেদী। কেউ কিছু বললে হয়ত খাওয়া রেখেই উঠে যাবে। তবে একজন তো আছেই রিশানের পেছনে লাগার জন্য। রিশান মাছের কাটা বেছে খেতে পারে না এজন্য শাহানা ওকে কাটা বেছে দিচ্ছিলেন। রিশান আড়চোখে রুপকে একবার দেখে নিলো। রুপের দৃষ্টিও তখন ওর দিকে ছিলো। রিশান দ্রুত চোখ নামিয়ে খেতে শুরু করলো।
এত বড় ছেলে মাছের কাটা বাছতে পারে না হিহি হি।
উপস্থিত সবাই খাওয়া থামিয়ে রুপের দিকে তাকালো। রুপ তখনও হাসছে। রুপ যে রিশানকে বলেছে হৃদিতা সেটা বুঝতে পেরে রিশানের দিকে তাকিয়ে রুপকে থামানোর চেষ্টা করলো। রিশানের মুখটা আবারো গোমড়া হয়ে গেলো। এই মেয়েটা পেয়েছে কি কেনো লেগে আছে পেছনে? রিশান মনে মনে বললো,পাজি মেয়ে খুব হাসি পাচ্ছে না। হাসতে থাক আমারো সময় আসবে তখন বুঝবি।
.
বিকেলে শাহানা খান,হুমায়রা বেগম রিতা বসে গল্প করছে। হৃদিতা ভাবলো বড়দের মাঝে না যাওয়াই ভালো। হৃদিতা রিফার রুমে এলো,রিফা তখন ঘুমাচ্ছে। রিফা কনসিভ করেছে দুইমাস হলো। প্রেগন্যান্সির জন্য ইদানীং তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। হৃদিতা তপ্ত শ্বাস ফেললো। একা একা মোটেও ভালো লাগছে না। রুপ ঘুমিয়েছে। রিশানও নেই বাড়িতে। হৃদিতা ছাদে চলে এলো। বিকেলের নরম রোদ ছাদের একপাশে বিচরণ করছে। হৃদিতা সেদিকে গেলো না অন্য পাশে গিয়ে দাড়ালো। হৃদিতা রেলিং ধরে দাড়িয়ে সামনে থাকা আতাফল গাছের দিকে তাকালো। একটা ডালে দুটো হলুদ রং এর পাখি বসে আছে। পাখি দুটোর নাম জানা নেই হৃদিতার। দেখতে বেশ সুন্দর পাখিদুটো। তারা পাশাপাশি বসে মাথা এদিক ওদিকে করছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে। ওরা হয়ত ওদের ভাষাতে কথা বলছে। এ দৃশ্য বেশ ভালো লাগছে হৃদিতার। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো তার। হঠাৎ করেই একটা পাখি উড়ে চলে গেলো আর অন্য পাখিটা চুপচাপ সেখানেই বসে রইলো। হৃদিতার হাসি মিলিয়ে গেলো। ইশশ পাখিটা কেনো চলে গেলো,অন্য পাখিটা একা হয়ে গেলো তো। নিশ্চই মন খারাপ হয়েছে পাখিটার।
ঘরে নেটওয়ার্ক কম থাকায় নিশান ফোন কানে চেপে ছাদে এলো। ছাদের উত্তরদিকে দাড়িয়ে ৭/৮ মিনিটের মত অফিসিয়াল কথা শেষ করলো সে। তারপর দুমিনিট ফোন ঘেটে নিচে নামতে গিয়ে তার চোখ পড়লো ছাদের দক্ষিণ দিকে। হৃদিতা উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে আছে তবে নিশানের ওকে চিনতে অসুবিধা হলো না। সেও ধীর পায়ে এসে দাড়ালো হৃদিতার ঠিক দেড় হাত দূরে। হৃদিতা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরলো। নিশানকে দেখে তেমন চমকালো না সে। হৃদিতা বললো,
আপনি এখানে?
আমারো তো একই প্রশ্ন আপনি একা ছাদে কি করছেন? মা কাকিমা আন্টির সাথে না দেখলাম কিছুক্ষণ আগে।
বড়দের মাঝে আনইজি লাগছিলো তাই চলে এসেছি।
ওও আচ্ছা। আর আমি ছাদে এসেছিলাম একটা ইমপর্টেন্ট কল করতে।
হৃদিতা কিছু বললো না কেবল সামনে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইলো। নিশান হৃদিতার দিকে সেকেন্ড চারেক তাকিয়ে নজর ফেরালো। নাহ নিজের অনুভূতিকে দমানো যাচ্ছে না। এই মেয়েটা পুরোই এলোমেলো করে দিয়েছে তাকে। মনপাখিটা বোধহয় আর আটকে রাখা সম্ভব নয়। সে খাচা ভেঙে বের হওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে। হৃদয় আকাশে প্রেমের বর্ষণ যেন ক্ষণে ক্ষণে নামতে চাইছে। হৃদিতাকে আজ সরাসরি বা লুকিয়ে অনেকবার দেখেছে নিশান। যতবার দেখেছে মনটা ততবারই বলেছে এই মেয়েটাকে তার চাই খুব করে চাই। তবে নিশানের চিন্তা অন্য জায়গায় হৃদিতা কি তাকে চায় বা কখনো চাইবে? আবার যদিও হৃদিতা চায় তাহলে কি ওর পরিবার মেনে নেবে?
নিরবতা ভেঙে হৃদিতা কোনো ভনিতা ছাড়া বললো,
আপনি তো বিয়ে করেছিলেন আপনার বউ কোথায় এখন? এ বাড়িতে বা আপনার সাথে তো দেখি না তাকে।
নিশান খুবই অবাক হলো হৃদিতার কথা শুনে! অবাক হওয়ারই কথা এ ব্যাপারে সবাই জানে অথচ হৃদিতা কিছুই জানে না! নিশান বিষ্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
আপনি কিছুই জানেন না!
হৃদিতা তাকালো। নিশানও তাকিয়ে আছে।
না তো কি জানবো আমি?
নিশান ফোস করে শ্বাস ফেললো। হৃদিতার মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে সত্যি সে কিছুই জানে না। নিশান আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
বিয়ের একমাস পরে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। এ বিয়েতে আমার এবং রাইসার কারোই মত ছিলো না। সে শুধুই আমার বন্ধু ছিলো মাত্র। ওর প্রতি কখনোই কোনো ফিলিংস তৈরি হয়নি আমার। শুধুমাত্র বাবা মায়ের কথা রাখতে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। আর রাইসাকে ওর পরিবার বাধ্য করেছিলো। রাইসা অন্য একজনকে ভালোবাসতো। বিয়ের রাতেই সে কথা আমাকে ও জানিয়েছে তবে কথাটা যদি বিয়ের আগে জানাতো তাহলে বিয়েটা অন্তত হতো না। তারপর আর কি যেহেতু আমারো ওর প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না এজন্য দুজনের পথ আলাদা করে নিলাম।
.
দুদিন পর নিশান নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। শাহানা খান ছেলের জন্য ধোয়া ওঠা ব্ল্যাক কফি নিয়ে রুমে এলো। নিশান মাকে দেখে কফির মগটা হাসিমুখে নিলো। শাহানা খান বসলেন ছেলের পাশে। নিশান ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে মাকে বললো,
মা তুমি কিছু বলতে চাইছো আমাকে?
শাহানা খান মৃদু হেসে বললেন,
তুই কাজ শেষ কর তারপর নাহয় বলি।
নিশান ল্যাপটপটা সাইডে সরিয়ে বললো,
কাজ পরেও করা যাবে। তুমি বলো কি বলবে?
শাহানা খান কয়েকসেকেন্ড চুপ থেকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
হৃদিতাকে তোর কেমন লাগে?
নিশানের বুকটা ধক করে উঠলো। মা হঠাৎ হৃদিতার কথা কেনো জিজ্ঞেস করছে! কিছু কি বুঝতে পেরেছে? নিশান এদিক ওদিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
হৃদিতার খারাপ কিছু চোখে পড়েনি আমার। অবশ্যই ভালো বলা যায়।
শাহানা খান হাসলেন। তিনি দুদিন আগে ছেলের চোখে যা দেখেছিলো তা মিথ্যে নয়। যদি মিথ্যে হতো তাহলে নিশান আজ নিঃসংকোচে বলতে পারতো না হৃদিতাকে অবশ্যই ভালো বলা যায়। শাহানা খান হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
হৃদিতাকে বিয়ে করতে চাস?
মায়ের কথায় নিশান চমকালো, থমকালোও বেশ! মা যে এমন কিছু বলবে কল্পনাও করেনি সে। তাবে কি মা তার মনের অনুভূতি সত্যিই বুঝতে পেরেছে?
.
হৃদিতা না চাইতেও ইদানীং নিশানকে নিয়ে একটু বেশি ভাবছে। সময়ে অসময়ে কেনো যে নিশানকে এত মনে পরে বুঝতে পারছে না হৃদিতা। এই তো কিছুক্ষণ আগে মা বলে গিয়েছে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে। ১০ দিন পর রিয়াদের বিয়ে আজ তারা শপিং এ যাবে। অথচ হৃদিতা তৈরি না হয়ে এখনো নিশানের ভাবনাতে পড়ে আছে। ফুপির বাড়ি থেকে এসেছে ১৩ দিন হলো। এর মাঝে নিশানের সাথে আর দেখা হয়নি। তবে হৃদিতার মন যেনো বারবার বলছে নিশানকে একপলক দেখতে। তার সাথে দুটো কথা বলতে।
শপিং শেষ করে রাত ১০ টার পরে হৃদিতারা বাড়িতে ফিরলো। সবাই সারাদিন কেনাকাটা করে ক্লান্ত থাকায় যে যার রুমে চলে গেলো। বাইরে থেকে ডিনার করে আসায় খাবারের আয়োজন করতে হলো না।
হৃদিতা রুমে এসে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বেডে গা এলিয়ে দিলো। কি যে শান্তি লাগছে এখন। একটু পরেই চোখে ঘুম নামলো। কতটুকু ঘুম হলো হৃদিতা জানে না ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো মেয়েটা। উফ এত্ত আরামের ঘুমে কে ব্যাঘাত ঘটালো। আবারো ফোন বেজে উঠতে হৃদিতা চোখ বন্ধ রেখে রিসিভ করলো বিরক্তিমাখা ঘুমজড়ানো কন্ঠে বললো,
কে আপনি বলুন তো এত রাতে কল দিয়েছেন কেনো?
মাত্র ঘুম ভাঙায় হৃদিতার কথাগুলো কিছুটা জড়িয়ে আসছিলো। ফোনের ওপর পাশে থাকা নিশান হৃদিতার ঘুমজড়ানো কন্ঠস্বরটা ভীষণ ভাবে অনুভব করলো। কারো ঘুমে জড়ানো কন্ঠ এত সুন্দর হয় বুঝি! রাইসার ঘুমজড়ানো কন্ঠ ও শুনেছে নিশান তখন তো এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি! নিশান মৃদু হেসে টাইম দেখলো ১১:৪৩ বাজে। রিশানের থেকে শুনেছে হৃদিতা এত তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। তাইতো মায়ের ফোন থেকে নাম্বার নিয়ে কল দিয়েছে। হৃদিতারা যাওয়ার পর আর দেখা বা কথা কিছুই হয়নি। অফিসের কাজের চাপে অনেকটা বিজি ছিলো কিনা। যার কারনে নিশান চেয়েও খোজ নিতে পারেনি প্রিয় মানুষটার।
নিশান গলা পরিষ্কার করে বললো,
আপনি ঘুমিয়েছেন জানলে কল দিয়ে বিরক্ত করতাম না আপনাকে। আপনি ঘুমান হৃদিতা আমি কল কাটছি।
নিশানের কথা কর্ণপাত হতে ঘুম উবে গেলো হৃদিতার। নড়েচড়ে দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ কচলে ফোনের স্কিনে তাকালো। নাম্বারটা সেভ করা নেই নম্বারটা অপরিচিত। কন্ঠস্বরটা বড্ড চেনা লাগছে। হৃদিতার মন বলছে ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিটি নিশান। তাহলে কি সত্যি নিশান কল দিয়েছে তাকে! নাকি আজও সপ্ন দেখছে সে?নিশান কল কেটে দেবে বললেও এখনো কাটেনি। হৃদিতা সিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলো,
আপনি নিশান বলছেন?
নিশান নিরবে হাসলো। এবার মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে তারমানে ঘুম ভেঙে গেছে। আবার খারাপও লাগছে হৃদিতার ঘুম ভাঙিয়েছে বলে।
ঠিক ধরেছেন আমি নিশান। কিন্তু আপনি বুঝলেন কি ভাবে,আমি তো নিজের নাম বলিনি?
ওপাশে খানিক নিরবতা। অতঃপর হৃদিতা বললো,
কন্ঠ শুনে মনে হলো আপনি হবেন।
প্রায় পাঁচ মিনিট কথা হলো। তারপর ফোন রাখলো দুজনে। হৃদিতা ফোন রেখে মুচকি হাসলো। একরাশ ভালো লাগা ছেয়ে গেলো মনজুড়ে। কেনো যে হঠাৎ এত ভালো লাগছে বুঝতে পারলো না। নিশান যে এতরাতে ফোন দিয়ে তাকে চমকে দেবে ভাবতেই অবাক লাগছে হৃদিতার! তবে একটা প্রশ্নও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নিশান কেনো এত রাতে ফোন দিলো? কই আগে তো কখনো এভাবে ফোন দিয়ে কথা বলেনি!
হৃদিতা থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তারপর নিশানের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করলো,
অন্যদিনের তুলনায় আজকে আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করায় বড্ড বেমানান লাগছিলো। আপনি বরং আমাকে তুমি করেই বলবেন অনুমতি দিলাম।
#চলবে……