#হৃদয়_আকাশে_প্রেমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রাবণী_সারা
#পর্ব-৪
রিয়াদের বিয়ের জন্য দুপুর পরে মেয়ে দেখতে যাবে সবাই। এজন্য হৃদিতাকে মা আজ ভার্সিটি যেতে মানা করেছে। এদিকে হৃদিতার সকাল থেকে শরীর ভালো লাগছে না। কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। এটা যে জ্বর আসার পূর্ব লক্ষণ বেশ বুঝতে পারছে হৃদিতা।
রিয়াদ রুমে এসে বোনকে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। তারা সবাই রেডি মেয়ে দেখতে যাবে বলে অথচ তার বোন রেডি না হয়ে শুয়ে আছে!
হৃদিতা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেললো। ভাইয়াকে দেখে উঠে বসে খানিক হাসলো। রিয়াদ হৃদিতার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
হৃদি এসময় শুয়ে ছিলি কেনো শরীর খারাপ লাগছে?
হ্যা ভাইয়া মাথাটা কেমন ঝিনঝিন করছে। ভীষণ দুর্বল লাগছে।
হুমায়রা বেগম রুমে এসে ভাইবোনকে বসে থাকতে দেখে বললেন,
তোরা বসে বসে গল্প করছিস। মেয়ের বাসা থেকে ফোন দিচ্ছে,তোর বাবা তাড়াতাড়ি নিচে আসতে বলছে তোদের।
মা হৃদির তো শরীর ভালো না দেখছি আজকে মেয়ে দেখাটা ক্যান্সেল করে দাও।
সে কি হৃদির আবার কি হলো! এই মেয়েটা এত চাপা কেনো বুঝিনা কখনো নিজের সুবিধা অসুবিধা গুলো মুখ ফুটে বলেনা।
হুমায়রা বেগম হৃদিতার কাছে এসে কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখলো গা কিছুটা গরম। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। তিনিও মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পরে গেলেন। ওদিকে যে পাত্রীর বাসার লোকেরা তাদের অপেক্ষায় আছেন। এ মুহুর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারছে না তিনি। হুমায়রা বেগম হৃদিতার বাবাকে এসে বললো। তিনি পাত্রীর বাসার ফোন দিয়ে জানতে চাইলো আজ না গেলে কোনো প্রবলেম হবে নাকি তাদের। পাত্রীর বাবা জানালো পাত্রীর বড় ভাই আজই তার কর্মস্থলে ফিরে যাবে। নিজের বড় ছেলের উপস্থিতি ছাড়া তারা কিছুতে এগোবে না।
হৃদিতা মায়ের থেকে সব শুনে ভাবলো তার জন্য আজকের শুভ কাজটা অশুভ করার কোনো মানেই হয় না। সবাই মেয়ে দেখে পছন্দ করলে পরে নাহয় সে গিয়ে দেখে আসবে। অতঃপর হৃদিতা নিজে বাড়িতে থেকে সবাইকে জোর করেই পাঠালো পাত্রী দেখতে।
______
নিশানের অফিসের একজন কলিগের এক্সিডেন্ট হয়েছে তিনদিন আগে। বর্তমানে সে একপা ভেঙে নিজের বাসায় রয়েছেন। আয়মান খান নিশানকে বললেন বাসায় গিয়ে তাকে দেখে আসতে এবং কিছু টাকাও দিয়ে আসতে বললেন। নিশান বাবার কথায় সায় দিয়ে ম্যানেজারের থেকে কলিগ রায়হান সাহেবের ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ঠিকানা অনুযায়ী স্থানে এসে নিশান থমকালো। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। যার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে ভাগ্য যেন ঘুরেফিরে তার কাছেই এনে দাড় করাচ্ছে। সে যে ঠিকানায় এসেছে তা হৃদিতাদের বাড়ির ঠিকানার সাথে মিলে যাচ্ছে। এ বাড়িটা তিনতলা। বাড়িটা হৃদিতাদের নিজেদের। ওরা দোতলার পুরো ফ্ল্যাটে থাকে। তারমানে রায়হান সাহেব এই বাড়িতেই তিনতলায় ভাড়া থাকেন। নিশান আগে জানলে এখানে কখনোই আসতো না। কিন্তু এখন তো এসেই পড়েছে ফিরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। নিশান মেইন গেট পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলো। দোতলায় এসে হৃদিতাদের দরজার সামনে হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লো সে। তার অবচেতন মনটা হৃদিতার দর্শন পেতে চাইছে। নিশান ফোস করে নিশ্বাস ফেললো। পা বাড়ালো তিনতলার দিকে।
৪:১৩ বাজে হৃদিতা বেড থেকে নেমে দুর্বল পায়ে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো। মাথাটা খুব ভাড়ী হয়ে আছে। তীব্র জ্বর না হলেও কপাল মাথা বেশ গরম। হৃদিতার শরীরে হালকা শীত শীত অনুভূত হচ্ছে তারপরের বিকেলের মৃদু বাতাস ভালো লাগছে। মন চাইছে খোলা জায়গায় দাড়িয়ে একটু নিশ্বাস নিতে। হৃদিতা সুতি ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বের হলো। উদ্দিশ্য ছাদে যাবে। মা বাড়ি থাকলে এ অবস্থায় কখনোই বেরোতে পারতো সে। মেইন দরজার কাছে এসে দাড়িয়ে পড়লো হৃদিতা। অসুস্থতা অনেকটাই কাবু করেছে তাকে। এই দুর্বল শরীরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে পারবে কিনা এটাই ভাবছে সে। মিনিটখানিক দাড়িয়ে ভাবলো রেলিং ধরে ধরে উঠলেই তো হবে।
নিশান রায়হান সাহেবের বাসায় আধঘণ্টা থেকে বের হলো। দোতলায় নামার জন্য দুটো সিঁড়ি বাকী তখনই হৃদিতা দরজা খুলে বের হলো। নিশান দাড়িয়ে পড়লো হৃদিতাকে দেখে। যদিও হৃদিতা এখনো তাকে দেখেনি। নিশানের কপালে দুটো ভাজ পড়লো,ভ্রুও কুঁচকালো হৃদিতাকে দেখে। তার মনে একটাই কথা এলো,হৃদিতা কি অসুস্থ? চোখমুখ এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেনো?
হৃদিতা দরজা লক করে উপরে উঠতে নিলে নিশানকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থমকালো! অবাক হয়ে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে রইলো।
হৃদিতা আপনি কি অসুস্থ?
হৃদিতা নিজেকে সামলে বললো,
ওই সামান্য জ্বর হয়েছে। কিন্তু আপনি এখানে?
নিশান পূর্ণদৃষ্টিতে হৃদিতাকে আরো একবার দেখে নিলো। হৃদিতা বলছে সামান্য জ্বর তবে নিশানের মোটেও তা মনে হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে মেয়েটার কপালে একবার হাত রাখতে। নিশান নিজের ইচ্ছেকে দমালো। ব্যাপারটা অনুচিত হবে।
নিশান তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
আপনাদের তিনতলায় আমাদের অফিসের একজন কলিগ থাকেন। সে এক্সিডেন্ট করেছে তাকেই দেখতে এসেছিলাম। বাই দ্যা ওয়ে,জ্বরের মেডিসিন খেয়েছেন? তাছাড়া আপনি এমন শরীর খারাপ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
হুম খেয়েছি ঔষধ। রুমে একা শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। একটু ফ্রেশনেস দরকার এজন্য ছাদে যাচ্ছিলাম।
আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে দুর্বল আপনি। এ অবস্থাতে ছাদে না গেলে হয় না? অসাবধানতায় পড়েও যেতে পারেন। আপনি বরং ভেতরে যান দুর্বলতা কমলে তখন নাহয় ছাদে যাবেন।
হৃদিতা পিটপিট করে তাকালো নিশানের দিকে। নিশানের বারন কি শোনা উচিত? হঠাৎ করেই সেদিনের সেই সপ্নটা মনে পড়লো হৃদিতার। অন্য রকম এক অনুভূতি ছেয়ে গেলো মনজুড়ে। শরীরটাও যেনো আরো নেতিয়ে পড়তে চাইলো। চেয়েও আর ছাদের দিকে পা বাড়াতে পারলো না মেয়েটা। এদিকে নিশানের সামনে দাড়িয়ে থাকতেও অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। দরজায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে মেঝেতে দৃষ্টি রেখে মৃদু স্বরে বললো,
আপনাকে ভেতরে আসতে বলতে পারছি না বাসায় কেউ নেই। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
হৃদিতা কথা শেষ করে একমুহূর্তও দাড়ালো না। দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে লক করে দিলো। নিশান বিষ্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বন্ধ দরজায়! কি হলো হৃদিতার! তার কোনো কথায় কি রাগ করলো মেয়েটা? রাগ করার মতো তেমন কিছুও তো বলা হয়নি। ছাদে যেতে চেয়েও কেনো গেলো না। শরীরটা আরো বেশি খারাপ করলো না তো? নিশানের মনে আপনাআপনি এসকল ভাবনার উদয় হতে লাগলো। পাশাপাশি চিন্তাও হচ্ছে হৃদিতার অসুস্থতা নিয়ে।
.
পাঁচদিন পর হৃদিতা আজ ভার্সিটিতে এসেছে। জ্বর মাথাব্যথা একেবারে ঘর বন্দি করে দিয়েছিলো যেনো। এখন সে সুস্থ। বাইরের খোলা হাওয়া বাতাসে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পেরে খুব ভালো লাগছে হৃদিতার।
পরপর দুটো ক্লাস করে হৃদিতার আর ক্লাস করতে মন চাইছে না। সময় বিলম্ব না করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে ভার্সিটির বাইরে এসে দাড়ালো। হৃদিতার ফোন বেজে উঠতে ব্যাগ থেকে বের করে দেখলো রিয়াদ কল দিয়েছে। হৃদিতা রিসিভ করতে ওপাশ থেকে রিয়াদ জিজ্ঞেস করলো,
হৃদি তোর ক্লাস শেষ হয়েছে বের হবি কখন?
আমি দুটো ক্লাস করে বেরিয়ে এসেছি ভাইয়া। আজ আর ক্লাস করবো না।
ও তাহলে তো ভালোই হলো। আমি তোহার সাথে মিট করতে এসেছি তুইও চলে আয়,….. রেস্টুরেন্টে। সেদিন তো ওকে দেখতে যেতে পারিস নি আজ নাহয় দেখে নে।
হৃদিতা ভাইয়ের কথা শুনে অবাক স্বরে বললো,
ভাইয়া তোমাদের দেখাশোনা হলো মাত্র চার পাঁচদিন হবে এখনি দেখা করা শুরু করে দিয়েছো! সত্যি করে বলোতো তোমরা একে ওপরকে আগে থেকেই চিনতে তাইনা?
রিয়াদ হুট করে কিছু বলতে পারলো না। সে আড়চোখে তোহার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলো। অতঃপর বোনকে বললো,
হৃদি তুই যা ভাবছিস তেমন কিছু না। তোর যদি ওর সাথে দেখা করার ইচ্ছে থাকে তাহলে চলে আয়।
হৃদিতা ভাইয়ার বলা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে রিকসা থেকে নেমে ভেতরে যেতে নিলে হুট করে নিশান এসে দাড়ালো সামনে। নিশান হঠাৎ এভাবে সামনে আসাতে হৃদিতা চমকে উঠলো। হতভম্ব হয়ে তাকালো নিশানের দিকে। খানিকটা বিরক্তও হলো হৃদিতা। এভাবে হুট করে কেউ সামনে এসে দাড়ায়! হৃদিতা কিছু বলার আগে নিশান কিছুটা রাগি স্বরে বললো,
হৃদিতা আপনাকে সেই ভার্সিটির সামনে থেকে ডাকছি শুনতে পাননি? নাকি শুনেও না শোনার ভান করছিলেন?
হৃদিতা বিষ্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকালো নিশানের দিকে। আশ্চর্য! তার ডাক শুনে কেনো না শোনার ভান করবে! নিশান তো তার শত্রু নয় যার জন্য তাকে এড়িয়ে চলবে।
হৃদিতা স্বাভাবিক ভাবে বললো,
আপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারন নেই যে না শোনার ভান করবো। আপনি ডেকেছেন শুনলে অবশ্যই সাড়া দিতাম আমি। তো বলুন কি দরকারে ডেকেছিলেন যার জন্য ভার্সিটি থেকে এখানে অবদি চলে এসেছেন?
নিশান পর পর দুবার শ্বাস ফেললো। হৃদিতাকে ওভাবে বলাটা মোটেও উচিত হয়নি। সত্যি তো হৃদিতা শুনতে পেলে অবশ্যই সাড়া দিতো। নিশান মুখের গম্ভীরতা কাটিয়ে মৃদু হেসে বললো,
আপনার শরীর এখন কেমন এটা জানার জন্য ডেকেছিলাম। জ্বর কমেছে?
হৃদিতা এবার চরম পর্যাণ অবাক হলো। মনে মনে বললো, এই কথা জানতে নিশান ভার্সিটি থেকে এতদূর অবদি এলো! আমার শরীরের কন্ডিশন জেনে তার কি কাজ!
এরই মাঝে হৃদিতার ফোন বেজে উঠলো। রিয়াদ কল দিচ্ছে। হৃদিতা ফোন কেটে দ্রুত বললো,
হ্যা হ্যা আমি এখন একদম ঠিক আছি জ্বরও কমেছে। ভেতরে ভাইয়া আমার জন্য অপেক্ষা করছে আসছি।
হৃদিতা চলে যেতে নিশান নিজেই নিজেকে বকতে লাগলো। কেনো সে চেয়েও কনট্রোল রাখতে পারছে না নিজেকে। নিশান অফিস থেকে কোনো একটা কাজে বের হয়েছিলো। হৃদিতার ভার্সিটির সামনে দিয়ে আসার সময় হৃদিতাকে দেখে কয়েকবার হৃদিতাকে ডেকেছে। হৃদিতাও তার গাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে রিকসায় উঠে পড়েছিলো। নিশানের তখনই মনে হলো হৃদিতা শুনেও তার ডাকে সাড়া দেয়নি। খানিক রাগ হলো নিশানের। তাইতো হৃদিতার পিছু পিছু রেস্টুরেন্ট অবদি চলে এসেছে।
.
রিশান আজ লুঙ্গী পড়েছে। লুঙ্গী পড়ে সে ভালো ভাবে হাটতেও পারছে না। একটু হাটতে গেলে পায়ের তলায় লুঙ্গীর নিচের অংশ চলে যাচ্ছে। আবার ওদিকে ওপরের অংশ চেপে ধরে রেখেছে। বাবা শাফিন ভাইয়াকে মাঝে মাঝে লুঙ্গী পড়া দেখে তারও শখ জেগেছে মনে। ছুটির দিন হওয়াতে ড্রইংরুমে সকলেই রয়েছে। রিশানের কান্ড দেখে সবাই মিটিমিটি হাসছে। নিশান তো এটা ওটা বলে রীতিমত রিশানকে রাগিয়ে দিয়েছে। কলিংবেল বাজতে রিতা গিয়ে দরজা খুলে হুমায়রা বেগম হৃদিতা রুপকে দেখে খুশি হলো ভীষণ। আজ সকালেই রিতা হুমায়রা বেগমকে ফোনে অনুরোধ করেছিলো মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে আসতে। ওরা ভেতরে আসতে নিলে রিশানের নজর পড়লো রুপের দিকে। ততক্ষণে রুপ ও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে রিশানের দিকে। হঠাৎ করে রিশানের ভীষণ লজ্জা লাগছে। এখানে আর একমুহূর্ত থাকবে না সে। রিশান তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে নিলে লুঙ্গী পায়ে বেধে ধপাস করে নিচে পড়লো। উপস্থিত সকলে বিষ্ময় নিয়ে তাকালো। নিরবতা ভেঙে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো রুপ। রিশান রাগি দৃষ্টিতে চাইলো রুপের হাসিমাখা মুখে। ভাড়ী বজ্জাত মেয়ে তো! সে পড়ে গেছে আর এই মেয়ে কিনা তার অসময়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে!
#চলবে…..