#হৃদয়ে শুধু আপনি❤️
#লেখনীতে:অনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৬
অনেকক্ষণ যাবত ক্যান্টিনে বসে আছে আরশি। সামনেই বসে আছে সেই অপরিচিত ছেলেটা।মানে জিসান! আরশি ছেলেটার চাহনী দেখে বার বার জোরপূর্বক হাসি দিচ্ছে। আর ছেলেটা আরশিকে ড্যাব ড্যাব করে দেখছে।আরশি আর চুপ করে থাকতে না পেরে মুখ খুললো,
-“আপনি কিছু বলছেন না যে?”
জিসানের হুঁশ এলো মনে হয়।নিচের দিকে তাকিয়ে সানগ্লাসটা খুলে নিলো। দাঁত বের করে হেসে বললো,
-“কি বলবো?”
-“কি বলবেন মানে!আমাকে এখানে আনলেন কেন?”(ভ্রু কুঁচকে)
-“আমাকে আপনার বাবা পাঠিয়েছেন।”
আরশি এমন কথা শুনে বেশ অবাক হলো।বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে বললো,
-“বাবা পাঠিয়েছেন?”
-“জ্বী।”
-“কিন্তু কেন?আপনি কি এখানেই পড়েন?”
-“না।আমি আমার বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করি।”
বুক ফুলিয়ে গর্বের সহিত বললো জিসান।আরশি নিজের নখগুলো একবার পরখ করে বললো,
-“ওহ তো আমার কাছে বাবা কেন পাঠালো?”
-“আসলে আপনার বাবা আমাদের কোম্পানিতেই জব করেন। আমি ওনার বসের ছেলে।”
-“ওহ।”
আরশির বলা শুধু ‘ওহ’ শব্দটা মনে হয় জিসানের তেমন পছন্দ হলো না।তবুও হেসে বললো,
-“আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না? ”
আরশি বোকা বোকা গলায় বললো,
-“কি প্রশ্ন করবো?”
-“এইযে আমি কেন এসেছি।”
-“ওমা, আপনি নিজেই জানেন না আপনি কেন এসেছেন?”
জিসানের চেহারাটা দেখার মত হয়েছে।আরশি কি ইচ্ছে করেই এমন করছে নাকি আসলেই বোকা সে বুঝতে পারছে না।এবার যে হালকা কেশে বললো,
-“আসলে আমি আপনার বাবার ফোনে আপনার ফটো দেখেছি।আর আমার আপনাকে ভালো লেগেছে।”
লাজুক লাজুক গলায় বললো জিসান।আরশি অবাক হয়ে বললো,
-“এটা বলতে আপনি ভার্সিটিতে চলে এসেছেন?”
-“জ্বী।”
আরশি ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতে বললো,
-“অনেক সময় লস করে দিলেন যে।আমি ক্লাসে যাই।গুড বাই।”
আরশিকে উঠতে দেখে জিসান অবাকের শীর্ষে।ভ্রু কুঁচকে নরম গলায় বললো,
-“তাহলে আমি কি করবো?”,
-“ও আল্লাহ!আপনি কি করবেন তা আমি কিভাবে বলবো?”
বলতে বলতে আরশি সামনে আসতে থাকা ফারিহা আর তারিনের দিকে এগুচ্ছে।জিসানও পিছন পিছন আসতে আসতে বলছে,
-“তাহলে ভার্সিটি শেষে রেস্টুরেন্টে যাই?”
-“আমার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।”
-“তোমার বাবা বলেছে আমার সাথে রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলতে।”
আরশি দাঁড়িয়ে গেলো।একটা ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
-“সত্যিই কি বাবা বলেছে? নাকি আপনি এতক্ষণ শুধু শুধু মজা করছেন আমার সাথে?”
জিসান সানগ্লাসটি চোখের দিতে দিতে বললো,
-“আরে না। আচ্ছা আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে। আপনি যান। ভার্সিটি শেষে আমি অবশ্যই আসব।”
আরশি বিরবির করে বললো,
-“না আসলেই খুশি হবো।আর আপনারও মঙ্গল হবে।”
-“জ্বী কিছু বললা?”
-” না না।”(হালকা হেসে)
-“আচ্ছা যাও।”
আরশি আর কথা না বলে তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে লাগলো।আর জিসান আরশির যাওয়ার পথে তাকিয়ে ভাবলো,
-“মেয়েটার বিহেভিয়ার আশ্চর্যজনক হলেও মেয়েটার চেহারাটা বেশ মায়াবী।মুখটায় মায়া মায়া ভাব আছে।বিশেষ করে চোখগুলো বেশি সুন্দর।বাবাকে বলে একেই আমার জীবনসঙ্গিনী বানাবো।”
ভেবেই জিসান হাসলো।এদিকে জিসান ফারিহা আর তারিনের দিকে এগিয়ে গেলো।ফারিহা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জিসানকে দেখিয়ে আরশিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-” কে রে ওটা?”
আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“আর বলিস না। বাবা নাকি একে পাঠিয়েছে।”
তারিন বেশ অবাক হয়ে বললো,
-“কিহহ!আঙ্কেল পাঠিয়েছেন? কেন রে?কে ওই ছেলেটা,তোর কাজিন?”
আরশি ক্লাসের দিকে যেতে যেতে বললো,
-” না রে,বাবার বসের ছেলে।আমাকে দেখে নাকি পছন্দ করেছে।”
ফারিহা বোতল খুলে পানি খাচ্ছিলো।এই কথা শুনে কাশি উঠে গেলো।আরশি দাঁড়িয়ে গেলো।ফারিহার পিঠে চাপড় দিতে দিতে বললো,
-“কাশি উঠলো কেমনে? হাঁটতে হাঁটতে কেউ পানি খায়?”
ফারিহা কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে বললো,
-” না না কিছু না। চল।”
তারিন সন্দেহজনক চাহনী দিয়ে বললো,
-“আমার তো মনে হয় তুই ওই ছেলেটার পছন্দ করাটা শুনে বিষম খেলি!”
ফারিহা জোরপূর্বক হেসে বললো,
-” আরে না না। এমনি কাশি উঠে গেলো।”
আরশিও আর কথা না বাড়িয়ে তারিনের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগলো।আর ফারিহা পিছনে পিছনে আসতে আসতে ভাবছে,
-“এই খবর যদি মুগ্ধ পায় তাহলে তো ওই পোলা শেষ। আমি গিয়ে চুপি চুপি আগে বলে আসি।”
ভাবতে ভাবতে ফারিহা সেখান থেকে সাইড কেটে পড়লো।আরশি তারিনকে বলছে,
-“বুঝলাম না ভাই,এত মেয়ে থাকতে ছেলেটা আমাকেই কেন!”
-“আরে পছন্দ তো হতেই পারে। এত কিউট একটা মেয়ে।”
-“সমস্যা তো অন্য জায়গায়।মুগ্ধ জানলে তো..”(মনে মনে)
আরশিকে চুপ করে থাকতে দেখে তারিন আরশিকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
-“কিরে কি ভাবছিস?”
-” না না কিছু না।”
_____________
-“ওই ছেলেটা কে ছিল আরশি?”
মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো মুগ্ধ।ভ্রু জোড়া তার কুঁচকে আছে।আরশি ঢোক গিলে বললো,
-“কোন ছেলেটা মুগ্ধ?”
মুগ্ধ আড়চোখে একবার তাকিয়ে বললো,
-“যার সাথে আপনি সকালে কথা বলছিলেন।”
-“কই কেউ না তো।”
বলতে বলতে আরশি মুখের ঘাম মুছতে লাগলো।সে কিছুতেই মুগ্ধকে জানতে দিবে না। কারণ ইতোমধ্যে সে গোপনসূত্রে জানতে পেরেছে যে তার পিছনে লেগে থাকা ছেলেগুলোকে এতদিন যে পিটিয়েছিলো সে মুগ্ধই।তাই এখন সে চাইছে না জিসানকে মার খাওয়াতে।এতে তার বাবার চাকরীর সমস্যাও হতে পারে।
-“তাহলে সকালে আমার সাথে কথা বললেন না কেন? আমি আপনাকে কত খুঁজেছি!”
নিচের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করছিলো আরশি।মুগ্ধের কথা শুনে মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুগ্ধ আরশির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। সেই দৃষ্টিতে রয়েছে একরাশ অভিমান।আরশি হাসলো।মুগ্ধের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
-“ক্লাস ছিলো তো তাই।”
-“মোটেও না।আপনি ওই ছেলেটার সাথে ক্যান্টিনে বসে ছিলেন। জানি আমি।”
আরশি এবার উপায়ন্তর না পেয়ে রাগী গলায় বললো,
-“আরে কোন ছেলেটার সাথে মুগ্ধ? বেশি হচ্ছে কিন্তু। যান বাসায় গিয়ে রেস্ট নিন। এখনো কিন্তু অসুস্থতা কমে নি।”
মুগ্ধ আরশির দিকে রাগী চোখে তাকায়। তারপর সেই পার্কের বেঞ্চটায় বসে পড়ে।আরশি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মুগ্ধের পাশে বসতেই মুগ্ধ অন্যদিকে তাকালো।আরশি নরম গলায় বললো,
-“এমন কেন করছেন? বললাম তো কেউ না ছেলেটা।”
-“থাক আর বলতে হবে না।”
মুগ্ধের কথায় স্পষ্ট অভিমানের ছোঁয়া পেলো আরশি।আরশি নিজের ঘাড়টা একটু এগিয়ে মুগ্ধের চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এদিকে ফিরুন।”
-” না।সরুন আমি চলে যাবো।”
-“কই যাবেন?”(অবাক হয়ে)
-“বাইক নিয়ে যাব।”
আরশির নিজের স্বপ্নের কথাটা মনে পড়ে গেলো। এখনো সে সেই ভয়ানক স্বপ্নটা ভুলতে পারেনি। তাই সে মুগ্ধের হাত ধরে বললো,
-“আমি না করেছি।”
-“আপনি আমার কথা শোনেন?”
-“উফ,আচ্ছা বসুন বলছি।তবে আমায় একটা প্রমিজ করতে হবে যে আপনি এটা শোনার পর কোনো রিয়াক্ট করতে পারবেন না।”
মুগ্ধ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
-“কথাটা শোনার পর আমি প্রমিজ করবো।”
-“তাহলে আমিও বলবো না।”
মুগ্ধ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
-“আচ্ছা আচ্ছা সরি সরি। বলুন।প্রমিজ করছি কোনো রিয়াক্ট করবো না।”
আরশি এবার ভয়ে ভয়ে মুগ্ধ কে সবটা বললো যে ছেলেটা আরশিকে পছন্দ করে।মুগ্ধের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আরশি তা দেখে বললো,
-“এইযে রেগে যাচ্ছেন।প্রমিজ কিন্তু ভাঙা যায় না।”
মুগ্ধ নিজেকে শান্ত করলো।তারপর হেসে বললো,
-“আরেহ না। আমি রাগ করিনি। সুন্দরী বউ থাকলে মানুষ তো নজর দিবেই।”
মুগ্ধের মুখে ‘বউ’ শব্দটা শুনে একটা অজানা শিহরণ বয়ে গেলো আরশির মন বেয়ে।বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। আলাদারকম একটা অনুভূতি হলো।মুগ্ধ আরশির দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
-“কোথায় লুকানো যায় আপনাকে বলুন তো?”
আরশি জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। মুগ্ধ অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
-“চলুন বিয়ে করে ফেলি। তারপর সোজা হানিমুনে চলে যাব। ওখানে তো আর কেউ দেখবে না।”
আরশি হেসেই ফেললো।মুগ্ধের চুলটা আবারো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
-“পড়াশোনা টা করেন।”
মুগ্ধ আরশির কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো।ব্যস্ত পার্কটা আস্তে আস্তে খালি হচ্ছে। গোধুলির আলো-আঁধারের খেলা মন ভরে দেখছে আরশি আর মুগ্ধ। দুজনই নিশ্চুপ।আরশির কাঁধে মাথা রেখে মুগ্ধ বললো,
-“আমাদের বিয়ের পর আমাকে এভাবে কাঁধে মাথা রাখতে দিবে আরশি?”
আরশি চুুপ করে শুনছে। মুগ্ধ আবার বললো,
-“আমাকে খাইয়ে দিবেন তো? গতকাল রাতের মত?গতকাল রাতে অনেক মজা করে খেয়েছি।”
।
।
মায়াকে পড়িয়ে বাসায় আসতে আসতে রাত ৮ টা বেজে গেলো।মুগ্ধ এসে আরশিকে বিল্ডিং এর সামনে বাইক থেকে নামিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“সাবধানে থাকবেন। কালকে দেখা হবে।”
-“নিজেও বাসায় গিয়ে পড়তে বসবেন।আমার বাসার সামনে যেন ঘুরঘুর করতে না দেখি।”
-“করবোই।মধু যেখানে ভ্রমররাজা তো সেখানেই থাকবে।”
আরশি না হেসে পারে না। মুগ্ধের হাতে চিমটি কেটে বলে,
-“ভালোই ভালোই বাসায় যান।”
-“রাতে সমস্যা হলে কল দিয়েন।”
আরশি মুগ্ধ কে বিদায় দিয়ে বাসায় ঢুকলো।বাসায় ঢুকতেই নিজের বাবাকে সোফায় বসে থাকতে দেখলো আরশি।অবাক হয়ে বললো,
-“বাবা তুমি এখানে? এতক্ষণে তো খেতে বসে যাওয়ার কথা।”
জুনায়েদ আহমেদের মুখে স্পষ্ট কঠোরত্ব ফুটে উঠেছে।তিনি শক্ত গলায় বললেন,
-“জিসান গেছিলো?”
-“হ্যা বাবা। তুমি নাকি পাঠিয়েছো?”
-“হ্যা। ও আমার বসের ছেলে।তোমাকে পছন্দ করেছে।ওর সাথে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা ছিলো। গিয়েছিলে?”
আরশি এতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিলো।এখন মাথাটা উঁচু করে বললো,
-“বাবা,আমি তো পড়াতে গিয়েছিলাম মায়াকে।”
জুনায়েদ আবারো শক্ত গলায় বললেন,
-“এসব পড়ানো এখন বাদ দাও। তোমার বিয়ে ঠিক করেছি আমি।জিসানের সাথে।”
আরশির পায়ের তলার মাটি সরে গেলো যেন।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার।কি করবে এবার?
চলবে….