#হৃদয়ে শুধু আপনি❤️
#লেখীনিতেঃঅনুসা রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৪
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরশি।ভার্সিটিতে পা রাখার সময়ও সে আজ মুগ্ধের দেখা পায়নি।আর এই সময়ও পাচ্ছে না। এতে অবশ্য তার খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু সে হচ্ছে না।মনের কোনো একটা জায়গায় মন খারাপের সৃষ্টি হচ্ছে। নিজেকে অস্থিরতার মাঝে উপলব্ধি করতে পারছে।বিষয়টা হয়তো তারিন আর ফারিহা লক্ষ্য করলো। তারিন ফারিহাকে ফিসফিস করে বললো,
-“আজকে আরশির মনটা খারাপ মনে হচ্ছে না?”
ফারিহা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।তারপর দ্বিগুণ ফিসফিসিয়ে বললো,
-“দাঁড়া ওকে জিজ্ঞেস করি।”
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পরেও কাঙ্খিত মানুষটির দেখা না পেয়ে আরশির বুক চিঁড়ে আবারো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেলো।ফারিহা হালকা কেশে বললো,
-“তুই কি কাউকে খুঁজছিস আরশি?”
আরশি আনমনা হয়ে হবাব দিলো,
-“সে তো নেই।”
তারিন ফারিহার দিকে একবার তাকিয়ে আবারো আরশির দিকে তাকায়। তারপর বলে,
-“কে নেই আরশি?”
আরশির ধ্যান ভাঙে। জোর পূর্বক হেসে বলে,
-“কেউ না তো।”
বলেই আরশি কয়েক পা এগিয়ে হাঁটতে লাগে।বলতে গেলে সে আপাতত পুরো কলেজ মাঠটাই পায়চারী করে চলেছে।ফারিহা আর তারিনও পিছনে পিছনে আসছে।হঠাৎই আরশি মুগ্ধের বন্ধু তিতাস, আয়মান আর নীলকে দেখতে পেল।তিনজনে একটা জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছে।আরশির চোখ সেদিকে তাকিয়ে একজনকে খুঁজে চলেছে। কিন্তু সে নেই।আয়মান হঠাৎই সামনে তাকিয়ে আরশিকে দেখতে পেলো। সে আরশির দিকে এগিয়ে আসতেই আরশি চোখ সরিয়ে নিলো।আয়মান মুচকি হেসে বললো,
-“আসসালামু আলাইকুম ভাবী।”
আরশি অবাক হয়ে তাকায়।’ভাবী’ ডাকটার সাথে সে তেমন পরিচিত নয়৷ তবে এদের মুখ থেকে শুনে মন্দও লাগছে না। তবুও কাঠ কাঠ গলায় বললো,
-“জ্বী ওয়া আলাইকুমুস সালাম।ভাবী বলার কারণ?”
আয়মান হাসলো। তারপর বললো,
-“কারণটা হয়তো আপনার অজানা নয় ভাবী।”
আরশি থতমত খেয়ে গেলো। তবুও বললো,
-“প্লিজ আমায় এসব নামে ডাকবেন না। আমি আপনাদের থেকে সিনিয়র। আপু ডাকবেন।এতেই হবে। ”
-“সরি ভাবী। মানতে পারলাম না।”
-“কে বলেছে আপনাদের এসব বলে ডাকতে আমায়?”(ভ্রু কুঁচকে)
-“মুগ্ধ বলেছে ভাবী বলে ডাকতে। “(মুচকি হেসে)
আরশির বুকটা ধক করে উঠলো।পিছন থেকে ফারিহা বললো,
-” সে বললেই কি ভাবী ডাকতে হবে নাকি।”
আয়মান হ্যা বোধক মাথা নাড়ায়।ফারিহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশি হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়।আয়মান আবারো বলে,
-“কিছু লাগবে ভাবী?”
-“না আমার আবার কি লাগবে।”
বলেই সে আঁড়চোখে আশেপাশে তাকায়।আয়মান বিষয়টা খেয়াল করে বললো,
-“আপনি যাকে খুঁজছেন সে নেই।”
-“মানে?”(ভ্রু কুঁচকে)
-“হ্যা। আপনি মুগ্ধকেই খুঁজছেন তো?”
আরশি অন্য পাশে ফিরে বললো,
-“মোটেও না। আমি কেন ওই বেয়াদবটাকে খুঁজবো। ”
-“আপনার চাহনী দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভাবী।”
পিছন থেকে বলা তিতাসের এমন কথায় আরশির কেমন যেন লাগলো। আসলেই সে মুগ্ধকে খুঁজছে? কেন?মুগ্ধ তাকে আর বিরক্ত করছে না। এতেই তো তার খুশি হওয়ার কথা।তিতাস আবার বললো,
-“ভাবী,মুগ্ধ এখানেই নেই। আজ আসেনি। আর তার সাথে আমাদের কথাও হয়নি।ফোনও বন্ধ রয়েছে।জানি না ছেলেটা কোথায়।”
আরশি তিতাসের দিকে তাকায়।তারপর আবারো মাথাটা নিচু করে ফেলে।তিতাস মুচকি হেসে বলে,
-“আপনি সুখে থাকুন, এটাই হয়তো চায় ও।”
আয়মান আরশির সামনে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“ভাবী,এই কথাটা তো নিশ্চয়ই শুনেছেন যে আমাদের তাকেই চাওয়া উচিত যে আমাদের ভালোবাসে।তাকে নয় যাকে শুধু আমরা ভালোবাসি।”
আরশি মুখ তুলে আয়মানের দিকে জিজ্ঞাসাসূচক চাহনী দেয়।আয়মান হেসে বলে,
-“এমন ভালোবাসা আমরা চেয়েও পাই না আর আপনি পেয়েও ফেলে দিচ্ছেন। আফসোস!”
আরশি কি বলবে বুঝতে না পেরে আর কিছু না শুনে সেখান থেকে চলে এলো।পিছন পিছন ফারিহা আর তারিনও দৌড়ে গেলো।আরশি বট গাছটার সামনে এসে বসে পড়লো।ফারিহা আর তারিনও এসে কাঁধে হাত রাখলো।আরশি এবার কেঁদে দিলো। তারপর বললো,
-“আমি কি করবো বল তোরা।মুগ্ধ আমায় ভালোবাসে এটা নাহয় আমি মানছি। ছেলেটা ভালোবাসে আমায়। কিন্তু সমাজ কি এটা মানবে? লোকে কি ভালো চোখে দেখবে?আমার বাবার সম্মানটা কোথায় থাকবে বল তো? লোকে বলবে ছেলের কপাল খারাপ তাই বুড়ি কপালে জুটেছে। বল তোরা!বলবে না?”
তারিন আরশির সামনে বসে পড়লো। আরশিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“লোকে কি বলবে সেটা জানি না তবে কেন যেন আমার মন বলছে তুই মুগ্ধ কে ভালোাবসিস।”
আরশি কান্না থামিয়ে তারিনের দিকে তাকায়। ফারিহাও হালকা হেসে বললো,
-“হ্যা আরশি। তুইও মুগ্ধকে ভালোবাসিস। নয়তো ওর জন্যে তোর এত কষ্ট হতো না। তুই ওকে মিস করছিস।”
আরশি মাথা নিচু করে ভাবতে লাগে।তারিন আরশির থুতনি ধরে বলে,
-“এমন ছেলে আর পাবি বলে মনে হয় না। তোর বিষয়টা জানি না তবে আমি পেলে কবেই হ্যা বলে দিতাম।”
ফারিহা মাথা নাড়িয়ে বলে,
-“আমিও। একে তো ভার্সিটির নিউ ক্রাশ। আমরা বের হয়ে গেলে ওই ভার্সিটিতে মেয়েদের উপর রাজত্ব করবে বলে মনে হচ্ছে।”
আরশি বারকয়েক চোখের পলক ফেলে বললো,
-“কি যে করবো আমি!”
_______________
মায়াকে আরশি পড়াতে এসেছে অনেকক্ষণ হলো।মায়া নিজের মত অংক করছে। আরশি যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজেকে সংযত করতে।কিন্তু তার অবাধ্য চোখ বারংবার খুঁজে চলেছে মুগ্ধকে।না পেয়ে চোখে অশ্রু টলটল করছে।আরশি বারবার চেষ্টা করছে সেই পানি লুকাতে। বারবার চোখের পলক ফেলছে যেন পানি না পড়ে।কিছুক্ষণ পর মায়া বললো,
-“আপু এটা পারছি না।”
আরশি ভড়কে গেলো। চোখ থেকে পানিটা পড়তেই আরশি তাড়াতাড়ি করে তা মুছে নিয়ে বললো,
-“দেখি কোনটা?”
মায়ার চোখ এড়ায় না।সে অবাক হয়ে বলে,
-“আপু তোমার চোখে পানি কেন?”
-“আরে কিছু না। এমনি। তুমি বলো কোনটায় সমস্যা?”
মায়া কিছু বলতে গিয়েও বলে না। অংকটা দেখিয়ে দেয় আরশিকে। আরশিও মায়াকে পড়ানো শুরু করে। কিন্তু এখনো তার মনটা কেমন কু ডাকছে। হঠাৎ দরজা খুলে শর্মিলা প্রবেশ করলেন। হাতে খাবারের ট্রে।তিনি তা আরশির সামনে দিয়ে বললেন,
-“নাও কিছু জলখাবার।”
-“না না তার কি দরকার ছিলো আন্টি?”
-“সারাদিন ভার্সিটি করেছো। নাও খাও।”(মুচকি হেসে)
মায়া অংক করছে।আর আরশি সেদিকে তাকিয়ে আছে।শর্মিলা বললেন,
-“তোমার বাবার শরীর কেমন আছে আরশি?”
-“জ্বী আন্টি ভালো।”
শর্মিলা চুপ করে রইলেন।তিনি কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারছেন না। কোনোরকম ইনিয়েবিনিয়ে বললেন,
-“তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আরশি?”
-“জ্বী আন্টি”
-“আসলে গতকাল থেকে মুগ্ধ বাসায় নেই। ছেলেটা সারাদিন হয়ত না খাওয়া। বন্ধুদের কল করে জানলাম ভার্সিটিও যায়নি। বাইক নিয়ে বের হয়েছিলো। ও তো আবার বাইক এক্সিডেন্ট বেশি করে।রেস টেস করে।মা তুমি কি জানো ও কোথায়?”
আরশি কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। তারমানে শর্মিলাও ছেলের এসব বিষয়ে জানেন। বিষয়টা আরশির জন্য অনেক লজ্জার।আরশি জোরপূর্বক হেসে বললো,
-“না আন্টি আমি তো দেখিনি।”
-“তুমি আবার জিজ্ঞেস করায় কিছু মনে করিও না। আসলে ও কারোর কাছে যাক আর না যাক।তোমার কাছে তো যায়। তাই আর কি।”
আরশি মাথাটা নিচু করে ফেললো। তার জন্যেই তো মুগ্ধ বাসায় আসছে না। আরশির মনে পড়ে গেল গতকালকে বলা কথাটা,
-“আপনার কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি চলে গেলে যদি আপনি না কাঁদেন তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।”
ভেবেই আরশির হার্ট ক্রমাগত লাফাতে লাগলো।ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারছে যে সে মুগ্ধের মায়ায় পড়ে গেছে।
🤍
মুগ্ধদের বাসায় পা রাখতেই বাড়িটা কেমন থমথমে অনুভব করলো আরশি।বাড়িতে ঢুকতেঔ দেখতে পেলো সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ।যেটা ডেকে খাটিয়ার উপর রাখা।আরশি ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে যায়।সামনেই শর্মিলাকে কান্নারত অবস্থায় দেখতে পায়। সাথে মায়া,মুগ্ধর বাবা জুয়েল সাহেব কেও দেখতে পেলো।শর্মিলাকে কাঁদতে দেখে আরশি বলে,
-” আন্টি কাঁদছেন কেন আপনি? আর এটা কার লাশ?”
শর্মিলা মুখে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“আমার সব শেষ আরশি। আমার কলিজার ধন শেষ!”
আরশি অবাক হয়ে বলে,
-“কি বলছেন এসব আন্টি। আমি তো বুঝতেই পারছি না।”
শর্মিলা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“মুগ্ধ বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।িকে যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারিনি। আরশি। আমার ছেলেটাকে আমি বাঁচাতে পারিনি।”
বলতে বলতে তিনি বসে পড়লেন।কাঁদতে লাগলেন হু হু করে।আরশির পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো যেন।সে যেন পাথর হয়ে গেলো। এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে গেলো।সাদা কাপড়টা উঠাতেই মুগ্ধের মুখটা ভেসে উঠলো। আরশি মুগ্ধের মাথাটা নিজের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। চারিদিক থেকে ভেসে আসলো মুগ্ধের সেই কথা কাথাটা,
-“যতদিনে বুঝবেন ততদিনে হারিয়ে যাব আরশি।”
আরশি চিৎকার করে বলতে লাগলো,
-“আপনি ফিরে আসুন মুগ্ধ।দেখুন আপনার আরশি আপনার কাছেই। আপনাকে আর দূরে রাখবো না মুগ্ধ। এই মুগ্ধ! চোখ খুলুন না প্লিজ। দেখুন আমি আপনার কাছেই রয়েছি। আর কখনো আপনাকে কষ্ট দিবো না মুগ্ধ। আপনি না বলেছিলেন আমাকে ছেড়ে আপনি থাকতে পারবেন না। তাহলে কেন চলে গেলেন মুগ্ধ? কেন?”
আরশি অনবরত মুগ্ধের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলছে,
-“মুগ্ধ প্লিজ!দেখুন,আপনি কিন্তু আরেকটা চড় খাবেন।এই মুগ্ধ, আমাকে আর আপু বলে ডাকতে হবে না।আপনি নাম ধরে ডাকলেও কিছু বলবো না।সারাদিন বিরক্ত করলেও কিছু বলবো না। এখন আমাকে কে বিরক্ত করবে সারাদিন?কার উপর রাগ দেখাবো আমি?কার অভিমান মাখা চোখ দুটো দেখবো মুগ্ধ? বলুন না মুগ্ধ! এই মুগ্ধ উঠুন প্লিজ।আপনি না বলেছিলেন আপনার আমার কান্না সহ্য হয় না। তাহলে আজ কেন শুনতে পারছেন না আপনি আমার কান্না,কেন দেখতে পারছেন না আমার এই কান্নারত চোখ,মুখ। উঠুন প্লিজ!”
বলতে বলতে আরশি ক্রমাগত মুগ্ধের বুকে মাথা রাখছে।কিন্তু মুগ্ধের কোনো প্রকার রেসপন্স নেই।সে তো চলে গেছে। হারিয়ে গেছে।যেমনটা আরশি চেয়েছিলো। মুক্তি দিয়েছে সে আরশিকে।
চলবে….