হৃদয়ে রক্তক্ষরণ পর্ব-৪৫+৪৬

0
7

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ৪৫
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজ
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
[প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত]
[পর্বটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।লাইনগুলো স্কিপ না করে,একটু মনযোগ দিয়ে পড়বেন।]

“নিধির আকস্মিক আ**ক্রমণে হতভম্ব হয়ে গেলো নির্জন।”

“প্রচন্ড যন্ত্রণা নিয়ে নিজের হাত চেপে ধরে, তীব্র কৌতূহল এবং অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ডার্ক কুইন,তুমি আমাকে এভাবে আ**ঘা*ত করলে কেনো?’

“নিধি নির্জনের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে, তড়িৎ গতিতে ছু**রি দিয়ে নির্জনের বাম হাতে আ**ঘাত করতেই, দূরে সরে গেলো নির্জন।কা**টা হাতের যন্ত্রণায় চোখজোড়া বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।এই প্রথম সবচেয়ে প্রিয় মানুষ টিকে এতটা আ**ঘাত করলো নিধি,যেটা সে কখনোও কল্পনাও করতে পারেনি।”

“নির্জন কা**টাযুক্ত হাত নিয়ে নিধির দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই, নিধি নির্জনের ডান পায়ে আ**ঘাত করে।অতঃপর নির্জনের বুকে ধা**ক্কা দিতেই,নির্জন তার দুর্বল শরীর নিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে।সেই সুযোগে নিধি ওর পায়ের বাঁধন খুলে, নির্জনের দিকে একবার অশ্রুভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে টেবিলে থাকা নিজের এবং নির্জনের ফোন নিয়ে দরজা খুলে বাহির থেকে লক করে,ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলতে থাকে,

‘আপনি অসুস্থ,নির্জন।আপনি নিজেও জানেন না যে আপনি অসুস্থ।অতীত কে কেন্দ্র করে আপনি আমাকে দিনের পর দিন আ**ঘাত করেছেন।আমি কিছুই বলতে পারিনি,অথচ আজ যখন আপনাকে আ**ঘাত করলাম,তখন খুব কষ্ট পেলেন, তাই না?হাহ!আমিও এমনই কষ্ট পেয়েছি নির্জন।আমি চলে যাচ্ছি,চিন্তা করবেন না;খুব দ্রুতই ফিরে আসব।’
বলেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে,সদর দরজা খুলে এলোমেলো পা ফেলে রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকল।”

“রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিধির মাহিরের কথা মনে পড়তেই,ও নিজের ফোন বের করে মাহিরের ফোনে কল করতেই,কয়েকবার রিং হওয়ার পর মাহির ফোন রিসিভ করলো।
মাহির নিজের বরাদ্দকৃত কক্ষে রোগীর জন্য প্রেসক্রিপশন করছিলো।নিধির ফোন পেয়ে,কিছুটা অবাক হয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই,নিধি মাহির কে নির্জনের সাথে ঘটে যাওয়া সকালের ঘটনাগুলো সংক্ষেপে বলে এবং ওর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানালো।আর ওকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে বললো।”

“নিধির মুখনিঃসৃত এহেন ঘটনা শুনে, মাহির যেন বোকা বনে গেলো।নির্জন কে মাহিরের কাছে গম্ভীর স্বভাবের মনে হলেও, কখনোই অস্বাভাবিক লাগে নি।’
ভেবে নিধির কথায় সায় জানিয়ে ওকে ২০মিনিট অপেক্ষা করতে বলে,আরও ২জন পেশেন্ট দেখে,হসপিটাল থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।”

“এদিকে রাস্তার এক সাইডে দাঁড়িয়ে,এলোমেলো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পথচারীদের দেখছে নিধি।মনে মনে ভাবতে থাকল,

‘যদি কোনোক্রমে নির্জন এসে পড়ে,তখন তো আমাকে আবারও বদ্ধ খাঁচায় আটক করবে।না, না, নাহ,আমি কিছুতেই তার বন্দিনী হয়ে থাকব না।তার হিং**স্র ভালোবাসার থেকে সারাজীবন একা থাকাও ভালো।লাগবে না ওই পৈ**শাচিক ভালোবাসা।’
এক মনে কথাগুলো ভাবতেই,চোখজোড়া বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো নিধির।আশপাশে তাকিয়ে,সন্তর্পণে নিজের অশ্রুসজল চোখ মুছে, আবারও পথচারীদের দিকে মনোনিবেশ করলো।ওর মস্তিষ্কশূন্য প্রায়,বারবার শুধু একটা কথাই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে,

‘এতদিন একজন হিং**স্র মানসিক রোগীর সাথে একই ছাদের নিচে কিভাবে বসবাস করলাম?’

ভাবতেই গায়ে কিছুটা কাঁপন দিয়ে উঠলো নিধির।”

“প্রায় ৩০মিনিট পর,মাহির গাড়ি নিয়ে নিধির বলা জায়গায় পৌঁছাতেই,মাহির কে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নিধি।মাহির গাড়ির দরজা খুলে দিতেই,নিধি দ্রত পায়ে গাড়িতে উঠে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

‘এখান থেকে দ্রুত চলুন,প্লিজ।তাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।উনি যেকোনো সময় চলে আসতে পারে,আর..
বাকিটা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে আসলো নিধির।কারণ, সকাল থেকে কোনো খাবার খায় নি নিধি।”

“নিধির অসহায় মুখস্রির দিকে তাকিয়ে, খুব মন খারাপ হলো মাহিরের।নিধির দিকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে,ভরসার সহিত বললো,

‘চিন্তা করবেন না আপু,আপনার এই ভাইটি আছে তো।সে আসলেও,এই পাবলিক প্লেসে আপনার সাথে কিছুই করতে পারবে না।মনে হয় আপনি খুব তৃষ্ণার্ত, আগে পানিটুকু খেয়ে নিন,তারপর গাড়ি স্টার্ট দেই।’

“মাহির বলতেই নিধি বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে, গলা ভিজিয়ে নিলো।’
তারপর মাহির গাড়ি স্টার্ট দিলো।যাত্রাপথে নিধিকে কিছুই জিজ্ঞেস করে নি মাহির।কারণ,নিধির কাছ থেকে নির্জনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ শুনে বুঝেছে,এতদিন এই মেয়েটার ওপর কতটা শারীরিক এবং মানসিক ধকল গিয়েছে।মাথা ঠান্ডা করে সবকিছু জানতে হবে।”

“যাত্রাপথে মাহিরকে তোহাও ফোন দিয়েছিলো।মাহির তোহার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছে।কারণ,এই মুহুর্তে তোহা কে এইসব কথা বললে,মেয়েটা কান্নাকা**টি শুরু করবে,যেটা মাহির একদমই চায় না।কারণ,তোহা ওর শ্বশুর,শাশুড়ি সহ ওর মাকে প্রচুর সময় দেয়,এই মুহুর্তে এগুলো বললে হয়তো বারবার ফোন দিয়ে পা**গল করে ফেলবে।এর থেকে বাসায় গিয়ে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু বুঝিয়ে বলবে।’
ভেবে তোহার সাথে নিধির কোনো বিষয়ে কথা বলে নি মাহির।”

“মাহির হসপিটালের পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি পার্ক করে, নিধিকে নিয়ে হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করে তার পরিচিত ড. মায়া চৌধুরীর কেবিনে নিয়ে গেলো।ড. মায়া চৌধুরী একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। তিনি মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা যেমন, উদ্বেগ, অবসাদ, ও মানসিক রোগের চিকিৎসা এবং পরামর্শ প্রদান করেন।”

” ড.মায়া কয়েকজন রোগী দেখে,মাত্রই চায়ের কাপে ঠোঁট জোড়া লাগাতেই,মাহির নিধিকে নিয়ে তার কেবিনে প্রবেশ করে সালাম দেয়।”

“মাহিরের সালামের জবাব দিয়ে,তিনি নিধির দিকে তাকাতেই বিস্ময় ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

‘নিধি, তুমি এখানে?’

“কেবিনে ঢোকার পর নিধি ফ্লোরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিলো।কর্ণকুহরে পরিচিত একটি নারী কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই,নিধি ড.মায়ার দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো।অতঃপর বিস্ময়ের সুরে বললো,

‘আন্টি,আপনি এই হসপিটালে জব করেন?কিন্তুু আপনি তো বলেছিলেন,আংকেল আপনাকে জব করতে দিবে না।’

“নিধির মুখনিঃসৃত ‘আংকেল’ শব্দটি শুনতেই,মায়াবী মুখস্রি চুপসে গেলো ড. মায়ার।তিনি ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

‘সে অনেক কথা।আগে চেয়ারে বসো।আগের বাসাটা ছেড়ে দেওয়ার পর,প্রায় ৭বছর পর তোমার সাথে দেখা হলো।কেমন আছো?আর ড.মাহির কি তোমার পরিচিত?’

“ড.মায়া এবং নিধির কথপোকথন শুনে মাহির বুঝতে পারলো,যে তারা পূর্ব পরিচিত।তাই সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে, মাহির নিধির সাথে তার সম্পর্কের কথা বুঝিয়ে বললো।”

“ড.মায়া নিধির শুষ্ক ঠোঁটজোড়া, ক্লান্ত চাহনী এবং অসহায় মুখস্রি দেখে বুঝে ফেললেন,কিছু একটা হয়েছে।নইলে,মাহির তো ওকে এখানে নিয়ে আসতো না।’
ভেবে,তর্জনী দিয়ে চশমা ঠিক করে নিধিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘চা বা কফি খাবে?’

“মাহির ম্লান হেসে বললো,

‘ম্যাম,নিধি আপু সকাল থেকে কিছু খায় নি।হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে দুপুরের খাবার অর্ডার দিলে ভালো হতো।’

“ড.মায়া নিধির নিচু করে রাখা মুখস্রির দিকে তাকিয়ে এসিস্ট্যান্ট কে ডাক দিয়ে ক্যান্টিন থেকে খাবার আনতে বললেন।
তার কথা মতো কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার চলে এলো।ড.মায়া নিধির হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত করে বললেন,

‘আগে খাবার গুলো খেয়ে নাও।তারপর সবকিছু শুনবো।’

“মায়ার কথা মতো, নিধি প্লেটে থাকা খাবার দেখে হাত ধুয়ে খাবার খেতে লাগল।প্লেটের অর্ধেক খাবার খাওয়ার পরমুহূর্তে নিধির নির্জনের কথা মনে পড়লো।ভাবলো,

‘নির্জন কে তো রুমে তালাবদ্ধ করে রেখেছি।সেও তো না খেয়ে আছে।এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো।’

কথাগুলো ভাবতেই চোখের কোণে নোনাজল চলে এলো নিধির।
নিধির মুখস্রির এহেন দৃশ্য নজর এড়ালো না ড.মায়া এবং মাহিরের।”

“নিধি হাত ধুয়ে বললো,সে বাকিটুকু খাবার আর খেতে পারবে না।”

“ড.মায়া আর কথা বাড়ালেন না।এসিস্ট্যান্ট এসে টেবিল পরিষ্কার করে খাবারগুলো নিয়ে যেতেই,মায়া নিধির পানে চেয়ে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এইবার বলো তো,এই মিষ্টি চেহারার মেয়েটা এত বিষন্ন কেনো?তোমার এই হাল হলো কিভাবে?’

“মাহির নিধিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

‘নিধি আপু, আপনি ম্যাম কে সবকিছু খুলে বলুন।আশা করি, তিনি সঠিক সমাধান দিতে পারবেন।’

“নিধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলের ওপর দৃষ্টি রেখে, মলিন স্বরে ড.মায়াকে নির্জনের অতীত কাহিনী থেকে শুরু করে, এই পর্যন্ত ওর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা বুঝিয়ে বললো।
অতঃপর হেঁচকি তুলে কান্না করে উঠলো।”

“নির্জনের অতীত কাহিনীগুলো শুনে ড.মায়ার চোখেও অশ্রু জমা হলো।প্রতিনিয়ত এমন কতশত পেশেন্টের জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলো শুনে, সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।সত্যি, একটা মানুষের জীবন পরিবর্তন হওয়ার জন্য,তার অতীতের কিছু তিক্ত ঘটনাই যথেষ্ট।’
‘ভেবে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে নিধির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘হুম,তোমার বর্ণনা শুনে আমার এতদিনের অভিজ্ঞতায় মনে হলো,
তোমার হাজবেন্ড নির্জন Borderline Personality Disorder (BPD),
Obsessive-Compulsive Personality Disorder (OCPD)
এবং
Obsessive Love Disorder(OLD)
এই ৩টি রোগে ভুগছে।”

“কারণ,নির্জন ছোটবেলায় তার মায়ের রে**পের সাক্ষী ছিলো। সেই ভ**য়াবহ দৃশ্য তার কচি মনে গভীর ক্ষ**ত তৈরি করে।এরপর, তার সৎ মা তাকে দিনের পর দিন নি**র্যাতন করেছে, তাকে অন্ধকার রুমে আটকে রেখেছে এবং শারীরিক, মানসিক অ**ত্যাচার করেছে। এ ধরনের ট্রমা একজন শিশুর মনের গভীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। সেই অতীতের ভ**য়াবহতার সঙ্গে বড় হতে হতে নির্জন ধীরে ধীরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং অবচেতনভাবে নিজের মনকে এই কষ্টের সাথে মানিয়ে নেয়। কিন্তু তার মধ্যে জন্ম নেয় ৩টি মানসিক রোগ-

“১.Borderline Personality Disorder (BPD) এবং ২.Obsessive-Compulsive Personality Disorder (OCPD)।
এবং
৩.Obsessive Love Disorder(OLD)”

“ড.মায়ার এহেন কথা শুনে মাহিরের মুখস্রি স্বাভাবিক থাকলেও, নিধি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘মানে?’

“ড.মায়া বললেন,
‘রিল্যাক্স,বলছি।’

“১|BPD (Borderline Personality Disorder)এর লক্ষণঃ
এই রোগে আক্রান্ত মানুষরা গভীরভাবে ভীত থাকে, তারা ভয় পায় যে তাদের কাছের মানুষরা তাদের ছেড়ে চলে যাবে বা তাদের ভালোবাসবে না। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় তাদের জীবন সঙ্গীকে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা অনুভব করে এবং সেই কারণেই অতিমাত্রায় পজেসিভ হয়। তাই তারা প্রতিটি পরিস্থিতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চায় এবং অন্যদের থেকে আশ্রয় নিতে চায়।”

নির্জনের BPD-এর লক্ষণগুলো হলোঃ

১. ইমোশনাল ইন্সট্যাবিলিটি: নির্জনের আবেগের মধ্যে স্থিতিশীলতা নেই। সে কখনো তোমাকে চরম ভালোবাসে, আবার কখনো অযথা সন্দেহ করে এবং রেগে গিয়ে তোমাকে আ**ঘাত করে।

২. আবেগের বিপুল ওঠাপড়া: BPD রোগীরা অল্প সময়ের মধ্যেই উন্মত্ত ভালোবাসা এবং চরম ক্ষো**ভের মধ্যে দুলতে থাকে। নির্জনের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। সে কখনো তোমাকে জীবনের সবকিছু মনে করে, আবার কখনো মনে করে তুমি তাকে ধোঁকা দিচ্ছো।

৩. শূন্যতার অনুভূতি: নির্জনের মন প্রায়ই শূন্যতায় ভরে থাকে। সে সবসময় তোমাকে নিজের জীবনের কেন্দ্র মনে করে, কিন্তু তাও তার মনে হয় কিছু একটা হারিয়ে গেছে।

৪. আত্মপরিচয়ের সমস্যায় ভোগা: BPD রোগীরা প্রায়ই নিজেদের ব্যক্তিত্ব বা পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত থাকে। নির্জন কখনো নিজেকে তোমার প্রতিরক্ষক মনে করে, আবার কখনো তোমার প্রতি হিং**স্র হয়ে ওঠে।

৫. পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা: BPD আক্রান্তদের সম্পর্কের জটিলতা তাদের জীবনের প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তারা কারো কাছ থেকে একটু দূরত্ব অনুভব করলেই, মনোবেদনায় ভুগতে থাকে।

২|OCPD (Obsessive-Compulsive Personality Disorder) এর লক্ষণ হলোঃ

“নির্জনের OCPD-এর কারণে সে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চায়।তোমার প্রতি তার ভালোবাসাও এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বন্দী হয়ে যায়। ড. মায়া বলেন,

‘OCPD-এর কারণে নির্জন সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম রকমের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।তুমি কোনোভাবেই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে সে প্রচণ্ডভাবে রেগে যায় এবং হিং**স্র আচরণ করে। এই নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা থেকেই সে তোমাকে বন্দী করে রাখতে চায় এবং এমনকি তুমি কারো সঙ্গে মিশলে বা কোনো কিছুকে বেশি গুরুত্ব দিলে তার ভ**য়ং*কর হিংসা হয়।”

নির্জনের OCPD লক্ষণগুলোঃ

১.পারফেকশনিজম: নির্জন তার সবকিছুকে পারফেক্ট রাখতে চায় এবং সে একই নিয়মে তোমাকেও চলতে বাধ্য করে। এটি তার ব্যক্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. কঠোর নিয়ন্ত্রণ: সে সবসময় মনে করে, তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিছু হলে জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে। সম্পর্কেও সে চায় তুমি তার নির্দেশ মেনে চলো, নাহলে তার হিংসা জন্মায়।

৩. শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা: OCPD আক্রান্তরা সম্পর্কেও অযথা নিয়মকানুন চাপিয়ে দেয়, যা নির্জনের ক্ষেত্রে তোমার জীবনে হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি।

৩|OLD (Obsessive Love Disorder) নির্জনের মধ্যে লক্ষণসমূহঃ
১. অতিরিক্ত পজেসিভনেস: নির্জন তোমাকে নিয়ে পা**গলের মতো পজেসিভ।সে তোমাকে এমনভাবে ভালোবাসে যে,তোমার উপর পুরোপুরি অধিকার করতে চায়। তার মতে, তোমার উপর শুধু তারই অধিকার থাকতে হবে, এবং তুমি অন্য কারো সাথে মিশলে সে সেটিকে সহ্য করতে পারে না।

২. নজরদারি: নির্জন সবসময় তোমার উপর নজর রাখে। সে তোমার ফোন কল, মেসেজ, যোগাযোগ সবকিছুতেই নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়।

৩. সম্পত্তি মনে করা: তার ভালোবাসা তোমার প্রতি নয়, বরং তোমাকে নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণে রাখার চরম আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে। তোমার স্বাধীনতা সে সহ্য করতে পারে না।

৪.প্রতিক্রিয়াশীল হিংসা: যখনই মনে হয় যে তুমি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছো, নির্জন প্রচণ্ড রেগে গিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে।যার ফলে আজ পর্যন্ত তুমি তার এতগুলো আ**ঘাত এবং হিং**স্রতার সম্মুখীন হয়েছো।”

“এটাকে বলা হয় ম্যানিপুলেট (Manipulate)।এই শব্দের অর্থ হলো,কাউকে বা কোনো পরিস্থিতিকে নিজের সুবিধামতো পরিচালনা বা প্রভাবিত করা। ম্যানিপুলেশন সাধারণত গোপনভাবে করা হয়, যাতে অন্য ব্যক্তি বুঝতে না পারে যে তাকে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এটি ইতিবাচক বা নেতিবাচক উভয়ভাবেই হতে পারে, তবে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয় বেশি, যেমন কোনো ব্যক্তিকে ঠকিয়ে বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করা।
ধরতে পারো, এটা কিছুটা ‘ডার্ক রোমান্সের’ ক্ষুদ্র একটি অংশ,যেটা আমরা সাধারণত ইংরেজি উপন্যাস গুলোতে পড়ে থাকি।তবে বাস্তবিক জীবনে এই ঘটনাগুলো এতটাও ব্যাপক নয়।ডার্ক রোমান্স হলো, যেখানে ভালোবাসার সঙ্গে অন্ধকার, বিপদ, এবং মানসিক বা শারীরিক যন্ত্রণা মিশে থাকে। এতে সম্পর্কগুলো সাধারণত জটিল, গভীর এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হতে পারে।এই মানুষগুলো চরিত্রগুলোর মধ্যে পজেসিভনেস, ম্যানিপুলেশন, ট্রমা, কিংবা কখনো কখনো সহিংসতাও থাকতে পারে।তাছাড়া নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং অন্ধকার দিক থাকে। তবে, এই অন্ধকারের মধ্যেও তাদের সম্পর্কের মধ্যে কিছু গভীরতা এবং আকর্ষণ থাকে।ডার্ক রোমান্সের সৌন্দর্য তার অস্বাভাবিক ও বিপজ্জনক প্রেমের মধ্যে লুকানো থাকে, কিন্তু সেটি কখনো কখনো ভ**য়াবহ এবং অস্বস্তিকর অনুভূতি তৈরি করতে পারে।তবে এগুলো ফিকশনাল জেনার।বাস্তব জীবনে এই ধরণের মানুষগুলো আমাদের জন্য বিপজ্জনক।
আশা করি, বুঝতে পেরেছো।”

“ড.মায়ার একাধারে বলা কথাগুলো শুনে,নিধি শুকনো ঢোক গিলে বললো,

‘এই রোগের কি কোনো চিকিৎসা নেই, আন্টি?নির্জন কি সবসময় এমনই থাকবে?আমি কি কখনো তাকে সুস্থ অবস্থায় পাবো না?’

“নিধির করুণ কন্ঠস্বর শুনে, ম্লান হাসলেন ড. মায়া।তার জীবনেও তো কত কষ্ট!অথচ,তিনি সবসময় অন্যের কষ্ট লাঘব করার চিন্তায় মগ্ন থাকেন।কারণ,এটাই তার পেশা।এই পেশা টা কে খুব সম্মান করেন মায়া।যখন মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীদের পরিবার তার কাছে তাদের কষ্টের কথাগুলো বলে,তখন তিনি তাদের সঠিক পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন।পরমুহূর্তে, সেই রোগীগুলো যখন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়,তখন যেই আনন্দ টা তিনি পান,সেটাই তো তার কাছে সবচেয়ে তৃপ্তির জায়গা মনে হয়।’

ভেবে নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে নিধির কাঁধে হাত রেখে বললেন,

‘তুমি এত বোকা হলে কবে থেকে, বলো তো?তুমি তো খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিলে।অথচ, সেই দুষ্টু স্বভাবের মেয়েটা কত শান্ত হয়ে গেছে,ভাবা যায়?ডোন্ট ওয়ারি,নিধি।সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।আচ্ছা শোনো,

নির্জনের এই রোগগুলো ধীরে ধীরে তার জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।তাই তাকে Cognitive Behavioral Therapy (CBT) এবং Dialectical Behavioral Therapy (DBT), উভয় থেরাপি একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। BPD রোগীদের জন্য DBT খুবই কার্যকর।কারণ,এটি আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। OCPD-এর জন্য CBT প্রয়োগ করে তার নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা কমিয়ে স্বাভাবিক জীবনধারা ফিরিয়ে আনা হবে।”

BPD-এর চিকিৎসায় DBT:

১. আবেগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা: DBT নির্জনকে শেখাবে কীভাবে তার অতিমাত্রায় আবেগের ওঠাপড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং কীভাবে তার আবেগকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে।

২. পরিপূর্ণতা এবং মিথ্যাবোধ: এই থেরাপি নির্জনকে শেখাবে যে তার মধ্যে যে শূন্যতার অনুভূতি এবং সম্পর্কের ভীতিটা আছে, তা তার নিজস্ব আবেগের বি**কৃতি এবং বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।

৩. সম্পর্কের দক্ষতা উন্নয়ন: DBT নির্জনকে শেখাবে কীভাবে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়, যেখানে পজেসিভনেস বা নিয়ন্ত্রণের কোনো স্থান নেই, বরং পরস্পরকে সমানভাবে সম্মান এবং স্বাধীনতা দিতে হয়।

OCPD-এর চিকিৎসায় CBT:

১. নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা কমানো: CBT নির্জনকে শেখাবে যে, সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয় এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা মানুষকে আরো অস্থির করে তোলে।

২. কগনিটিভ পুনর্গঠন: নির্জনকে শেখানো হবে তার পারফেকশনিস্টিক চিন্তাভাবনাগুলো কিভাবে নেগেটিভ প্রভাব ফেলছে এবং এগুলোকে ধীরে ধীরে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তরিত করা হবে।

OLD এর চিকিৎসাঃ
১. সাইকোথেরাপি (থেরাপি):
কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT): এটি নির্জন কে তার অস্বাভাবিক চিন্তাধারা ও আচরণ চিহ্নিত করে,সেগুলো পরিবর্তন করতে সহায়তা করবে।

২.সাইকোডাইনামিক থেরাপি: এই থেরাপির মাধ্যমে নির্জনের পুরনো অভিজ্ঞতা এবং অবদমিত অনুভূতির কারণে সৃষ্ট মানসিক সমস্যাগুলোর গভীর বিশ্লেষণ করা হবে।”

৪|সব শেষে সাপোর্টিভ থেরাপি এবং পরিবারঃ
তোমারও এখানে একটি বিশাল ভূমিকা থাকবে। ড.মায়া নিধিকে বুঝিয়ে বলেন,

‘তোমার ভালোবাসা এবং ধৈর্য নির্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে ধীরে ধীরে এই মানসিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে।কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন থাকবে তোমার পাশে থাকা এবং তাকে বুঝতে চেষ্টা করা।কারণ,এই পৃথিবীতে এখন তুমি ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নেই।তোমার প্রতি তার এহেন নিষ্ঠুর আচরণ গুলো গড়ে উঠেছে, তার ভেতরে থাকা মানসিক রোগগুলোর কারণে।যেটা সে নিজেও জানে না।এই অবস্থায় তাকে সারিয়ে তুলতে তোমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে হবে।”

“নিধি করুণ স্বরে শুধালো,

‘কিন্তু, এখানে আসার আগে আমি তো তাকে রুমে আটকে রেখে এসেছি।তার চিকিৎসা কিভাবে করাবো?সে তো নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ দাবি করছে।’

“ড.মায়া ফোন উঠিয়ে কাউকে কল করে কিছু কথা বললেন।অতঃপর ফোন রেখে নিধির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘নিধি, নির্জনকে আটকানোর জন্য আমি বিশেষ একটি টিমকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।তুমি এবং মাহির তাদের কে নিয়ে যাবে। তারা খুব দক্ষ, কিন্তু তুমি জানো, এটা সহজ হবে না। নির্জন এখন এমন এক মানসিক অবস্থায় আছে, যেখানে সে খুবই বিপ*জ্জনক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তুমি ভে**ঙে পড়ো না। আমি জানি, তোমার জন্য এটা কতটা কষ্টের।’

“নিধি মাথা নিচু করে বসে আছে।তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে। এই মুহূর্তে সে অনুভব করছিলো কেমন যেন এক দ্বন্দ্ব এবং বি**ষাদের মধ্যে আছে। একদিকে নির্জনের প্রতি তার ভালোবাসা, আর অন্যদিকে তার ভ*য়ং**কর আচরণ থেকে মুক্তির তৃষ্ণা।তার হৃদয় দোটানায় ভুগছে।নির্জন, যাকে সে একসময় ভালোবেসেছিলো, সেই আজ তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তবুও, তাকে এভাবে আটকে রাখা, তাকে নিজের হাতে বন্দী করা,নিধি নিজেকে প্রবল অপরাধবোধে আচ্ছন্ন মনে করছিলো।”

“ড.মায়া বুঝতে পারছিলেন,নিধির মনের অবস্থা। তিনি কোমলভাবে নিধির হাতে হাত রেখে বললেন,

‘তুমি যদি নির্জনের ভালো চাও, তাহলে এই কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নেওয়াটা অপরিহার্য। সে নিজেকে ধ্বং**সের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আর সেই সঙ্গে তোমাকেও। এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে গেলে, তার চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।’

“নিধি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,

‘কিন্তু,আন্টি ও তো আমাকে ভালোবাসে। কেনো এমন হলো?কেনো তার ভালোবাসা এত অন্ধকার,নিষ্ঠুর আর নিয়ন্ত্রণময় হয়ে উঠল?’

“ড.মায়া একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলেন,

‘ভালোবাসা যখন সীমাহীন হয়ে যায় এবং সেই সঙ্গে মানসিক অসুস্থতার মিশ্রণ থাকে, তখন তা ভ**য়ং*কর হয়ে ওঠে। ভালোবাসা আর নিয়ন্ত্রণ যখন একসঙ্গে মিশে যায়, তখনই সম্পর্কটি এক ধরনের বিপদে পরিণত হয়। নির্জন তোমাকে ভালোবাসে, কিন্তু তার ভালোবাসার মধ্যে পজেসিভনেস এবং হিংসার মিশ্রণ আছে, যা তাকে মানসিকভাবে বি*পজ্জনক করে তুলেছে।’

“এই কথা শুনে, নিধির হৃদয় ভারী হয়ে উঠল। সে জানত, নির্জন তাকে পা**গলের মতো ভালোবাসে, কিন্তু সেই ভালোবাসা এখন তাকে কষ্টের জালে বন্দী করেছে। নিধি অনুভব করছিলো যে, তার এই কঠিন অবস্থান থেকে বের হতে হবে। তবুও, নির্জনের জন্য তার মনের গভীরে থাকা ভালোবাসা তাকে আরও দুর্বল করে তুলছিলো।
অবশেষে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর,নিধি নাদিয়াকে ফোন করে সংক্ষেপে কিছু ঘটনা বললো।নাদিয়ার শরীর খারাপ থাকায়,দিগন্ত ওর মন ভালো করার জন্য বিভিন্ন ধরনের মজার কথা বলছিলো।নিধি ফোন দেওয়ার পর নাদিয়া ফোন লাউডস্পিকারে রেখে কথা বলে।আর পাশ থেকে দিগন্ত সবকিছু শুনে হতভম্ব হয়ে যায়।তার প্রিয় বন্ধু কিনা এতদিন,এতটা মানসিক অবসাদে ভুগছিলো?অথচ,সে তার এতটা কাছে থেকেও,ছিটেফোঁটাও জানত না।’
ভেবে মন বিষন্ন হয় দিগন্তের।তৎক্ষনাৎ বিছানা থেকে উঠে নাদিয়াকে বলে,রেডি হয়ে নির্জনের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।”

“এদিকে নিধি এবং মাহির নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে নির্জনের বাসায় পৌছে যায়।”

“সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সবাই শুনতে পেলো, ভেতর থেকে নির্জনের ভ**য়ানক চি**ৎকার ভেসে আসছে। তার কণ্ঠে আ**তঙ্ক, রাগ, আর নিধির জন্য অদম্য তৃষ্ণা।বারবার একই কথা ভেসে আসছে,

‘নিরু! তুমি কোথায় গেলে? আমাকে ফেলে যেতে পারবে না, তুমি আমার, শুধু আমার।আমার সাথে বিশ্বাসঘা*তকতা করলে,এর শাস্তি তুমি পাবে।’

“নিধি মুখ চেপে ধরে কান্না আটকে দরজা খুলে দিতেই দেখলো, নির্জন দরজায় ধা**ক্কা দিতে দিতে তার হাত র**ক্তাক্ত হয়ে গেছে।দুই হাত এবং পায়ের কা**টা জায়গায় নিজেই ব্যান্ডেজ করেছে।
নির্জনের শরীর থেকে ঘাম ঝরছিলো, এবং চোখগুলো আ**গুনের মতো জ্বলছিলো।”

“নিধিকে দেখে পা**গলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো নির্জন।কপালে চুমু দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘তুমি জানো,তুমি ছাড়া আমার পৃথিবী অর্থহীন মনে হচ্ছিলো।কোথায় ছিলে তুমি,হ্যা?তোমার সাহস তো কম নয়!মায়ের মতো তুমিও কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও,হ্যা?’

কথাগুলো বলতে বলতেই নিরাপত্তা বাহিনী,মাহির এবং দিগন্ত রুমে চলে আসলো।
নির্জন তাদের দিকে তাকিয়ে প্রথমে থমকে গেলো।”

“নিধিকে ছেড়ে দিয়ে,ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘১,২,৩,৪,৫…উফফ!বিরক্ত লাগছে।এতগুলো পুরুষ এখানে কেনো?আর তুৃমি বোরকা ছাড়া কেনো?এরা যে তোমাকে দেখছে,সেদিকে কি তোমার খেয়াল নেই,হুম?’

বলেই দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘এই, তুই আমার বাড়িতে এসেছিস কেনো?যাহ,বেরিয়ে যা।আজ থেকে তোদের সবার এই বাড়িতে আসা নিষেধ।কেউ আসতে পারবে না।এখানে শুধু আমি আর আমার ডার্ক কুইন থাকব।’

“নির্জনের কথা শুনে, দিগন্ত যা বোঝার বুঝে গেলো।ওর সন্দেহ গুলো সব সত্যি ছিলো।
ভেবে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

“আমরা তোর ভালোর জন্য এসেছি নির্জন।তুই অসুস্থ,তোকে হসপিটালে নিয়ে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হবে।তাহলেই তুই সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবি।’

বলেই নির্জনের হাত ধরতে নিলে,নির্জন দিগন্তের বুকে খুব জোরে ধা**ক্কা দিয়ে কর্কশ স্বরে বলে উঠলো,

‘তোকে না বলেছিলাম,আমাকে স্পর্শ করবি না।তবুও এত দুঃসাহস দেখালি কেনো?আজ তো তোকে…

কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই নিরাপত্তা বাহিনী,দ্রুত নির্জন কে ধরে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করলো। তারা জানত, নির্জন ভ**য়ঙ্কর হতে পারে।”

“নির্জন কে এভাবে সবাই স্পর্শ করায়,নির্জন নিজেকে ছটফট করতে করতে মাটিতে আছড়ে ফেলছিলো, কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী তাকে ধরে রেখেছিলো। তার চোখে এক ধরণের পা**গলামি দেখা যাচ্ছিলো, যেখানে নিধির প্রতি তার আবেগ যেন পুরোপুরি তাকে গ্রাস করে নিয়েছে।”

“এদিকে,নির্জনের কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিধি এই দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারছিলো না। তার কান্না থামছিলো না, আর মন যেন ভে**ঙে যাচ্ছিলো। একসময় সে তার মুখ ঢেকে কান্নায় ভে**ঙে পড়লো। তার চোখে জল নিয়ে সে নিজের ভেতরকার যন্ত্রণাকে ধরে রাখতে পারছিলো না।”

“নির্জনের এই অবস্থা দেখে নিধির হৃদয় কেঁপে উঠলো।সে ভালোবাসতো নির্জনকে, কিন্তু এই ভালোবাসা তাকে কতটা বিপদে ফেলেছে, সেটা আজ সে পুরোপুরি বুঝতে পারলো।সেই মুহূর্তে সে জানত, নির্জনের এই ভ**য়াবহ মানসিক অবস্থার জন্য তারা দুজনেই ক্ষ**তিগ্রস্ত হয়েছে।তাই তো আজ সে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

কথাগুলো ভেবে,নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সবার সামনে হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠলো নিধি।”

“এদিকে নির্জন নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে,তাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।কিন্তু এইবার আর পারলো না।তারা নির্জনের হাত জোড়া খুব শক্ত করে বেঁধে দিলো এবং মেডিকেল টিমের একজন সদস্য এসে তার বাহুতে সতর্কতার সহিত ইনজেকশন পুশ করতেই,ধীরে ধীরে নির্জনের উগ্র মস্তিষ্ক এবং পুরো শরীর অসংলগ্ন হয়ে পড়লো।”

#চলবে..

#হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ
#পর্বঃ৪৬
#লেখিকাঃমেহের_আফরোজ
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“তারা নির্জনের হাত জোড়া খুব শক্ত করে বেঁধে দিলো এবং মেডিকেল টিমের একজন সদস্য এসে তার বাহুতে সতর্কতার সহিত ইনজেকশন পুশ করতেই,ধীরে ধীরে নির্জনের উগ্র মস্তিষ্ক অসংলগ্ন হয়ে পড়লো।”

“নির্জনকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো,নিধি যেন কিছুই করতে পারছিলো না।শুধু প্রিয় মানুষটির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকল।তার সারা শরীর শীতল হয়ে এলো,বুকের ভেতরটা ভা**ঙতে শুরু করলো।নির্জনের হাত দুটি শক্ত করে বাঁধা,আর চোখে-মুখে ধীরে ধীরে নেমে আসা অসংলগ্নতার ছায়া দেখেই নিধির বুকটা হাহাকার করে উঠল।সেই নির্জন,যাকে সে এত ভালোবাসে,এখন তাকে কেমন নিস্তেজ,কতটা অচেনা লাগছে।”

“নিধির চোখের কোনে অশ্রু জ্বলজ্বল করছে,কিন্তু সে জানে,এই কান্নার কোনো অর্থ নেই।নিধি এগিয়ে যেতে চেয়েও আটকে থাকল,যেন কেউ তার পা দুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে।নির্জনের কষ্ট,তার এই অবস্থাটা তাকে ভেতর থেকে ছিঁড়ে ফেলছিলো।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো,
“তবে এটাই কি শেষ…?”

ভেবে,নির্জনের নিস্তব্ধ চোখের দিকে এক ঝলক তাকালো,যেন ভেতরে কোথাও সেই আগের নির্জনকে খুঁজতে চায়।কিন্তু সমস্ত কিছুই যেন ফিকে হয়ে গেছে।”

“নির্জন কে নিয়ে যাওয়ার পর নিধির কাছে এসে দিগন্ত মলিন স্বরে বললো,

‘নিধি,তুমি চিন্তা করো না;নির্জন আবার সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে।ততদিন তোমাকে একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।’

“নিধির দৃষ্টি সদর দরজার দিকে আবদ্ধ।দিগন্তের কথায় কোনো সাড়া দিলো না সে।দিগন্ত বুঝতে পারলো,নির্জনের আচরণগুলো নিধির ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে।এই মুহূর্তে এই বাসায় নিধিকে একা রেখে গেলে,সেও হয়তো অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।’
ভেবে দিগন্ত,মাহির কে ইশারা করে নিধির সাথে কথা বলতে বললো।”

“মাহির চোখের পলক ফেলে দিগন্তের ইশারায় সায় জানিয়ে,নিধির কাছে এসে ভরসার সহিত বললো,

‘আপু,দিগন্ত ভাইয়া ঠিকই বলেছে।নির্জন ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে।জানি,এতদিন আপনার ওপর দিয়ে কতটা মানসিক প্রেশার গিয়েছে।কিন্তু দেখবেন,সঠিক চিকিৎসা পেলে ভাইয়া ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে।আর এখন আপনার এই বাসায় একা থাকাটা উচিত হবে না।আপনি আমার সাথে আমাদের বাসায় চলুন।সেখানে আপনার বোন,মা আছে।তাদের সাথে কথা বললে,আপনার মন কিছুটা হালকা হবে।প্লিজ চলুন,আপু।’

“মাহিরের মায়া ভরা কন্ঠে কথা শুনে,নিধি ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

‘নাহ!আমি এখানেই থাকব।এখান থেকেই আমার স্বামীকে প্রতিদিন দেখতে যাবো।আমাকে জোর করবেন না,ভাইয়া।’

“মাহির বুঝতে পেরেছে,নিধির মন-মস্তিষ্ক জুড়ে এখন শুধু নির্জনের কাহিনী গুলো ঘুরছে।কিন্তু এখানে থাকলে প্রতিটি পদে পদে সে নির্জনের ঘটনাগুলো মনে করবে,যেটা মানসিক ভাবে অসুস্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হবে।’
ভেবে নিধির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আপু,আপনি তো আর দীর্ঘদিনের জন্য আমাদের বাসায় যাচ্ছেন না।নির্জন ভাইয়া যতদিন হসপিটালে ভর্তি থাকবে,ততদিন থাকবেন।তাছাড়া আপনার বোন,আর মায়ের সাথেও তো আপনার অনেক দিন যাবৎ দেখা হয়নি।যেহেতু আপনার মা এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি,এমতাবস্থায় আপনি তার পাশে থাকলে,তার কাছেও ভালো লাগবে।’

“মাহিরের যুক্তিযুক্ত কথা শুনে,নিধি আর কিছু বলতে পারলো না।কোনো কথা না বাড়িয়ে কাভার্ড থেকে কিছু জামা-কাপড় বের করে,ব্যাগে ভরে নিলো।অতঃপর দিগন্তের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাহিরের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।”

“মাহিরের বাসায় যাওয়ার পর নিধির মলিন মুখস্রি দেখে, তোহা এবং তাহমিনা বেগমের মন খারাপ হয়ে যায়।তারা কিছু জিজ্ঞেস করতে নিলে,মাহির তাদের ইশারা করে থামিয়ে দেয়।অতঃপর রাতে খাওয়া-দাওয়া করার পর,নিধি নিজে থেকেই তাহমিনা বেগম কে জড়িয়ে ধরে পুরো ঘটনা খুলে বলে।সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে যান তাহমিনা বেগম,সেই সাথে তোহাও।
নিজের বড় মেয়েকে কি বলে স্বান্তনা দিবেন,সে ভাষাগুলোও যেন সে হারিয়ে ফেলেন।এদিকে নির্জনের অতীতের কষ্টের কাহিনী এবং পা**গলামি ঘটনা গুলো শুনে,তোহা যেন বিস্ময়ের শীর্ষে চলে গেলো।ও ভাবতে লাগল,

‘আপু তো একসময় এমন একজন সাইকো প্রেমিক চাইতো,কিন্তু নির্জন ভাইয়া কে দেখে তো একদমই সেরকম মনে হয় নি।শেষ পর্যন্ত আপুর সাথেই এগুলো হওয়ার ছিলো?’
আর কিছু ভাবতে পারলো না তোহা।ইদানীং কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করলে,নিজের কাছে বিরক্ত লাগে তোহার।মাথা খুব ভারী অনুভব হয়,খাবারেও অরুচি,সেই সাথে মুড সুয়িং তো আছেই।”

“রাতে মাহির তোহা কে নির্জনের মানসিক রোগ সম্পর্কেও বুঝিয়ে বললো।সবকিছু শুনে তোহা মাহির কে আশ্বস্ত করলো,
‘নিধি কে সবসময় মানসিক ভাবে ভালো রাখার চেষ্টা করবে।ছোট বোন হিসাবে এতটুকু দায়িত্ব তাকে পালন করতেই হবে।’

‘তোহার কথা শুনে মাহির তার স্বপ্ন-চারিনীর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।’

‘মাহিরের স্নিগ্ধ পরশ পেয়ে,মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো তোহা।ভাবতে থাকল,

‘আমি কত সৌভাগ্যবতী,যে মাহিরের মতো একজন আদর্শ স্বামী পেয়েছি।যে কিনা সব দিক থেকে পারফেক্ট।’

———
“রাত সাড়ে ১১টা।এখনও চোখজোড়া বন্ধ নির্জনের।একজন নার্স কিছুক্ষণ পর পর এসে দেখে যাচ্ছে,নির্জনের জ্ঞান ফিরলো কি না।”

“নির্জন কে যখন মানসিক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়,তখন তার সেন্সলেস অবস্থায় মেডিকেল টিম তাকে দ্রুতই পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায়,যেন তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দ্রুত মূল্যায়ন করা যায়।”

“নির্জনের নিস্তেজ শরীর নিয়ে ডাক্তারেরা তাকে প্রথমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করেন।প্রথমে ব্লাড টেস্ট করেন।শরীরে কোনো বি**ষাক্ত উপাদান আছে কি না,তা যাচাই করার জন্য এবং ওষুধের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য।
তারপর ব্রেইন স্ক্যান (CT/MRI) করা হয়।মস্তিষ্কের কার্যকলাপ স্বাভাবিক আছে কি না এবং সেখানে কোনো ক্ষতি বা অস্বাভাবিকতা আছে কি না তা দেখার জন্য।
তারপর ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাম (EEG) অর্থাৎ মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল কার্যকলাপ পরীক্ষা করা,যাতে কোনো ধরনের খিঁচুনি বা সাইকোটিক ব্রেকডাউনের কারণ বোঝা যায়।
তারপর হার্ট মনিটরিং করা হয়।নির্জনের হৃৎপিণ্ডের কার্যকলাপ পরীক্ষা করা হয়,যাতে তার শারীরিকভাবে কোনো ঝুঁকি আছে কি না বোঝা যায়।”

“ডাক্তারদের মনোযোগ ছিলো নির্জনের মানসিক ও শারীরিক স্থিতিশীলতার দিকে।তারা জানত,এ ধরনের মানসিক ব্রেকডাউনের ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি মস্তিষ্কে সরাসরি থেরাপি প্রয়োজন।”

“রাত ১২টার দিকে,নির্জন চোখজোড়া ধীরে ধীরে খোলা শুরু করে।প্রথমে তার চারপাশে অন্ধকারাচ্ছন্ন অচেনা জগৎ মনে হচ্ছিলো।ধীরে ধীরে,সে চোখ মেলে চারপাশের পরিবেশ দেখে,যেখানে শীতল সাদা আলো,হাসপাতালের যন্ত্রপাতি এবং ডাক্তারদের মুখ দেখা যাচ্ছিলো।”

“এভাবে অচেনা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করে,অবচেতন মনে তার মাথায় ভর করলো এক অস্থিরতা।
ভাবতে থাকল,

‘কোথায় আমি?কেনো এখানে?আমার নিরু,আমার ডার্ক কুইন কোথায়?আমার তো বাসায় থাকার কথা!’
কথাগুলো ভেবে নির্জন পুরনো কাহিনী গুলো মনে করার চেষ্টা করলো।কিন্তু ইনজেকশনের প্রভাবে মুহূর্তেই মস্তিষ্ক অসংলগ্ন হয়ে উঠল,আর সে হঠাৎ তীব্র পা**গলামি শুরু করলো।সে ছটফট করতে লাগল,ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রুঢ় স্বরে বললো,

‘আমি এখানে কিভাবে এসেছি?আমার ওয়াইফ কোথায়?আর আমার পুরো শরীরে এত ব্যথা কেনো?আমার জানা মতে,আমার কোনো এক্সিডেন্ট হয় নি।আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।তাহলে আমি এখানে কেনো?ওহ!বুঝেছি,নিরু আপনাদের কাছে আমার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে,যে আমি অসুস্থ,তাই না?উফফ!ওকে তো আজ আমি…’

বলেই বিছানা থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করলো।”

“ডাক্তাররা দ্রুততার সঙ্গে নির্জনকে আটকে ফেললো।একজন ডাক্তার চি**ৎকার করে বললেন,

“শান্ত হও নির্জন।আমরা তোমার উপকারের জন্য এখানে আছি।”

“কিন্তু নির্জনের ভেতরের অশান্তি আরও বাড়ছিলো।সে বাইরে যাওয়ার জন্য চি**ৎকার করতে থাকল।অতঃপর ডাক্তারের শরীরে আ**ঘাত করতে নিলেই,৩ জন পুরুষ এসে তাকে বেডে শক্ত করে বাঁধল,যেন সে নিজেকে এবং অন্য কাউকে আ**ঘাত করতে না পারে।”

“ডাক্তাররা দ্রুতই নির্জনকে সেডেটিভ ইনজেকশন পুশ করে দিলো,যাতে সে শান্ত হতে পারে।কিন্তু ইনজেকশন দেওয়ার সময়েও তার চোখে ছিলো অবর্ণনীয় ভয় এবং আ**তংক,যেন সে বুঝতে পারছে না,কি হচ্ছে তার সাথে।তার শরীর অল্প অল্প করে শান্ত হলেও,মনের ভেতর সেই কষ্টটা তখনও প্রজ্বলিত ছিলো।”

“কিছুক্ষণ পরে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেন যে,নির্জনের মানসিক অসুস্থতা এতটাই গুরুতর যে তাকে ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ECT) দেওয়া হবে।এটি তার মস্তিষ্কের রসায়নে সাময়িক পরিবর্তন এনে,তাকে স্থিতিশীল করতে পারে।তাকে অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হয়,যাতে সে অচেতন অবস্থায় থাকে।এরপর হালকা ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়।নির্জনের শরীর হালকা খিঁচুনি দিতে শুরু করে,ডাক্তাররা মনোযোগ সহকারে তার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।”

“এছাড়া,ডাক্তাররা তাকে অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ যেমন হ্যালোপেরিডল বা রিসপেরিডন দিতে শুরু করে,যা তার মানসিক বিভ্রান্তি কমিয়ে স্থিতিশীল রাখবে।ওষুধগুলো তার মস্তিষ্কের চিন্তা এবং অনুভূতির অতি সক্রিয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে।”

“যদিও নির্জন ইলেকট্রিক শকের সময় সরাসরি কোনো ব্যথা অনুভব করেনি।তবে অচেতন থাকার পর,যখন সে ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পেতে শুরু করলো,তখন তার মাথা ভারী আর অস্থির ছিলো।মনে হচ্ছিলো,পুরো শরীর যেন অন্য কারো হয়ে গেছে।কিছুই তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই।ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তার শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিলো,আর স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো।নির্জন বুঝতে পারছিলো না সে কে,কোথায় আছে বা কেনো এতটা কষ্ট হচ্ছে।এই মানসিক অসহায়ত্ব আর বিভ্রান্তি ছিলো তার সবচেয়ে বড় কষ্ট।”

“জ্ঞান ফেরার পর নির্জন আ**র্তনাদ করে উঠল,

‘আমার মাথায় কিছু হচ্ছে।আমাকে বাঁচাও!প্লিজ,আমাকে মুক্তি দাও।’

“ডাক্তাররা তখনও তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলো,কিন্তু তার কষ্টের গভীরতা এতটাই তীব্র ছিলো,যে কেউই তা পুরোপুরি বুঝতে পারছিলো না।”

“ইলেকট্রিক শক এবং ওষুধের পরেও,নির্জনকে কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।তাই ডাক্তাররা তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য মেন্টাল হেলথ ইউনিটে নিয়ে গেলো,যেখানে অন্যান্য মানসিক রোগীরাও থাকে।সেখানে তার চারপাশে বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষ থাকবে।”

“সেই ইউনিটের বেডে শুয়ে বিভিন্ন মানসিক রোগীদের চেঁচামেচি কানে ভেসে আসতেই,নির্জন চোখ জোড়া মেলে দেখলো,কেউ কাঁদছে,কেউ চুপ করে বসে আছে,কেউ হাতে স্টিলের প্লেট আর স্টিলের চামচ নিয়ে ঘন্টা বাজাচ্ছে,আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত সব আওয়াজ করছে।আবার কেউ কেউ নিজের অজান্তে দেয়ালে মাথা ঠুকছে।”

“মানসিক রোগীদের এমন কার্যকলাপ দেখে,ফিক করে হেসে উঠলো নির্জন।মনে হয়,সে অনেক দিন পর হাসলো।বেড থেকে দুর্বল শরীর নিয়ে নেমে,তাদের কাছে গিয়ে বললো,

‘আপনারা পা**গল নাকি?হসপিটালের মধ্যে এভাবে কেউ চি**ৎকার করে?এতে রোগীদের অসুবিধা হয়।দেখছেন না,ওই বেডে একজন ঘুমাচ্ছে?অথচ আপনারা এখানে অযথা চি**ৎকার করছেন।’
বলেই দেয়ালে যেই লোকটি মাথা ঠুকছিলো,তার কাছে গিয়ে বুকের ওপর দুই হাত ভাজ করে বললো,

‘এভাবে নিজের ক্ষ*তি করছেন কেনো?নিজেকে কষ্ট দেওয়াতো বোকামি।আমার দিকে দেখুন,গতকাল থেকে কিছু পৈ**শাচিক মস্তিষ্কের মানুষ আমাকে অকারণে আটকে রেখেছে,অথচ আমি আমার ওয়াইফ কে ভীষণ মিস করছি।কিন্তু তারা কোনোভাবেই সেটা বুঝতে চাইছে না।অবশ্য এর পেছনে আমার ওয়াইফেরও অনেক ভুল আছে,তার শাস্তি সে অবশ্যই পাবে।যাইহোক,আমি এতটা কষ্টে থাকার পরেও নিজের ক্ষ*তি করিনি।আমার তো মনে হয় আপনি পা**গল,তাই নিজের ক্ষ*তি করছেন।’
বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো নির্জন।”

“নির্জনের কথা শুনে লোকটি বড় নখযুক্ত আঙ্গুল দিয়ে নির্জনের হাতে খুব জোরে খা**মচে দিয়ে বলতে থাকল,

“তুই পা**গল,তোর বংশ পা**গল,আমাকে তুই পা**গল বললি কেনো?তুই জানিস,আমি প্রবাসী;ইতালিতে টাকার পাহাড় গড়েছি,সেই পাহাড়ের নিচে একটা ঘর করেছি।আমার ঘরটি সোনা দিয়ে মোড়ানো।কিন্তু কিছু ব**দমাশ লোক আমার অর্থ সম্পদ দেখে,হিংসা করে এই পা**গলাগারদে আমাকে নিয়ে এসেছে,যত্তসব।”

“লোকটি নির্জন কে খা**মচে দেওয়ায়,নির্জন চোখ-মুখ কুঁচকে দুর্বল শরীর নিয়ে বসে পড়লো।অন্য সময় হলে
এই লোকটির হয়তো এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হতো।”

“এদিকে লোকটির অদ্ভুত সব কথা শুনে,প্লেট এবং চামচ হাতে নিয়ে থাকা লোকটি হো হো করে হেসে বলতে থাকল,

‘তোর তো দেখছি চাপার অনেক জোর।আরে তুই তো এখন ভিখারি,তোর জামা-কাপড় ও তো ছেড়া,ছ্যাহ!দেখ দেখ,এটা হলো সোনার প্লেট,আর হীরার চামচ।আমি তো এটাতে ছাড়া কোনো খাবার খেতেই পারি না।এখানে সবাই ভিখারি,আসল বড়লোক তো আমি;হাহাহাহা।’

‘লোকটির কথা শুনে, এইবার পা**গল গুলোর মধ্যে দুটি ভাগ হয়ে গেলো।একদল আরেক দলের সাথে অদ্ভুত রকমের কথা বলে তর্ক করতে থাকল।যখন কেউ কারো কথায় ছাড় দিলো না,তখনই লেগে গেলো পা**গলে পা**গলে যুদ্ধ।একদল আরেক দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
এদিকে নির্জন বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাদের কান্ড-কারখানা দেখতে থাকল।’
কিছুক্ষণ পর কয়েকজন ওয়ার্ডবয় এসে সবগুলোকে একেক করে বিছানায় বেঁধে রাখলো।তবুও তাদের হট্টগোল ও বি**শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ শান্ত হয়নি।ওয়ার্ডবয়রা তাদের কে বেঁধে দেওয়ার পর,কেউ চি**ৎকার করলো,কেউ হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলো,আবার কেউ রাগে কাঁপতে থাকল।”

“পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ওয়ার্ডবয়রা ডাক্তারদের নির্দেশে পা**গলদের ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।ইনজেকশনগুলো ছিলো শক্তিশালী সেডেটিভ,যা দ্রুত কাজ করে।প্রতিটি রোগীকে আলাদাভাবে ইনজেকশন পুশ করা হলো।”

“যতক্ষণে সেডেটিভ কাজ করা শুরু করলো,তাদের চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে এলো।একের পর এক রোগী নিস্তেজ হয়ে গেলো,সেই সাথে যেন অদম্য পা**গলামির সেই আ*গুন নিভে গেলো।পুরো ওয়ার্ডটা হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো,কিছুক্ষণ আগের সেই চি**ৎকার,হইচই,রাগের সব আওয়াজ পুরোপুরি থেমে গেলো।”

“নির্জন দূর থেকে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখছিলো।মানসিক রোগীদের এই পা**গলামি,এই উ**ন্মাদনা এবং এর পরবর্তী নীরবতা,সবকিছুই যেন তাকে আরও অদ্ভুতভাবে তার নিজের ভেতরের যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।সে চুপচাপ তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।তার চোখে বিস্ময়,বেদনা আর এক ধরনের অদ্ভুত অস্বস্তি দেখা দিলো।”

“ওয়ার্ডবয়রা সবাইকে সোজা করে বিছানায় শুইয়ে রাখার পর,নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তুমি তোমার জায়গায় থাকো,নির্জন।এদের মতো আচরণ করলে,তোমাকেও এমনভাবে ঘুম পাড়িয়ে দিবো।’
বলেই তারা ইউনিট থেকে চলে গেলো।’

“নির্জন কিছু বললো না,কিন্তু তার মনে হলো,এটাই যেন সেই দুঃস্বপ্নের শুরু,যা থেকে বেরোনোর কোনো উপায় নেই।তবুও মনে মনে এখান থেকে পালানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে থাকল।”

“মাহির এবং দিগন্ত নির্জনের সব খোঁজ-খবর ড.মায়ার কাছ থেকে নিয়েছে।এদিকে নিধি চুপি চুপি এসে নির্জন কে দেখে গিয়েছে,ড.মায়ার কাছ থেকে তার খবর জেনেছে।এই দুই দিন নিধিও নির্ঘুম রাত কা**টিয়েছিলো।চোখের সামনে যেন বিষাদময় পুরনো স্মৃতিগুলো বারবার হানা দিচ্ছিলো।যদিও নিধি কে তোহার শ্বশুর,শাশুড়ি,তাহমিনা বেগম এবং তোহা যথেষ্ট পরিমাণে মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে,তবুও মন কে তো সে কোনো ভাবেই মানাতে পারবে না।কারণ,তার মন এবং মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল একটাই নাম,’নির্জন।”

————
“কে**টে গেলো ৭দিন।রুমের এক কোণে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে,হাতে স্টিলের বড় একটি চামচ নিয়ে গিটার বাজানোর মত আঙ্গুল নাড়িয়ে,নির্জন গেয়ে উঠল,

“আমি জানি কোনো একদিন,
কোনো এক নতুন ভোরে..
দেখা হবে আমাদের আবার,
এক স্বপ্নের শহরে..”

“নির্জনের গান শুনে,একজন এসে হাতে তালি দিয়ে বললো,

‘বাহ!তুই তো খুব ভালো গান গাইতে পারিস,আমিও পারি,শোন,

“ওই চাইয়া থাকোস কেন,কি কবি ক..
তুই কইলেই তো আমি কমু হ…”

“পা**গলের গান শুনে,বাকি পা**গল গুলো হো হো করে হেসে,নাচানাচি করলো।
সেটা দেখে বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেললো নির্জন।’
রেগেমেগে বললো,

‘এই তোর সমস্যা কি রে?আমার গানের প্রশংসা শুধু আমার নিরু করবে।তুই করলি কেনো, হ্যা?তোর সাহস হলো কি করে আমার গান শোনার?আজ তো তোর কানের ১২টা বাজাবো।’

বলেই ওই লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো নির্জন।লোকটির কানে বারংবার আ**ঘাত করতে থাকল।এক পর্যায়ে লোকটির কান থেকে র**ক্ত পড়া শুরু করলো।এদিকে নির্জনের এহেন কান্ড দেখে,বাকি পা**গল গুলোও নির্জনের ওপর হা**মলে পড়লো।লেগে গেলো আবার যুদ্ধ।”

“ইউনিটে বি**শৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়াতে ওয়ার্ডবয়রা এসে আবারও সবাইকে বেঁধে দিলো।এগুলো যেনো তাদের নিত্যদিনের কাজ।অতঃপর নির্জন সহ সবাইকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করতেই,ধীরে ধীরে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।”

——–
“সময় যেন স্রোতের ন্যায় চলতে থাকে।কে**টে গেলো দেড় মাস।নিধি ড.মায়ার কেবিনে বসে আছে।ড. মায়া নিধির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘এই দেড় মাসে নির্জনের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তার আগের মতো পা**গলামি আর নেই।ইলেকট্রিক শক থেরাপি এবং সঠিক ওষুধের প্রয়োগে সে এখন কিছুটা শিথিল হয়েছে।মাঝে মাঝে তার আচরণ স্বাভাবিক মনে হয়, তবে তার ভেতরে এক ধরনের গভীর হতাশা রয়ে গেছে।’

“নিধি সবকিছু আশ্চর্য হয়ে শুনছিলো।ড.মায়াকে প্রশ্ন করলো,

‘তাহলে সে কি এখন আর আ**ক্র*মণাত্মক নয়?’

“ড. মায়া মৃদু হাসলেন।বললেন,

‘না,আগের মতো আ**ক্র*মণাত্মক নয়।তবে মাঝে মাঝে সে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে,চুপচাপ তাকিয়ে থাকে শূন্যের দিকে।আমরা তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি,সে কিছুটা স্থির হয়েছে,কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ বলা যাবে না।’

“নিধির মুখে কিছুটা আশা ফুটে উঠল।ম্লান হেসে বললো,

‘তাহলে আমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে পারি?’

“ড. মায়া মাথা নেড়ে বললেন,

‘তুমি চাইলে দেখা করতে পারো।তবে মনে রেখো,তার মানসিক অবস্থা এখনও নাজুক।ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে।তোমার উপস্থিতি তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।’

“নিধির চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।এতদিন আড়ালে থেকে নির্জন কে দেখেছে,কিন্তু সামনে থেকে দেখা হয়নি।এবার তার সাহস হচ্ছিলো না।ভাবতে থাকল,

‘দেখা হওয়ার পর নির্জন কি বলবে?কেমন রিয়্যাকশন করবে?রেগেমেগে কথা শোনাবে না তো?’
ভেবে অদ্ভুত মনোভাব হচ্ছিলো নিধির।

“অবশেষে মনে সাহস যুগিয়ে ইউনিটের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে,দীর্ঘদিন পর নির্জন কে দেখে ডাক দিলো নিধি।”

“নির্জন রুমের এক কোণে বসে স্থির দৃষ্টিতে পা**গলদের কর্মকাণ্ড দেখছিলো।কর্ণকুহরে প্রিয়তমার কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই,বিস্ময়ের দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকালো নির্জন।সেই পরিচিত মুখ,সেই চেনা স্বর।আকস্মিক মুখের মধ্যে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো নির্জনের।মনে মনে আওড়ালো,

‘ওই যে আমার ভালোবাসা..’

ভেবে বসা থেকে উঠে দ্রুত পায়ে জানালার কাছে এসে,গ্রিল ভেদ করে হাত বাড়িয়ে,নিধির ডান হাত ধরে বলতে থাকল,

‘কোথায় ছিলে নিরু?আমার ডার্ক কুইন,আমার জানপাখি।জানো,মনে মনে কত খুঁজেছি তোমায়?তুমি তো বলেছিলে,আমি অসুস্থ।তাই তোমার কথা মেনে নিয়ে এতদিন আমি ডাক্তারের কথা মত সব মেডিসিন খেয়েছি।দেখো,এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ।চলো না,আমরা আমাদের বাসায় ফিরে যাই।জানো,আমার এখানে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।ওই পা**গল গুলোর চি**ৎকারের কারণে আমার কানে প্রচুর ব্যথা হয়।আমার কষ্ট কেউ বোঝে না,তুমি তো সব জানো,তাই না?প্লিজ,ডক্টর কে বলো,আমি এখন সুস্থ হয়ে গেছি।আমি বাহিরের পরিবেশে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে চাই।”

“এতদিন পর প্রিয় মানুষটির স্পর্শ পেয়ে,নিধির শরীরে যেন অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো।নির্জনের বাচ্চাদের মত বায়নাগুলো শুনে,নিধিও আবেগী হয়ে গেলো।তাছাড়া নির্জনের চোখেও আগের মত সেই হিং**স্রতা দেখতে পেলো না।ভাবলো,

‘নির্জন অসুস্থ থাকলে তো এতদিন পর আমাকে দেখার পর, আরও খারাপ আচরণ করতো।কিন্তু এই মুহূর্তে নির্জন কে দেখে একটুও ভয় লাগছে না।কারণ, নির্জনের চেহারায় কোনো উগ্র ভাব নেই,যেমন টা দেড়মাস আগে দেখেছিলো।যদিও আগের থেকে কিছুটা শুকিয়ে গেছে নির্জন।’

“নিধি,নির্জনের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে,শুকনো ঢোক গিলে বললো,

‘আ’ম স্যরি নির্জন,আপনাকে এখানে ভর্তি করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না।আপনাকে ছাড়া এতদিন আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি।প্রতিটি রাত যেন আমার কাছে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণার ছিলো।আচ্ছা,আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে আপনাকে ঘুরতে নিয়ে যাবো।হাত টা ছাড়ুন।’

“নিধির কথাগুলো শুনে নির্জন মুচকি হেসে বললো,

‘উহুম,ছাড়বো না।আগে প্রমিজ করো,তারপর ছাড়বো।’

“নিধি মুচকি হেসে বললো,

‘ওকে,প্রমিজ করলাম,আপনাকে ঘুরতে নিয়ে যাবো।এইবার তো ছাড়ুন।”

“নিধি বলতেই নির্জন হাত ছেড়ে দিলো।নিধি ড. মায়ার কেবিনে গিয়ে বললো,

“আন্টি, নির্জন আমাকে অনেকবার রিকোয়েস্ট করেছে,যে এখানে তার অনেক কষ্ট হয়,চারপাশের পরিবেশ যেন তার শ্বাস বন্ধ করে দেয়।আমি যদি তাকে কিছু সময়ের জন্য বাইরে,নদীর পাড়ে নিয়ে যেতে পারতাম… তার মন কিছুটা ভালো হতো।দরকার হলে আমরা কিছু গার্ড সঙ্গে নেবো।”

“ড. মায়া নিধির কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলেন।তিনি জানতেন,মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে এমন পরিবেশগত পরিবর্তন কখনও কখনও বিপজ্জনক হতে পারে,আবার তা উপকারীও হতে পারে।কিন্তু নির্জনের বর্তমান মানসিক অবস্থায় তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া কতটা নিরাপদ,তা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন।”
ভেবে বললেন,

“নিধি,আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা।নির্জন কে বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবটা সহজ না হলেও,তার মানসিক উন্নতির জন্য ভালো হতে পারে।তবে এটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণও।আমি অনুমতি দিতে পারি,তবে তোমাদের সঙ্গে অবশ্যই কিছু সিকিউরিটি গার্ড থাকবে এবং আমরা নির্জনের ওষুধ ঠিকঠাক চালিয়ে যাবো,যাতে তার আচরণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।”

“নিধি আশা নিয়ে বললো,

“আমি জানি,সে আমার কথা শুনবে।আমি তাকে শান্ত রাখতে পারব।”

“ড. মায়া একটু চিন্তিত গলায় বললেন,

‘ঠিক আছে।তবে খেয়াল রেখো,যদি কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়,সঙ্গে সঙ্গে গার্ডদের জানাবে।তোমার জন্যও এটি কঠিন হতে পারে।নির্জন এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়,তবে তার ভালো লাগা দরকার।আমি চাই সে মানসিকভাবে কিছুটা মুক্তির স্বাদ পাক।’

“ড.মায়ার কথা শুনে,নিধির মুখে স্বস্তির ছাপ ফুটে উঠল।এতদিনে হয়তো সে নির্জন কে সেই শান্ত নদীর ধারে নিয়ে যেতে পারবে।কিন্তু এই সফর কতটা শান্তিময় হবে,তা সময়ই বলে দেবে।”

“অবশেষে নিধি,ড.মায়ার অনুমতি নিয়ে,নির্জনকে নিয়ে হসপিটাল থেকে কিছুটা দূরে একটি নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলো।”

“নাম না জানা একটি নদী।সে নদীর পানিতে দুই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় এক চঞ্চলা মনের রমনী।নদীর পানির শীতল স্পর্শে মৃদু কম্পন বয়ে যায় রমনীর শরীরে,কিছুটা তার ভগ্ন হৃদয়ে।সে কম্পনে তার ভগ্ন হৃদয়টি আরও মজবুত হয়, আরও দৃঢ় হয়।যেমন দৃঢ় কোনো সুউচ্চ অট্টালিকার পিলার কিংবা দৃঢ় ভালোবাসার দেয়াল!”

“রমনীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা হিং**স্র যুবকটির মনের আনাচে-কানাচে হিংসা রা উঁকি দিয়ে বলছে,

‘দেখ,দেখ,দেখ… তোর ব্যক্তিগত প্রেয়সী নদীর ঢেউ খেলানো স্বচ্ছ পানির সৌন্দর্যে গা ভাসিয়ে দিয়েছে।তাড়াতাড়ি আটকে রাখ তাকে।নইলে আবারও তোকে প্রত্যাখ্যান করবে।তুই কি পারবি,তার হৃদয়হীনা প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে?”

“যুবকটি নিজের মনকে বিদ্রুপের সাথে উত্তর দিলো,

‘সে আমার,শুধুই আমার।তার অনুপস্থিতিতে প্রতিটি মুহূর্তে আমার #হৃদয়ে_রক্তক্ষরণ হয়।’
উত্তর টি দিয়ে যুবকটি আগে থেকে কুড়িয়ে আনা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইটের টুকরো গুলো কে নিজের শরীরে থাকা সর্বশক্তি দিয়ে নদীর বুকে ছুঁড়ে মারলো।”

“বিশালাকার সেই স্বচ্ছ পানির নদীটি যুবকটির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,মুহূর্তেই ইটের ক্ষুদ্র কণাগুলো গ্রাস করে নিলো।সেটা দেখে যুবকটি মনে মনে ‘চ’ কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করে বললো,

‘বেইমান নদী।আমার প্রেয়সীর দিকে বাঁকা নজর দেওয়ার সাহস তোর হলো কি করে?নাহ!এই রমনী শুধু আমার।আমি কিছুতেই তাকে তোর বুকে গা ভাসাতে দেবো না।’

কথা গুলো তার দিব্যশক্তি দিয়ে বলেই,পাশে থাকা রমনীর হাত ধরে টেনে বুকের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে নিলো।বহুদিনের তৃষ্ণার্ত বুকে মনে হয় শীতল স্রোতধারা বয়ে গেলো।যুবকটি তার ধূসর রঙা চোখ জোড়া বন্ধ করে তৃপ্তির সহিত গেয়ে উঠলো,

“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো,ছেড়ে দেবো না,
তোমায় বক্ষ মাঝে রাখবো,ছেড়ে দেবো না।”

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে