#হৃদয়ের_স্বন্ধিক্ষণ
#পর্বঃ২২(অন্তিম পর্ব)
#ফারিহা_খান_নোরা
তানিয়া বেগমের ছোট বেলার বান্ধবী আশা বেগম।দুজনের বাড়ি একই গ্রামে। আশা বেগমের বিয়ের পর তানিয়া বেগমের সাথে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ থাকে না। পরবর্তীতে তানিয়া বিয়ের পর স্বামী নুরুল সাহেব এর সাথে শহরে আসলে এক সময় তানিয়ার সাথে আশার আগের মতো সম্পর্ক গড়ে উঠে।আশা তানিয়ার বাসায় যাতায়াত করত।তেমনি একদিন দুপুর বেলা আশা বেগম প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর বাড়িতে যায়। মেইন গেট না লাগিয়ে চাপিয়ে দেওয়া ছিলো যার ফলে তিনি খুব সহজেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন।আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে তিনি তানিয়া বেগমের রুমে যান। রুমের দরজাও চাপিয়ে দেওয়া ছিলো।দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে সামনে তাকিয়ে দেখে অ’ন্ত’র’ঙ্গ অবস্থায় তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী ও খালেদ মনোয়ার। তাঁরাও তানিয়া বেগম কে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে যায়। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আশা বেগম তানিয়ার বিরুদ্ধে নোং’রা খেলা খেলেন।সেদিন দুজন মিলে তানিয়া কে মানিয়ে তার খাবারের মধ্যে হাই পাওয়ারের ঘুমের মেডিসিন দেন।এক পর্যায়ে চেতনা হারিয়ে ফেললে আশা তানিয়া বেগমের পোশাক অগোছালো করে খালেদ মনোয়ার এর সাথে অত্যন্ত ঘ’নি’ষ্ঠ ভাবে ছবি ও ভি’ডি’ও করেন।যা পরবর্তীতে আশা বেগমের জন্য তানিয়াকে ফাঁ’দে ফেলানোর একমাত্র অ’স্ত্র হয়ে উঠে।
নুরুল সাহেব এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে নিষ্প্রোভের দিকে তাকান। তাঁর চোখে ছিলো স্ত্রীর জন্য এক রাশ ঘৃণা।তিনি মুখ বিকৃতি করে হিসহিসিয়ে বলেন,
‘পৃথিবীতে হাতে গোনা কিছু মা থাকে যারা শুধুমাত্র নিজেদের দিকটা ভাবে আমার স্ত্রী তাঁদের মধ্যে একজন।সে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় ঢাকতে মেয়েকে আ’গু’নে ঠেলে দিতে চেয়েছিলো। একবারও মনে হয় নি, এতে করে মেয়ের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে। আমার স্ত্রী যদি এতো কিছু না করে আমায় সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলতো তাহলে আমি স্বামী হিসাবে তাকে অবশ্যই সার্পোট দিতাম।’
নুরুল ইসলামকে থামিয়ে দিয়ে নিষ্প্রভের অবাক সুরে বলে,
‘উনি যদি আপনাকে এসব না বলে থাকে তাহলে কে বলেছে এসব কাহিনী।’
‘খালেদ মনোয়ার! সরাসরি আমায় বলেন নি।বাড়িতে এসে আমার স্ত্রীকে এসব বলে ক্ষমা চেয়েছেন বার বার। আমার লাক ভালো কি খারাপ তা বলতে পারবো না,তবে সে সময় আমি বাড়িতে আসলে তাঁদের সব কথা শুনে ফেলি।’
নুরুল সাহেব নির্লিপ্ত ভাবে কথা গুলো বলেন।গলার স্বর কিছুটা গম্ভীর করে আবারও বলতে শুরু করেন,
‘তোমার ও তুরের বিয়েটা যেহেতু আমার স্ত্রীর হটকারী সিদ্ধান্তের ফল সেজন্য আমি চাই তুমি তুরকে ডিভোর্স দেও।এসব জানার পর আমি আমার স্ত্রীর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারবো না, আর আমার মেয়েকে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারবো না।’
নিষ্প্রোভ হাসতে থাকে নুরুল সাহেব অবাক হয়ে যায়।তিনি তো কোনো জোকস বলছে না,যে সামনের ছেলেটা তার কথায় এভাবে হাসবে। নিষ্প্রোভ হাঁসি থামিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। হাস্যকর কন্ঠে বলে,
‘শশুড় বাবা আপনি এই বয়সে বউ ছেড়ে থাকতেই পরবেন কিন্তু আমি এই বয়সে বউ ছেড়ে থাকতে পারবো না। বুঝতেই পারছেন তো সব। সেজন্য বলছি আপনি আপনার বউকে ছেড়ে দিবেন নাকি ধরে রাখবেন একান্তই আপনার ব্যাক্তিগত ব্যাপার তবে আমি আমার বউকে কিছুতেই ছাড়ছি না।’
নুরুল সাহেব হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে আছে।তার সামনে বসে থাকে ভদ্র ছেলেকে মুহূর্তের মধ্যেই নির্লজ্জের খেতাব দিয়ে ফেলেন। শশুর হয়ে প্রথম সাক্ষাতেই জামাই এর মুখে এমন কথা শুনে তিনি নিজেই লজ্জায় কথা বলতে পারছেন না।খ্যাক খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। মৃদু আওয়াজে ধ’ম’ক দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
‘ফাইজলামি রাখো আমি যা বলছি তাই করো।’
নিষ্প্রোভ এবার স্বাভাবিক মুখ করে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
‘বিয়ে করেছি ছেড়ে দেওয়ার জন্য না।বিয়ে যেভাবেই হোক না কেন আমরা এখন স্বামী স্ত্রী।একে অপরের সাথে জড়িত। আমি আমার স্ত্রীকে কোনো মতেই ছাড়তে পারবো না। আপনি আমার স্ত্রীর বাবা হতে পারেন আমি আপনাকে যথেস্ট সম্মান করবো তবে এ ব্যাপারে আমি কাউকে মান্য করবো না।একটা সম্পর্ক ভে’ঙে ফেলা অনেক সহজ কিন্তু গড়া অনেক কঠিন। আমারা একটু একটু করে এই অনিশ্চিত সম্পর্ক গড়ে তুলছি ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয়। সর্বোপরি আপনার মেয়েকে ভালো রাখা ও সুখী করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। আপনি এই দায়িত্ব থেকে আমায় অব্যাহত দিতে পারেন না।’
হঠাৎ করেই নুরুল ইসলাম চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে ও নিষ্প্রোভকে উঠিয়ে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।এমন ব্যাবহারে নিষ্প্রোভ অবাক হয়ে যায়। তিনি নিষ্প্রোভের পিঠে কয়েক বার হাত দিয়ে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলেন,
‘আমার মেয়ে একদম সঠিক মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। হঠাৎ বিয়ের কাহিনী জানার পর আমি এই সম্পর্ক মানতে পারছিলাম না। সেজন্য রে’গে যেয়ে এই সম্পর্ক থেকে মেয়েকে বের করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথায় এলো তুমি মানুষ হিসেবে কেমন একবার জানা উচিত।বেশ কয়দিন হলো আমি সবার অগোচরে তোমাকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছি আজ মনে হচ্ছে তুমি আমার মেয়ের জন্য একদম পারফেক্ট লাইফ পার্টনার।’
এরপর সেদিন নুরুল ইসলাম ও নিষ্প্রোভের মধ্যে বেশ কিছু কথা হয় যা কেউ জানে না।
সব কথা শুনে তুর বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।তার শরীরটা কেমন জেনো করছে।বুকের ভেতরটা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে এমন হয়। নিষ্প্রোভ তুরের অবস্থা বুজতে পেরে তুরকে নিজের সাথে জরিয়ে নেয়।তুর অসহায় কন্ঠে বলে,
‘মা আমার সাথে এমন করতে পারলো নিজের স্বার্থের জন্য আমার জীবণটা শেষ করে দিতেও পিছপা হয় নি। আমার নিজের প্রতিই ঘৃ’ণা হচ্ছে।কোন মায়ের গর্ভে আমি জন্ম নিয়েছি যে মা কিনা সব জেনেও আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল।’
নিষ্প্রোভ তুরকে ছেড়ে দিয়ে সে নিজেই তুরের কোলে মাথা গুঁজে দেয়। অকস্মাৎ এমন হওয়াই তুর কিছু না বুঝে নিষ্প্রোভের দিকে তাকিয়ে থাকে । নিষ্প্রোভ তুরকে শক্ত করে চেপে ধরে। যেন পিষে ফেলবে। বলে,
‘আমাকেই দেখো ছোট থেকে মায়ের আদর পাই নি। কারণ আমার মা ছোট রেখেই মা’রা গেছে।আর বাবা? তিনি তো থেকেও নেই।অতীতে আমাদের দুজনের লাইফে এমন কিছু হয়েছে যা সত্যিই অনেক কষ্টের।আগের এসব বাদ দিয়ে আমারা নিজেরা আমাদের সন্তানদের কাছে ভালো বাবা মা হবো তুর তুমি দেখে নিও।’
তুর আবেগে কেঁদে উঠে। কাঁদার সাথে শরীর কাঁপছে তার।সে ভাবে অল্প বয়সে মায়ের চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি নিষ্প্রোভ তার উপর বাবার এমন ব্যাবহার।সে নিষ্প্রভের মাথায় হাত দিয়ে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
‘হু আজ থেকে আমরা দুজন সব কিছু পিছনে ফেলে অনেক ভালো থাকবো।’
‘তোমার মাঝে জাদু আছে, তোমার কথায় জাদু আছে।তোমার স্পর্শে আমার এতো ভালো লাগে কেন?’
তুর নতমুখ আর তুলল না। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার।নিষ্প্রোভ তুরের মুখ নিজের হাতে নিয়ে নরম স্বরে বলল,
‘বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও।উনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।তিনি কোনো অন্যায় করেন নি।বাবা মা সম্মানের, আমি বলছি না, তুমি তোমার মাকে ক্ষমা করো তবে একটা কথা মাথায় রেখো তাদের দুজনের সাথে তুমি খারাপ ব্যাবহার করবে না।এতে করে আল্লাহ তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবে। আমি চাই না আমার স্ত্রী এমন করুক।’
সেইদিন তুর বাড়ির সবার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করে।তার বাবার সাথে আলাদা ভাবে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে।
________________
সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।যতো যা কিছু হোক না কেন,নিজ গতিতেই চলে। তেমনি কেটে গেছে আর একটি বছর।এই এক বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আফসান ও তাঁর আশা বেগমের চৌদ্দ বছরের জে’ল হয়েছে।এতেই শেষ নয়, আশা বেগম মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এখন উল্টো পাল্টা কাজ কর্ম করছে।তুর ও নিষ্প্রোভ এখন চুটিয়ে সংসার করছে। নিষ্প্রোভ ভালো একটা জব পেয়েছে।সে আলাদা বাড়িতে শিফট করতে চেয়েছিলো কিন্তু তুর এই বয়সে তাঁর শশুরকে একা ফেলে যেতে রাজি না।সেজন্য তাদের আর যাওয়া হয় নি। নিষ্প্রোভের সাথে তার বাবার সম্পর্ক এখনো আগের মতো আছে।তবে নিষ্প্রভ তার বাবার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে না। নুরুল ইসলাম এই বয়সে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে পারে নি। তানিয়া বেগম তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত।
আজ তুরের জন্মদিন সবাই একে একে ফোন করে তাকে উইশ করছে শুধু নিষ্প্রোভ ই সবার থেকে পিছিয়ে আছে।তুর মন খা’রা’প করে ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।একটু পর নিষ্প্রভ তুরকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।তুর কোনো ভ্রূক্ষেপ করে না। নিষ্প্রোভ তুরকে সামনে টেনে নিজের কান ধরে বলে,
‘সরি বউপাখি!’
তুর নিশ্চুপ। নিষ্প্রোভ তুরকে জড়িয়ে ধরে তুরের কপালে চুমু দিয়ে বলে,
‘উইশ করি নি বলে আমার বউ পাখিটার মন খা’রা’প? সে কি জানে আমার প্রতিটি মোনাজাতে তাঁর জন্য দোয়া সব সময় থাকে। আমি তোমার জন্মদিন উপলক্ষে কিছু পথচারী বাচ্চাদের আহারের ব্যাবস্থা করেছিলাম বউ সেজন্য সময় পাই নি,গ্রামে নেটওয়ার্ক ছিলো না।সরি বউপাখি!’
তুরের মন কিছুটা ভালো হয়ে যায়।সে আড়চোখে নিষ্প্রোভের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমার গিফট!’
নিষ্প্রোভ পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করে।একটা সিম্পেল চেইন বের করে তুরকে পড়িয়ে দিয়ে তুরের গলায় ঘনঘন কিস করতে থাকে।তুরের শরীরের অদ্ভুত শিহরণ জাগে,এই শিহরণের সাথে সে পরিচিত।তুর নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিষ্প্রোভকে বলে,
‘আপনি আমায় ডায়মন্ড উপহার দিয়েছেন। নিঃশব্দে ডায়মন্ড দামি তবে আমি আপনাকে সব থেকে দামি উপহার দিতে চাই যা সবকিছুর উর্ধ্বে।’
তুরের কথায় নিষ্প্রোভ ভ্রু কুঁচকে তুরের দিকে তাকায়।তুর একটু হেঁসে নিষ্প্রোভের ডান হাত নিয়ে তাঁর পেটে রেখে নিচু স্বরে বলে,
‘আপনার আর আমার সন্ধিক্ষণে আমাদের মাঝে কেউ আসতে চলেছে সাহেব।’
নিষ্প্রোভ আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। খুশিতে চিৎ’কা’র করে তুরকে কোলে তুলে বলে,
‘এ সব কিছু সম্ভব হয়েছে #হৃদয়ের_সন্ধিক্ষণ এর জন্য বউপাখি।’
ছোট বোনের সুখ ও ভরা সংসার দেখে তুরফা সবথেকে বেশি খুশি হয়। খুশিতে তার মন ভরে উঠে আর বারে বারে বলে উঠে,
তোদের #হৃদয়ের_সন্ধিক্ষণ এর সূত্রপাত আমার দ্বারা হয়েছে আমি চাই না এটা কেউ জানুক!
___________________সমাপ্ত________________
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।