#হৃদয়ের_সন্ধিক্ষণ
#পর্বঃ২০
#ফারিহা_খান_নোরা
আজ সন্ধ্যা থেকে আকাশ গুড়গুড় করছে। মুহূর্তেই আকাশ ভে’ঙে বৃষ্টি নামল।সময়টা শীতকাল,তুর বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসময়ি বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে।ছোটবেলা থেকেই তার বৃষ্টি ভালো লাগে। বৃষ্টি হলে স্কুল কামাই করা যেত খুব সহজেই।স্কুল কামাই দিয়ে সে দিনভর কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে যেত। ছোট বেলাটা কি সুন্দর ছিল,দুই বোন কতো খুনসুটি করতো।তুরফার কথা মনে পড়ে তুরের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়।ও বাড়ির সবাই তাকে অবহেলা করছে তা না হলে তাঁর বাবা বেশ কয়দিন হলো বাড়িতে ফিরছে তবুও একটি বারের জন্যও তাঁর খোঁজ নেয় নি।সে অই বাড়ির সবার কাছে এতোটাই পর হয়ে গেছে।এসব ভেবে তুর মুখ ভার করে নিচে নেমে এসে দেখে সিতারা টিভি দেখছে।মেয়েটা সারাদিন টিভিতে বাংলা ছবি দেখে। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে কখন সাকিব খান বের হয়ে ভিলেনদের শায়েস্তা করবে।মেয়েটার পছন্দের নায়ক শাকিব খান। তাঁর একটা ছবিও দেখা মিস করে না।হিরো ফা’ই’ট করলে সিতারা কখনো আগ্রহী হয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকবে আবার কখনো ঠোঁট গোল করে চেঁ’চি’য়ে বলবে,
‘ব্যাটাকে আরও মা’ই’র দেও ডিশুম ডিশুম করে।কতো বড় সাহস নায়িকা তুলে নিয়ে যায়।’
এই কথা গুলো বলার সাথে সাথে সে দুই হাত দিয়ে ঘু’ষি দেওয়ার এক্সপ্রেশন দেখায়। এই ব্যাপার গুলোর জন্য আশা বেগমের তো’পে’র মুখে পড়তো সে সব সময়।
বাড়িতে তুর আর সিতারা ছাড়া কেউ নেই। টিভিতে এখন বিজ্ঞাপন চলছে। সিতারা তুরকে লক্ষ করে মুখে হাঁসি নিয়ে উৎকণ্ঠার সুরে বলে,
‘নতুন ভাবি আমি ছবি দেহি। আপনে আহেন দুই জন এক লগে দেহি। আর মে’শা নায়িকারে তুইলা লইয়া গেছে পরে যে কি হয় হের লাইগা বইয়া আছি আর ইকটু হইলে শেষ হইবো তহন রাতের রান্না করমু।’
তুর সিতারার মুখের পানে তাকায়।ভাবে মেয়েটা কতো সরল কতো সহজেই খুশি হয়।শ্যামলা মুখটা মায়াই ভরা।সে ঠোঁটে মিষ্টি হাঁসির রেখা টেনে শান্ত কন্ঠে বলে,
‘সবার জন্য আজ আমি রান্না করবো। তুমি পুরোটা সময় টেলিভিশন দেখো সিতারা।’
সিতারা মাথা ঝাঁকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে বলে,
‘আচ্ছা ধন্যিবাদ নতুন ভাবি’
তুর রান্নাঘরের দিকে যায়।রাতের জন্য তুর খিচুড়ি রান্না করবে। যেহেতু বৃষ্টির সময় সাধারনত বাঙ্গালীরা এ সময়টা খিচুড়ি খেতে পছন্দ করে।এর আগেও তুর এই বাড়িতে খিচুড়ি রান্না করেছিলো কিন্তু আফসানের করা থার্ড ক্লাস কর্ম কান্ডের জন্য সেই খিচুড়ি আর পেটে পড়ে নি তাঁদের দু জনের।তুর জমপেশ খিচুড়ি রান্না করে যা দেখতে বেশ লোভনীয় লাগছে।খিচুড়ির সাথে বেগুন ভাজা, ইলিশ মাছ ভাজাও করে। ইলিয়াস মির্জা একটু আগেই বাড়িতে ফিরেছে।এসে তুরের সাথে টুকটাক কথা বলে উপরে চলে যায়।তুর ডিনার সার্ভ করতে চাইলে তিনি ইতস্তত সুরে বলেন,
‘ছেলেটা ফিরলে আমায় ডেকে দিও ওর সাথেই খাবো।’
তুর লিভিং রুমে কিছুক্ষণ ওয়েট করে। এরমধ্যে কলিং বেল বেজে ওঠে।তুর দ্রুত পায়ে দরজা খুলে এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিষ্প্রভ বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে ফিরেছে।বৃষ্টির পানিতে জবুথবু ভেজা মানুষটাকে দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে সরে নেয় তুর। বৃষ্টির পানি সমস্ত শরীর ভিজে গিয়ে গা চুয়েচুয়ে এখন পানি ঝরছে নিষ্প্রভের ।ডান হাত দিয়ে নিষ্প্রভ নিজের মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে তুরের দিকে আড়চোখে তাকায়।তুরকে বেশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু কুঁচকে নেয়। আশাহত দৃষ্টিতে তুরের দিকে তাকিয়ে ফ্লোরে হাঁটু ঠেকিয়ে জুতার ফিতাগুলো খুলতে থাকে।এই ফাঁকে তুর তোয়ালে নিয়ে হাজির হয়ে।তোয়াল নিষ্প্রভের দিকে বাড়িয়ে বলল,
‘মাথা মুছে নিন।’
তোয়ালে ধরা হাতটায় চোখ বুলিয়ে আবারও জুতা খোলার দিকে মনোযোগ দিল। অভিমানী সুরে বলল,
‘লাগবে না।’
নিষ্প্রভ তুরের সাথে কোনো কথা না বলে, যেতে নিলে তুর ভাবুক কন্ঠে বলে,
‘আজ আপনার কিছু হয়েছে?’
নিষ্প্রভ পায়ের গতি কমিয়ে বলে,
‘কেন বলো তো?’
‘কোন আবার! এই যে কোনো কথা বলছেন না।আশার পরে থেকে কেমন অদ্ভুত ব্যাবহার করছেন।বাবা আপনার সাথে ডিনার করার জন্য সেই কখন থেকে ওয়েট করছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে আসুন।’
নিষ্প্রভ এবার তুরের একটু কাছে চলে এসে তাচ্ছিল্য পূর্ণ কন্ঠে বলে,
‘সবার কথায় ভাবো শুধু আমার কথা ছাড়া।’
নিষ্প্রভ প্রস্থান করে তুর তাঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ পরে দুষ্টু হাসি দিয়ে বিরবির করে বলে,
‘আমাকে অনেক জ্বালিয়েছেন সাহেব কিছুক্ষণ একটু নিজে জ্বলুন।’
_________________
টেবিলে খাবার সার্ভ করছে তুর।দুই বাবা ছেলে কোনো কথা না বলে রোবটের মতো খেতে শুরু করে। ইলিয়াস মির্জা আদেশের সুরে বললেন,
‘তুমিও আমাদের সাথে খেতে বসে যাও মা।বলেছিলাম না আজ সবাই একসাথে খাবো?’
তুরের আজ একটু তাড়া আছে যার জন্য সেও না করে নি। ইলিয়াস মির্জা তুরের রান্নার বেশ প্রশংসা করলেও নিষ্প্রভ স্থির ভাবে খেতেই আছে তাঁর মুখে কোনো কথা নেই।খাবার পর্ব শেষে ইলিয়াস মির্জা নিষ্প্রভকে অনুরোধ করে,
‘কথা আছে বাবা লিভিং রুমে একটু অপেক্ষা কর।’
এই সুযোগে তুর চট করে সব গুছিয়ে রেখে রুমে চলে আসে। সাহেবের মন খা’রা’পে’র কারণ সে শুরুতেই বুঝতে পেরেছে তবুও না,বোঝার মতো করে ছিলো এতোক্ষণ।নিষ্প্রভের আলমারি থেকে শপিং ব্যাগটা বের করে।ব্যাগ থেকে একটা মেরুন রঙের কাতান শাড়ি বেরিয়ে আসে।শাড়িটা দুই পাশে গোল্ডেন জরি দিয়ে সুক্ষ্ম কাজ করা যা খুব সহজেই মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।তুর চটপট শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেয়।চুল আঁচড়ে ছেড়ে দেয়,চোখে হালকা কাজল দেয় আর ঠোঁটে মেরুন রঙেরই লিপস্টিক দিয়ে তার চিকন পাতলা ঠোঁট রাঙিয়ে নেয়।আয়নায় নিজের আদল দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায় তুর।এখন শুধু সাহেবের আশার অপেক্ষা।
___________________
‘বাড়িতে গাড়ি আছে বাবা।গাড়ি থাকতে এভাবে কেন ভিজে এসেছিস তুই?’
নিষ্প্রভ সোফায় বসে সামনে সেন্টার টেবিলে রাখা শো পিস এর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যপূর্ণ কন্ঠে বলে,
‘এর আগেও বহুবার এভাবেই এসেছি তখন তো একবারও এমন কথা বলেন নি?’
ইলিয়াস মির্জা অ’প’রা’ধী সুরে নিষ্প্রভকে বলে,
‘আমার মস্ত বড় ভু’ল হয়ে গেছে বাবা।তুই আমায় ক্ষমা করে দে।আমি সত্যি অন্ধ হয়ে ছিলাম।’
নিষ্প্রভ এবার একটু জোরেই হেঁসে ফেলে। ঠোঁটে মৃদু হাঁসির ছটা টেনে বলে,
‘ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার ছোটবেলাটা? মুছিয়ে দিতে পারবে আমার দুর্বিসহ অতীত।ভুলিয়ে দিতে পারবেন আমার প্রতি করা আপনার সুন্দর অল্পবয়সী স্ত্রীর করা সমস্ত অ’ত্যা’চা’র? পারবেন না,তাই এসব কথা আমার সামনে আর কখনো বলতে আসবেন না।’
ইলিয়াস মির্জার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তবুও আকুতির সুরে বললেন,
‘আমি বড় অন্যায় করে ফেলেছি তোর সাথে।জানি এর কোনো ক্ষমা নেই। তোকে আর কখনো বলবো না, আমায় ক্ষমা করতে। কিন্তু তুই আর অন্যের অধীনে চাকুরী করিস না।এই সমস্ত ব্যাবসা আর আমার যা কিছু আছে সব তোর।এখন বউ হয়েছে তাঁর ওর ভরোণ পোষণের সমস্ত দায়িত্ব তোর উপর।তুই ব্যাবসার হাল ধর বাবা।’
নিষ্প্রভ অবজ্ঞার সুরে বলে,
‘এতো দিন না জানতাম? এই ব্যাবসা এই বাড়ি সব আফসানের তাহলে আজ কেন আমার হচ্ছে? আপনি বরং একটা কাজ করুণ এই সমস্ত কিছু আফসান ও আপনার শখের বউকে লিখিয়ে দিন। লিখিয়ে দেওয়ার আগে বলবেন আমি আমার বউকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো।’
নিষ্প্রোভ এক নাগাড়ে এসব বলে গটগট পায়ে উপরে যেতে নেয় একটু পিছনে ফিরে সুক্ষ্ম কায়দায় বলল,
‘আমার বউকে আমি এমন বিলাসীতায় রাখব না।যে বিলাসীতা পেলে অন্য পুরুষের কাছে যেতেও দুই দন্ড ভাববে না।’
ইলিয়াস মির্জার কলিজায় খচ করে উঠে কথাটি।নিজেকে কাপুরুষের সমতুল্য মনে হচ্ছে।
______________________
নিষ্প্রোভ রুমে চলে আসে।ভেতরে ভেতরে রে’গে ফেটে প’ড়ে সে।প্রথমতো তুর তাকে আগ্রহ করেছে, দ্বিতীয় ইলিয়াস মির্জার এসব অবান্তর কথা তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না।খুব তো বউয়ের আঁচলা ধরে থাকতেন।বউ তো এখন জে’লে, সেখানে গেলেই হয়। এতোদিনে মনে পড়লো তাঁর ছেলের কথা।শা’লার দুনিয়াটার স্বার্থপর এসব ভাবতে ভাবতে সামনে তাকিয়ে মোমের আলোয় মায়াবতীকে দেখে থমকে যায় নিষ্প্রভ। নেশাগ্রস্ত ভাবে তাকিয়ে থাকে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুরুষালী হরমোন শিরশির করে জানান দিচ্ছে।এই মেয়েটার কাছে এলেই কেন সমস্ত কিছু ভুলতে বসে নিষ্প্রভ?
মোহগ্রস্ত নয়নে বিছানায় তুরের পাশে যেয়ে বসে নিষ্প্রভ।তার মুখে কোনো কথা নেই তবে চোখর দৃষ্টি দিয়ে তুরকে ঘায়েল করে।তুরের মাথা টা বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ে নিষ্প্রভ।এতোদিন একসাথে ঘুমালেও আজকের অনুভূতি তীব্র। দুজনের মাঝে তেমন দূরত্ব নেই বললেই চলে। নিষ্প্রোভ তুরের পিঠে এক হাত রাখে অন্য হাত তার মাথা বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বলে,
‘তুমি আমায় ক্ষমা করেছো?’
‘হু।’
‘তুমি আমাকে নিজের করে চাও না?’
কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসে তুরের। নিষ্প্রোভ আরও খানিকটা তুরকে জড়িয়ে ধরে। এতোদিনের জমে থাকা দূরত্ব ঘুচতে থাকে।তুর আবেগী হয়ে উত্তর দেয়,
‘আমি আপনাকে নিজের করে চাই নিষ্প্রভ।একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ঠিক যেমন করে পেয়ে থাকে।’
হাসি বিস্তৃত হয় নিষ্প্রভের। সে গায়ের টি-শার্ট খুলে ফেলে। অবাধ্য হাতে ছুঁয়ে দেয় স্বীয় স্ত্রীর শরীরের প্রতিটি জায়গা,এক চিলতেও খালি রাখে না। শরীরের সমস্ত ভার তুরের উপর দিয়ে অজস্র চুমু দিতে থাকে মুখে, গলায়, বুকে বিশেষ করে বুকের একটু নিচে তিলটাই। চুম্বন গুলো ধীরে ধীরে কা’ম’ড়ে পরিণত হয়।রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে যায় পূর্ণতা।বেসামাল মানুষটার স্পর্শ অজানা আনন্দ দেয় তুরকে।আজানা সুখে হারিয়ে যায় সে দুই হাত দিয়ে নিষ্প্রভের পিঠ খামচে ধরে তুর।ক্ষনে ক্ষনে গুঙ্গিয়ে উঠে সে।তার ঠোঁট দুটো নিষ্প্রভের দখলে।তুরের চোখের কার্নিশ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নির্গত হয়।যা ছিলো সুখের অশ্রু।তবুও প্রথমবার কাছাকাছি আসায় তুরের অবস্থা বেশ নাজুক।এক সময় তুর নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে।
চলমান।
#হৃদয়ের_সন্ধিক্ষণ
#পর্বঃ২১
#ফারিহা_খান_নোরা
নব্য দিনের সূচনা! চারিদিক আজানের সুমধুর ধ্বনি।আকাশে এখনো কিছু তারা ঝিকমিক করছে।আর কিছু সময় পরেই হয়তো পুরো আকাশ জুড়ে সূর্যের একচেটিয়া দাপটে চারিদিকে আলোকিত হয়ে যাবে।আজানের ধ্বনিতে নিষ্প্রভের ঘুম ভেঙে যায়। শরীরের উপরে ভারী কিছুর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায়। নিষ্প্রোভের ঠোঁট জুড়ে হাঁসির রেখা ফুটে উঠে।আজকের ভোরটা তাঁর জন্য স্পেশাল কারণ তাঁর বুকে মাথা রেখে অঘোরে ঘুমাচ্ছে তারই অর্ধাঙ্গিনী। নিষ্প্রোভ তার খসখসে ঠোঁট বাড়িয়ে অর্ধাঙ্গিনীর ললাটে স্পর্শ করে।সেই স্পর্শে তুর একটু নড়েচড়ে উঠে আবারও চুপ হয়ে যায় তবে তার দুই হাত দ্বারা আবদ্ধ নিষ্প্রভ।নিষ্প্রভ তুরের মাথায় হাত দেয়,সময় নষ্ট না করে কন্ঠ একটু নিচু করে বলে,
‘বউ উঠো।’
তুরের কোনো সাড়া শব্দ নেই।এবার কন্ঠটা একটু বাড়িয়ে ডাক দিলে তুর নড়েচড়ে উঠে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,
‘মাত্রই ঘুমালাম এভাবে ডাকছেন কেন ঘুমাতে দেন।’
তুর মি’থ্যে কিছু বলে নি, তাঁরা মাত্র দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছে। কিন্তু এখন ঘুমানো চলবে না কারণ নামাজের সময় নামাজ পড়তে হবে। নিষ্প্রোভ তুরের মাথা দুই হাত দিয়ে একটু উঁচু করে। আবছা আলোয় অর্ধাঙ্গিনীর ঘুমে আচ্ছন্ন বন্ধ চোখের দিয়ে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘এখন উঠতে হবে।ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিও বাঁধা দিবো না।’
এই ভোর বেলায় শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় তুর বিরক্ত হয়ে বিরবির করে কিছু বলে যা নিষ্প্রভের কান অবধি পৌঁছাতে পারে না।তুর দ্রুত গতিতে নিষ্প্রভের উপর থেকে উঠতে নেয় কিন্তু অদ্ভুত এক যন্ত্রনায় থামকে যায়।মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে,
‘উহু!’
নিষ্প্রোভ ঘা’ব’ড়ে যায়।শোয়া থেকে উঠে বসে তুরের দুই কাঁধে হাত দিয়ে হালকা ঝাঁকিয়ে উত্তেজিত সুরে বলে,
‘কি সমস্যা, ঠিক আছো তুমি??’
তুর নিজেকে ধাতস্থ করে প্রসঙ্গ পাল্টে কটমট চোখে নিষ্প্রভের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এই সকাল বেলা উঠাই বড় সমস্যা।এমনি ঘুমাতে পারি নি, তাঁর মধ্যে ডাকা ডাকি শুরু করছেন ভালো লাগে না।’
নিষ্প্রোভ দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বলে,
‘ঘুমাতে পারো নি কেন?’
তুর লজ্জায় পড়ে যায়। ঠোঁট বিরবির করে বলে,
‘নির্লজ্জ লোক ঘুমাতে পারো নি কেন! ঘুমাতে দিয়েছেন আপনি?’
বিরবির করে বলা তুরের এমন কথা শুনে নিষ্প্রভ ঠোঁট কামড়ে হাসে।তুর বিরক্ত হয়ে উঠে ফ্লোরে পা রাখতেই অপরিচিত ব্যা’থা জাগ্রত হয়।তুর আবারও কু’কি’য়ে উঠলে নিষ্প্রভ তুরকে কোলে তুলে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যায়।তুর বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে নিষ্প্রোভ তাঁর চোখ দুটো ছোট করে নিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,
‘হুস কোনো কথা না।’
____________________
ইলিয়াস মির্জা লিভিং রুমে বসে আছে। উনার সকালের নাস্তা সিতারা বানিয়ে দিয়েছে।তিনি অচেতন মনে কিছু ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে ওয়ালে শোভা পাওয়া ঘড়িটার দিকে তাকলে ঘড়ির কাঁটা তাকে বুঝিয়ে দেয় এখন বেলা দশটা।ছেলে ও ছেলের বউকে আজ প্রতিদিনের মতো নিচে দেখতে পেলেন না।তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে,ছেলে মেয়ে দুটোর শরীর ঠিক আছে কিনা।যদিও তাঁর নিজেরই শরীর ঠিক নেয়। কয়দিনে তার উপর দিয়ে যেসব যাচ্ছে এতে করে তাঁর শরীর মন কোনোটাই নিতে পারছে না।
ফজর নামায আদায় করে নিষ্প্রোভ ও তুর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। নিষ্প্রোভের ফোনে কল আসালে সে তড়িঘড়ি করে বারান্দায় চলে যায়।তুর আড়চোখে নিষ্প্রোভ কে লক্ষ্য করে উঠে পড়ে।ইশ ঘুম দিয়ে শরীরটা তাঁর বেশ ঝরঝরে লাগছে।কথা বলা হয়ে গেলে নিষ্প্রোভ ফোন রেখে শিথিল ও আদলে উচ্ছুক চোখে তাকিয়ে থাকা স্ত্রীর পানে দৃষ্টি রেখে শীতল কন্ঠে বলে,
‘তোমার শরীর এখন কেমন! কোনো সমস্যা হচ্ছে কি?’
‘না!’
তুর নরম কন্ঠে জবাব দেয়। নিষ্প্রোভ তুরকে বলে,
‘তাহলে ধীরে সুস্থে রেডি হয়ে নেও।আমরা এক জায়গায় যাবো।’
তুর অবাক চোখে তাকিয়ে নিষ্প্রোভের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
‘এভাবে হঠাৎ করে কোথায় যাবো আমরা। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি?’
‘সে না হয় গেলেই বুঝতে পারবে।’
বলেই নিষ্প্রভ তুরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রুম থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায়।তুর বিস্ময়কর দৃষ্টিতে নিষ্প্রোভের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
__________________________
রয়েল ব্লু কাতান শাড়ি পরিহিত তুর বাইকের পিছনে নিষ্প্রোভের কাঁধে হাত দিয়ে বসে রয়েছে। তাঁর শরীরে নিষ্প্রোভের মায়ের স্বর্নের গহনা শোভা পাচ্ছে।আজ সকালে নিষ্প্রোভ এগুলো বের করে নিজ দায়িত্বে তুরকে পরিয়ে দিয়েছে। নিষ্প্রোভ লুকিং গ্লাসে এমন পরমা সুন্দরীকে দেখে ক্ষনে ক্ষনে তার মাথা ঝিমঝিম করছে।হৃদয়ের বাঁক জুড়ে রঙিন প্রজাপতিরা উড়ছে। নিষ্প্রোভ নিজেকে স্বাভাবিক করে গাল ফুলিয়ে উৎসাহের সহিত তাকিয়ে থাকা স্ত্রীর কে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘কি ম্যাডাম রাস্তা কি চেনা চেনা লাগছে?’
নিজের জন্মের সূত্রপাত যে জায়গা থেকে শুরু তুর সেইটা চিনবে না,তা কি করে হয়? নিষ্প্রোভ বাইক থামালে তুর নেমে পড়ে।তুরের সুগভীর কণ্ঠটা বেজায় ক্ষি’প্ত হয়ে যথাসম্ভব কাট কাট ভঙ্গিতে বলে,
‘আপনি আমার সাথে এইটা ঠিক করলেন না? আমি আপনার কাছে এতোটাই বেশি হয়ে গেছি যে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে না জানিয়ে এই বাড়িতে নিয়ে আসলেন।’
নিষ্প্রোভ তুরের কাঁধ তাঁর বাম হাত বাড়িয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে,
‘আমার বউ আমার কাছে বেশি হবে কেন? তুমি আমায় ভুল বুঝছো জান। আমি কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই তোমায় এখানে নিয়ে আসি নি।’
তুর রা’গে গজগজ করতে থাকে। নিষ্প্রোভ এক হাতে ফল, মিষ্টি, খাবারে ব্যাগ নেয় ও অন্য হাতে তুরের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে এগিয়ে যায় জীবনের প্রথম বার শশুড় বাড়ি নামক গৃহে।
____________________
তুরদের বাড়িতে সবাই কাজে ব্যাস্ত। রান্না ঘর থেকে খাবারের গন্ধ সারা বাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে।মেয়ে জামাই সহ আসছে বলে কথা। নুরুল সাহেব নিজ হাতে বাজার করেছেন একটুও কার্পন্য করেন নি।রান্নার দিকটা তানিয়া বেগম ও তুরফা দেখছে।দূর্বা মেয়েটা সারাদিন খায় ও বাঁদরের মতো ছুটাছুটি করে।কোনো সময় এক জায়গায় থাকে না।এ নিয়ে নুরুল সাহেব মুখ না খুললেও তানিয়া বেগম বেশ চ’টে যায়।যার ফলে ছেলের সাথে এক সময় ঝ’গ’ড়া হয়।তুররা এই বাড়িতে আসছে তা নিষ্প্রোভ ও নুরুল সাহেব ছাড়া কেউ জানে না।
দরজা দিকে তুর ও নিষ্প্রোভকে ভিতরে আসতে দেখে নুরুল সাহেব বাদে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তুরফার মনে ভরে যায় তুরকে এই অবস্থায় দেখে। তানিয়া বেগম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ছোট মেয়ের পানে। চোখের কোনে জল চিক চিক করছে।এই মেয়েটার সাথে কতো বড় অন্যায় করতে চেয়েছিলেন সে। সেইদিন যদি আফসানের সাথে বিয়েটা হতো তাহলে মেয়ের জীবন পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যেতো। তানিয়া বেগম মাথা নিচু করে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আছে।দূর্বা পাশে থেকে তুষারের হাত ধরে কানের কাছে যেয়ে বলে,
‘স্বামী এইটা কি আপনার ছোট বোন?’
তুষার চোখ মুখ ক’ঠি’ন করে আস্তে ধ’ম’ক দিয়ে বলে,
‘এই তোমায় কতো বার বলছি সবার সামনে এভাবে আমাকে স্বামী স্বামী বলবে না।’
দূর্বা ভাবুক কন্ঠে বলে,
‘আপনি ভুল করছেন স্বামী। আমি সবার সামনে বলি নি।সবার পিছনে আপনাকে বলছি স্বামী।দেখেন সবাই সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমরাই সবার পিছনে।’
তুষার কটমট চোখে তাকিয়ে থাকে দূর্বার দিকে।দূর্ব ঢুক গিলে উৎসাহ নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে নুরুল সাহেব তুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তুরকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘কেমন আছিস মা?’
তুর অভিমান সুরে বলে,
‘তোমাদের না জানলেও চলবে। আমি কি তোমাদের নিজের মেয়ে বলো? নিজের মেয়ে হলে আমার সাথে তোমরা এমন করতে পারতে না।একজন তো নাটক করে আমার পুরো জীবণটাই নাট্যশালা করে দিয়েছে আর তুমি সব জেনেও এতোদিন আমার এক বারও খোঁজ নিয়েছো বাবা?’
নুরুল ইসলাম মেয়ের অভিমান বুজতে পেরে তুরের মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘মা আমার কথা শোন….!’
তুর কিছু বলতে না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে তাঁর রুমে চলে যায়।এতো দিন পর রুমে এসে ফ্লোরে বসে কান্নায় ভেঙে পরে। নুরুল সাহেব বিচলিত হয়ে মেয়ের পিছনে আসতে নিলে নিষ্প্রোভ বাঁধা দিয়ে বলে,
‘বাবা আপনি থাকেন আমি দেখছি।’
নিষ্প্রোভ রুমে এসে দেখে তুরের এই অবস্থা।সে এগিয়ে যেয়ে তুরের কাঁধে হাত দিলে তুর এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে বলে,
‘চলে যান আপনি।আপনারা সবাই এক,কি পেয়েছেন আমার সাথে।আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম আছে আপনাদের কাছে? একজন ধরে বেঁধে নাটক করে বিয়ে দের আর বাবা তিনি এতোদিন আমার খোঁজ নিয়েছে একবার ও? আর আপনি আজ আমায় না জানিয়ে এ জায়গায় নিয়ে এসেছেন।’
‘বললে তুমি আসতে না।’
তুর রে’গে বলে,
‘কেন আপনার কাছে কি বেশি হয়ে গেছি যে,এখানে নিয়ে আসলেন একবারের জন্য নাকি?’
নিষ্প্রোভ এবার তুরকে ধ’ম’ক দিয়ে বলে,
‘তুর তুমি কিন্তু কিছু না শুনে যা মুখে আসছে তাই বলছো।বাবার সাথেও ওমন ব্যাবহার করলে।এসব আমি তোমার দ্বারা আশা করি না।’
তুর তাচ্ছিল্য হেঁসে বলে,
‘এখন আশা করেন।আর কি জেনো বলছিলেন বাবার সাথে? আপনি আপনার বাবার সাথে কি ব্যাবহার করেন তা কিন্তু আমি দেখেছি।’
নিষ্প্রোভ নিজেকে সামলিয়ে বলে,
‘দেখো তুর আমার বাবা আর তোমার বাবার মধ্যে অনেক তফাৎ রয়েছে। আমার বাবা ছোট থেকে আমার সাথে অন্যায় করেছে।আর তোমার বাবা কি করেছে বল?’
তুর চেঁ’চি’য়ে বলে,
‘উনি এতোদিনেও আমার খোঁজ নেন নি।’
নিষ্প্রোভ আস্তে করে সম্রন্ত্র সুরে বলল,
‘কে বলল উনি খোঁজ নেয় নি? আজ থেকে এক সপ্তাহ আগে আমার অফিস টাইমে গার্ড এসে বলে আমার সাথে একজন ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছে। আমি অবাক হয়ে যাই আমার সাথে আবার এই অফিসে কে দেখা করবে।আগ্রহ নিয়ে নিচে যেয়ে দেখি মধ্য বয়সী একজন ভদ্রলোক যাকে আমি চিনি না,বা আগে কখনো দেখি নি। ভদ্রলোক আমায় বললেন আমি নিষ্প্রভ কি না। আমি হ্যা সূচক উত্তর দিলে তিনি বলেন,
‘আমি তোমার বাবার বয়সী কিছু মনে না করলে তোমার সাথে পাশের রেস্টুরেন্টে এক মগ কফি খেতে চাই।’
নিষ্প্রোভ অবাক হয়ে যায় পুরো ঘটনা ভালো করে বুজতে রাজিও হয়ে যায়। রেস্টুরেন্টে যেয়ে কফির অর্ডার দিয়ে দুজন বসে পড়ে। লোকটি গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বলে,
‘আমি নুরুল ইসলাম তুরের বাবা।’
‘নিষ্প্রোভ বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এভাবে তুরের বাবা তাঁর সামনে কেন?’
নুরুল ইসলাম কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,
‘কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।বসে পড় ইয়াং ম্যান।’
নিষ্প্রোভ কোনো কথা না বলে বসে পড়ে।চুপচাপ অবস্থায় কফিতে চুমুক দেয়। নুরুল সাহেব স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
‘তুরকে আমি আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই।মানে আমি চাই আমার মেয়ে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসুক।’
এইটুকু কথা শুনে তুর নিষ্প্রভের কাধ ঝাঁকিয়ে বলে,
‘ওহ আচ্ছা এই জন্য আপনি আমায় এখানে একবারে রেখে যেতে এসেছেন! আমি শুরুতেই বুজতে পেরেছিলাম।’
নিষ্প্রোভ তুরকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে হাস্যকর ভাবে বলে,
‘এজন্য কি লোকে বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে।আগে পুরো কথাটা তো শুনবে।’
তুর রে’গে বলে,
‘তা আপনার তো বুদ্ধি হাঁটুর উপরে। হাঁটুর উপরে বুদ্ধি নিয়ে এখন দয়াকরে সব খুলে বলুন।’
নিষ্প্রোভ হেঁসে একে একে বলতে শুরু করে।এরপরে নিষ্প্রোভ যা বলে তা শুনে তুর স্তব্ধ হয়ে যায়।
চলমান।