#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৪৪
#তানিশা সুলতানা
সাদির মেজাজ বেশ খিটখিটে হয়ে আছে। এমনিতেই গোমড়ামুখো আজকে যেনো আরও বেশি গোমড়ামুখো হয়ে গিয়েছে। কথার সাথে তিক্ততা বেরিয়ে আসছে। কারো সাথে ঠিকঠাক কথা বলছে না। ছোঁয়ার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। ছোঁয়া বেশ বুঝতে পারছে তখনকার সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাহেবের এই মেজাজ। কিন্তু এতে তো ছোঁয়ার দোষ নেই তাই না?
ছোঁয়া কি জানতো তখনই তার বাবা আসবে? জানলে কখনোই ড্রেসটা পড়তো না। বা সাদিকে উঁসকাতো না। বাবা তো হুট করেই চলে এসেছে। কিন্তু এই সামান্য বিষয়টা সাদিকে কে৷ বোঝাবে?
ছোঁয়া বোঝাবে?
সাদি শুনবে?
কখনোই না। উল্টো ছোঁয়াকে কথা শুনিয়ে দিবে। বকে দিবে। চর থা*প্প*ড়ও দিতে পারে। যে মেজাজ।
সেলিম বসে আছে সোফায়। ছোঁয়া তার পাশেই বসে আছে। সাদি খেতে বসেছে। তাকে খাবার বেরে দিচ্ছে সিমি। পরি দুই দাদিমার সাথে সাদির ফুপি বাড়িতেই রয়ে গিয়েছে।
সিমি সাদির প্লেটে আস্ত একটা করলা তুলে দিবে বলে
“থেকে যাবে আজকে?
সাদি মুখের খাবার শেষ করে জবাব দেয়
” থেকে গেলে তোমাদের প্রবলেম না কি?
সিমি যেনো কথাটা বলেও বিপদে পড়েছে। সে ঠিক এভাবে বলে নি কথাটা। সাদি তো চলে যায় হুটহাট করে। তাই জিজ্ঞেস করেছে।
ছোঁয়ার ছোট্ট মনখানা আবারও চুপসে যায়। আখিঁ পল্লবে ভীর জমায় অশ্রু কণারা।
মনটা বিষিয়ে উঠেছে। কি করে প্রেমিক পুরুষের রাগ ভাঙাবে?
কাছে ঘেসলেই বকে দিবে যে?
সেলিম বিরক্ত। মনে মনে কয়েকটা গালি দেয় সাদিকে। মুখে বলার তো সাহস নেই। ধরিবাজ ছেলে কি না? কিসের মধ্যে কি বলে ফেলবে।
তবুও চুপ থাকা যাবে না।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নেয় সেলিম। তারপর বলে ওঠে
“রাগ নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরবে না ছেলে।
সাদি সরু চোখে তাকায় সেলিমের দিকে।
” তো বুড়ো বয়সে গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে হাত ধরে লান্স করবো? ধরাধরি করে রিকশায় ঘুরবো?
থমথমে খেয়ে যায় সেলিম। লজ্জাও পায় বটে। দুই মেয়ের সামনে ছিহহ ছিহহ।
মেয়েরা ধরতে পারলো কি কিছু? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তাকায় মেয়েদের মুখপানে। দুই মেয়েরই নজর সাদমান চৌধুরীতে বন্দী। তার মানে ওরা ধরতে পারে নি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেলিম। একটু হাসার চেষ্টা করে বলে ওঠে
“এ যুগের ছেলে মেয়ের কি আর লজ্জা শরম আছে? রাস্তায় বেরুলেই দেখা মেলে কতশ
বাকিটা শেষ করতে পারে না সেলিম। সাদি বলে ওঠে
” এই যুগের বুড়োদেরও লজ্জা শরম কম। বউ বাচ্চা থাকতেও তাদের গার্লফ্রেন্ড লাগে। চরিত্র তাদেরও খারাপ।
শুকনো ঢোক গিলে সেলিম। মুখ কেনো খুলতে গিয়েছিলো সে? নিজের গালে নিজেরই চর মারতে ইচ্ছে করছে। এটা কি সাধারণ ছেলে? এ হচ্ছে বজ্জাত। মস্ত বড় বজ্জাত। সম্পর্কের মানে বোঝে না। বুঝলে কি আর শশুড়ের পেছনে লাগতে আসতো?
সাদির খাওয়া শেষ। সে হাত ধুয়ে উঠে পড়েছে। ছোঁয়া তাকিয়েই আছে সাদির মুখপানে। কিন্তু সাদি একবারের জন্যও তাকালো না। টিস্যু দ্বারা হাত মুছতে মুছতে ছুটে নিজ কামড়ার পানে।
সেলিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সিমি খাবার গুছিয়ে রাখছে।
ছোঁয়ার ইচ্ছে করছে সাদির কাছে যেতে। কিন্তু বাবার সামনে দিয়ে কি করে যাবে? চোখে মুখে তার অন্ধকার ভর করেছে।
এরই মধ্যে ছোঁয়াকে সুযোগ করে দিতে সিমি বলে ওঠে
“ঘুমবি না?
ছোঁয়া এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়।
” যাচ্ছি যাচ্ছি
আব্বু গুড নাইট
সেলিম মাথা নারে। ছোঁয়া এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসে।
দরজা বন্ধ করে বেলকনিতে যায়। সাদি এবং তার রুম পাশাপাশি হওয়াতে বেলকনি দিয়ে আসাযাওয়া করা যায়।
কিন্তু সাদির কক্ষের সামনে এসে ছোঁয়ার শেষ আশা টুকু মিলিয়ে যায়। দরজা বন্ধ। ঢুকবে কি করে?
দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে আঁখিপল্লব হতে। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে দরজায় টোকা দেয়
“দরজা খুলুন না আব্দুল কুদ্দুসের আব্বু। আপনার আধপাগল বউ কাঁদছে। তার বুকের বা পাশটায় ব্যাথা করছে। আপনার হাতের থা*প্প*ড় খাওয়ার জন্য পেট গুরগুর করছে। চোখ রাঙানো দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। ধমক খাওয়ার জন্য হৃদয় কাঁদছে।
সাদি সবেই বিছানা ঝেড়েছে। একটু ঘুমবে। আধপাগল বউয়ের আধপাগল কথাবার্তা কানে পৌঁছাতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। এগিয়ে গিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। আরও একটু উতলা করে চায় সে তার বউকে। যাতে পরবর্তী সময় পাগল করতে আসলে প্রিপারেশন নিয়ে আসে।
বয়স পেরিয়েছে একত্রিশ। চাহিদা তারও আছে। সেও চায় বউকে উজার করে ভালোবাসতে। ছোট্ট দেহখানা বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাত পার করতে। নিজের উম্মাদনায় ছোঁয়াকে পিষে দিতে।
বয়স কম, পড়ালেখা এসব নিয়ে আপাতত তার মাথায় কিছু আসছে না। সারাক্ষণ পাগল ছোঁয়া সনিধ্য গুলোই তার মাথায় আসছে। এবং মস্তিষ্ক অসুস্থ করে দিচ্ছে।
কাছে পাওয়ার তাগিদ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অসয্য এক পিঁড়া হচ্ছে অবুঝ প্রেয়সীর জন্য।
সাদির থেকে রেসপন্স না পেয়ে ছোঁয়া আবারও বলতে থাকে
” জামাই খুলুন না দরজাটা। পাক্কা প্রমিজ জ্বালাবো না আপনায়। চুপটি করে পাশে শুয়ে থাকবো। একটাও কথা বলবো না। একটুও জ্বালাবো না।
তখনই সাদি গম্ভীর গলা ভেসে আসে
“না জ্বালালে এখানে কি? নিজের রুমে গিয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকো ইডিয়েট।
সাদির ধমকে ছোঁয়া হতদম্ভ। সে কি জ্বালাতে বলছে?
” জ্বালাবো।প্রচুর জ্বালাবো।
প্লিজ দরজা খুলো।
হাসি পায় সাদির। হাসি চেপে মুখটা গম্ভীর করে বলে
“ট্রায়ার্ড আমি। তোমার জ্বালা সয্য হবে না।
ছোঁয়া এবার বুঝতে পারছে না কি বলবে?
একবার জ্বালাতে বলছে আবার জ্বালাতে বলছে না। কোন পরিস্থিতি এটা? লোকটা চাইছেটা কি?
” আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে।
মাথা টিপে দিবোনি। পা টিপে দিবে।
কারেন্ট গেলে বাতাস করবো।
মশা তাড়িয়ে দিবো। তবুও আমায় নিন না একটু। প্লিজজজ আব্দুল কুদ্দুসের পাপা।
বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরে সাদি। ইসস এভাবে বললে রাগ করে থাকা যায়? ঢং করে রাগ গলাতে উস্তাদ সে।
“ভালোবাসতে পারলে এসো।
নাহলে দুইশত হাত দূরে যাও ইডিয়েট
চলবে
#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৪৫
#তানিশা সুলতানা
দীর্ঘ এক ঘন্টা ঘ্যান ঘ্যান করার পরে অবশেষে দরজা খুলেছে সাদি। ছোঁয়ার চোখে পানি টলমল করছে। প্রেয়সীর মলিন মুখখানা দেখে বুকটা কেঁপে ওটে সাদমান চৌধুরী। দোষটা তো তার অবুঝ বউয়ের নয়। দোষটা হচ্ছে চরিত্রহীন শশুড়ের। শশুড়কে আচ্ছা করে টাইট দিতে হবে। শুধু শুধু বউটাকে কাঁদালো।
সাদির ইচ্ছে করছিলো বউটাকে বুকের মধ্যে আগলে নিতে। কিন্তু কিন্তু কিন্তু
নরম হওয়া চলবে না।
ছোঁয়া হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নেয়
“পাষাণ পাষাণ পাষাণ
সাদি জবাব দেয় না। চলে যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। ঘুমনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো বলে শার্ট খুলে ফেলেছে। ফর্সা লোমশ যুক্ত বুক খানা ছোঁয়ার দুর্বলতা। ভালো করেই জানে সাদি।
ছোঁয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে খাটের ওপর বসে। আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সাদি অবয়ন। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট এবং উদাম বুক। নেশা লেগে যাবে না?
হাত পা বুকে অজস্র লোম। যা ছোঁয়ার ছোট্ট সত্তাকে বেসামাল করে দিচ্ছে।
বউয়ের মন পড়তে পেরে বাঁকা হাসে সাদি। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ছোঁয়ার ওপর পাশে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।
ছোঁয়া মুখটা গোমড়া করে বসে থাকে। হার্টলেস লোক একটা। একবার বললোও না ” ছোঁয়া আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাও”
পাষাণ।
দয়ামায়া নেই একটুও।
কান্না পায় ছোঁয়ার। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না। অবাধ্য আঁখি পল্লবের অবাধ্য অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে দুই গাল বেয়ে। নাকে পানি চলে আসে। এই একটা সমস্যা। চোখে পানি আসার আগেই নাকে পানি চলে আসবে।
মাঝেমধ্যে ছোঁয়ার ইচ্ছে করে নাক খানা কেটে ফেলতে। শান্তিতে একটু কান্নাও করতে দেয় না।
পাষাণ লোকটার মতো নাকটাও পাষাণ।
কতোখন ছোঁয়া একই ভাবে বসে ছিলো জানা নেই। কিন্তু যখন কোমরে চিনচিন ব্যাথা করে উঠলো তখন আর বসে থাকতে পারলো না।
গুটিগুটি পা মেলে শুয়ে পড়ে শখের পুরুষের পাশে। লোকটা ঘাড় ব্যাঁকা করে বুকের ওপর কোলবালিশ দিয়ে আরামসে ঘুমচ্ছে। কি করে আসলো তার ঘুম?
তার বউটা বসে কাঁদছে তাতে তার কিচ্ছু এসে যায় না? ঘুমটাই বড় হয়ে গেলো?
অভিমানে বুক খানা ভাড়ি হয়ে আসে। মনে মনে কঠোর প্রতিজ্ঞা করে ফেলে। লোকটাকে ছুঁয়ে দিবে না। তার পেছনে আর ঘুরবে না। ইগনোর করবে। চরম লেভেলের ইগনোর যাকে বলে।
আবার পরমুহূর্তেই ভাবে। এখন তো সে ঘুমিয়ে আছে। একটুখানি ছুঁয়ে দিলে কি আর হবে? বুকে মাথা রাখলে সে কি টের পাবে? অবশ্যই পাবে না।
আবার না হয় সে জেগে ওঠার আগেই সরে আসবে।
যেই ভাবা সেই কাজ।
আলতো হাতে কোলবালিশ সরিয়ে। মাথাটা রাখে লোমশ যুক্ত বুকখানার ওপরে। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে ছোঁয়া।
আহহহহহা
এখানে এতো শান্তি কেনো? মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব সুখ এখানে এসেই জমা হয়েছে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে ছোঁয়ার।
সাদি একটু নরেচরে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় বউটাকে।
ছোঁয়া চমকে ওঠে। জেগে গেলো না কি?
চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে।
সাদি চুমু খায় ছোঁয়ার চুলের ভাজে।
ফিসফিস করে বলে ওঠে
“তোমাকে বুকে না নিলে ঘুম হয় না জান।
তার মানে সাহেব ঘুমায় নি? জেগেই ছিলো? মুখ বাঁকায় ছোঁয়া।
বুকে আঁকিবুঁকি করতে করতে নরম গলায় আমতাআমতা করে বলে
” এখন ভালোবাসুন।
“উহু
” কেনো?
“মুড নাই
মুখটা কালো করে ফেলে ছোঁয়া। সরে যেতে চায়। কিন্তু সাদির শক্ত বাঁধন ছাড়িয়ে সরতে পারে না।
” আমাদের ফাস্ট নাইট এভাবে হবে না। একটু স্পেশাল হবে। আফটার অল আব্দুল কুদ্দুস আসার প্রথম ধাপ এগোবো বলে কথা।
লজ্জা পায় ছোঁয়া। লজ্জা মাখা মুখখানা সাদি দেখতে পেলে নিশ্চয় স্পেশাল করার জন্য অপেক্ষা করতো না। এখুনি বাচ্চা বউটাকে ভালোবাসায় মুরিয়ে ফেলতো।
_____
সকাল সকাল সেলিমের হাঁকডাক। কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে শুধু তারই গলা শোনা যাচ্ছে।
সাদির ঘুম ভেঙেছে আরও কিছুখন আগে। বুকের ওপর ঘাপটি মেরে বিড়াল ছানার মতে ঘুমিয়ে আছে অধপাগল বউ। একটু নরাচরা করলেই তার ঘুম ছুটে যাবে। যা সাদি চাইছে না। সারাক্ষণ ছুটোছুটি করতে থাকে। এখন একটু শান্তিতে ঘুমোক না হয়।
কিন্তু জল্লাদ শশুড়ের জন্য কি আর ঘুমতে পারবে?
সাদির ইচ্ছে করছে পুরো এলাকার লেক জড়ো করপ চিৎকার করে বলতে
“শুনুন সকলে আমার শশুড় আমার বউকে আদর করতে দেয় না। আমাদের প্রাইভেসি নষ্ট করে।
কিন্তু এই কথাখানা বললে কি আর সমাজে মুখ দেখানো যাবো?
অবশ্যই না
হাহহহহ
মানসম্মানের ভয়ে আমরা কতো কিছু করি না।
ছোঁয়ারও ঘুম ছুটে যায়। সে মাথা তুলে ঘুম ঘুম কন্ঠে মুচকি হেসে বলে
” গুড মর্নিং আব্দুল কুদ্দুসের পাপা
সাদির কি হয়ে যায় নিজেও জানে না। একটা সেকেন্ডও নষ্ট করে না।
দুই হাতে আগলে নিয়ে ওষ্ঠদ্বয়ের ভাজে নিজের ওষ্ঠদ্বয় বিলিন করে দেয়।
হতদম্ভ ছোঁয়া আবেশে চোখ বন্ধ করে দেয়।
রাতে এতো খোঁচাখুঁচির পরেও কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো না। আর সেই বরের কি না এখন মধু খাওয়ার সাধ জেগেছে।
সেলিমের আরেকটা চিৎকারে সাদি বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ছেড়ে দেয় বউকে। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নেশালো গলায় বলে
“গুড মর্নিং জান
” আই লাভ ইউ
“উমমমমম ভালোবাসি
যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমাকে কলেজে ছেড়ে আমি অফিস যাবো।
চলবে
#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৪৬
#তানিশা সুলতানা
ছোঁয়ার জন্মদিন আগামীকাল। আর সাদি বাড়িতে ফিরতে পারবে না। ছোঁয়ার ইচ্ছে ছিলো ঠিকঠিক বারোটায় তার বর তাকে বার্থডে উইস করবে। হ্যাপি বার্থডে বলবে। ছোট একটা কেক কাটবে।
কিন্তু তার বরটাই লাপাত্তা। সকালে বলেও গেলো না যে বাসায় ফিরতে পারবো না। দিব্যি কলেজে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো।
কলেজ শেষ করে ছোঁয়া বাসায় ফেরার পরে জানতে পারলো সাদমান চৌধুরী ওরফে ছোঁয়ার করলা বর বাসায় ফিরবে না আজকে।
মনটা তার ভীষণ খারাপ। প্রতি বছর ছোঁয়া অপেক্ষায় থাকতো সাদির থেকে একটু শুভ জন্মদিন শুনবে বলে। কিন্তু কোনোদিনও সেই সুভাগ্য হয় নি। আজকে তো সে ছোঁয়ার বর। তো আজকে তো একটু উইস পেতেই পারতো।
কলেজ থেকে ফিরে ছোঁয়া কিচ্ছু মুখে তুলে নি। মন খারাপ করে বসে আছে তার রুমের বেলকনিতে। নাজমা বেগম অনেকখন টানা টানি করে গিয়েছে খাওয়ার জন্য। কিন্তু ছোঁয়া যায় নি। বলেছে পরে খাবে। নাজমা বেগমও ভেবে নিয়েছে হয়ত খেয়ে এসেছে। তাই জোর করে নি।
সিমিও এসেছিলো। তবে খাওয়ার জন্য জোর করে নি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো জন্মদিনে কি উপহার নিবে। প্রতি বছরই ছোঁয়া এটা ওটা আনতে বলে। কিন্তু এই বছর কিছুই আনতে বলে নি।
বলেছে “গিফট কি বলে দিতে হয়? তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই এনো”
সিমি প্রথমে অবাক হয়েছিলো। পরে চিন্তা করলো বয়স বাড়ছে। তার সাথে বুদ্ধি। চিন্তা ভাবনা বদলেছে।
বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে আসে। ছোঁয়ার মন ঠিকই হচ্ছে না। সে এখনো বেলকনি থেকে নরে নি।
তখনই ছোঁয়ার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা পায়ের কাছে ফ্লোরে পড়ে ছিলো। ছোঁয়া কালো আসমান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফোনের দিকে তাকায়। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফোনটা হাতে তুলে। রিসিভ করার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু সাদি নামটা দেখে রিসিভ না করে পারলো না।
ভালোবাসার মানুষ তো। তার ডাকে সারা না দিয়ে পারা যায়?
ফোনটা কানে রাখতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ
“ভাইয়ার সাথে চলে এসো জান।
তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
বলেই কল কেটে দেয়। চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায় ছোঁয়ার। তার গোমড়ামুখো করলা বর তার জন্য সারপ্রাইজ রেখেছে?
এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়। অগোছালো চুল গুলো হাত খোঁপা করে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। কাউকে না জানিয়ে চলে আসে বাইরে। সেখানে সিফাত গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ছোঁয়াকে ঝড়ের বেগে আসতে দেখে মুচকি হাসে। পাগল একটা।
ছোঁয়া সিফাতের সামনে এসে দুই হাতে পেট চেপে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে
” ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলো।
আমার জামাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
সিফাত শব্দ করে হেসে ওঠে।
“চলো
__
বাসর ঘর সাজানোর দায়িত্ব চেপেছে সামির আশিক শিপন রিমি এবং ইরার কাঁধে। সকলেই কাজে লেগে পড়েছে। আর সামির ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে গাঁদা ফুলের একখানা মালা গলায় পড়ে উচ্চস্বরে গান ধরেছে
“আকাশে লক্ষ তারা চাঁদের মতো আলো দেয় না
আমার মন মানে না যৌবন জ্বালা সহে না।
আমার বাপ বুঝে না
বিয়ে আমার দেয় না
দুঃখ আমি রাখবো কোথায়?
ঐশি তো পাত্তা দেয় না
বুইড়া তো হইয়া গেলাম
বিড়াল মারতে পারলাম না”
সামিরের উদ্ভট গান শুনে সকলেই হেসে ফেলে।
সামির দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
“সাদি চাচা
যার মেশিন নিয়ে কাল ওবদি চিন্তিত ছিলাম আমি। সেও বাসর করতে যাচ্ছে। আর আমি?
তরতাজা জোয়ান রোমান্টিক বেডা আমার কপালে বাসর জুটছে না?
দুঃখের কথা কমু কার কাছে?
সামিরের আহাজারিতে কেউ দুঃখ পায় না। বরং সকলেই মজা নেয়।
আশিক বলে ওঠে
“তোর কপালে বিয়া নাই।
সামির এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়। আশিকের পা দুটো চেপে ধরে
” এমন কথা কইস না। বিয়া ছাড়া আমি বাঁচতে পারমু না।
রিমি চুল টেনে সরিয়ে দেয় সামিরকে।
“ডিস্টার্ব করিস না সর এখান থেকে।
শিপন বলে ওঠে
” তোরা দুজন সর। ছোঁয়া চলে আসছে প্রায়। তোরা গিয়ে তাকে সাজিয়ে দে। বাকিটা আমরা সামনে নিবো।
রিমি এবং ইরা মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়।
এখনে সামিরের মাথায় একখানা বুদ্ধি চলে আসে।
“সাদি চাচার খাট ভাঙলে কেমন হয়?
আশিক এবং শিপন ভ্রু কুচকে তাকায়।
সামির ব্যাপারটা ওদের বুঝিয়ে বলে। এবং ওরাও সঙ্গ দেয় সামিরকে। প্ল্যানিং করে ফেলে সাদি চাচাকে জব্দ করার।
___
বাসর খাট সাজানো শেষ। সাদিও চলে এসেছে। সামির সাদিকে পানজাবি পড়িয়ে দিয়েছে। সাদির পড়ার একদম ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু আজকে কেনো জানি বাঁধা দিতে ইচ্ছে হলো না।
ওইদিকে ছোঁয়াকে সাজিয়ে দিচ্ছে ইরা এবং রিমি। সব জিনিস সাদি পছন্দ করে কিনে এনেছে৷ এটা রিমির থেকে শুনেছে ছোঁয়া। আর শুনতেই মনটা খুশিতে নেচে উঠেছে। বরের থেকে প্রথমবার কিছু পেলো। মনটা খুশি হয়ে যাবে না?
লাল টুকটুকে জামদানী শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউজ। হালকা মেকাপ। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। গায়ে হালকা গোল্ডের গহনা। সব মিলিয়ে পারফেক্ট লাগছে ছোঁয়াকে। নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে ছোঁয়া।
রিমি ছোঁয়ার গালে হাত দিয়ে বলে
” মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ
বন্ধু আমার আজকে পাগল হয়ে যাবে।
ছোঁয়া লাজুক হাসে।
“আপু লজ্জা দিও না প্লিজ। আমার গা শিওরে উঠছে।
হেসে ফেলে রিমি।
আরও একটু লজ্জা দিতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু বাচ্চা একটা মেয়ে। তাকে আর কতো লজ্জা দিবে?
ছোঁয়াকে ফুলসাজানো খাটে বসিয়ে দেয় রিমি। বসিয়েছে সামিরের নির্দেশনা মতে। কারণ সামির ওঁত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়াকে বার বার বলছে
” ছোঁয়া বউদের ডান পাশে বসতে হয়। বা পাশে বররা বসে। তুমি জানোই তো স্বামীর বা পাজরের হার দিয়ে বউদের তৈরি করা হয়?
সামিরের ছলে গলে গিয়েছে ছোঁয়া। সে আর বাম পাশে বসবেই না।
ছোঁয়াকে বসিয়ে সকলে দরজার কাছে চলে যায়। সাদি কোনো কথা না বলে দশ হাজার টাকার একটা ব্যান্ডিল সামিরের হাতে দেয়। সামির খুশি হতে পারে না। ভেবেছিলো বন্ধুর সাথে একটু মশকরা করবে। কিন্তু তা আর হতে দিলো কই?
“শালা বাসর করার জন্য একদম পাগল হয়ে গিয়েছে। একটু মশকরা করতেও দিলো না।
সাদি সামিরের কান ধরে তাকে দরজা থেকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এবং ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। সামির বিশ্ব জয়ের হাসি দেয়।
” তোরা দাঁড়া এখানে। এখুনি একটা ম্যাজিক দেখাবো।
শিপন আশিক ওরা বুঝতে পারলেও ইরা এবং রিমি বুঝতে পারে না। ওরা সামিরের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর সামির আশিক শিপন দরজায় কান পাতে।
সাদি ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে মুচকি হাসে। ছোঁয়া লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে রেখেছে। পৃথিবীর সমস্ত লজ্জা যেনো আজকে তার ওপরে ভর করেছে। এতো লজ্জা এতোদিন কোথায় ছিলো?
এই যে মাথা তুলে সাদির দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না।
সাদি খাটে বসতে যায়। নিজের ভরটা খাটের ওপর দিতেই ঠাসসস করে শব্দ হয়ে খাটটা ভেঙে যায়। ছোঁয়া লাফিয়ে ওঠে। সাদিও হতদম্ভ। খাট কি করে ভাঙলো?
সামির চেঁচিয়ে ওঠে
“কি হলো? কি হলো?
কিসের শব্দ?
ছোঁয়া এক দৌড়ে দরজা খুলে দেয়। ভয় পেয়েছে সে ভীষণ।
হুরমুরিয়ে রুমে ঢুকে পড়ে সকলে। ইরা ছোঁয়াকে জড়িয়ে নেয়।
সাদি শুকনো ঢোক গিলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
“সামির বিশ্বাস কর ভাই। খাটটা আগেই ভাঙা ছিলো।
সাদির চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। এরকম বেকায়দায়র সম্মুখীন সে আগে হয় নি। বন্ধু বান্ধবরা কি ভাববে? বাসর রাতে খাট ভাঙলো?
সামির দাঁত কেলিয়ে খাটটার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে সে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আহহহা বাসর ঘরে বন্ধু খাট ভেঙেছে? ইতিহাসের পাতায় কি লিখে রাখা উচিত নয়?
রিমি দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” একটু প্রাইভেসি দিলাম কি না দিলাম তাতেই খাট ভেঙে ফেললি?
সামির রাজকীয় ভঙ্গিমায় ভাঙা খাটের এক কোণায় বসে পড়ে
“আহহ রিমি আমাদের সাদু বেবি স্পেশাল না?
তার বাসর স্পেশাল হবে না?
আশিকও তাল মেলায়
“সাদির থেকে আমাদের শেখা উচিত। বাসর ঘরে খাট ভাঙা বাদ্ধতামূলক।
সামির হাই তুলে বলে
” বাসর ঘরে খাট ভাঙতে না পারলে বউকে ছুঁয়েও দেখবো না। এই যে সাদির ভাঙা খাটের কসম।
চলবে