#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৪ |
আবির’রা চলে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। ওরা চলে যেতেই মার্জান এবং রথির মধ্যে ভয়ানক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ভয়ানক বলতে মাত্রাতিরিক্ত ভয়াবহ। তাতানকেও হোস্টেল পাঠানো হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের কারণ বাড়িতে থাকা নিয়ে। রথির মা রথিকে অনেক বুঝিয়েছে সে ওখানে চলে যাবে কিন্তু রথি অমত জানায়। সে বারংবার তার মাকে এটাই বলে,
-‘কেন মা? এই বাড়ি তোমার, আমি জানি! এই ভাবী জাস্ট নকল কাগজ দেখাচ্ছে তোমাকে। বিশ্বাস না হলে আমি এটা খুব শীঘ্রই প্রমাণ করবো!’
বলেই রথি হনহন করে বেরিয়ে যায়। এদিকে রথির মা এসব সহ্য করতে পারেন না, তার রক্তচাপ বেড়ে যায়। সাইফ তখনই বাড়ি ফিরে৷ মাকে পরে যেতে দেখে সাইফ দ্রুত এগিয়ে যায় মায়ের দিকে। মার্জান রথির মাকে ধরতে গেলে সাইফ চোখ গরম করে থামিয়ে দেয়। থমথমে গলায় বলে,
-‘খবরদার তুমি আমার মাকে ছুঁবে না! আজ যদি আমার মায়ের কিছু হয়, তোমার বাপ-চাচা, তাতান কিছুই মানবো না!’
বলেই আমেনার সাহায্যে মাকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলো। এদিকে মার্জান বারংবার ঘেমে একাকার হচ্ছে। নাহ জলদি কিছু একটা করতে হবে নয়তো সে সব খুইয়ে ফেলবে সব!
রাত নয়টা। বাইরে তীব্র বাতাস চারপাশে ধুলোময় করে ফেলেছে। মানুষের চোখ-মুখে ধুলো-বালি ঢিকে যা তা অবস্থা। এই অবস্থা দেখে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না ঝড়-বৃষ্টি হবে। তাই সে তার হাতের ফাইলটি রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার দিকে যেতেই দেখলো বাইরে ঠিক তার জানালার পাশে রথি দাঁড়িয়ে। তার মাথা নিচু এবং হাতদুটোও মুঠ করে রেখেছে। রথিকে দেখে নাশিদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। মৃদু সুরে রথিকে ডাকলো। কিন্তু রথি ভাবলেশহীন, এক চুলও নড়লো না। নাশিদ আবারও ডাকলো। আবারও। কিন্তু রথির কানে ডাকটি প্রবেশ করলো না। নাশিদ উপায় না পেয়ে থানা থেকে বেরিয়ে রথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কী হলো, এতবার ডাকছি শুনতে পাও না!’
রথি এবার খানিক নাক টানলো। সেই শব্দে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না রথি কাঁদছে। নাশিদ খানিকটা বিচলিত হয়ে পরলো। এদিকে ঝড় আসবে আসবে ভাব হলেও এখন পরিবেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
নাশিদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই রথি দু পা এগিয়ে নাশিদের ডান বাহুতে আলতো মাথা ঠেকিয়ে
ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘একান্ত সময় চাই!’
রথির এরূপ আবদার নাশিদকে বিষম খাওয়ালো। তবে নাশিদ রথির আবদার ফেলতে পারলো না। নাশিদ রথির উদ্দেশ্যে বলে,
-‘এখানে থাকবে নাকি অন্য কোথাও যেতে চাও!’
-‘** হোস্টেল যেতে চাই। আমার তাতানের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন নাশিদ সাহেব?’
নাশিদ এ মুহূর্তে বুঝলো না এই তাতান কে? তবে রথি যেই হোস্টেলের কথা বললো ওটার ৮০% ই বাচ্চারা। এর মানে কী কোনো বাচ্চা? তবে নাশিদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো না। সে রথির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘ঠিক আছে, তুমি অপেক্ষা করো। আমি আসছি!’
বলেই নাশিদ রথিকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এতক্ষণে রথিও চোখ মুখে ফেললো। নাশিদ আসতেই রথিকে গাড়িতে উঠতে বললে রথি নাশিদকে থামিয়ে বলে,
-‘আমি রিক্সা করে যাবো৷ এই গাড়ি টাড়িতে বিরক্ত হয়ে গেছি।’
এবারও নাশিদ রথির কথার অমত করলো না। কেন যেন রথির এই আবদার গুলো সে ফেলতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণটার উত্তর নাশিদের জানা নেই। নাশিদ কথা না বাড়িয়ে রথির সঙ্গে যেতে লাগলো কিন্তু আফসোস কোনো রিকশা নেই। নাশিদের মাথায় এই ঢুকছে না রথি কেন রাত করে বাসা থেকে বেরিয়ে তারই থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো? নাশিদ রথিকে প্রশ্ন করবে তখনই রথি বললো,
-‘নাশিদ সাহেব, ওইযে রিকশা!’
নাশিদ আর প্রশ্ন করতে পারলো না। রিকশা ডেকে দুজনেই উঠে বসলো। নাশিদ আজ ইউনিফর্ম পরেনি, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।
রথি এবং নাশিদ পাশাপাশি একই রিকশায় বসা। এই অনুভূতি যেন প্রকাশ করার মতো নয়। রথি মনোযোগ দিয়ে এই মুহূর্তটি উপভোগ করছে আর নাশিদ নিজেকে বিভিন্ন প্রশ্নে গুলিয়ে ফেলছে। এই মানুষটা তার পাশে থাকলে রথি যেন চোখ বুজে সব ধরণের বিপদ অতিক্রম করতে পারে। হ্যাঁ এতোটাই জায়গা করে নিয়েছে সে রথির মনগহ্বরে। রিকশায় তাদের নিরবতাই চললো, কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহসটা জোগাতে পারলো না।
নাশিদ ভাড়া মেটাতে গেলে রথি তাকে থামালো। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,
-‘ভাড়া দুজন মিলিয়ে ঝিলিয়ে দেয়াটাই ঠিক মনে করি!’
নাশিদ এবার রথির কথায় পাত্তা দিলো না। একপ্রকার জোর করে নিজেই ভাড়া দিলো যার কারণে খানিক মন খারাপ হলো। অতঃপর নাশিদ দারোয়ানকে বলে ভেতরে ঢুকলো। রিসিপশনে গিয়ে মেয়েটাকে তাতানের নাম, ক্লাস বলতেই মেয়েটি তাতানকে এখানে আনার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে তাতান আসলো। নাশিদ রিসিপশনের মেয়েটিকে বলে তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে আসলো।
রথি তো তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তার সবকিছু এখন মরিচিকার মতো লাগছে। ভেতরটায় কেমন তুফান হচ্ছে। নাশিদ স্থির দৃষ্টিতে রথির কান্না দেখছে। তার সহ্য হচ্ছে না রথির চোখের জল, তাই সে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালো।
—————————–
-‘আপনার ননদ তো ভালোই বড়লোকী পোলার লগে ঘুরে বেড়ায়! আমি যখন বললাম আমার হাতে ওরে তুলে দিতে তখন কেন দিলেন না?’
মার্জান খানিক আতকে উঠলো শামুনের জোড়ালো কন্ঠস্বরে। মার্জান কখনোই এই শামুনের হাতে রথিকে তুলে দেবে না। শামুন মারাত্মক খারাপ যা মার্জানের অজানা নয়। হয়তো মার্জান ওদের সহ্য করতে পারে না তাই বলে এই না যে সে রথির খারাপ চায়। মার্জান ভাবনা ছেড়ে থমথমে বলায় বললো,
-‘যা সম্ভব না, তা নিয়ে কথা বলতে আসবে না। নিষেধ করিনি?’
শামুন চোখ গরম করে মার্জানের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করতে বলে,
-‘আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করছি এখন তবে! (কিছুটা থেমে) রথিকে না পেলে আমি সব তছনছ করে দিবো, এমনকি আপনাকেও!’
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। এখন মার্জানের মাথায় হাত। সে কী করবে এখন? নাহ কোনো না কোনো সলিউশন তাকে বের করতেই হবে।
রথি কোচিং থেকে ফেরার সময় থানায় উঁকি দিতে দিতেই যাচ্ছিলো তখনই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খায়। রথি মাথা উঁচু করে সামনে তাকাতেই আঁতকে উঠলো কারণ তার সামনে নাশিদ ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে। নাশিদকে দেখে রথি একটি শুকনো ঢোঁক গিললো। এর মানে কী সে ধরা পরে গেলো? নাশিদ একইভাবে ভ্রু কুচকে বললো,
-‘যেভাবে আজ উঁকি দিতে দিতে যাচ্ছিলে, এই উঁকি দেয়া কী রোজ চলে?’
নাশিদের এরূপ কথায় রথি লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হতে শুরু করলো। এরকম কিছু হবে কে জানতো? কী লজ্জা, কী লজ্জা!
নাশিদ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রথির কান্ড দেখছে। রথি এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারলো না। সে নাশিদকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত দৌড়ে চলে গেলো। নাশিদের এই দৃষ্টি রথির সহ্য করার ক্ষমতা নেই, একদমই নেই। নাশিদ পিছে ঘুরে রথির ছুটে যাওয়া দেখছে৷ কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে আপনমনে হেসে উঠলো। থানার সামনে নাশিদকে একা একা হাসতে দেখে নয়ন ভ্রু কুচকালো। সে নাশিদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-‘কী ব্যাপার স্যার, এভাবে হাসছেন কেন?’
-‘কিছু না, মিশনে চলো৷ দেরী হচ্ছে!’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে থানায় ঢুকে একটা ব্যাগ এনে নাশিদের সঙ্গে তাদের মিশনে রওনা হলো। আজকের মিশনটা কিছু মহিলাকে কয়েকটি বেআইনি হোটেল থেকে উদ্ধার করা।
রথি ছুটে বাসায় আসতেই চমকে উঠে। মার্জান এবং তার মা হেসে হেসে কথা বলছে। রথিকে মার্জান দেখতেই মুচকি হেসে রথির মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তাহলে আমি রথিকে নিয়ে কালই গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। কী বলেন মা? বিকালে সাইফকে দিয়ে তাতানকেও নিয়ে আসবো, একবারের জন্য।’
মা যেন অনেকটা খুশি হলেন। আর রথি? সে তো মার্জানের কথার আগা-মুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
~চলবে।
#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৫ |
আবছা অন্ধকার ঘরের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে আপনমনে ফুঁপিয়ে চলেছে রথি। তার আঁখিপল্লব অশ্রুসিক্ত! সে একমনে কাঁদছে। রথির ভাবী কিছুক্ষণ আগেই তাকে এই ঘরে বন্দি করে গেছে। রথি এখন গাজীপুরে আবিরের ফ্ল্যাটে আছে। এখানে ঘরোয়াভাবে রথি এবং আবিরের বিয়ের ব্যবস্থা করেছে চাচী আর ভাবী।
বিয়ের কথা শুনতেই রথির কেমন সব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। কোনো এক জায়গা থেকে কেউ চিৎকার করে বলছিলো এই বিয়ে করলে তুই ভালো থাকবি না, কারণ তুই অন্যকাউকে ভালোবাসিস। তাকেই তোর লাগবে। রথি অমত জানায় সে বিয়ে করবে না এবং সে এই মুহূর্তে বাড়ি চলে যাবে!
এই কথা শুনতেই ভাবী জোর করে তাকে বদ্ধ ঘরে বন্ধ করে দেয়, রথির ফোনটাও সুইচড অফ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। এই বদ্ধ ঘরে বন্দি হতেই রথি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলো তার নাশিদকে প্রয়োজন। নাশিদ তার প্রিয়জন, সে ছাড়া অন্য কাউকে কখনোই মেনে নিতে পারবে না।
জীবনটা কীভাবে যেন নতুন ঝামেলায় মোড় নেয়। একে একে বুঝতে পারলো তার ভাবী কেন একান্তই তাকে নিয়ে এই গাজীপুরে এসেছে। রথি তার ভাবীর প্রতি ঘৃণায় নাক সিটকালো। এই মানুষটাকে সে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না।
কিছুক্ষণ বাদে হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো মার্জান। রথির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে শুধুমাত্র নাশিদ এবং নাশিদের স্মৃতিগুলো ভাবতে মগ্ন। মার্জান পা ভেঙ্গে ফ্লোরে বসে খাবার এগিয়ে শক্ত গলায় বললো,
-‘খাবারটা খেয়ে নে!’
-‘খাবো না, চলে যাও এখান থেকে।’
মার্জান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেঝেতে প্লেটটা রেখে খুবই শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-‘দেখ রথি, আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি রাজি হয়ে যা। আবির ভালো ছেলে, তোকে ভালো রাখবে!’
-‘আমার তোমার ভালোর প্রয়োজন নেই? তুমি যাবে?’
চিৎকার করে বললো রথি। মার্জান আরও কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু রথি মার্জানের কোনো কথাই কানে নেয়নি। মার্জান নিরাশ হয়ে তপ্তশ্বাস ফেললো। অতঃপর খাবার রেখেই চলে গেলো। রথি এখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
তার মধ্যে চলছে চরম হাহাকার, মারাত্মক হাহাকার। কেন সে বুঝতে দেরী করলো, নাশিদকে সে একান্ত ভাবে চায়? কেন আগে উপলব্ধি করেনি? এমন হবে জানলে সে আগেই নাশিদকে তার জীবনে প্রবেশ করাতো। সব তো ঠিকই ছিলো তাহলে কেন সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো?
নাশিদের মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভাসছে আর প্রতিনিয়ত ভেতরটা পুড়ছে, ভয়াবহভাবে।
রথির কাঁদতে কাঁদতে পুরোটা দিন চলে গেলো। খাবারটা আগের জায়গাতেই পরে রইলো।
সন্ধ্যায় মার্জান যখন চাচীর কাজে হাত লাগাতে ব্যস্ত তাতান তখন চুপিচুপি রুমে গিয়ে রথির ফোনটা নিয়ে অন করলো। অতঃপর ডায়াল লিস্টে ‘পুলিশম্যান’ নামটা দেখে তাতান কিছু না ভেবেই সেই নম্বরে কল দিলো। দুই তিনবার রিং হতেই তাতান চটজলদি বলতে লাগলো,
-‘আমার ফুপ্পিকে ওরা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে, আমার ফুপ্পি অনেক কান্না করছে!’
বাকি কথা বলার আগেই তাতান তার মায়ের আসার শব্দ পেলো। সে জলদি কল কেটে ফোন বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিলো।
রাতে ভাবী আরেক দফা খাবার দিতে এসে দেখে রথি আগের খাবারই খায়নি। ভাবী তপ্তশ্বাস ফেলে খাবারটা দিয়েই চলে গেলো। আগের খাবারটা সে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। রথি খাবারের দিকে একমনে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আপনমনে বলে উঠলো,
-‘যেখানে মনের সুখ নেই সেখানে এই খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না গো ভাবী! নাশিদ আপনি কোথায়? আমার কথা কী একটু মনে পরছে না? একটু আমার বাসায় গিয়ে আমার খবরটা নিয়ে আসুন। পারছি না আর! পুরো একটা দিন কেটে গেলো! এর মানে কী আবিরকে আমার…’
আর ভাবতে পারলো না রথি, কেঁদে উঠলো। আজ যদি বাবা থাকতো তাহলে হয়তো এমন কিছু হতো না। বাবা থাকলে হয়তো কারো এসব করার স্পর্ধাও হতো না। এসব ভেবে কাঁদতে কাঁদতেই রথি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেলো।
মাঝরাতে হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দ পেলো। সেই শব্দতেই রথির ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। পিটপিট করে তাকাতেই কোনো মানুষের অবয়ব দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গেই রথির ঘুম পুরোপুরিভাবে কেটে গেলো। রথি চোখ গোলগোল করে অবয়বটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। অবয়বটি ধীরে ধীরে রথির দিকে এগিয়ে আসছে। রথি যেই চিৎকার দিবে অবয়বটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘চেঁচাবেন না। আমি আবির!’
কন্ঠস্বর শুনে রথি শান্ত হলেও পরবর্তীতে দ্বিধা তৈরি হলো তার। আবির এতো রাতে এই রুমে কেন এসেছে? আবিরের খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই তো? রথি কাঁপা গলায় বলে,
-‘কেন এসেছেন এই অসময়ে?’
-‘ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি!’
-‘সাহায্য? কিসের?’
আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। অতঃপর থমথমে গলায় বলা শুরু করলো,
-‘দেখুন কোনো এক সময় আপনাকে পছন্দ করলেও এখন একজনকে ভালোবাসি। তখন হয়তো ভালোবাসা এবং পছন্দের পার্থক্য বুঝতাম না। তবে এখন বুঝি, উপলব্ধি করি। আমি আপনার বান্ধুবিকে ভালোবাসি রথি তাই আমিও এই বিয়ে করতে চাই না। মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন।’
-‘তাহলে এখন উপায়? এই বিয়ে হলে দুটো জীবন চোখ বুজে শেষ হয়ে যাবে!’
-‘আমি তো সেজন্যই এলাম। আমি আপনাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। আপনি চলে যান, মায়েরা এখন ঘুমাচ্ছে। এখনই সুযোগ। আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি, আপনি খুব শীঘ্রই মেইন রোডে যেতে পারবেন। আর কিছু টাকাও..’
-‘টাকার চিন্তা করতে হবে না। আপনি শুধু আমায় এখান থেকে বের করুন!’
আবির মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং রথিকেও উঠতে বললো। রথি উঠে দাঁড়ালেও ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যেতে নেয় তবে সে নিজেকে সামলে নেয়। সারাদিন এভাবে না খেয়ে, কান্না করে কাটানোর ফলই হয়তো এটা! রথি কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে আবিরের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। নিচে নামতেই আবির পথ বুঝিয়ে দিলো এবং রথির মোবাইলটাও এগিয়ে দিলো।
-‘আমি আগে ভাগেই তাতানকে দিয়ে আপনার ফোনটা নিজের কাছে রেখেছিলাম। আপনি এটা নিয়ে যান!’
রথি ফোনটা নিয়ে আবিরকে ধন্যবাদ জানালো। এই আবির না থাকলে সে যে এভাবে পালাতে পারতো না। রথি আবিরকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো। আর আবির নাফিসাকে কল করলো।
-‘রথিকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি নাফিসা, এখন আল্লাহ ভরসা!’
রথি দ্রুত ছুটতে লাগলো। সে এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে নাশিদের কাছে যেতে চায়। প্রাণপণে ছুটছে সে। মাঝেমধ্যে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলেও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। দিনের চেয়ে এই মাঝরাতটা পুরোই জনমানবশূন্য। সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন আর রথি নিজেকে বাঁচাতে ছুটতে ব্যস্ত। রাস্তা-ঘাট পুরো শূন্য। একটি গাড়ির চিহ্ন অবধি নেই। সেই রাস্তার মাঝে দিয়ে দৌড়ে চলেছে রথি। তার বারবার মনে হচ্ছে সে এই শহর ছাড়তে না পারলে ভাবী তাকে খুঁজে বের করে সত্যি সত্যিই আবিরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন সে আফসোস করবে কেন এই রাতে সে দ্রুত পালালো না। সারাজীবন আফসোস করার চেয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটে চলা ঢের ভালো। মাঝেমধ্যে রিস্ক না নিলে জীবনে অনেককিছুই খোয়াতে হয়, অনেককিছু।
রথির চোখের সামনে তার মায়ের চেহারাটা ভেসে উঠছে। ভাসছে তাদের সুখের সংসারের এক চিত্র। যেখানে বাবা-মা, ভাইয়া, রথি সবাই।
এসব ভাবতে ভাবতেই রথি যখন অদূরে মেইন রাস্তা দেখতে পেলো তখন খানিক থেমে হাঁপিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। অতঃপর আবার ছুটতে লাগলো। যখনই সে মেইন রাস্তায় উঠবে তখনই বাম পাশ থেকে একটা গাড়ি এদিকে আসতে লাগলো। গাড়িটি রথির খুব কাছে, খুব। রথি ভয়ে চিৎকার দিয়ে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো।
নাশিদ দৌড়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো। তার সঙ্গে নয়নও নামলো। রথির গায়ে লাগার আগেই নয়ন গাড়ি থামিয়ে ফেলেছিলো। নাশিদ ছুটে রথির সামনে আসতেই রথিকে বুকে টেনে নিলো এবং রথির গালে আলতো চড় দিতে লাগলো।
-‘এই রথি, রথি? এই? কী হলো? কথা বলছো না কেন? নয়ন! ও কেন কথা বলছে না?’ বিচলিত হয়ে বললো নাশিদ।
-‘স্যার শান্ত হোন। ম্যাম জ্ঞান হারিয়েছে, তাকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।’
নাশিদ আর ভাবতে পারলো না। রথিকে কোলে নিয়ে সে পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। নয়নও দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সারা রাস্তাতেই নাশিদ রথিকে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলো কিন্তু রথি কোনো সাড়াই দিলো না।
—————————-
-‘দেখুন মি. নাশিদ, উনি ভয় পাওয়ার কারণে জ্ঞান হারালেও মানসিকভাবে উনি অনেকটা দুর্বল। আই থিংক পেশেন্টের উপর অনেক মানসিক চাপ তৈরি করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কোনোটাই উনি ঠিকমতো করেননি।’
নাশিদ চুপ করে শুনলো কিছু বলার উত্তর পেলো না।
-‘এখন করণীয় কী ডক্টর?’
-‘আপাতত ওনার স্যালাইন করছে আর উনি এখন ঘুমাচ্ছে। ওনাকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে, কোনোরকম চাপ বা হতাশা থেকে বিরত রাখতে হবে। এই ধরণের মেন্টালি স্ট্রিস কোনো মানুষের জন্যই কল্যাণকর নয়।’
নাশিদ তপ্তশ্বাস ফেলে উঁকি দিয়ে রথিকে দেখলো। রথি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।