হিমাংশুর জলপদ্ম পর্ব-০৭

0
660

#হিমাংশুর_জলপদ্ম [৭]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

লাল টুক টুকে শাড়ি পরে সাদা বিছানার চাদরে স্বামীর অপেক্ষায় বসে আছে কুমুদ।দেখতে দেখতে কলো আকাশে সূর্যের তীর্যক আলো এসে পড়লো কুমুদের শরীরে তবু তার স্বামীর দেখা পাওয়া গেল না।লতা পাল ঘরের দরজায় জোরে বারি দিয়ে দরজা খুলে মুখ ভেঙচি দিয়ে কুমদের উদ্দেশ্যে বললো,

– এহনো সং সাইজ্জা বয়ে আছিস ক্যান? যা গিয়া ভাত চড়াই দে।

বুক ফেটে কান্না বের হতে চায়লো কুমুদের।তবে সে নিজেকে শক্ত করে চলে গেল রান্না ঘরে গায়ে এখনো তার লাল বেনারসি। নাকে কোনো সিঁদুরের অস্তিত্ব নেই।মেহেদী রাঙা হাতে দু মুঠো চাল ঝেড়ে ভাত বসালো কুমুদ।এভাবে পাঁচ দিন অতিবাহিত হলো।পাঁচ দিনের দিন সে জানতে পারলো তার স্বামী পাল বাড়ির বড় ছেলে ইন্দ্র পাল না।বরং পাল বাড়ির মেঝো ছেলে দেব পাল তার স্বামী।যাকে সে কখনো চোখের দেখাও দেখিনি। এ কথা শুনার কুমদের চারদিকটা অন্ধকার হয়ে এলো।তবে একদিক থেকে ভালোও লাগলো কার সে ইন্দ্রকে তেমন একটা পছন্দ করতো না।এসব ভাবতে ভাবতে পুকুরে কাপড়গুলো পানিতে ভাসাচ্ছে কুমুদ।সন্ধ্যা নেমে এলো প্রায়। এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি কুমুদের আর খাবেও না ভাবছে।রাতে একবারে থাকলে খেয়ে নিবে।কাপড়গুলো উঠিয়ে দুই সিঁড়ি পাড় পরতেই একটি বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে কুমুদের উদ্দেশ্যে বললো,

– দিদি রে শিশু গাছের তলায় দাদার পাওয়া গেছে।

কুমুদের হাত থেকে কাপড়গুলো পরে গেল।সে মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ছুটে বাড়ি যেতেই দেখতে পেল বাড়িতে মানুষের ঢল নেমেছে।লতা চিৎকার করে কাঁদছে আর তাকে ঘিরে গ্রামের সকলে নানান কথা বলছে।কুমুদ তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই লতা দৌড়ে এসে কুমুদের চুলের মুঠি ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– রাক্ষসী। গিলে খেলি আমার ছেলেটাকে?আমি জানতাম তুই একটা রাক্ষসী।

কুমুদ একহাতে চুল ধরে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো।কান্নারত কামিনী দৌড়ে এসে কুমুদকে ছাড়িয়ে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল।কুমুদ তার দিদিকে জরিয়ে ধরে অঝরে কাঁদতে রইলো।
অবুঝের মতো দিদিকে প্রশ্ন করলো,

– দিদি আমরা কেন এতো অভাগা?আমাদের কপালেই কেন এতো দুঃখ?

কামিনী ডুকরে কেঁদে উঠলো কি বলে নিজের বোনকে শান্তনা দেবে সে?সেও যে জন্ম থেকে এই একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যাচ্ছে সব জায়গায়।আজ পর্যন্ত কেউ তার এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না।

————
পিটপিট করে চোখ খুললো কুমুদ।চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার।সে খেয়াল করলো তার শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাসের সাথে ধূলোগুলোও তার বুকে জমা হচ্ছে। কুমুদ দূর্বল শরীরটা মাটি থেকে ওঠানোর চেষ্টা করলো।ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে।নিজের অবস্থান সম্পর্কে সে অজ্ঞাত। ঘরে আধারের রাজত্বে সে কিছু দেখতেও পারছে না।প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে সুপ্রিরয়ার রক্তাক্ত শরীর চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কুমুদ কেঁদে উঠলো।তবে গলা থেকে কোনো শব্দ বের হলো না।আওয়াজ বের করার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো ধূলোয় তার গলা আঁটকে গেছে।একটা কাশি দিলো কুমুদ। সাথে সাথে আরও কয়েকটা কাশি দিলো সে।চোখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো চারিদিকে। তবে কিছু দেখতে পেলো না সে।বুঝতে পারলো এখন রাত।বসে অপেক্ষা করলো সকাল হওয়ার।আবছা আলোয় ঘরের চটের বস্তাগুলো চোখে অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হতেই কুমুদ ঠাওর করতে পারলো সকাল হয়েছে।পাকস্থলী টানটান করছে খিদের যন্ত্রণায়।গলা বুক জ্বলে যাচ্ছে তৃষ্ণায়।দুই হাতে পেটে চাপ দিয়ে আবারাও মেঝেতে শুয়ে পড়লো কুমুদ।

————
– কিরে হিমাংশু তুই পড়াচ্ছিস?

হিমাংশু হাতে থাকা ইংরেজি সংবাদপত্রটি পাশে রেখে চায়ের কাপে শব্দ করে একটি চুমুক দিলো।মিনালের চোখে চোখ রেখে বললো,

– হ্যাঁ পড়াচ্ছি তাতে কি সমস্যা?

মিনাল থতমত মুখে বললো,

– না কোনো সমস্যা না।না মানে তুই তো এটার পক্ষে কখনো ছিলি না যে পড়াশোনার ক্ষতি করে টাকা আয় করা!তাহলে তুই নিজে কেন এখন?

হিমাংশু খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো,

– বিয়ে করেছি টাকা আয় না করলে বউকে খাওয়াবো কি?

মিনাল চমকে উঠে বললো,

– কিহ্?তুই বিয়ে করেছিস?কবে কখন?

– করলাম।

– এতো তাড়াতাড়ি?

– একদিন না একদিন তো করতেই হবে আগে আর পরে আগেই না হয় করে ফেললাম।

– বাহ বাহ তুই তো খুব বুদ্ধিমান।তা বাড়ি যাবি কবে?

– যাবো দেখি দুই একদিনের মধ্যে। চা খাবি?

– আমার কাছে টাকা নেই।

– আমি দিচ্ছি খাবি?

মিনাল উপর নিচ মাথা নাড়ালো। হিমাংশু টং দোকানের চা ওয়ালাকে ইশারায় এককাপ চা দিতে ইশারা করলো।তারপর আবারও চোখ হাতে থাকা ইংরেজি সংবাদপত্রে রাখলো।মিনাল মুখ কুঁচকে বললো,

– কি সারাটাদিন এই কাগজ পড়িস?যুদ্ধে যাবি না?

হিমাংশু চোখ খবরের কাগজে রেখেই বললো,

– এবার মনে হচ্ছে দেশ ভাগ হবেই।আর ইংরেজও দেশ ছাড়বে।

– ধূর যা হওয়ার হবে আমরা আদার বেপারী জাহাজের খবর নিয়ে লাভ নেই।বাদ দে তো।চল কলেজের ভিতরে যাবি তো?

হিমাংশু হাতের খবরের কাগজটিকে দুটিভাজ দিয়ে তার পাশে রাখলো।বললো,

– চল।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে