হিমাংশুর জলপদ্ম পর্ব-০৫

0
649

#হিমাংশুর_জলপদ্ম [৫]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

সুপ্রিয়ার সাথে এ কয়েকদিনে বেশ খাতির হয়েছে কুমুদের। দিনগুলো বেশ ভালোই যাচ্ছে কুমুদের।হিমাংশুর সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো স্মরণ করে আর হিমাংশুর অপেক্ষায় দিন গুণতে গুণতে বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল অবলীলায়।তবে এর মধ্যে একটি জিনিস কুমুদকে বেশ ভাবাচ্ছে ইদানীং আর তা হলো তার প্রতি দ্বীপের বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ। যা দ্বীপের থেকে কোনো ভাবেই আশা করা যায় না।কুমুদের দিকে তার চাহনি যেন কুমুদের মন এক নিমিষেই বিষিয়ে দিতে সক্ষম।তাল পুকুর থেকে মাটির কলসে পানি নিয়ে সবে বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করেছে কুমুদ সাথে সাথে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে তার হাত থেকে মাটির কলসটি নিচে ফেলে দিলো কেউ।হতবাক কুমুদ মাথা তুলে তাকাতেই ছলছল চোখে কান্নারত সুপ্রিয়াকে দেখতে পেল গালে হাত দেওয়া অবস্থায়। অবাকে কুমুদের চোখ কপালে উঠে গেল।সুপ্রিয়ার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,

– কি হয়েছে দিদি?

সুপ্রিয়া ডুকরে উঠলো।তার জবাব দেওয়ার ভাষা নেই।সে কিই বা জবাব দিবে?তার স্বামী যৌতুকের জন্য তার গায়ে কালসীটে দাগ ফেলে এ কথা তো আর ঢাক ঢোল পিটিয়ে সারা পাড়াকে জানাতে পারে না সে।তার স্বামী বংশীয় পরিবারের ছেলে নয় বলে তার মান সম্মান নাই বা থাকতে পারে তাই বলে কি সুপ্রিয়ারও কোনো মান সম্মান নেই?সে তো উচ্চ বংশের মেয়ে।নিত্যরঞ্জন রায় গৃহ এলাকার নাম করা বাড়ি আর সে বাড়ির মেয়ে হয়ে সুপ্রিয়া কিভাবে নিজের মান সম্মান সব খুইয়ে দেয়?
কুমুদের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ছুট দেয় তাল পুকুরের দিকে।হঠাৎই কুমুদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই বীভৎস দৃশ্য! এ দৃশ্য তো তার আগেও দেখা।তার দিদি এমনভাবেই ছুটে নদী গহ্বরে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিল।আজ সে দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে কি?সেদিন কুমুদ কিছু করতে পারেনি।তবে আজ সে থেমে থাকবে না।এক দিদিকে হারিয়েছে সে নিজের দোষে এখন যখন আবার এক নতুন দিদি পেল তাকেও এই একই ভাবে কুমুদ হারাতে চায় না।কুমুদ চিৎকার দিয়ে দৌড়ে সুপ্রিয়ার পিছন পিছন গেল।সুপ্রিয়া ঝাঁপ দিতে উদ্ধত হয়েছে ঠিক সেই সময় কুমুদ জাপ্টে ধরলো পিছন থেকে।সুপ্রিয়া কাঁদছে আর নিজেকে ছাড়ানোর জন্য কুমুদের সাথে ধস্তাধস্তি করছে।কান্নারত করুণ কন্ঠে সুপ্রিয়া বললো,

– আমাকে ছেড়ে দে কুমুদ।আমি আর এই বিষাক্ত বাতাস নিতে পারছি না।

কুমুদ সুপ্রিয়াকে আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরলে ভেজা কন্ঠে বললো,

– না না আমি তোমাকে ছাড়বো না দিদি।তুমিও চলে গেলে এই পৃথিবীতে আমি বড্ড একা হয়ে যাবো গো দিদি।আমাকে ছেড়ে যেও না।

সুপ্রিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো। বুকটা ভিষণ ভারি হয়ে আছে।কুমুদকে ছাড়িয়ে নিচে বসে পড়লো কাঁদতে কাঁদতে। কুমুদও সুপ্রিয়ার সাথে বসে পড়লো।কুমুদ সুপ্রিয়া চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে ধরা কন্ঠে বললো,

– দিদি তোমার কি হয়েছে আমাকে বলো।তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বলো দিদি।

সুপ্রিয়া দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– তুই আমার কষ্ট লাগব করতে পারবি না রে কুমুদ।আমার কষ্ট হৃৎপিণ্ডে।

– কেন তোমার এতো কষ্ট হচ্ছে আমাকে বলো, দিদি?

– তোর জামাইবাবুকে আমি যে এতোটা বছরে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।কিন্তু উনি টাকার জন্য আমার গায়ে হাত তুলতে একবারও ভাবে না।তার এ আচারণ যে আমাকে খুব পিড়া দেয় রে কুমুদ।

– জামাইবাবু তোমার গায়ে হাত তুলেছে কেন?

থমকে যায় সুপ্রিয়া।একি করছে সে? সে তার স্বামীর নামে বদনাম করছে? নিজেকে সংযত করে বললো,

– আরে না রে গায়ে হাত তুলবে কেন? একটু বকাবকি করেছে এই আরকি।চল বাড়ি যায়।

সন্দিহান দৃষ্টিতে সুপ্রিয়ার দিকে তাকালো কুমুদ। পরক্ষণে নিজের কৌতুহল দমিয়ে সুপ্রিয়াকে আর ঘাটালো না। বুকে হাজারো চাপা ব্যাথা নিয়ে দূর্বল পায়ে কুমুদের হাতে হাত রেখে হাঁটা ধরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।

কুমুদ এবং সুপ্রিয়া বাড়িতে প্রবেশ করে দ্বীপের দেখা পেল না।সুপ্রিয়া দ্বীপ ও তার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষে ঢুকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।সারা ঘর এলোমেলো অগোছালো হয়ে আছে।মনে হচ্ছে ঘরে হয়তো ডাকাত পড়েছিল তারাই ঘরের এ হাল করেছে।সুপ্রিয়ার বুঝতে বাকি রইলো না ঘরের এ হাল তার প্রাণ প্রিয় স্বামী দ্বীপের কাজ।ঘুনে খাওয়া কাঠের আলমারিটা হাট করে খোলা।সেদিকে এগিয়ে গেল সুপ্রিয়া আলমারি হাতিয়ে বুঝতে পারলো তার বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া সখের গয়নাগুলো আর নেই।তাও চলে গেল দ্বীপে লোভের দখলে।কান্নার বেগটা আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল।

কুমুদ সুপ্রিয়ার ঘরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সুপ্রিয়ার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে গলা উঁচিয়ে বললো,

– দিদি ভাত বসালাম আমি তুমি একটু বিশ্রাম নেও।

অপর পাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।কুমুদও অপর পাশ থেকে কোনো সাড়ার অপেক্ষা করলো না।কুলোয় দুইমুঠ চাল নিয়ে তা ভালো করে ঝেড়ে ধুয়ে চুলো জ্বালালো।এ যেন এক বিশ্বযুদ্ধের সমান।পাতা দিয়ে চুলো জ্বালাতে বেশ হিমশিম খেতে হলো কুমুদকে।উত্তরে বাতাস এসে বার বার চুলোর আগুন নিভিয়ে দিচ্ছে।

– একটা চুলো তাই ঠিক করে জ্বালাতে পারো না আবার এদিকে লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বউ সেজে বসে আছো।বলি খাওয়াবে কি আমাকে?

হঠাৎ পিছন থেকে ভরাট কন্ঠে এ কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরলো কুমুদ।সাদা পাঞ্জাবিতে স্নিগ্ধ এক পুরুষের আদল চোখে ভেসে উঠতেই কেঁপে উঠলো কুমুদ। সে কুমুদের দিকে এগিয়ে এসে কুমুদের কোমর অবধি কালো কুঁচকুঁচে আধা জটা চুলগুলো হাত খোঁপা করে মাথায় শাড়ির লাল আঁচল দিয়ে দিলো।একটু নিচু হয়ে হিসহিস করে কানে বললো,

– এবার একদম আমার বউয়ের মতো লাগছে।

কুমুদ কিছু বলছে না শুধু অবাক চোখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে।পিছন ফিরে যেই না সেই স্নিগ্ধ পুরুষকে স্পর্শ করতে গেল সাথে সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সেই পুরুষ।কুমুদ চমকে উঠে ঠোকর আলগা করে অস্ফুট স্বরে আনমনেই উচ্চারণ করলো,

– হিমাংশু!

সাথে সাথে দুইহাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো।দু’গালে থাপ্পড় দিয়ে নিজে নিজে বললো,

– ছিঃ!ছিঃ!হায় হরি মাফ করো।স্বামীর নাম মুখে নিয়ে নিলাম।মাফ করো আমাকে।ছিঃ!ছিঃ!

বলতে বলতে নাকে পোড়া গন্ধ আসতেই হুঁশ এলো কুমুদের চুলোর উপরে ভাতের তলা থেকে বেশ খানিকটা পুড়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। নাকে পোড়া গন্ধ লাগছে বেশ কঠোর ভাবে।কুমুদ হাঁড়িটা তুলে পাশে রাখলো।এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি প্রবেশ করলো দ্বীপ।আশে পাশে কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে উঠে গেল।কুমুদ অবাক হয়ে সেদিকে একবার দেখলো।ফের নিজের কাজে মন দিলো।আলুগুলো চাক চাক করে কেঁটে নুন,তেল,শুঁকনো মরিচে ভেজে ফেললো।সুপ্রিয়া আর দ্বীপের জন্য একটি কাঁসার থালায় ভাত আর আলু ভাজি উঠিয়ে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো সুপ্রিয়াকে,

– দিদি…ও দিদি..ভাত হয়ে গেছে যে জামাইবাবুকে নিয়ে খাবে আসো।

ভেতর থেকে কোনো জবাব এলো না না সুপ্রিয়ার কোনো জবাব পাওয়া গেল না দ্বীপের কোনো জবাব পাওয়া গেল।তাই কুমুদ আবার সেই একই ভঙ্গিতে ডাক দিলো সুপ্রিয়াকে,

– ও দিদি খাবে না?জামাইবাবুকে নিয়ে খেতে এসো ভাত বেড়েছি তো।

এবারও কোনো সাড়াশব্দ পেল না কুমুদ।তাই দুইহাতে দুই কাঁসার তালা নিয়ে হেঁটে বারান্দা পেরিয়ে সুপ্রিয়ার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। দরজাটা খোলা ছিল। দরজা ভেদ করে চোখজোড়া ঘরের অন্তরালে পৌঁছাতেই সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো কুমুদের। হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল থালা দুটো।কাঁসার থালা আর মাটির সংঘর্ষে তৈরি হলো এক অদ্ভুত শব্দ তরঙ্গ।থালা পড়ার শব্দে দ্বীপ জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে পিছন ঘুরে তাকালো।কুমুদকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সে।দ্বীপ পিছন ফিরতেই কুমুদের চোখের সামনে স্পষ্ট হলো মেঝেতে পড়ে থাকা সুপ্রিয়ার রক্তাক্ত দেহটি।শরীরের চারপাশে রক্তের বন্যা। থম মেরে সেই রক্তের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে কুমুদ!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে