হিমাংশুর জলপদ্ম পর্ব-০১

0
977

#হিমাংশুর_জলপদ্ম [১]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

কুমুদকে টেনে হিঁচড়ে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছে তার শ্বাশুড়ি।গায়ে তার একখানা সুঁতি সাদা শাড়ি সেও জায়গায় জায়গায় ছিঁড়া।হাতের শাখা পলাগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে।শিথির সিঁদুর লেপ্টে আছে তার কপাল আর মাথা জুড়ে।চোখমুখ সব পানিতে ভেজা।সারা গায়ে বিবর্ণ কাল সীটে দাগ বসে আছে।কুমুদের পাঁচ দিনের শ্বাশুড়ি এক ঘটি পানি দিয়ে কুমুদের কপাল ও মাথার অবশিষ্ট সিঁদুরের অস্বস্তিও ধুয়ে মুছে দিলো।চোখ দিয়ে অবলীলায় ঝড়ে যাচ্ছে মুক্ত দানা।জটা পাকানো চুলগুলো যেন মাথার ভাড় বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকশ গুণ। সবে চৌদ্দ বছরে পা দিতে দিতেই তার জীবনে শুরু হলো কঠিন প্রলয়।সর্বপ্রথম তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিবাহ।অতঃপর দিন পাঁচেক না যেতে বিধবা! এই পাঁচ দিনে নিজের স্বামীকে একপলক দেখার সুযোগও হয়নি কুমুদের।দেখবে কিভাবে এতোদিন তো ঘরমুখো হলো না তার স্বামী। আর আজ যখন বাড়ি ফিরলো তখন জানা গেল সে স্বর্গবাস নিয়েছে।আর তার সাথে নাকি চৌদ্দ বছরে পদর্পনকারী কুমুদকেও জ্বলন্ত চিতার কালো ধোঁয়ায় মিশে যেতে হবে।দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা চিতার দিকে ভীত চাহনি দিয়ে ঢোক গিললো কুমুদ।এ কেমন আচার?যাকে সে চোখের দেখাও দেখলো না তার জন্য মাত্র চৌদ্দ বছরে জীবন উৎস্বর্গ করবে?শ্বাশুড়ির আলতা রাঙা পা ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো কুমুদ দিশাহীন হয়ে বলতে লাগলো,
-ছেড়ে দেন মা।দয়া করুন এই জ্বলন্ত চিতায় আমাকে ছুঁড়ে ফেলবেন না।

ডান হাতে কুমুদের জটা পাকানো চুলগুলো মুঠো করে ধরে তলপেট বরাবর একটি পায়ের আঘাত করলো কুমুদের শ্বাশুড়ি লতা পাল।আরেক হাতে দু গাল চেপে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললেন,
– অলক্ষ্মী মুখপুড়ি!অনাথ দেখে এনেছিলুম ছেলের জন্য। যাতে মাসে একবারের জন্যও বাপের ভিটেই না যাস।নইলে তো বাপটা আমার না খেতে পেয়ে মরতে।আমার সেই সোনার ছেলেকে শেষ করে দিলি মুখপুড়ি।তোকে আমি বাঁচিয়ে রাখবো ভাবলি কেমন করে?

কুমুদের সাদা শাড়িতে শ্মশানের কাঁদামাটি নিজের মনে বেশ নকশা এঁকেছে।কুমুদ দু-হাত এক করে করুণ স্বরে বলে উঠলো,
-আমি কিছু করিনি মা।আমি তো এই পাঁচটা দিনে আপনার ছেলের মুখও দেখিনি।

-মর!মর!মুখপুড়ি ছ্যা!ছ্যা!ঐ অপবিত্র মুখে আমায় মা ডাকবি নে একদম। রাক্ষসী ছেমড়ি আমার সোনার টুকরোটাকে গিলে খেলো রে।

কথাটা শেষ করে দু’হাতে বুকে থাবা দিতে দিতে আবারও জ্ঞান হারালেন লতা।এ নিয়ে ছয়বার হলো।গ্রামের সকল মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করতে ব্যস্ত।এই সুযোগে পালিয়ে যাওয়ার তোড় করে কুমুদ। তবে কয়েক কদম ফেলতে না ফেলতে জটলা পাকিয়ে থাকা চুলে টান পরে তার।কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ চুলির মুঠি ধরে টেনে জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করতে যায়।তবে ধস্তাধস্তির দরুন এবারও নিজের শ্বাসটা টিকিয়ে রাখে কুমুদ। নিশ্বাসের সাথে চিতার কালো ধোঁয়াগুলো মিশে যেন শ্বাসরোধী এক দ্বার তৈরি করেছে নাসারন্ধ্রে।শ্বাসটাকে ধরে রাখতে নাকের সাথে সাথে মুখেরও সাহায্য নেয় কুমুদ।কুমুদের চুলগুলো আরো দৃঢ় করে ধরে চিতার কাছে নিয়ে আসে লতা।চিতার আগুনের তাপে মুখটা ঝলসে ওঠে কুমুদের।শক্তিতে কুমুদের সাথে পেরে না উঠে লতা কটমট করে বলে উঠলো,
– শক্তি বেড়েছে মুখপুড়ির।আমার ছেলেটাকে গিলে শক্তি বেড়েছে কাল নাগিনীর!তোকে আমি ছেড়ে দেব না রে মুখপুড়ি তোকে তো আমি আমার ছেলের চিতার আগুনেই শেষ করবো।

কুমুদকে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় লতা।কুমুদ টাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়তে যায় জ্বলন্ত চিতায়।ওমনি তার হাতের কব্জিতে টান পেয়ে নিজের পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে কুমুদ।ঘুটঘুটে অন্ধকারে চিতার আগুনেই চারপাশটা আলোকিত হয়ে আছে।এ যেন আধারে জ্বলা মোমবাতির একটি টুকরো।সেই আলোতে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিতা এক স্বল্প বয়সী যুবককে নিজের হাত ধরে থাকতে দেখে চমকে ওঠে কুমুদ। ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় নিজের হাত সেই যুবকের হাত থেকে।সে ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকিয়ে আছে কুমুদের দিকে।মস্তিষ্ক হাজার প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসেছে মুহুর্তে। একি? এতো রাতে এই নারী কেন এই জ্বলন্ত চিতায় ঝাপ দিতে যাচ্ছিল?এতো মানুষ দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখার শর্তেও কেউ বাঁচাতে এলোনা!নিজে মস্তিষ্কের কৌতূহল মেটাতে সে মুখ ফুটে বলেই বসলো,
– একি?এখানে একজন জ্বলন্ত চিতায় ঝাপ দিচ্ছে আর আপনারা দাঁড়িয়ে দেখছেন?

ছেলেটির সামনে এগিয়ে এলো লতা।চোখজোড়া কোটর থেকে বের করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-এই ছোকড়া কে রে তুই?ওকে বাঁচালিই বা কেন?

-মানে একটা মানুষ মৃত্যুর মুখে আর তা নিজের চোখে দেখেও আমি তাকে বাঁচাবো না?আপনাদের মতো দাঁড়িয়ে শুধু দৃশ্য গিলবো?

– আমার গাঁয়ে এসে আমার মুখের উপর কথা?এই রাক্ষসী মরলে তোর কি রে?ও আমার ছেলেকে গিলে খেল তখন তুই কোথায় ছিলি?

– মানে?

ছেলেটার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না লতা।গ্রামের একমাত্র চামচা হরিকে ইশারায় চিতার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝালো।হরি কচুমাচু করে কুমুদের দিকে এগিয়ে গেলেই কুমুদ দুকদম পিছিয়ে গেল।তা দেখে লতা দাঁত কিড়মিড় দিয়ে বললেন,
– এই হরি দেখছিস কি?রাক্ষসীটাকে চিতায় ওঠা আমার বাপটার আত্মাটা একটু শান্তি পাক।

যেই কথা সেই কাজ লতার অনুমতি পেয়ে হরি একমুহূর্ত দেরি করলো না। কুমুদের হাত ধরে টেনে আবার চিতায় নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত হলো।পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটি এতক্ষণ চুপচাপ সব দেখলেও এবার আর চুপ রইলো না সে।দ্রুত পা চালিয়ে কুমুদের কাছে গিয়ে হরির থেকে কুমুদের হাত ছাড়িয়ে হরিকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিলো সে।চিৎকার করে বলে উঠলো,
-কি দোষ ওর কেন ওকে এই চিতায় পুড়াতে চান?

এতক্ষণে একগ্রামবাসী মুখ খুললো।ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ওর দোষ ও বিধবা।

ছেলেটি অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
-বিধবা?

-হ্যাঁ। সামনে যার চিতা জ্বলছে তা হলো ওর স্বামীর চিতা।আর ওকে এখন এই চিতায় বসে ওর স্বামীর সাথে স্বর্গে যেতে হবে।

-সতীদাহ্!

– হ্যাঁ।হ্যাঁ ঐ একি কথা।

কুমুদ নিজের হাত ছাড়াবার জন্য ছেলেটির সাথে একপ্রকার ধস্তাধস্তি শুরু করলো।ছেলেটি কুমুদের হাত ধরে নিজের পিছনে লুকিয়ে ফেললো।ভীত কন্ঠে বললো,
– না না এই অন্যায় আমি হতে দেব না।এতোটুকু একটা মেয়ের সাথে এই অন্যায় হতে পারে না।

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন লতা কোমরে বাঁধা শাড়ির আঁচলটি আরও শক্ত করে বেঁধে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললেন,
– তাহলে কি করবি তুই?এই বিধবা রাক্ষসীর দায়িত্ব নিবি তুই?একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ এই মেয়ে যদি আজ চিতায় না ওঠে তবে ওকে গ্রাম ছাড়া হতে হবে।

– সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার থেকে এই জঘন্য গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া ভালো।অন্তত বেঁচে তো থাকতে পারবে।

মুখ ভেঙচি দিলেন লতা।এমন সময় লতার একমাত্র জা তার কাছে এগিয়ে এসে তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,
– ছেলেটা বেশ ছোট এতোকিছু বোঝেনা।তুমি এককাজ করো ঐছেলেটাকে বলো কুমুদকে বিয়ে করতে তাহলে দেখবে লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। তখন ঐ কাল নাগিনীটাকেও চিতায় উঠিয়ে দেওয়া যাবে।

– ঠিক বলেছিস।অসভ্য এসে আমাদের আটকাতে।এই সমাজকে আটকাতে।

কুমুদের এই মুহুর্তে নিজের প্রাণ বাঁচানোর কথা ছাড়া আর কোনো কথা মাথায় আসছে না।এই ছেলে তো তার ভালোই করতে চায়ছে।যদি এই ছেলেটার বদৌলতে সে এযাত্রায় প্রান ভিক্ষা পায় তবে ক্ষতি কি?ছেলেটার পিছনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো কুমুদ।লতা মুখে কুৎসিত হাসি দিয়ে ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললেন,
– এই ছেলে নাম কি তোমার?

ছেলেটি ভ্রুকুটি করলো একটু আগেও যে তাকে তুইতুকারি করছিল হঠাৎ এখন সে কেন এতো ভালো ব্যবহার করছে?তবু ছেলেটি ভদ্রতার খাতিরে বললো,
– হিমাংশু আমার নাম।হিমাংশু রায়।

– দেখে তো এ গাঁয়ের লাগছে নে।তা বাড়ি কই তোমার?এখানে কোথায় এয়েছো?

– বাড়ি শহরে।পাশের গ্রামে দিদির ননদের শ্বশুর বাড়ি এসেছি।

– ওকে তুমি বাঁচাতে চাও?

– অবশ্যই আমি আপনাদের মতো অমানুষ না।

– এ রে কি কয় দেখ ছোকরা আমরা নাকি অমানুষ। তা ছোকরা তোমার বুঝি জানা নেই জোয়ান মাইয়ার স্বামী মরলে সেই মাইয়ারেও চিতায় ওঠায় দিতে হয়।

– এটা অনেক আগের রীতি এখন আর এটি প্রচলিত নেই তাহলে কেন এই মেয়েটির সাথে এমন অবিচার হচ্ছে?

– হ আগের রীতি বটে।তই আমরা এখনও পালন করি এই রীতি।আমাগো গ্রাম এই রীতিতেই চলে।তাই ভালোই ভালোই কইতাছি ঐ নাগিনী রে আমাগো হাতে তুইলা দাও।

– না আমি এখানে উপস্থিত থাকতে ওকে এভাবে পুডতে দেবো না।

– এ রে কয় কি ছোরা।ঐ মাইয়া না পুইড়া এই গাঁয়ে থাকতে পারবে?

কোমরে হাত বেঁধে ভ্রু যুগল নাচিয়ে নাচিয়ে কথাটা বললেন লতা।পাশ থেকে তার জা আবারো তাকে তাগাদা দিলেন আসল কথাটা বলার জন্য।লতা মুখ খুলে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই হিমাংশু বললো,
– কেন আপনারা ওকে মারতে চান?ওকে ছেড়ে দিন।কি করলে ওকে ছেড়ে দিবেন আপনারা?

লতার মুখের কুৎসিত হাসিটা আবারও ফিরে এলো।সে তার সারা শরীর দোলাতে দোলাতে বললেন,
– ছড়তে পারি তবে এক শর্ত আছে।দেখ ওই তো এই গায়ে আর থাকবার পারবো না।আর না ওর দায়িত্ব কেউ নিবো।তা তুই যদি ওরে বিয়া কইরা ওর দায়িত্ব নিস তবেই ছাইড়া দিমু।

লতার কথা শেষ হতে না হতেই হিমাংশুর মাথায় বাঁজ পড়লো।কি বলছে এসব?তার বয়স তো বেশি না সবে বাইশে পা দিলো এখনই বিয়ে?তাছাড়া তার বাবা-মা এভাবে বিয়ে করলে তা মেনে নেবে না তা নিশ্চিত। কিন্তু মেয়েটাকেও তো এভাবে জ্বলন্ত চিতায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় না।কি করবে সে?
লতার কথা কর্ণপাত হতেই কুমুদের ভিতরটা হু হু করে উঠলো এবার আর তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।লতা জেনেশুনেই এমন একটা শর্ত দিয়েছে যা কখনই পূরণ হবার নয়।
লতার জা পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে লতার কানে আবারও ফিসফিসিয়ে বললো,
– দেখেছো দি কেমন দারুন বুদ্ধি দিলাম।

হিমাংশু চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
– অসম্ভব আমি এমন কিছুই করতে পারবো না।

হু হু করে কেঁদে উঠলো কুমুদ পিছন থেকে হিমাংশুর দুই পা জরিয়ে মাটিতে বসে পড়লো।চমকে উঠলো হিমাংশু।হিমাংশুর দুই পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কান্নারত অবস্থায় আঁটকে আসা গলাটা দিয়ে সামান্য আওয়াজ বের করে বললো,
– দয়া করে আমাকে বাঁচান।আপনার পায়ে পড়ি আমাকে বাঁচান।

কুমুদের আহাজারি দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো লতা বিদ্রুপ করে বললো,
– কচু বাঁচাবে তোকে রাক্ষসী। ও হলো উঁচু বংশের ছেলে তোর মতো জাত পরিচয়হীন মাইয়ারে দিয়ে জুতোও পরিষ্কার করায় না সেখানে বিয়ে তো অনেক দূরের কথা।

জ্বলজ্বল করে উঠলো হিমাংশুর চোখ।সটান মেরুদণ্ড সোজা করে কুমুদের ডান হাত ধরে একটানে কুমুদকে দাঁড় করিয়ে দিলো।তারপর চিতার চারপাশে সাতবার ঘুরে আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো।লতা এবং পুরো গ্রামবাসী তাদের দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো।কুমুদ নিজেও বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে হিমাংশুর দিকে।এক গ্রামবাসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– সিঁদুর আছে?

সেই লোকটির চোখ দুটো আরও বড় হয়ে গেল।অতঃপর দৌড়ে গিয়ে তার বউয়ের সিঁদুরের কৌটিটা এনে হিমাংশুর হাতে দিলো।কালবিলম্ব না করে হিমাংশু সেখান থেকে তর্জনি ও বৃদ্ধ আঙুলের সাহায্যে কিছুটা সিঁদুর নিয়ে কুমুদের সিথিতে ছড়িয়ে দিলো। কেঁপে উঠলো কুমুদ। সাদা শাড়িতে সিথি ভরা লাল টকটকে সিঁদুর আগুনের হলুদ আলো এসে ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে।কোমর অবদি কালো কুঁচকুঁচে চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে চলেছে দিকবিদিকশুন্য হয়ে।অবাক চোখে কুমুদের দিকে তাকিয়ে আছে হিমাংশু নিজেকে যেন কোনো নতুন দেবীর আবিষ্কারক মনে হচ্ছে। এদিকে ক্ষিপ্ত লতা পাল ভাবতেই পারেনি হিমাংশু সত্যি সত্যি তার শর্ত পূরণ করবে।ছেলেটাকে তো সে বোকা মনে করেছিল।ক্রোধে ফেটে পড়ে লতা বললেন,
– কি ভেবেছিস তোরা?এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি?তোদের দুটোকেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবো।

লতার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে তাকে ধাক্কা দিয়ে শ্মশানে ঢুকলো লাল খয়েরীর মিশ্রণে তৈরি রঙের শাড়ি পরা এক যুবতী।দেখতে বেশ কিছুটা কুমুদের মতো।তবে সে কুমুদের থেকে একটু ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী। কুমুদের দিকে ভয়াতুর দৃশ্য নিক্ষেপ করলো।কুমুদের সিঁথি সিঁদুর দেখে চমকে উঠে লতা পালের দিকে তাকালো সে।লতা তার দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে।দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
– এসেছে আরেক কাল নাগিনী।

সে জলে ভরা ঘোলা চোখ নিয়ে কুমুদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
– পালা! কুমুদ,পালা।

বলেই দৌড়ে শাড়ির আঁচল মাটিতে ঘেঁষতে ঘেঁষতে শ্মশানের ধারের নদীর পারে চলে গেল সে।কেউ কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়লো নদীগহ্বরে।সবাই সেদিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠলো। হঠাৎ এমন কিছু হবে তা উপস্থিত কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।হিমাংশু চিৎকার করে বলে উঠলো,
– আরে…উনি তো লাফ দিলেন কেউ বাঁচান ওনাকে।আমি সাঁতার জানিনা।

– ও কে পরে বাঁচা আগে নিজে বাঁচতে পারিস কিনা তা দেখ।

কথাটা বলে দাঁত খিঁচিয়ে একটা বিশ্রি হাসি দিলো হরি।কুমুদ তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছে এ দৃশ্য যেন তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। যখনই মস্তিষ্ক আবার সচল হলো কান্নায় ভেঙে পড়লো কুমুদ। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
– দিদি!আমার দিদিকে বাঁচাও কেউ ও যে সাঁতার জানে না।

কুমুদ দৌড়ে নদীর কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো।নাহ্ নদীর পানি একদম নিস্তব্ধ! কিছুক্ষণ আগেও এখানে তার দিদি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। ঠিক যেমন ঝড়ো হাওয়ায় মোম দবদব করে নিস্তব হয়ে যায় ঠিক তেমন ভাবে তার দিদি ছটফট করে পানিতে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।নদীর কিনারায় বসে পড়লো কুমুদ অঝরে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে শুধু একটা বলতে লাগলো,
– দিদি…!ওকে কেউ বাঁচাও ও যে সাঁতার জানে না।

হিমাংশু করুণ চোখে তাকিয়ে আছে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী দিকে।পিছন থেকে হঠাৎ শোরগোলের আওয়াজ পেতেই হিমাংশু ঘাড় বাঁকালো।সাথে সাথে পিলে চমকে উঠলো তার।অর্ধশতাধিক মানুষ হাতে মশাল আর ধারালো অস্ত্রে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।শুঁকনো এক ঢোক গিললো হিমাংশু।কুমুদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার পিছন ফিরে দেখলো।অতঃপর কোনো কিছু না ভেবে কুমুদের ডান হাতটা নিজের হাতে মুঠোয় ধরে দিকবিদিক ভুলে দৌড় লাগালো।পিছন থেকে উচ্চধ্বনিতে শোনা গেল এক বাক্য,

– ধর ওগো। যেন পালাতে না পারে।আজকাই দুইটাকে জ্যান্ত পোড়াবো।

কুমুদ তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।তার চোখের সামনে শুধু তার বোনের ছটফটানির দৃশ্য ভাসছে।হিমাংশু কুমুদের হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে কোনো এক অজানা বিলে এসে থামলো।হিমাংশু কুমুদের হাত ছেড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো।সামনে তাকিয়ে সীমানাহীন বিল দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো তার অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,
– এ কোথায় এসে পড়লাম?

কথাটা শেষ করে পাশে তাকিয়ে কুমুদকে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– নাম কি তোমার মেয়ে?

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে