#হাসনাহেনা ❤️
#জিন্নাত_আফরিন
||পর্ব: ০৯||
হেনাকে হসপিটালে নিয়ে যায় নিবিড়। এর মাঝেই নাইরা বেগম, নাইমা, আর নীহান সাহেব কে ফোন করলে তারা ছুটে আসে।
তাকে দ্রুত চেক-আপের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। নিবিড় কেবিনের সামনে পাগলের মতো পায়চারী করতে লাগল। নীহান সাহেব এসে বললেন, “কী হয়েছে বাবা? হেনা মায়ের কী হয়েছে? হসপিটালে কেন নিয়ে এলি ওকে?”
নিবিড় অশ্রুজল চোখে বলল, “জানি না আব্বু। আজ ওকে নিতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই ওই বেয়াদব ক্যারেক্টার লেস টার হাতে পড়েছিল। কোনরকম তার থেকে বেঁচে আমার কাছে এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ মাথা চেঁপে ধরে চিৎকার দিয়েছিল, যেন খুব কষ্ট পাচ্ছিল সে। এরপর হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল।
আব্বু, ও এখানে আসার পর থেকেই দেখছি অনেকবার অজ্ঞান হয়েছে। কী হয়েছে ওর আব্বু?”
নীহান স্বান্তনা দেয় ছেলেকে, “শান্ত হও বাবা ওর কিছুই হয়নি। কিছুই হবে না ওর। আল্লাহ’র উপর বিশ্বাস রাখো।”
কিন্তু নিবিড় নিজেকে সামলাতে পারে না। একটু পরই মলিন মুখ ড. রীনা বেরিয়ে এলেন। নিবিড় দ্রুত ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করল, “ম্যাম.. হেনা! কেমন আছে ও? আর.. ওর কী হয়েছে?”
ড. রীনা কেন যেন চুপ হয়ে থাকে। নীহান সাহেব বললেন, “কী ব্যাপার ড. কিছু বলছেন না কেন? কী হয়েছে হেনার?”
রীনা মলিন মুখে একটা রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা.. পেশেন্টের এক্স-রে রিপোর্ট।”
নীহান সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে সেটি নিলেন। থমকে গেলেন সেটা দেখে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠেন, “হ-হেনার ব-ব্রেন টিউমার?”
মাথায় বা’জ পড়ল সবার। নিবিড় বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পড়ল। সে যেন এক মূর্তি যার মধ্যে কোন প্রাণ নেই। নাইরা বেগম হতভম্ব হয়ে বললেন, “এ-এসব ক-কী বলছেন ড. রীনা? হ-হেনার ব্রেন.. টিউমার?”
রীনা মাথা নাড়লেন। নাইরা বেগম আর নাইমা কেঁদে উঠলো। নিজেদের সামলাতে পারল না তারা। নীহান সাহেব হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এদিকে নিবিড় নির্জীব। কী শুনছে সে? হেনার ব্রেন টিউমার?
নীহান সাহেব বললেন, “মিস. রীনা, কিছু তো করুন। কোন ভাবে তো হেনাকে বাঁচানো যেতে পারে।”
রীনা বললেন, “হয়তো যেতে পারে, কিন্তু খুব টাফ ব্যাপার।”
নিবিড় যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কানে শুধু একটা কথাই বাঁজছে, হেনাকে সে হারিয়ে ফেলবে। ড. রীনা প্রস্থান করলেন। নীহান, নাইরা বেগম আর নাইমা তিনজন মিলে গেল হেনার কেবিনে।
তারা বেরিয়ে আসতেই শেষে নিবিড় হেলেদুলে প্রবেশ করল তার রুমে। হেনা বিছানায় আঁধশোয়া হয়ে বসে আছে। নিবিড় হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে জাপ্টে জড়িয়ে ধরল হেনাকে। কাঁদতে লাগল সে। হেনা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। নিবিড়ের পিঠে হাত রেখে বলল, “আরে.. আ-আপনি কাঁদছেন নিবিড় ভাই?”
নিবিড় কিছু বলে না। হেনা আবারো বলল, “কী হলো নিবিড় ভাইয়া আপনি কাঁদছেন কেন? কিছু কী হয়েছে? দেখুন এভাবে কাঁদলে তো আমি কিছুই বুঝতে পারব না আপনি বলুন প্লীজ।”
নিবিড় তাকে ছেড়ে বলল, “কিছুই হয়নি হেনা। কিছুই হয়নি। তুই ঠিক হয়ে যাবি। তোর কিছুই হবে না। আমি আছি না তোর পাশে?”
হেনা কিছুই বুঝতে পারল না, “কী হয়েছিল আমার?”
“কিছুই হয়নি তোর শুধুই টেনশন করছিস। কিছুই হয়নি তোর।”
হেনার সন্দেহ হলো। নিবিড় এমন করছে কেন? নিশ্চয়ই কোন কিছু একটা হয়েছে।
___________
হেনাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। নিবিড় আর বাকিরা আগের থেকে যত্ন বাড়িয়ে দিল তার৷ নিবিড় তাকে আজকাল নিয়মিত ক্লাসও করতে দেয় না। বলতে গেলে তেমন ঘর থেকেই বের হতে দেয় না৷ তার একটাই চিন্তা, হেনার যাতে কিছু না হয়।
এর মাঝে বেশ কয়েকবার অজ্ঞানও হয়েছে সে। এতে সবাই আরো ঘাবড়ে গেছে। নাইমা প্রায় সময়ই হেনার সঙ্গে কাঁটায় এখন। নাইরা বেগম এখন নিজ হাতে তাকে খাওয়ান, নিজেই তাকে আদর যত্ন করেন, গল্প শোনান সেউ ছোট্টবেলার মতো। নীহান সাহেবও এখন প্রায় বাসায় থাকেন আর নাইমা হেনাকে নিয়ে গল্পগুজব করেন। আর রইল নিবিড়! সে তো পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই রাতে হেনা ঘুমিয়ে গেলে তার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। হেনার বেশ কয়েকবার ঘুম ভে’ঙে যাওয়ায় সে নিবিড়কে লক্ষ করেছিল। সে প্রায় সময়ই তাকে জায়নামাজে বসে থাকতে দেখতো। রাতে ঘুম ভে’ঙে গেলে দেখতো নিবিড় তাহাজ্জুদ পড়ছে, আর দু’হাত তুলে খুব কাঁদছে আর কী যেন বলছে।
সবই হেনাকে খুব ভাবায়। কী হচ্ছে এসব তার সাথে? তবে কী তার বড় ধরনের কিছু হয়েছে যার জন্য সবাই এমন করছে?
_________
মাথায় বা’জ পড়ল হেনার। হাতে সেই রিপোর্ট। থম মে’রে রিপোর্টের দিকে চেয়ে রইল সে। নাইরা বেগমের ড্রয়ারে তার চিরুনি আর তেল খুঁজছিল৷ এর মাঝে একটা রিপোর্টে পেশেন্টের নামের মধ্যে তার নাম দেখতে পায় সে। কৌতুহল বশত সেটা হাতে নিয়ে পড়তেই মাথায় আকাশ ভে’ঙে পড়ল তার। তার ব্রেন টিউমার? আর এটা তাকে কেউ জানায় নি? কেন জানায় নি? কেঁদে ফেলল হঠাৎ হেনা। তার কী আর তার ফুঁপি, বাবা, নাইমা আর নিবিড়ের সাথে থাকা হবে না? তাদের সঙ্গে জীবন কাটানো হবে না? তার চেয়ে বড় কথা, তবে কী নিবিড়কে তার মনের কথা জানানো হবে না?
মুহুর্তেই তার চোখ লাল বর্ণ ধারণ করল। ছুটে রুমে গেল। সব এলোমেলো করে দিল। সব জিনিস এদিক ওদিক ছুড়ে মা’রতে লাগল। তারপর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে পড়ল। কান্নায় ভে’ঙে পড়ল সে।
নিবিড় প্রবেশ করতেই আশপাশ দেখে অবাক হয়ে গেল। হেনাকে এভাবে নজরে আসতেই সে বেশ ভড়কে গেল। দৌড়ে এসে বলল, “হেনা! কী হলো এখানে? এই অবস্থা কেন? আর তুই কাঁদছিস কেন? প্লীজ বল। কী হয়েছে?”
হেনা কান্না থামিয়ে মুখ তুলে তাকাল নিবিড়ের দিকে। উঠে নিবিড়কে ধাক্কা মে’রে বলল, “আপনারা, আপনারা সবাই আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন, মিথ্যে বলেছেন যে আমার কিছুই হয়নি। কেন করলেন এমন বলুন!”
নিবিড় অবাক হয়ে বলল, “কিসব বলছিস তুই?”
হেনা হাতে থাকা রিপোর্ট টা দেখিয়ে বলল, “এবার বলুন মিথ্যে বলেন নি? বলুন! আমায় কেন এর কথা বলেন নি। কেন লুকিয়েছেন?”
নিবিড় থমকে গেল৷ হেনা চেঁচিয়ে বলল, “বলুন কেন লুকোলেন?”
নিবিড়ের আঁখিকোণে জল দেখা গেল। হেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার জীবনে কী কখনোই সুখ নামক জিনিস টা থাকবে না নিবিড় ভাই? আমি এমন কেন? কেন ভাগ্য আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? কেন বলুন? আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই, আপনার সঙ্গে জীবন কাটাতে চাই। আমি.. আপনাকে ভালোবাসি নিবিড় ভাই, ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।”
নিবিড় আবারো থমকে গেল। হেনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই পাগলি কাঁদছিস কেন? দেখ তোর কিছুই হবে না। আমি.. আমি আছি না তোর সাথে। তোর কিছুই হবে না তুই ঠিক হয়ে যাবি।”
“আ-আমি হয়তো.. আর বাঁচবো না, ন-নিবিড় ভাই.. আমি হয়তো…
“চুপ! একদম চুপ কোন কথা বলবি না তুই। কিছু হবে না তোর আমি সব ঠিক করে দেব।”
হেনা আবারো অজ্ঞান হয়ে গেছে। নিবিড় এবার আরো বেশি পাগলামি শুরু করল। তাদের চিৎকার শুনে এর মাঝে নাইমা, নাইরা বেগম আর নীহান সাহেবও হাজির হয়েছেন। হেনা অজ্ঞান হয়ে গেছে দেখে নীহান সাহেব বললেন, “নাহ! আর অপেক্ষা করা যাবে না। এভাবে মেয়েটা কে আমরা ডুবতে দিতে পারি না। অনেক হয়েছে। আজই আমরা ওকে হসপিটালে নিয়ে যাব। হেনা বাঁচবে। অবশ্যই সে আমাদের জন্য বাঁচবে। বাঁচতে হবে তাকে।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]