#হাসনাহেনা ❤️
#জিন্নাত_আফরিন
#প্রথম_প্রহর
সতেরোর গণ্ডি পেরিয়ে আঠারো হতে না হতেই সৎ মা রূপা বেগম এক চল্লিশ বছর বয়সী বুড়োর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন হেনার। আফজাল সাহেব আপন বাবা হয়েও তিনি চুপ। রূপাকে তিনি খুব ভালোবাসেন। তার কথাতেই উঠবস করেন। তাই এতেও না করেন নি।
হেনা অনেক কান্না করেছে। পায়ে পড়েছে শুধুমাত্র বিয়েটি থামিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিয়ে তো থামায় নি। উল্টো ব্যাতের ঝাড়ু দিয়ে আধঘন্টা মতো আ’হার করেছে তাকে।
_________
রুমের কোণে বধুবেশে চুপটি করে বসে আছে হেনা। চোখ বেয়ে অসংখ্য অশ্রুকণা বিরতী হীন ভাবে পড়ে চলেছে। মা’র খাওয়ার ফলে আরো দূর্বল হয়ে পড়েছে। অবশ্য এ নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই কোন না কোন বাহানায় রূপা বেগমের মা’র খেয়ে আসছে সে। কিন্তু সে তো এটা ভাবে নি যে আঠারো বছরে পা রাখতেই তার মা এভাবে তার বাবার বয়সী একজনের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করবে।
হাসনাহেনা নূর। আফজাল সাহেব আর আফিয়া বেগমের একমাত্র মেয়ে। দূর্ভাগ্যবশত আফিয়া বেগম হেনার ছয় বছর হতে না হতেই ক্যানসারে মারা যান। আর আফজাল সাহেব মেয়ের দেখাশুনা করার জন্য হেনার সাত বছর বয়সেই রূপা বেগমকে বিয়ে করেন। রূপা আর আফজালের কোন সন্তান নেই। কিন্তু সৎ মা তো আর আপন মা হয় না। অত্যাচারে অত্যাচারে বড় হয়েছে হেনা। কিন্তু এত বড় চমক সে পাবে এটা কখনো কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি সে।
হঠাৎ দরজায় কেউ ধাক্কা দিলে কেঁপে উঠে হেনা। চোখ মুছে আস্তে করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কাছে যেতেই কেউ একজন বলল, “হেনা আমি! তোর ফুঁপি।”
হেনার মুখে যেন আঁধার মিলিয়ে আলো নেমে এলো। ফট করে দরজা খুলে দিল। তারপর ঝাপটে জড়িয়ে ধরল নাইরা বেগমকে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি এই বিয়ে করতে চাই না ফুঁপি। প্লীজ তুমি আমায় এখান থেকে নিয়ে চলো। প্লীজ! আমি ওই বুড়োকে বিয়ে করব না। আমায় বাঁচাও তুমি।”
“হেনা মা চিন্তা করিস না। তোকে নিয়ে যেতেই এসেছি।”
হেনার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠে, “সত্যি? তুমি আমায় নিয়ে যাবে ফুঁপি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। শোন! তুই একদম কাঁদবি না। বুঝেছিস? একদম কাঁদবি না। তুই কাঁদলে আমার একদম ভালো লাগে না বুঝলি?”
হেনা কিছু বলে না। নাইরা বেগম বললেন, “চিন্তা করিস না। আমার উপর ভরসা রাখ। এখন আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছ ফুঁপি?”
“কোথাও যাচ্ছি না। আমি আসছি।”
নাইরা বেগম চলে যায়। নাইরা বেগমের কথায় ভরসা পেলেও আবার কান্নায় ভে’ঙে পড়ে। কী করবে সে এখন? ওই লোকটার সাথে বিয়ের পিরিতে বসবে? কিছুতেই না৷ বাবার বয়সী লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে রূপা বেগম? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এতটা নির্লজ্জ আর পাষাণ কে হতে পারে? হেনা বারবার মা’কে স্মরণ করছে, “মা গো! কেন আমায় ফেলে চলে গেলে তুমি? দেখো আজ তোমার অনুপস্থিতিতে আব্বুর স্ত্রী আমায় বুড়ো লোকটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তুমি কেন আমায় ফেলে চলে গেলে বলো? আমি যে এই কষ্ট আর নিতে পারছি না।”
_________
“হেনা! বেরিয়ে আয়। বেরিয়ে আয় বলছি। নাহলে দরজা ভে’ঙে টেনে বের করব তোকে।”
রূপা বেগমের কথায় আবারো চমকে উঠল হেনা। প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কিছু না খাওয়ার ফলে আরো দূর্বল হয়ে পড়েছে হেনা। কিন্তু দরজা সে খুলবে না। সে কিছুতেই ওই লোকটার সঙ্গে বিয়ের পিরিতে বসবে না। কিন্তু রূপা বেগম ধমক দিয়েই যাচ্ছেন, “হেনা! কী হলো শুনতে পাচ্ছিস না? বেরিয়ে আয় বলছি। মুখপুড়ি বেরিয়ে আয় নাহয় আজ তোর একদিন কী আমার একদিন!”
হেনা কেঁদে ফেলল। ফর্সা মুখ টুকটুকে লাল আকার ধারণ করেছে। এদিকে আফজাল সাহেবও এসে যোগ দিলেন, “হেনা! হেনা দরজা খোল। নাহলে দরজা ভা’ঙব আমি।”
হেনা আশাহত হলো। তার বাবাও এই মহিলার খপ্পরে পড়ে একদম বদলে গেছে। আফজাল সাহেব এবার জোড়ে জোড়ে ধা’ক্কাতে থাকলে হেনা ভয় পেয়ে যায়। যদি দরজা ভে’ঙে এসে মা’রে? হেনা গিয়ে দরজা খোলে দেয়। রূপা বেগম বললেন, “বাহ্! আমার মেয়েটা কে তো দারুণ লাগছে। খুব সুন্দর লাগছে।”
হেনা করুন দৃষ্টিতে তাকাল রূপার দিকে। আজ কেন এই মেয়েকে সুন্দর লাগছে তার? অন্যদিন হলে তো মুখপুড়ি ছাড়া কথাই বলে না। আজ কী মুখ পুড়ে নি তার?
রূপা বেগম তাকে টেনে নিয়ে যান বিয়ের আসরে। হেনা এদিক ওদিক ফিরে নাইরা বেগমের উপস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথাও নাইরা বেগমকে দেখতে পায় না হেনা। এতে সে আশাহত হয়। ভে’ঙে পড়ে হেনা। কাঁদতে থাকে নিশ্চুপে। সেই লোকটার দিকে তাকাতেই তার আশা গুলো চুরমুর করে ভা’ঙতে লাগল। রূহ যেন এক্ষুণি বেরিয়ে যাবে। এই লোকটা? শেষে এই লোকটার সাথেই বিয়ে ঠিক করেছে রূপা? এই লোকটাই তো এইদিন তার সঙ্গে বা’জে কিছু করতে চেয়েছিল। কলেজ থেকে আসার সময় একা পেয়ে তাকে ধ’র্ষ’ন করার চেষ্টা করেছে। হেনা কোনমতে বেঁচে ফিরেছে। কিন্তু আজ.. তার কাছেই ধরা দিচ্ছে রূপা তাকে? এখন সে কী করবে? লোকটা তার দিকে তাকিয়ে পৈশাচিক হাসছে। ময়লা যুক্ত কালি লাগানো দাঁত গুলো বেরিয়ে আসছে। হেনার গাল গুলিয়ে যাচ্ছে।
বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। লোকটা ফটাফট কবুল বলে দিয়েছে তিনবার। এবার হেনার পালা। হেনা কী করবে বুঝতে পারে না। রূপা বেগম ইশারায় ধামকি দিচ্ছেন তাকে। হেনা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কাঁদতে লাগল নিঃশব্দে। কী করবে সে এখন? এই লোকটাকে বিয়ে করলে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে। হঠাৎ তার আশার আলো জাগিয়ে নাইরা বেগম প্রবেশ করেন সেখানে। রূপাকে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে হেনাকে তুলে বুকে জড়িয়ে নেন। রূপা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “এসব কী আপা? এই শুভ সময়ে তাকে এভাবে টেনে তোলার মানে টা কী?”
নাইরা বেগম আঙুল দেখিয়ে শাসিয়ে বললেন, “চুপ! একদম চুপ! জাহান্নামে যাক তোর শুভ সময়। লজ্জা করে না? এই টুকুন একটা মেয়েকে তার বাপের বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছিস? তোর সাহস কী করে হয়?”
“দেখুন আপা! এভাবে আমার বাড়ি এসে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না আপনি।”
“আরে সর তুই! তুই কোন সাহসে হেনাকে এই চরিত্রহীন বুড়ো টার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছিস? টাকার জন্য? বেয়াদব! তোর সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।”
“দেখুন আপা! ও আমার মেয়ে। ওর সঙ্গে আমি যা খুশি করব আপনি এতে নাক না গলালেই হয়।”
এবার নাইরা বেগম এগিয়ে এসে ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দেন তার গালে। রূপা বেগম যারপর নাই অবাক হলেন। আফজাল সাহেব রে’গে এসে বললেন, “আপা! এভাবে তুমি সবার সামনে আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার সাহস কোথায় পেলে?”
“তুই চুপ কর! তোর বউ কীভাবে সাহস পায় আমার মেয়েকে এই বুড়োর হাতে তুলে দেওয়ার? আর তোর কীভাবে দিলে দিল এসব করতে? বিবেকে বাঁধল না নিজের মেয়ের সাথে এমন করতে?”
“দেখো আপা আমরা ওর মঙ্গলের জন্যই এসব করছি। আমি ওর বাবা, ওর বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। ওর যার সাথে বিয়ে দেই সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি এতে নাক না গলালেই হয়।”
“বাপ হতে পেরেছিস? বল বাপ হতে পেরেছিস তুই? আগে বাপ হ! তার পর বলিস এটা তোর মেয়ে। তুই যদি ওর বাপই হোস তাহলে এসব কী করে করতে পারলি? এই চরিত্রহীন ধ’র্ষ’ক টার সাথে কীভাবে ওর বিয়ে দিতে পারছিস?”
আফজাল সাহেব চুপ মেরে গেলেন। নাইরা বেগম এই লোকটার দিকে থুথু ছুড়ে বলল, “যা শালা ল’ম্প’ট! এক্ষুণি নিজের দলবল নিয়ে বেরিয়ে যা। আর কখনো যদি হেনার দিকে ফিরেও তাকাস তোর চোখ খুবলে নেব আমি। যা বেরিয়ে যা। নাহলে ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে বের করব তোকে।”
লোকটি ঘৃণিত দৃষ্টিতে হেনা আর নাইরা বেগমের দিকে চেয়ে থাকে। নাইরা বেগম এবার রে’গে তার সঙ্গে আসা কিছু ছেলেকে আদেশ দেয় তাকে বের করে দেওয়ার জন্য। তারা তাই করে। ধা’ক্কা দিয়ে তাদের সেখান থেকে বের করে দেয়। আফজাল সাহেব বললেন, “এসব কী আপা? তোমার কোন অধিকার নেই এভাবে আমার মেয়ের বিয়ে ভে’ঙে দেওয়ার।”
“আর তোরও কোন অধিকার নেই এভাবে ওর জীবন টা ন’ষ্ট করার। হেনার বিয়ে তো হবে। কিন্তু ওর মতো চরিত্রহীনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তুই কেমন মহান বাবা হতে চাস?”
“আচ্ছা? ওকে কে বিয়ে করবে? সবাই জানে এখন ওর বিয়ে থেকে ওর বরকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাহলে ওকে কে বিয়ে করবে?”
নাইরা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “কেউ বিয়ে করবে না? ঠিক আছে। আমার ছেলের সাথে ওর বিয়ে হবে। নিবিড়ের সঙ্গেই ওর বিয়ে হবে।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ্]