হারানোর বেদনা পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
925

#হারানোর_বেদনা
#পর্ব_২০(অন্তিম পর্ব)
#লেখক_দিগন্ত
রুশার ডায়েরি ঘেটে অনেক কিছুই জানতে পারে নিলা।রুশা তার জীবনের অনেক ছোট ছোট ঘটনা লেখা ছিল সেই ডায়েরিতে।রোহানের প্রতি রুশার অনুভূতি, মিরাজ খানের অপকর্ম সবকিছুর কথাই লেখা ছিল।রুশা এটাও লিখেছিল যে আকাশ ছেলেটাকে তার বিশ্বাস নেই।আকাশ যখন নিজের বাবার সাথে মিলে নকল ওষুধের ব্যবসা করতে পারে তখন আরো অনেক কিছু করতে পারে।ইরিনার ঘটনার জন্যও হয়তো সে দায়ী।তবে এসবের সত্যতা যাচাই করার জন্য রুশার কাছে কোন প্রমাণ ছিলনা।তাই রুশা চেয়েছিল সব প্রমাণ সংগ্রহ করে তারপর সবাইকে সবকিছু জানাতে।

ডায়েরিটা পড়ে নিলা বুঝতে পারে সে কত বড় একটা ভুল করেছে।নিলা ভাবে,
-“আকাশ ভাইয়াই কি তাহলে রুশার সাথে এমন করেছে।আমায় সবকিছু জানতেই হবে।যে করেই হোক জানতেই হবে।”
________
নিহানের সাথে দেখা করার জন্য জেলে যায় নিলা।নিলাকে এভাবে দেখে নিহান খুশি হয়।নিলা এসে নিহানকে বলে,
-“আমি খুব ভালো করেই বুঝে গেছি আপনি নিরপরাধ।আপনি প্লিজ যা জানেন সব আমাকে বলুন।আমি চাই ইরিনার খু*নিদের শাস্তি দিতে, সাথে রুশার খু*নিদেরও শাস্তি দিতে চাই আমি।”

নিলার কথা শুনে নিহান অবাক হয়ে বলে,
-“রুশা মানে তোমার বোন।ওর কি হয়েছে?”

নিলা তখন নিহানকে পুরো ঘটনাটা ব্যাখ্যা করে।সব শুনে নিহান বলে,
-“আমি আগে থেকেই আকাশের ব্যাপারে অনেক কিছু জেনে গিয়েছিলাম।আকাশ একটা নয় অনেক অপরাধের সাথে যুক্ত।তুমি হয়তো জানোনা আকাশ একজন নারী পা*চারকারী।আমরা সিআইডির লোকেরা অনেকদিন থেকেই আকাশকে সন্দেহ করছি কিন্তু বড় কোন প্রমাণ পাইনি জন্য এতদিন চুপ থাকতে হয়েছে।কাল আনোয়ার স্যার আমার সাথে দেখা করেছে।তিনি বলেছেন তার কাছে ইতিমধ্যেই অনেক প্রমাণ আছে।আর কয়েকদিন গেলেই আকাশ পর্যন্ত আমরা পৌঁছাতে পারব।”

সবটা শুনে নিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।নিলা এখন শুধু এটুকুই চায় যেন আকাশ ধরা পড়ে।ইরিনা,রুশার সাথে যে অন্যায় করেছে সে যেন শাস্তি পায়।

জেল থেকে বেরোনোর পরই নিলার কাছে আনোয়ার হোসেনের কল আসে।ফোন রিসিভ করতেই আনোয়ার হোসেন বলেন,
-“নিলা আমার কিছু ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই।তুমি কি পারবে সাহায্য করতে?”

নিলা সম্মতি জানায়।আনোয়ার হোসেন এরপর নিলাকে কিছু কথা বলেন।সব শুনে নিলা বলে,
-“আপনি যা যা বলেছেন আমি ঠিক তাই করব।”

কলটা কে*টে দিয়ে আকাশের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে যায় নিলা।আকাশ তখন বাড়িতে বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল।কলিং বেলের শব্দ শুনে আকাশ বিরক্ত হয়।তবে দরজাটা খুলেই তার সব বিরক্তি গায়েব হয়ে যায়।কারণ সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নিলা।নিলাকে ভেতরে আসতে বলে আকাশ যায় নিলার জন্য কফি বানিয়ে আনতে।

আকাশ কফি এনে নিলাকে বলতে থাকে,
-“আমি শুনলাম তোমার বোনের ব্যাপারে।আমি বুঝতে পারছি এই সময় তোমার মনের অবস্থাটা কেমন।কিন্তু তুমি তো জানোই মানুষ মরণশীল।জন্ম নিলে সবাইকে একদিন ম*রতে হবেই।তাই এই নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই।সামনে তোমার পরীক্ষা।তুমি ভালো করে পড়াশোনা করো।দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

নিলা বাকা হেসে বলে,
-“হুম ঠিকই তো।মানুষ মরণশীল।কিন্তু ভালো ভালো মানুষগুলোকেই যেন মৃত্যু তাড়াতাড়ি গ্রাস করে আর কিছু ময়লা আবর্জনা পৃথিবীতে টিকে থাকে সুন্দর পৃথিবীটাকে ভাগাড়ে পরিণত করার জন্য।”

-“মানে? এসব তুমি কি বলছ? তোমার কথার অর্থ আমি বুঝে পাচ্ছিনা।”

-“কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।খেয়ে নেওয়া দরকার।”

নিলার কথা শুনে আকাশ কফি খেতে শুরু করে।কফি খেয়ে শেষ করার আগেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

নিলা আকাশ জেগে আছে কিনা সেটা চেক করে নেয়।আকাশ ঘুমিয়েছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর নিলা পুরো বাড়িটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে যাতে আকাশের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়।আনোয়ার হোসেন তো তাকে এমনটাই করতে বলছিল।

অনেক খোঁজার পর সে আকাশের ওয়ারড্রব থেকে কিছু ফাইল পায়।যেখানে নকল ওষুধের ব্যবসা আর নারী পা*চারের সাথে আকাশের জড়িত থাকার সব প্রমাণ ছিল। নিলা হাতে প্রমাণগুলো নিয়ে আকাশের কাছে আসে।তারপর আকাশের গায়ে গরম কফি ঢেলে দেয়।আকাশের জ্ঞান ফিরলে সে নিলার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কি করছ তুমি? আর ইউ ম্যাড?”

নিলা গগণবিহারী হাসি হেসে বলে,
-“হ্যাঁ আমি পাগল।আমার পাগলামীর কিছু দেখোনি তুমি।ধীরে ধীরে কষ্ট দিয়ে যখন তোমায় মা*রব তখন বুঝবে আমি কেমন সাইকো।”

আকাশ ভালো করে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় নিলা তাকে বেধে রেখেছে।পালানোর কোন পথ নেই দেখে আকাশ বলে,
-“আমায় এভাবে বেধে রেখেছ কেন? কি চাইছ তুমি?”

-“আমি সব সত্য চাই।তোমার ওয়ারড্রব থেকে এই ফাইলগুলো আমি পেয়েছি।যেটা দেখে স্পষ্ট তুমি এবং তোমার বাবা নকুল ওষুধের ব্যবসা এবং নারী পা*চারের সাথে জড়িত।কিন্তু আমি জানি এছাড়াও তুমি আরো অনেক খারাপ কাজের সাথে যুক্ত।ইরিনা আর রুশাকেও তুমি মে*রেছ তাইনা?”

আকাশ হচকচিত হয়ে বলে,
-“তুমি ভুল ভাবছ।হ্যাঁ এটা ঠিক আমি ইরিনাকে মে*রেছি,নিহানকেও আমি ফাসিয়েছি কিন্তু রুশাকে আমি মা*রিনি।আমি কেন রুশাকে মা*রতে যাবো বলো? ওর সাথে আমার কি শত্রুতা।আমি তো ওকে কোনদিন দেখিওনি শুধু এটুকুই জানি রুশা নামে তোমার একটা বোন আছে।”

-“তাহলে কে মে*রেছে আমার বোন রুশাকে?”

-“আমি সত্যি এই ব্যাপারে কিছু জানিনা।আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ।”

-“আমি কোন অপরাধীদের ছাড়ব না।”

কথাটা বলে নিলা একটা ছু*রি বের করে আকাশের দিকে আঘাত করতে গিয়েও থেমে যায়।তারপর বলে,
-“তোর মতো মানুষকে মে*রে আমি নিজের হাত নোংরা করতে চাইনা।আমি চাই আইন তোকে শাস্তি দিক।”

তখন পুলিশ এসে আকাশকে গ্রেফতার করে।আনোয়ার হোসেন নিলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“তুমি আজ খুব ভালো কাজ করেছ নিলা।”

নিলা বলে,
-“আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি।রুশার খু*নিকে শাস্তি পাইয়ে দেওয়ার আগে আমার শান্তি নেই।”
___________
রোহান ঘরে বসে ছিল।কাল রাত তগর তার চোখে ঘুম নেই, এক সেকেন্ডও শান্তিতে থাকতে পাচ্ছেনা রোহান।
সব যায়গায় শুধু রুশাকেই দেখতে পাচ্ছে।রুশার স্মৃতিগুলো রোহানের জন্য অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এরমধ্যে নিলা চলে আসে রোহানের রুমে।নিলাকে দেখে রোহান চমকে যায়।নিলা এসে রোহানকে জোরে একটা থা*প্পড় মা*রে।তারপর বলে,
-“কি দোষ করেছিল রুশা? কেন ওর সাথে এত বড় অন্যায় করলে? ও তো তোমায় সত্যি ভালোবেসেছিল।”

মিরাজ খানকে গ্রেফতার করার পর তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন রোহানই রুশার খু*নি এবং এসব কাজে তার অন্যতম সহযোগী।নিহান তো এসব বিশ্বাসই করতে চায়নি কিন্তু পরে অনেক প্রমাণ দেখে যা রোহানের বিরুদ্ধে।তখন সে বুঝতে পারে সবকিছু।

নিলা রোহানের হাতে রুশার ডায়েরি তুলে দেয়।যেই ডায়েরির প্রতিটা পাতায় রোহানের কথা লেখা।রুশা যেদিন রোহানকে প্রথম দেখেছিল সেদিনই রোহানকে ভালোবেসেছিল।রোহানকে নিজের আইডল ভাবত সে।রোহানের জন্য নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল মেয়েটা।

ডায়েরিতে এসব দেখে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে রোহান চিৎকার করে বলতে থাকে,
-“তুমি তুমি ফিরে এসো প্লিজ।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।তোমার কথা খুব মনে পড়ছে।আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আর কোন কষ্ট দেবনা।প্লিজ একবার ফিরে আসো আমার কাছে।”

রোহান এরপর ছুটে চলে যায় কবরস্থানে।রুশার কবরের সামনে গিয়ে বসে কাঁদতে থাকে সে।কথায় আছে, মানুষের কাছে সবথেকে বড় শাস্তির নামই বিবেকের দং*শন। অনুশোচনা, অনুতাপ একজন মানুষকে পুরোপুরি ভেঙে দিতে পারে।রুশাকে মে*রে রোহান ভেবেছিল সে এখন শান্তিতে থাকতে পারবে কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।রুশাকে হারিয়ে তার এখন এমন কষ্ট অনুভব হচ্ছে নিজের মৃত্যুতেও হয়তো তার এত কষ্ট হতোনা।এই কষ্টের নামই যে হারানোর বেদনা।

যেই রোহান নিজেকে বাঁচানোর জন্য রুশাকে মে*রে ফেলেছিল।অথচ আজ সে চায় নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও রুশাকে ফিরিয়ে আনতে।

নিলা এসে রোহানকে টেনে তুলে রুশার কবর থেকে।তারপর বলে,
-“আমার বোনের কাছে একদম যাবেনা।তোমার জন্যই আমরা ওকে হারিয়েছি।”

রোহান অনুরোধ করে বলে,
-“আমাকে প্লিজ ওর কাছে থাকতে দাও।আমি ওকে কখনো নিজের মনের কথা বলার সুযোগ পাইনি।আমিও যে পছন্দ করতাম রুশাকে।”

নিলা তাচ্ছিল্য করে বলে,
-“আর নাটক করবেন না।যদি সত্যি রুশাকে পছন্দ করতেন তাহলে এভাবে নিজের হাতে এত নিষ্ঠু*রভাবে মেয়েটাকে মা*রতে পারতেন না।”

রোহান চুপ থাকে।কি বলবে সে? তার যে আর কিছুই বলার নেই।লোভে এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছিল সে যে নিজের ছাড়া আর কারো কথাই ভাবেনি।এই লোভের জন্যই তাকে অনুভব করতে হবে আজীবনের বেদনা।

রোহান পুলিশকে অনুরোধ করে বলে,
-“প্লিজ আমাকে মে*রে ফেলুন।আমি রুশার কাছে যেতে চাই।”

পুলিশ এসে সোজা রোহানকে গ্রেফতার করে নিয়ে চলে যায়।

নিহান রোহানকে বলে,
-“তোকে নিজের ভাই ভাবতেও আমার লজ্জা করছে।তুই এমন অ*মানুষ জানলে কোনদিনও তোকে বিশ্বাস করতাম না।”
___________
নিহান আর নিলা একসাথে বাড়িতে আসে।তারা সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে আবার নতুনভাবে নিজেদের জীবন শুরু করতে চায়।নিহান নিলাকে বলে,
-“আমায় অনেক অবিশ্বাস করেছ।এখন সারাজীবনের ভালোবাসা দিয়ে সেইসব মিটিয়ে দিতে হবে।”

নিলা বলে,
-“আমিও চাই আপনাকে ভালোবেসে ভালোবাসার অতল সাগরে তলিয়ে যেতে।জীবনে অনেক বেদনা সহ্য করেছি।কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।আপনাকে হারানোর বেদনা আমি সহ্য করতে পারবো না।”

নিহান নিলাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
-“আমি আজীবন একসাথে থাকব।”

এরপর দুজনেই হারিয়ে যায় ভালোবাসার অতল সাগরে।

অন্যদিকে জেলে বসে মৃত্যুর থেকেও কঠিন শাস্তি ভোগ করছে রোহান।আকাশ,মিরাজ খানের ফাঁ*সির আদেশ হলেও আর রোহানের আমৃত্যু কারাবাসের শাস্তি হয়েছে।এখনো প্রতিরাতে রুশাকে স্বপ্নে দেখে রোহান।যা তাকে মানসিকভাবে পুরোপুরি বেদনায় রেখেছে।এই বেদনা যে পৃথিবীর সবথেকে বড় বেদনা।যার নাম ~হারানোর বেদনা~
~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~~~~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে