হারানোর বেদনা পর্ব-০২

0
923

#হারানোর_বেদনা
#পর্ব_২
#লেখক_দিগন্ত

সুমি ভয়ে ভয়ে বলে,
-“আমি আপনার বন্ধু রুদ্রর নির্দেশেই এমন করেছি।রুদ্র স্যার আমায় অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে বলেছিল আপনার ঘনিষ্ঠ হতে।আপনার বাচ্চার মা হওয়ার নাটকও আমি তার কথাতেই করি।”

নিলয় সুমির কথা শুনে জোরে হেসে ফেলে।তারপর সুমির গলা চে*পে ধরে বলে,
-“তুই কি ভেবেছিস তোর মতো একটা চরিত্রহীন মেয়ের কথায় আমি আমার বন্ধুকে অবিশ্বাস করব? আমি আর রুদ্র শুধু বন্ধুই নই একে অপরকে ভাইয়ের মতো দেখি।আমরা একে অপরের জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।”

সুমি অনেক কষ্টে নিজের গলা থেকে নিলয়ের হাত ছাড়িয়ে বলে,
-“এই অন্ধবিশ্বাসই আপনার কাল হয়েছে।আমাকে অবিশ্বাস করলে কিছু করার নেই, কিন্তু এটাই সত্য ওনার আদেশেই আমি সব করেছি।”

নিলয় সুমির কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।নিলয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে করেই হোক সে নিজে থেকে ষড়যন্ত্রকারীকে খুঁজে বের করবে।কারো কথায় প্ররোচিত হয়ে নয়।
________________
মেঘলা চুপচাপ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল।এতক্ষণ শক্ত হওয়ার অভিনয় করলেও এখন আর সে চুপ থাকতে পারছে না।মেঘলা সবসময় ভেবেছিল নিলয়ের জীবনে সেই একমাত্র নারী হবে।অন্য কোন মেয়ের দিকে নিলয় চোখ তুলেও তাকাবে না।সেখানে যে নিলয় এভাবে তাকে ঠকাবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

মেঘলার মা মরিয়ম বেগম এসে তাকে শান্তনা দিয়ে বলে,
-“আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।তুই ঐ ঠকবাজ ছেলের কথা ভুলে যা।আমরা তোর আবার ধুমধাম করে বিয়ে দেব।”

মেঘলা তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে বলে,
-“যেই ছেলেকে এতবছর ধরে ভালোবাসি, যার সাথে এতবছর সংসার করলাম।সেই যখন আমায় ধোকা দিল তখন অন্য কোন ছেলেকে কিভাবে বিশ্বাস করব আম্মা? তার থেকে ভালো আমি একাই আমার মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবনটা কা*টিয়ে দেব।কোন পুরুষ মানুষকেই আমি আর বিশ্বাস করি না।”

মরিয়ম আর এই বিষয় নিয়ে কথা বাড়ান না।তিনি শুধু মেঘলাকে একটা কথাই বলেন,
-“নিজেকে শক্ত কর।মনে রাখিস তোর একটা মেয়ে আছে।মেয়েটার জন্য হলেও তোকে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।”

এরমধ্যে নিলা সেখানে চলে আসে।নিলা এসে মেঘলাকে আঁকড়ে ধরে বলে,
-“আমার আব্বুর কথা খুব মনে পড়ছে।প্লিজ আম্মু আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে চলো।”

মেঘলা নিজের চোখের জল মুছে নিলার গালে হাত দিয়ে বলে,
-“আচ্ছা তুমি বলো তোমার কি একজন খারাপ মানুষের সাথে থাকতে ভালো লাগবে।”

নিলা মাথা নাড়িয়ে “না” বলে।সাথে এটাও বলে,
-“কিন্তু আমি আব্বুকে খুব ভালোবাসি।আমি জানি আমার আব্বু কোন অন্যায় করতে পারে না।”

মেঘলা এবার রেগে গিয়ে বলে,
-“যদি তাই হয় তাহলে চলে যাও নিজের বাবার কাছে আর এখানে থাকতে হবে না।”

কথাটা বলেই মেঘলা সেখান থেকে চলে যায়।নিলা মরিয়মকে ধরে কাঁদতে থাকে।
________________
রাত ১২ টার সময় কলিংবেলের শব্দে মেঘলার ঘুম ভেঙে যায়।এতরাতে কে এসেছে সেটা ভাবতে ভাবতে সে দরজার কাছে চলে যায়।তারপর দরজা খুলে দেখে নিলয়কে!

নিলয় মাতাল হয়ে তার বাড়িতে এসেছে।নিলয়কে এখানে এভাবে দেখে মেঘলা একইসাথে রেগে যায় আবার নিলয়ের জন্য তার দুশ্চিন্তাও হয়।

নিলয় এক পা এক পা করে ঘরে ঢুকে মেঘলাকে জড়িয়ে ধরে।মেঘলা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।নিলয় মাতাল অবস্থাতেই বলতে শুরু করে,
-“আমাকে বিশ্বাস কেন করলে না তুমি? আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি মেঘলা।আমার জীবনে তুমিই একমাত্র নারী।তুমিই প্রথম আর তুমিই শেষ অন্য কেউ নেই।তোমাকে হারানোর বেদনা যে আমার সহ্য হচ্ছেনা।আমি তোমাকে আবার ফিরে পেতে চাই।”

কথাটা শোনামাত্রই মেঘলা তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিলয়কে দূরে ঠেলে দিয়ে বলে,
-“আমার সাথে এত অন্যায় করেও তোমার শান্তি হয়নি? এখন এত রাতে আবার নাটক করতে এসেছ? এখানে এসেছ কেন যাও নিজের নতুন বউয়ের কাছে যাও।আজ না তোমাদের বাসর রাত।সেই রাতটা এভাবে নষ্ট করো না।”

নিলয় মেঘলার হাত চেপে ধরে বলে,
-“আমি সুমিকে বিয়ে করিনি মেঘলা।ও একটা ঠকবাজ মেয়ে।ও আমার সাথে প্রতারণা করেছে।”

-“আমি তোমার কোন কথা বিশ্বাস করি না নিলয়।এসব তোমার নাটক।আর কত নাটক করবে তুমি? নাটক করে করে একটুও ক্লান্ত হওনা কি? ১৭ টা বছর ধরে তো কেবল আমার সাথে ভালোবাসার নাটক করলে।সেই স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমার সেই ভালোবাসাকে এভাবে অপমান না করলেও পারতে।”

নিলয় এবার মেঘলাকে পুরো ঘটনা খুলে বলে।

সবটা শুনে মেঘলা নিজেও খুব অবাক হয়।কিন্তু সে নিলয়কে বিশ্বাস করতে পারছিল না।আবার তার নিলয়ের চোখ দেখে এটাও মনে হচ্ছিল যে নিলয় সত্য বলছে।তাই সবমিলিয়ে সে দোটানায় পড়ে যায়।

হঠাৎ করে নিলয় সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।মেঘলা অনেক কষ্টে তাকে নিয়ে গিয়ে ঘরে শুইয়ে দেয়।মেঘলার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছিল।নিলয় কি সত্যি বলছে নাকি এটা তার নতুন নাটক?
.
নতুন একটি দিন শুরু হয়।সাথে নতুন বিপদেরও আনাগোনা ঘটে।নিলয় খুব শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।অথচ মেঘলার চোখে ঘুম নেই।সারারাত তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেই চলে গেছে।এখন তার মনে হচ্ছে নিলয় ঠিকই বলছে।তার মন চাইছে নিলয়কে বিশ্বাস করতে।কিন্তু তার মস্তিষ্ক বলছে অন্য কথা।মন আর মস্তিষ্কর এই লড়াইয়ে মেঘলা পুরোপুরিভাবে ক্লান্ত।

নিলয় ঘুম থেকে উঠে পড়ে।তারপর মেঘলার কাছে গিয়ে বলে,
-“মেঘলা তুমি চলো আমার সাথে।আমি চাই তোমাকে আর নিলাকে আবার নিয়ে যেতে।তোমাদের ছাড়া যে আমি ভালো নেই।”

মেঘলা কিছুই বলে না।শুধু নিলয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।ছেলেটাকে একবার বিশ্বাস করে অনেক কষ্ট পেয়েছে সে।আবার কি তাকে বিশ্বাস করবে নাকি করবে না? মেঘলা সেটা কোনভাবেই ঠিক করতে পারছিল না।

নিলা তাদের ঘরে চলে আসে।নিজের বাবাকে দেখে সে খুশি হয়।ছুটে গিয়ে নিলয়ের কোলে উঠে বলে,
-“আব্বু তুমি এসেছ।তুমি ঐ খারাপ মহিলাটাকে বিয়ে করোনা প্লিজ।আমি চাই তোমাকে আর আম্মুকে নিয়ে হ্যাপি থাকতে।”

নিলয় তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি।আমার এত সুন্দর একটা মেয়ে থাকতে, এত ভালো স্ত্রী থাকতে কোন দুঃখে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব? তোমরা এখন আমার সাথে চলো।আমি তোমাদের নিয়ে সারাজীবন সুন্দরভাবে থাকতে চাই।”

নিলা নিলয়ের সাথে যেতে রাজি হলেও মেঘলার কোন ইচ্ছেই ছিলনা নিলয়ের সাথে যাওয়ার।মেঘলা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়,
-“আগে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে তারপর।তোমার মুখের কথায় আর আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারবো না।আমি এবার প্রমাণ চাই।”

নিলয় মেঘলাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
-“আমাকে সামান্য কিছুদিন সময় দাও।আমি সব প্রমাণ জোগাড় করব।শুধু কয়েকটা দিন লাগবে।”

নিলয়ের কথাটা শুনে মেঘলা ভরসা পায়।তাছাড়া মরিয়ম এসেও তাকে বোঝায়।সবমিলিয়ে মেঘলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে নিলয়কে আরেকটা সুযোগ দেবে।
__________________
নিলয়ের হাত ধরে আবার নিজের শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসে মেঘলা।সারা রাস্তা নিলয় অনেক খুশিতেই ছিল।কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার সব খুশি মিলিয়ে যায়।বাড়ি এসে সে দেখে সুমি আর তার পরিবারের সব সদস্যরা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

নিলয় রেগে গিয়ে তাদের কথা শোনাতে যাবে তখন লতিফা বেগম তাকে একটা থা’প্পড় মে’রে বলে,
-“আমার মাথা আর কত নিচু করবি তুই? বিয়ে করে নতুন বউ রেখে কোথায় গিয়েছিলি? কাল রাতে এই মেয়েটা তার পুরো পরিবার নিয়ে চলে এসেছে।আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশী সবাই এসব ব্যাপারে জেনে গেছে।লজ্জায় আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারছি না।এসব দেখার জন্যই কি আমি বেঁচে আছি?”

লতিফার কথা শুনে নিলয় অবাক হয়ে যায়।তারপর রেগে গিয়ে সুমির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-“বেহা*য়া মেয়ে তুই আবার চলে এসেছিস? কাল তোর সমস্ত পর্দা ফাঁস করলাম তাও তোর শান্তি হয়নি।”

সুমি নিলয়কে বলে,
-“তুমি এমন করছ কেন নিলয় কাল রাতেই তো আমাদের বিয়ে হলো।আর এখনই সব ভুলে গেলে?”

সুমির কথা শুনে নিলয়ের পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।কি বলছে কি সুমি? তাদের বিয়ে মানে? সে তো কাল সব সত্য প্রকাশ করে চলে এসেছিল।নিলয় তখন সুমিকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-“চুপ আর একটাও মিথ্যা কথা বলবি না।”

-“আমি কোন মিথ্যা বলছি না নিলয়।আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে।কাজী সাহেব নিজে সাক্ষী আছেন।কি হলো কাজী সাহেব বলুন।”

কাজী এগিয়ে এসে বলে,
-“জ্বি, আমি তো কাল আপনাদের বিয়ে দিলাম।”

নিলয় পুরোপুরি হতবাক হয়ে যায়।সুমির পরিবারের সদস্যরাও সবাই বলে বিয়ে হয়ে গেছে।নিলয় আর কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছিল না।সে খুব বড় একটা ভুল করেছে কাল রাতে একা একা সুমির বাড়িতে চলে গিয়ে।

যদি কয়েকজন বরযাত্রী নিয়ে যেত তাহলে আর এই সমস্যা হতোনা।

মেঘলা এবার এগিয়ে এসে নিলয়কে একটার পর একটা থা’প্পড় মা’রতে থাকে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“তোমাকে বিশ্বাস করা আমার উচিৎ হয়নি।তোমার মতো চরিত্রহীন পুরুষ কখনো বিশ্বাসের যোগ্য না।”

নিলাকে কোলে তুলে নিয়ে মেঘলা আবার ফিরে যায়।নিলয়ও ছুটতে থাকে তাদের পেছনে।
.
মদ খেতে খেতে সেলিব্রেট করছিল রুদ্র।নিলয়কে আজ সে সবদিক থেকে অসহায় করে দিয়েছে।একজন নারী এসে রুদ্রর সামনে বসে।তাকে দেখে রুদ্র জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলে,
-“এখন রুদ্র পুরোপুরি অসহায়।রুদ্রর এই অবস্থা দেখে তোমার কেমন লাগছে।”

রুদ্রর সামনে বসে থাকা নারীটি বলে,
-“আজ আমি খুব খুশি।নিলয়কে হারানোর বেদনা দিয়ে এবার আমরা সারাজীবন আনন্দে থাকতে পারব।”
বলে দুজনেই হাসতে থাকে।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে