হারকিলিস

0
882

বিজয়ের বেশে আদালত থেকে বেরিয়ে গেল চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ মামলার পাঁচ আসামি। উপযুক্ত সাক্ষী, তথ্য প্রমাণ না থাকায় বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে তারা। পাশে অসহায় পরাজিত সৈনিকের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ধর্ষিতার পরিবার। ধর্ষক সবাই প্রভাবশালী পরিবারের, তাই কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হয় নি। থানার ওসি তাদের কেনা গোলাম। শত হাতে পায়ে ধরা সত্ত্বেও কেইস ফাইল করতে রাজি হয়নি। পরে জেলা মহিলা সমিতির চাপে কেইস ফাইল করলেও জোরালো তদন্ত করে তথ্য প্রমাণ কিছুই যোগাড় করেনি যার ফলে বেকসুর খালাস পেয়ে যায় অপরাধীরা।

ঘটনার শুরু গত দুই মাস আগে। স্কুল থেকে একা একা বাড়ি ফিরছিল ৮ বছরের সুরাইয়া। পথের ধারে ঝোপের ভেতর আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল ধর্ষক মানিক ও তার বন্ধুরা। কাছাকাছি আসতেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে মুখ চেপে ধরে সুরাইয়ার। এরপর টেনে হিঁচড়ে পাশের ধান ক্ষেতে নিয়ে করে পাশবিক নির্যাতন। রক্তাক্ত অজ্ঞান সুরাইয়াকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় পাঁচ পাষন্ড।

সন্ধ্যে হওয়ার পর ও মেয়ে বাড়ি না ফেরায় চিন্তিত হয়ে পড়ে সুরাইয়ার বাবা মা। পরে লোক মারফতে খবর পায় সুরাইয়া হাসপাতালে। ঐ পথে মাগরিবের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন কয়েকজন মুসল্লি। বিবস্ত্র সুরাইয়াকে ধান ক্ষেতে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গিয়ে জায়নামাজ দিয়ে ঢেকে দেন তার পবিত্র ছোট্ট শরীর। এরপর সবাই মিলে ধরাধরি করে নিয়ে যান স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে।

হাসপাতালে মেয়ের করুণ অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুরাইয়ার হতদরিদ্র পিতা মাতা। জ্ঞান ফিরলে সুরাইয়া বাবা মা কে জানায়, ওদের এলাকার বখাটে যুবক রতন, মানিক, হীরু, গোপাল আর জলিল অনেকদিন ধরেই ওকে উত্যক্ত করতো। কয়েক দিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে ওকে ধাওয়া করেছিল তারা। ও দৌড়ে স্কুলের ভেতরে চলে যায়। সেদিন ওরা ওকে ধরতে পারেনি। কিন্তু আজকে ওরা ওকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছে। বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সুরাইয়া।

ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে স্থানীয় মাতবরেরা মিলে একটা সালিশ ডাকে। সালিশে ধর্ষণের ঘটনাকে ধর্ষকদের ছেলেমানুষি আর বয়সের দোষ বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে ৫০০০ টাকা সুরাইয়ার বাবার হাতে দিয়ে ঘটনার মীমাংসা করে দেয়া হয়। আর ব্যাপারটা যাতে থানা পুলিশ পর্যন্ত না গড়ায়, তা বারবার সাবধান করে দেয়া হয়। তাতে নাকি তার মেয়েরই বদনাম হবে!! এরপর এলাকাবাসীকেও হুঁশিয়ারি জানানো হয়, তারা যেন এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাতামাতি না করে।

সুরাইয়ার ভাই সজীব ঢাকায় পড়ালেখা করে। বোনের ঘটনা জানতে পেরে ছুটে চলে আসে বাড়িতে। বাবা আর স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে থানায় গেল মামলা করতে। থানার ওসি মামলা তো নিলোই না, উল্টো তাদেরকে শাসিয়ে দিলো,
“এরপর যদি এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নামে হয়রানি করতে আসে, তাহলে তাদেরকেই মানহানির মামলায় ফাঁসিয়ে দিবে। ”

নিরুপায় হয়ে থানা থেকে বেরিয়ে আসে সজীব আর তার সাথের লোকেরা। থানার ওসি সাহায্য না করলেও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে ঐ থানার কন্সটেবল হাফিজ মিয়া। জানালো, “ওদের আগেও অনেকে এসেছে মানিক বাহিনীর নামে মামলা করতে। কিন্তু ওসি কারো মামলাই নেয়নি। কারণ সে মানিকের বাবা স্থানীয় প্রভাবশালী নেতার ডান হাত। সেই নেতার সব অপকর্ম টাকা খেয়ে ধামাচাপা দিয়ে দেয় থানার ওসি। সুতরাং তার কাছে সাহায্য চেয়ে লাভ নেই। ”
বলে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ওদের ধরিয়ে দিলো। কার্ডটা ছিল জেলা মহিলা সমিতির সভাপতি রোকসানা বানুর।

অতঃপর জেলা মহিলা সমিতির চাপে বাধ্য হয়ে ওসি গ্রেফতার করে মানিক বাহিনীকে আদালতে তোলে। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায় অপরাধীরা।

জেল থেকে বেরিয়েই শুরু করে দেয় সুরাইয়ার পরিবারের উপর অত্যাচার। গভীর রাতে ঢিল পড়তে থাকে টিনের চালে। প্রতি রাতে গরু,ছাগল,হাঁস,মুরগি চুরি হতে থাকে। গ্রামের একমাত্র টিউবওয়েল। সেখান থেকেও পানি নিতে দেয়া হয়না তাদের। সুরাইয়ার পরিবার বুঝলো, এখানে নিরাপদ নয় সুরাইয়া। তাই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো পাশের গ্রামের মামা বাড়িতে। মামার সাথে রওনা হলো সুরাইয়া।

পরদিন ভোরে সুরাইয়ার মামাকে রক্তাক্ত গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে এলাকাবাসী। এক মাইল দূরে পাওয়া যায় সুরাইয়ার জবাই করা লাশ। রাতের আঁধারে কে বা কারা তাকে খুন করে ফেলে রেখেছে কেউ দেখেনি। কিন্তু না দেখলেও সবারই জানা আছে খুনি কারা!!

সুরাইয়া হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে পড়লো টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লো। রাজপথ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করলো। ন্যায় বিচারের দাবিতে আন্দোলন করলো সবাই। তারপরও কিছু হলো না। পুলিশ পারলোনা আসল অপরাধীদের গ্রেফতার করতে। মিডিয়ার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুরাইয়ার ভাই সজীব। খুনিদের নাম প্রকাশ করে ফাঁসি দাবি করলো। বিভিন্ন চ্যানেলে সেটা লাইভ দেখানো হলো।

সংবাদ সম্মেলন শেষ করতে করতে রাত হয়ে গেল। সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল সজীব। অতর্কিত হামলা চালায় মানিক বাহিনী। কুপিয়ে জখম করে। হাটের শেষে বাড়ি ফিরছিল কয়েকজন। তারা ধাওয়া করলে পালিয়ে যায় মানিক বাহিনী। পরে তারা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে সজীবকে।

প্রত্যেকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় খুব গুরুত্ব সহকারে খবরটা ছাপায়। ঢাকা থেকে সজীবের সব বন্ধুরা ছুটে আসে। দু একজন পুলিশের কাছে যাওয়ার কথা বলে, বাকিরা নাকচ করে দেয়। জানে, গিয়ে কোনো লাভ হবে না। ওদিকে মিডিয়ায় খবরটা ছড়িয়ে পড়লে গা ঢাকা দেয় খুনিরা।

কিছুদিন পর কনস্টেবল হাফিজ মিয়া সজীবের সাথে দেখা করতে বাড়িতে আসে। তাকে দেখে ক্ষেপে যায় সজীবের বন্ধুরা। জানতে চায়, এতকিছুর পরেও কেন পুলিশ খুনিদের ধরতে পারছে না??

জবাবে হাফিজ মিয়া জানালো, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কিছু দুর্নীতিবাজ লোক আছে, যাদের জন্য চাইলেও সাধারণ পুলিশ সদস্যরা আসল অপরাধীদের ধরতে পারে না।

এরপর হাফিজ মিয়া তার নিজের জীবনের করুণ কাহিনী শোনালেন। তার একটা কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ছিল, নাম জিনিয়া। টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ জোগাতো, তার গরীব বাপের সংসারে ও দু চার পয়সা দিতো। খুব হাসিখুশি মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল। একদিন টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে কিছু মানুষরূপী জানোয়ারের হাতে গণধর্ষণের শিকার হয় মেয়েটি। একটু ন্যায় বিচারের জন্য কত দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন হাফিজ মিয়া, কিন্তু কোন ন্যায় বিচার পাননি। একজন আইনের লোক হয়েই তার নিজের মেয়েকে ন্যায় বিচার তিনি দিতে পারেননি সেখানে সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার পাবে কোত্থেকে??? লজ্জা, ঘৃণা, অপমানে আত্মহত্যা করে জিনিয়া।

বলতে বলতে অঝোরে কাঁদলেন হাফিজ মিয়া। “আইনের হাত পাও বান্ধা কয়ডা মাথাওয়ালা লোকের হাতে। ওগো কাছে ন্যায় বিচার চাইয়া লাভ নাই। একজন মেয়েহারা বাপের আর্জি, আপনেরা ওগোরে ছাইড়েন না। প্রয়োজনে সব ধরনের সাহায্য করতে রাজি। ওগো সব গোপন তথ্য আছে আমার কাছে!! ”

ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি গোপাল মাসীর বাড়ি লুকিয়ে ছিল। মাঝরাতে টয়লেটে যাওয়ার জন্য বের হয় গোপাল। বাড়ির বাইরে আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল সজীব আর তার বন্ধুরা। গোপাল বের হতেই তাকে অনুসরণ করে তারা। সুযোগ বুঝে তার মুখ চেপে ধরে বাড়ির পেছনে নিয়ে যায়।

সকালে বাড়ির লোকেরা বাড়ির পেছনের ডোবায় গোপালের ক্ষত বিক্ষত লাশ দেখতে পায়। মাথায় গুলি করা হয়েছে, সারা শরীরে কুপিয়ে জখম করার চিহ্ন। গলায় একটা প্ল্যাকার্ড ঝুলানো। তাতে লেখা,
“আমি গোপাল। আমি সুরাইয়ার ধর্ষক। আমিই ওকে খুন করেছি। এমন শাস্তিই আমার প্রাপ্য। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ”
নিচে লেখা “হারকিউলিস”

রতন গিয়েছিল ছোট বোনকে নাইওর আনতে। দু দিন ধরে নিখোঁজ ছিল সে। তৃতীয় দিন পুলিশ তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে। তার গলাতেও ঝুলানো ছিল প্ল্যাকার্ড। তাতেও লিখা ছিল একই কথা। আর নিচে লিখা ছিল “হারকিউলিস”।

হীরু গিয়েছিল মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে। সেও হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যায়। কয়েক দিন পর তারও বিবস্ত্র ক্ষত বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আর গলায় ঝুলানো সেই একই প্ল্যাকার্ড। যাতে নিজের নাম সহ জবানবন্দি লিখা। আর নিচে লিখা “হারকিউলিস”।

জলিলও গা ঢাকা দিয়েছিল। কয়দিন পর তারও ক্ষতবিক্ষত লাশ মিললো। সাথে গলায় ঝুলানো হারকিউলিস এর নাম লিখা প্ল্যাকার্ড।

মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো হারকিউলিস এর নাম। দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কে এই হারকিউলিস?? টেলিভিশন মিডিয়ায় পক্ষে বিপক্ষে বাকবিতন্ডা চলতে থাকলো। সরকার এই সিরিয়াল কিলার কে ধরার জন্য রেড এলার্ট জারি করলো। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে হারকিউলিস এক ন্যায় বিচারকের প্রতীক, এক জাতীয় বীরের নাম। কারণ মিডিয়ার মাধ্যমে সবাই জেনে গেছে, হারকিউলিস যাদেরকে খুন করেছে তারা সবাই সুরাইয়া হত্যা মামলার আসামি। যাদের ফাঁসির দাবিতে তারা এতোদিন আন্দোলন করেছিল। আইন যা করতে পারেনি হারকিউলিস তা করে দেখিয়েছে। তাইতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু হারকিউলিস এর জয়ধ্বনি।

ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি মানিক পালিয়ে দুবাই যেতে চেয়েছিলো। পথিমধ্যে তাকে অপহরণ করে সজীব ও তার বন্ধুরা। খুন করে লাশটা গুম করতে যাবে তখনই বাধঁলো ঝামেলা। ঐ এলাকার পানের দোকানদার দেখে ফেলে তাদের। তারা হতভম্ব হয়ে যায় কি করবে এখন।

– আপনেরা হারকিউলিস তাইনা?? আপনেগোরে আমি ঠিকই চিনছি। এই হারামজাদার ছবি আমি পেপারে দেখছি। ডরাইয়েন না, আমি কাউরে কমু না। আপনেরা কাম সারেন, আমি ওইদিকে পাহারা দিতাছি।

পরদিন মানিকের ক্ষত বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয় পানের দোকানদার কে জিজ্ঞেস করে পুলিশ, কাউকে দেখেছে কিনা। সে সোজা অস্বীকার করে, কিছুই দেখেনি সে।
– কি বলো তুমি?? তোমার দোকান এত কাছে, তারপর ও বলছো কিছুই দেখোনি!!
– কাইলকা রাইতে দোকানে ছিলাম না তো স্যার। ছোডো মাইয়াডার অসুখ, ডাক্তারের কাছে গেছিলাম, আমি কিছুই দেহিনাই।

পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করে চলে গেল। এভাবেই একে একে খুন হলো সুরাইয়ার ধর্ষকেরা। কি ভাবছেন হারকিউলিস এর মিশন শেষ?? না, হারকিউলিস এর মিশন সবে তো শুরু!!

দেশের আনাচে কানাচে যেখানেই ধর্ষক নামক পশুগুলো ঘুরে বেড়াবে, সেখানেই ছুটে যাবে হারকিউলিস। একটা একটা করে শেষ করবে এইসব মানুষরূপী জানোয়ারগুলোকে। বিচারহীনতার এই অপসংস্কৃতি যতদিন শেষ না হবে, ততদিন হারকিউলিস তার তান্ডব চালিয়েই যাবে।

ধর্ষকেরা সাবধান হয়ে যাও, হারকিউলিস আসছে!!!

লেখা: আফরিন শোভা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে