হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ পর্ব-০৩

0
688

#হাজার_ফুলের_মাঝে_একটি_গোলাপ
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা মনি

শামিমার বান্ধবী মোহনা এসে তার হাত ধরে বলে,
‘আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি শামু। আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবি?’

শামিমা ভ্রু কুচকে বলে,
‘তোকে না কতবার বলেছি আমাকে শামু নামে ডাকবি না। আমার কত সুন্দর একটা নাম আছে শামিমা। আমাকে শামিমা বলেই ডাকবি আর না পারলে ডাকবি না। তবুও এরকম আজেবাজে নামে ডাকবি না।’

মোহনা মুখ বাকিয়ে গিয়ে বলে,
‘তুই এতো ব্যাকডেটেড কেন? খালি আম্মা-খালাম্মার মতো কথাবার্তা। আমি যেটা বলছি সেটা শোন আগে।’

শামিমা মোহনাকে ভালো করে পরখ করে নেয়। মোহনাকে কিরকম অস্থির লাগছে।

শামিমার অনুমতি না নিয়েই মোহনা বলতে শুরু করে,
‘আসলে ফেসবুকে মায়াবী রাজকন্যা নামে আমার একটা ফেক আইডি আছে। সেই আইডি দিয়ে আমি ললিতের সাথে কথা বলতাম। কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে ওর উপর একটা আসক্তি তৈরি হয়। তাই ওকে বলি ওর সাথে দেখা করব। দিনের বেলা তো ভার্সিটি,টিউশনি এসবেই চলে যায়। তাই আমি ওকে বললাম রাতে দেখা করতে। তুই তো জানিস আমার বাবা-মা কেমন? কোনদিনও আমায় রাতে বাড়ি থেকে বের হতে দিত না। তাই আমি ফন্দি করে তোদের সবাইকে নিয়ে পিকনিক করতে চলে যাই। আমার পরিকল্পনা ছিল ললিতের সাথে কথা বলব। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল আর,,,,,’

মোহনা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই শামিমা তার গালে জোরে একটা থা’প্পর মা’রল। মোহনা রাগী চোখে শামিমার দিকে তাকায়।

শামিমা এবার কেদেই দেয়। মোহনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘কেন করলি এমন তুই? আজ তোর জন্য আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমার মা-বোন সবাই আমাকে ভুল বুঝছে। প্রতি মুহূর্তে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি। তুই আমাকে এ কোন জাহান্নামের দিকে ঠেলে দিলি।’

মোহনা শামিমাকে শান্তনা দিয়ে বলে,
‘আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে। আমি ললিতের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম ছেলেটা সত্যিই ভালো না। আমি কি করব বল। তুই একটা কাজ কর ডিভোর্স দিয়ে দে ললিতকে।’

শামিমা মোহনার কথা শুনে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে। মোহনার থেকে কিছুটা দূরে এসে বলে,
‘বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক। যেভাবেই হোক না আমাদের বিয়েটা হয়েছে। ওনার স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব ওনাকে সঠিক পথ দেখানো। আমি চেষ্টা করে যাব। দেখা যাক কি হয়। আমি এত সহজে ধৈর্য হারালে তো চলবে না।’

মোহনাঃআমি শুনলাম ললিত তোর বোনের বয়ফ্রেন্ড। তোরা তো এখন একই বাড়িতে আছিস। আমার খুব ভয় লাগছে যেন কোন অঘটন না ঘটে যায়।

মোহনার কথায় শামিমার মনেও একটা আশংকার জন্ম হয়। মোহনা তো কথাটা ভুল বলেনি। এই বিষয়ে শামিমাকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।

৫.
ললিতের ঘুম ভাঙতেই নিজের চোখের সামনে সুমিকে দেখতে পায়। সুমিকে দেখে ললিত কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখে মিথ্যা হাসি দেয়।

সুমি ললিতের মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘তুমি ঠিক আছো তো ললিত। আমি জানি তুমি বাধ্য হয়ে আমার আপুকে বিয়ে করেছ। তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো তাইনা?’

ললিতঃহ্যা জানু। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার মনে হয় এইসব তোমার আপুর চক্রান্ত। সেই তোমার থেকে আমাকে কেড়ে নেওয়ার জন্য এমন করেছে।

সুমিঃআমারও তাই মনে হয়। আপু ছোটবেলা থেকেই আমাকে হিংসা করে। আমার মতো সুন্দরী নয়তো তাই আমাকে দেখে জ্ব’লে।

ললিত বিড়বিড় করে বলে,
‘তুমি তো একটা মেকআপ সুন্দরী। মেকআপ না করলে ভূতের মতো লাগে। সেই তুলনায় তোমার আপু তোমার থেকে অনেক সুন্দরী। যাকে বলে ন্যাচারাল বিউটি।’

সুমিঃকিছু বললে ললিত?

ললিতঃনা কিছু না। আচ্ছা তোমার আপু কোথায়?

সুমিঃকোথায় আবার যাবে ভার্সিটিতে গেছে।

ললিতঃতোমার কলেজ নেই?

সুমিঃআছে তো। আমি আজ কলেজ যাইনি। তোমাকে এরকম অসুস্থ ফেলে রেখে আপু ভার্সিটিতে যেতে পারে কিন্তু আমি কলেজে যাবো না।

ললিতঃভালো। আমারও আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হলো না। কাল চলে যাব। তুমি আমার জন্য কিছু নিয়ে আসতে পারবে?

সুমিঃতুমি কি খাবে বলো আমি এখুনি এনে দিচ্ছি।

ললিতঃআমি এই বাড়ির নতুন জামাই। আমার জন্য ভালো ভালো খাবার আনো। পোলাও,কোরমা,কাবাব এসব কিছু আনো।

সুমিঃআমি এগুলো কোথায় পাবো? আমি তো এসব রান্না করতে পারিনা।

ললিতঃতোমার আম্মুকে বলো রান্না করতে।

সুমিঃআচ্ছা তুমি দাড়াও আমি দেখছি।

সুমি দৌড়ে রান্নাঘরে চলে আসে। শাহানাজ পারভীন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত ছিল। সুমি এসে তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কি রান্না করছ আম্মু?’

শাহানাজ পারভীন বেগুন কা’টতে কা’টতে বলেন,
‘এইতো বেগুন ভাজি দিয়ে ভাত করব। সাথে মুসুর ডাল।’

সুমি মুখ বাকিয়ে বলে,
‘ঘরে যে নতুন জামাই এসেছে তাকে এসব খাওয়াবে?’

সুমির কথা শুনে শাহানাজ পারভীন তেলে বেগুনে জ্ব’লে ওঠেন।
‘ঐ ছেলেটার জন্য তো আমি এক গ্লাস পানিও দিতে চাইনা। সকাল সকাল মদ খেয়ে এসেছে। গোটা এলাকায় কথাটা রটে গেছে। আমি লজ্জায় কাউকে মুখই দেখাতে পারছি না। তার জন্য ভালোমন্দ রান্না করব এটা ভাবলি কি করে? যা হয়েছে তা দিয়ে খেলে খাবে না খেলে নাই। আমার কোন ঠেকা পড়েনি জামাই আদর করে খাওয়ানোর।’

সুমি রেগে গিয়ে তর্ক করতে শুরু করে। একপর্যায়ে শাহানাজ পারভীন রাগ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। সুমি রেগে গিয়ে রান্নাঘরের সব জিনিস ফেলে দিতে থাকে।

আয়েশা বেগম রান্নাঘরে ছুটে এসে এমন অবস্থা দেখে রাগারাগি করতে করতে বলেন,
‘এসব কি করছিস সুমি? বৌমা কই তুমি। তোমার মেয়ের কাণ্ড দেইখা যাও।’

সুমিকে আটকাতে গেলে সে আয়েশা বেগমকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে,
‘এই বুড়ি একদম বাড়াবাড়ি করবি না। বসে বসে খেয়ে যে আমার বাবার টাকা ধ্বংস করছিস তার উপর আমাকেই তে’জ দেখাচ্ছিস। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঘাড় ধরে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসব।’

কথা বলা শেষ হতেই সুমির গালে ঠাস করে একটা থা’প্পর এসে পড়ে। শক্ত হাতের থা’প্পরে সুমি দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। শামিমা রাগে টগবগ করতে করতে সুমির দিকে তাকিয়ে আছে। সুমি উঠে এসে শামিমাকে বলে,
‘তোর এত বড় সাহস তুই দাদিকে এভাবে বলছিস। এত সাহস তুই পেলি কোথায়? ভুলে গেলি এই দাদিই তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। আজ শুধু আব্বুকে একবার আসতে দে তারপর দেখ আমি কি করি।’

সুমি শামিমাকে হুমকি দিয়ে বলে,
‘তুই যদি আব্বুকে কিছু বলিস তাহলে আমি কিন্তু,,,,’

শামিমাঃকি করবি তুই?

সুমিঃললিতকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব।

শামিমাঃসুমি!

সুমি আর কোনকিছু না বলে চলে যায়। শামিমা আয়েশা বেগমকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলে। পড়ে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছেন তিনি। শামিমা তার কোমড়ে মালিশ করে দিতে দিতে বলে,
‘তুমি ঠিক আছো তো দাদি? বেশি ব্যাথা লাগে নি তো?’

আয়েশা বেগম চোখ থেকে অশ্রু মুছতে মুছতে বলেন,
‘আল্লাহর রহমতে তোর মতো একটা নাতনী পেয়েছি। আমি কিভাবে খারাপ থাকবো?’

শামিমা বিনিময়ে মৃদু হেসে তার মোলায়েম হাত দিয়ে দাদির কোমড়ে মালিশ করতে থাকে।

৬.
শাহানাজ পারভীন এবং আলতাফ উদ্দিন অনেকক্ষণ থেকে বসে আছেন। শামিমা তাদের বসে থাকতে বলে কোথায় যে চলে গেল তারপর থেকে আর আসছেনা৷ কিছুক্ষণ পর শামিমা মোহনাকে নিয়ে তাদের সামনে আসে।

মোহনাকে দেখে শাহানাজ পারভীনের ভ্রু কুচকে যায়। মেয়েটাকে এমনিতেই তার ভালো লাগে না। মোহনা বলতে শুরু করে,
‘ললিত সেদিন আমার সাথে দেখা করতেই এসেছিল। এখানে শামিমার কোন দোষ নেই আঙ্কেল আন্টি। আমার জন্যই সব হয়েছে। আপনারা প্লিজ শামিমাকে আর দোষ দেবেন না।’

শাহানাজ পারভীনকে উদ্দ্যেশ্য করে আলতাফ উদ্দিন বলেন,
‘দেখেছ তো, তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমাদের মেয়ে এরকম কাজ করতেই পারে না।’

শাহানাজ পারভীনঃতোমার মেয়ে কি করেছে না করেছে সেটা বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হলো এটা যে ওর জন্যই সমাজে সবাই আমাদের নিয়ে খারাপ কথা বলছে। আমার ওকে আর সহ্য হচ্ছেনা।

শামিমাঃআম্মু। এসব কি বলছ তুমি?

শাহানাজ পারভীনঃযা বলছি একদম ঠিক বলছি। আমি আগেই জানতাম তুই এরকম কোন কাজ করতে পারিস না। দোষটা আসলে তোর নয় তোর ভাগ্যের। কিন্তু আমি কি করব বল, সমাজের লোকের এত মন্দ কথা যে আমার সহ্য হচ্ছেনা। তাই তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করছি। আগে যখন সবাই আমাকে শামিমার মা বলত তখন গর্বে আমার বুক ফুলে যেত। আর এখন মাথা নিচু হয়ে যায়। সমাজের লোক যে এতকিছু বুঝবে না। তারা শুধু সমালোচনা করে যাবে।

কথাটা বলে চোখের জল মুছতে মুছতে শাহানাজ পারভীন চলে যান। আলতাফ উদ্দিন এসে শামিমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিয়ে বলেন,
‘কোন চিন্তা করিস না। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর আম্মুকে একটু সময় দে।’

শামিমা মুখে একটা মিথ্যা হাসি আনে। কারণ সে তার মাকে চেনে। একবার যখন সে রাগ করেছে তখন এত সহজে সেই রাগ ভাঙানো সম্ভব নয়।

মোহনাকে বাইরে একটু এগিয়ে দিয়ে এসে শামিমা নিজের রুমে প্রবেশ করে। শামিমা রুমে আসতেই ললিত তার দিকে একটি পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘নাও এই পেপারে সাইন করে দাও।’
চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে