#হাজার_ফুলের_মাঝে_একটি_গোলাপ
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা মনি
ললিত ঘরে ঢুকতেই শামিমা গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ললিতের মনে কামবাসনা জেগে ওঠে। সে শামিমার দিকে এগিয়ে যাবে তখনই শামিমা একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।
ললিতের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে শামিমা তার হাতে বালিশ ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘আমার সাথে এক রুমে আপনি থাকতে পারবেন না।থাকলে হলে বাথরুমে গিয়ে ঘুমান।’
ললিত ক্ষেপে গিয়ে বলে,
‘এসব কেমন কথা? আমি তোমার স্বামী। আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোমার উপর।’
শামিমা তা’চ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
‘আপনার মতো দু’শ্চরিত্র মানুষকে আমি স্বামী হিসেবে মানি না। যেদিন আপনাকে পবিত্র করতে পারবো সেদিনই আপনাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেব।’
শামিমার কথা শুনে ললিত ভ্রু কুচকে বলে,
‘এমন ভাব করছ যেন তুমি খুব ভালো মেয়ে। তোমার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। তুমি নিজেই তো ফেসবুকে আমার সাথে প্রেম করতে।’
শামিমা নিজের কান চেপে ধরে বলে,
‘এই কথা শোনাও পাপ। আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি আমি জীবনে কোন ছেলের সাথে প্রেম করা তো দূরের কথা অপরিচিত কোন ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলিনি।’
ললিত বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে,
‘নিজেকে এত ধর্মপ্রাণ দেখাতে হবে না। তুমি যে এক নম্বরের বকধার্মিক সেটা আমার বোঝা শেষ।’
শামিমা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘আমার ঈমান নিয়ে কোন কথা বলবেন না। আপনার মতো পাপিষ্ঠের মুখে আমার সম্পর্কে কোন কথা শুনতে চাইনা।’
৩.
এবার ললিত শামিমার চু’লের মুঠি ধরে বলে,
‘এই নাটক করছিস কেন? তুই তো ফেসবুকে মায়াবী রাজকন্যা নাম নিয়ে আমার সাথে প্রেম করতি। রাত বিরেতে আমার সাথেও দেখা করতে চেয়েছিলি। এখন এমন নাটক করছিস যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানিস না।’
শামিমা অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘আমার আল্লাহ জানেন আমি এসব কিছুই করিনি। আমার কোন ফেসবুক একাউন্টই নেই। ফেসবুক তো দূর আমার কাছে স্মার্টফোনই নেই। আমি বাটন ফোন ইউজ করি। পড়ালেখা আর কোরআন শরিফ পাঠ করেই আমি আমার দিন কা’টাই।’
ললিতঃতাহলে তুই ওত রাতে পদ্মবিলের পাশে কি করছিলি একা একা?
শামিমাঃআমি একা যাইনি। আমরা কয়েকজন বান্ধবী মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সাথে আমার ভাইয়াও ছিল। আমরা ৮ টার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম। আমি আমার বান্ধবীদের জন্য ওখানে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম তখনই আপনি এসে,,,,,,’
শামিমার কথাগুলো শুনে ললিতের মাথা গরম হয়ে যায়। ললিত বুঝতে পারে শামিমা তার মায়াবী রাজকন্যা নয়। ললিত তখন শামিমার উপর রাগ ঝাড়ার জন্য তাকে প্র’হার করতে উদ্যত হয়। শামিমা আল্লাহু আকবর বলে ললিতের হাত ধরে ফেলে। তারপর ললিতকে টেনে নিয়ে গিয়ে বাথরুমে লক করে দেয়। এরপর নিজে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ললিত চিৎকার করতে থাকে। শামিমা সেদিকে কান না দিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে বলতে থাকে,
‘আল্লাহ তুমি আমায় ধৈর্য দাও। আমি যেন মানুষটাকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনতে পারি। এখন উনি আমার স্বামী। স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব আমার স্বামীকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনা। তুমি শুধু আমায় একটু সাহস আর ধৈর্য দাও আল্লাহ।’
এরপর শামিমা ঘুমিয়ে পড়ে। ললিতও একসময় ক্লান্ত হয়ে বাথরুমেই ঘুমিয়ে পড়ে।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে শামিমা বাথরুমের দরজা খুলে দেয়। তারপর ললিতকে ডেকে তুলে বলে,
‘ফজরের নামাজের সময় হয়ে এসেছে। একটু পর আযান দেবে। আপনি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে মসজিদে চলে যান।’
ললিত বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
‘আমি নামাজ পড়ি না। এত সকালে ঘুম থেকে ডাকলি কেন? আমি কোনদিন ৮ টার আগে ঘুম থেকে উঠিনা।’
শামিমা শান্তভাবে বলল,
‘এতদিন যা করেছেন তা আর এখন করতে পারবেন না। এখন আমি আপনার স্ত্রী। আপনাকে দ্বীনের পথ দেখানো আমার কর্তব্য। আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলুন। তাহলে জীবন সুন্দর হবে। নিন উঠে পড়ুন। আব্বুর সাথে যান মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে নিন।’
ললিত কোন কথা না বলে আমার শুয়ে পড়ল। শামিমা এক মগ পানি এনে ললিতের গায়ে ঢেলে বলল,
‘উঠে পড়ুন বলছি। আপনার মধ্যে বসবাস করা শ’য়তানকে আমার কাছে হারতেই হবে।’
ললিত রাগে শামিমার দিকে তাকায়। শামিমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক বাতলি পানিতে গিয়ে শামিমার মুখ ডুবিয়ে দেয় ললিত। শামিমার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল তার জীবন বুঝি এখানেই থমকে যাবে। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় শামিমা।
ললিত শামিমার গলা টি’পে ধরে বলে,
‘আমার সাথে বেশি বাড়াবাড়ি করলে এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি হবে।’
কথাটা বলে ললিত বেরিয়ে যায়। শামিমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ললিতের যাওয়ার দিকে। আড়ালে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শামিমা বলতে থাকে,
‘আপনি যে খারাপ মানুষ সেটা আমার বোনের সাথে যখন প্রেম করতেন তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি সুমিকে কত বুঝিয়েছি কিন্তু সুমি বোঝেনি। প্রতিদিন মোনাজাতে আল্লাহর কাছে চাইতাম সুমি যেন আপনার মতো খারাপ মানুষের কবল থেকে বের হয়ে আসে। আমার সেই দোয়া কবুল হয়েছে ঠিকই। কিন্তু দেখুন ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ আমি আপনার স্ত্রী। তবে আল্লাহর উপর আমার বিশ্বাস আছে। তিনি যা করেন তার পিছনে বড় কোন উদ্দ্যেশ্য থাকে। আপনার সাথে যখন আমার বিয়ে হয়েছে তখন আপনার স্ত্রী হিসেবে সব কর্তব্য আমি পালন করবো।চেষ্টা করবো আপনাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। বাকিটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম।’
শামিমা ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। তারপর ছাদে চলে যায়। সকালের মিষ্টি বাতাস যে তার খুব প্রিয়। ছাদে গিয়ে শামিমা দেখে শাহনাজ পারভীন আড়ালে লুকিয়ে কাদছেন।
শামিমা খুব ভালোভাবেই জানে উপরে উপরে যতই রাগ দেখান না কেন তার আম্মু তাকে খুব ভালোবাসে। শামিমা তার আম্মুর কাছে গিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,
‘আম্মু,,,,’
শাহনাজ পারভীন রেগে গিয়ে বলেন,
‘কে তোর আম্মু? আমার শুধু দুটো ছেলে মেয়ে সুমি আর শাহাদাত। তুই আমার কেউ না দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে।’
শামিমার চোখে জল চলে আসে। অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে শামিমা বলে,
‘আমাকে দূরে চলে যেতে বলছো। একদিন খুব করে চাইবে আমাকে। আমাকে ফিরে পেতে চাইবে। কিন্তু সেদিন আমি আসব না।’
৪.
ললিত রাগে টগবগ করতে করতে ক্লাবে চলে আসে। ক্লাবে ললিতের বন্ধুরা মিলে ক্যারাম খেলছিল। ললিত এসে তাদের সাথে যোগ দেয়।
ললিতের এক বন্ধু তাকে বলে,
‘কি রে ললিত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিলি যে? আমাদের তো দাওয়াতও দিলি না।’
আরেকজন বলে,
‘আরে বুঝলি না সব টাকা বাচানোর ধান্দা। আজ কিন্তু তোর কোন কথা শুনব না। আমাদের সবাইকে কিন্তু ট্রিট দিতেই হবে।’
ললিত তার বন্ধুর কলার ধরে বলে,
‘কিসের ট্রিট চাস? আমার জীবন নষ্ট হওয়ার?’
ললিতের বেস্ট ফ্রেন্ড আমান তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন? যতদূর শুনলাম ঐ মায়াবী রাজকন্যা আইডির মেয়েটার সাথেই তোর বিয়ে হয়েছে।তোর তো খুশি হবার কথা।’
ললিত আমানের দিকে তাকিয়ে কষ্ট কষ্ট মুখ করে বলে,
‘ওটা বউ নয় রা’ক্ষসী।’
ললিতের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। ললিত অপমানিত বোধ করে। আমান ললিতকে শান্তনা দিয়ে বলে,
‘বিয়ের পর এমন কথা সবাই বলে। কয়েকটা দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন দেখবি আমাদের ভুলে যাবি আর সারাক্ষণ বউ বউ করবি।’
ললিত এবার বাধ্য হয়ে তার বন্ধুদের সব ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। সব শুনে আমান মাথায় হাত দিয়ে বলে,
‘তোর দুঃখের গল্প শুনে আমি শিহরিত। আসলে জীবনটাই বেদনাময়। তুই চিন্তা করিসনা দোস্ত। সব সমস্যার সমাধান আমার কাছে আছে। বাজার থেকে নতুন মাল এনেছি। খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা পুরো বোতল ম’দ শুধু তোর জন্য।’
ম’দের কথা শুনে ললিত খুশি হয়। এটা তার প্রিয় নেশা। মদ পেলে সব ভুলে যায়। ললিত ঢকঢক করে মদ গিলে খায়।
মদ খেয়ে মাতাল হয়ে টলতে টলতে শামিমার বাড়ির দিকে যেতে থাকে ললিত।
শামিমা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। বোরখা পড়ে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবে তখনই ললিত এসে উন্মা’দের মতো দরজা ধাক্কাতে থাকে। শামিমা দরজা খুলে ললিতকে মদ্যপ অবস্থায় দেখে রেগে যায়। নাক হাত দিয়ে বলে,
-“আপনি কোন সাহসে এসব হারাম খেয়ে বাড়িতে এসেছেন? আপনার কি একটুও লজ্জা নেই ছিহ!”
ললিত শামিমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,
‘বেশ করেছি মদ খেয়েছি। আরো হাজারবার খাবো। কি করবি তুই?’
শামিমা ললিতকে জোর করে টেনে রুমে নিয়ে যেতে থাকে। শাহনাজ পারভীন ললিতকে এই অবস্থায় দেখে রেগে গিয়ে বলেন,
‘এই দিন সেখার আগে আমার মৃত্যু হলোনা কেন? শেষে কিনা এইরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করলি তুই শামিমা। এক্ষুনি এই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের কর।’
শামিমা তার আম্মুকে অনুরোধের সুরে বলে,
‘আমি ওনাকে সামলে নেব। তুমি দয়া করে আব্বুকে কিছু বলোনা।’
শাহনাজ পারভীন মুখ বাকিয়ে বলেন,
‘তাকেই সবার আগে বলব। আসতে দে তোর আব্বুকে। নিজের ফুলের মতো পবিত্র মেয়ে কেমন ছেলেকে বিয়ে করেছে দেখে যাক।’
শামিমার চোখে জল চলে আসে। তার আম্মুর এইরকম ব্যবহার তার ভালো লাগছে না। অনেক কষ্টে ললিতকে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। রাগে শামিমার শরীর জ্ব’লে যাচ্ছিল। শামিমা লেবুর সরবত করে এনে ললিতকে খাইয়ে দেয়। ললিত প্রথমে খেতেই চাচ্ছিল না। শামিমা জোর করে খাইয়ে দেয়। ললিত হঠাৎ বমি করতে শুরু করে। তারপর জ্ঞান হারায়। শামিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ললিতকে পরিস্কার করিয়ে দেয়। তারপর ললিতকে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে চলে যায় ভার্সিটির উদ্দ্যেশ্যে।
শামিমা ভার্সিটিতে ঢোকার সাথে সাথেই তার বান্ধবী মোহনা এসে শামিমার হাত ধরে বলে,
‘আমি অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছি শামু। আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারবি?’
চলবে….?