#হাজার_ফুলের_মাঝে_একটি_গোলাপ
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
১.
‘নিজের ছোট বোনের বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে তোর একটুও লজ্জা করল না আপু?’
নিজের ছোট বোন সুমির মুখে কথাটা শুনে ভাবলেশহীন ভাবে শামিমা বলল,
‘আমি এখন ললিতের ওয়াইফ। আমরা একটা হালাল সম্পর্কের মধ্যে আছি। তুই এখন আর এসব প্রেমের কথা তুলিস না। ললিত এখন শুধুই আমার।’
সুমি অট্টহাসিতে ফে’টে পড়ে। তার এই হাসির মধ্যে তা’চ্ছিল্য ছিল। সুমি শামিমার দিকে আঙুল তুলে বলে,
‘আমি তোকে চ্যালেঞ্জ করছি তোর আর ললিতের একসাথে সংসার করা কোনদিনও হবে না। আমি ললিতকে চিনি, ললিত শুধু আমায় ভালোবাসে। তোর জন্য ওর মনে একটুও যায়গা নেই।’
শামিমাও চুপ থাকার মেয়ে নয় সুমিকে মুখের উপরেই বলে দেয়,
‘দেখি ললিত কার কাছে যায়। নিজের স্ত্রীর কাছে নাকি প্রেমিকার কাছে।’
গালে হাত দিয়ে শোফায় বসেছিল ললিত। কোথা থেকে কি হয়ে গেল সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সেই স্কুল লাইফ থেকে সুমির সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একপর্যায়ে সুমির প্রতি বিরক্ত লাগা শুরু হয় তার। তাই সুমির থেকে লুকিয়ে ফেসবুকে ‘মায়াবী রাজকন্যা’ নামক আইডির অন্য একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে শুরু করে। মেয়েটার সাথে কথা বলে ললিত খুবই প্রসন্ন হয়। কারণ মেয়েটার কথা শুনেই বোঝা গেছিল সে খুব ভদ্র, পরিপাটি আর সংসারী। যাকে বলে ওয়াইফ ম্যাটারিয়াল। একসময় মেয়েটার প্রতি তার একটা আসক্তি তৈরি হয়। তাই তাকে বলে সে মেয়েটির সাথে সামনাসামনি দেখা করতে চায়।
মেয়েটিও সম্মতি জানিয়ে বলে,
‘তুমি আজ রাত ৮ টায় পদ্মবিলের পাশে চলে এসো। ওখানেই আমরা দেখা করবো।’
মেয়েটির প্রস্তাব শুনে ললিত তো প্রথমে ঘাবড়ে যায়। এত রাতে একটা মেয়ের সাথে কিভাবে দেখা করবে? প্রথম প্রথম এই নিয়ে মনে সংশয় থাকলেও অবশেষে নিজের অবাধ্য মনের কাছে হেরে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে ললিত।
তাই তো রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে যায়। আর সেখানেই হয়ে যায় বিপত্তি। ললিত গিয়ে দেখে একটি মেয়ে পদ্মবিলের সামনে পায়চারি করছে। এত রাতে কেউ দেখবে না ভেবে ললিত গিয়ে শামিমাকে জড়িয়ে ধরে।
ঘটনার আকস্মিকতায় শামিমা ভয়ে চিৎকার করে দেয়। তার চিৎকার শুনে আশেপাশের অনেক মানুষ ছুটে আসে। এত রাতে দুটি ছেলে মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে সবাই ভাবে তারা কোন অনৈতিক কাজ করছিল। তাই সবাই মিলে তাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করে।
ললিত শামিমা দুজনের কেউই এই বিয়েতে রাজি ছিলনা। পরে দুজনের পরিবারকে খবর দেওয়া হয়। শামিমার মা এসে প্রথমেই শামিমার দু গালে থা’প্পর মা’রে।
শামিমার মা শাহানাজ পারভীন বিলাপ করে বলতে থাকেন,
‘আজ যদি সুমি এই কাজটা করত আমি মানতাম। কিন্তু তুই এভাবে আমাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলি? পাড়ায় আমি মুখ দেখাব কি করে? আগে সবাই আমাকে দেখে সম্মান নিয়ে বলতো দেখো শামিমার মা যাচ্ছে, শামিমার মতো ভদ্র মেয়ে আর হয়না, সবাই তাদের মেয়েকে বলতো শামিমাকে দেখে শেখ। এখন তারাই তো আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে ঐ দেখ শামিমার মা যেই মেয়েটা কুকা’ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তুই জন্মের পরই ম’রলি না কেন?’
শামিমা কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেয়না। ললিতের বাবা-মা সমাজে লোকলজ্জার ভয়ে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।
কিন্তু শামিমার বাবা আলতাফ উদ্দিন সাফ জানিয়ে দেন,
‘আমার মেয়ের উপর আমার ভরসা আছে। আমি জানি আমার মেয়ে এরকম কোন কাজ করবে না। আমার মেয়ে হাজার ফুলের মাঝে একটি গোপাল। যার দ্বারা কোন অপবিত্র কাজ সম্ভব নয়।’
শাহানাজ পারভীন ভ্রু কুচকে বলেন,
‘তুমি যদি আজ মেয়েটার বিয়ে না দিয়ে ঘরে তুলছ তাহলে কিন্তু আমি এই মেয়েকে বা’চিয়ে রাখব না। ওকে জন্ম দিয়ে যে পাপ করেছি ওকে নিজের হাতে মে’রে সেই পাপমোচন করব।’
আলতাফ উদ্দিন একবার শামিমার দিকে তাকান। শামিমা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। তার লাল হয়ে যাওয়া চোখ দেখেই আলতাফ উদ্দিন বুঝতে পারলেন তার মেয়ে নির্দোষ। নিজের মেয়ের উপর বিশ্বাস থাকলেও সমাজের লোকের নানান কথা বন্ধ করার জন্য আলতাফ উদ্দিন শামিমাকে গিয়ে বলেন,
‘আমি জানি শামিমা তুই ফুলের মতোই কোমল। তোর মনে কোন পাপ নেই। তুই যে আমার পবিত্র ফুল। কিন্তু আজ যে তোর চরিত্রে দাগ লেগেছে মা। তুই কি চাস বল যে লোকে তোকে নিয়ে খারাপ কথা বলুক? তাই আমি তোর কাছে অনুরোধ করছি তুই বিয়েটা করে নে। নাহলে যে আমার পবিত্র ফুলটাকে সবাই অপবিত্র বলবে। আমি যে সেটা মেনে নিতে পারবো না শামিমা।’
নিজের বাবার এমন আকুল আবেদনে শামিমা সাড়া না দিয়ে পারেনা। তাইতো সে রাজি হয় ললিতকে বিয়ে করতে।
তারপর কাজি ডেকে আজই তাদের বিয়ে পড়ানো হয়।
স্মৃতি থেকে বেরিয়ে ললিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আসলেই কি শামিমা সেই মেয়ে যার সাথে প্রতিদিন আমার কথা হতো? আর হলেই বা কি না আর হলেই বা কি আমাদের বিয়ে তো হয়ে গেছে। এখন তো আমি সম্পর্কটাকে অস্বীকার করতে পারি না। আর তাছাড়া এই সুমির থেকে পিছু ছাড়ানোরও দরকার ছিল। যা হওয়ার ভালোই হয়েছে একদিক দিয়ে।’
২.
ললিতের বাবা-মা তাকে শামিমার বাড়িতেই রেখে চলে যায়। তাদের এক কথা,
‘এখন এদের ঘরে তুললে সমাজে নানান কথা বলবে সবাই আমাদের নিয়ে। আমরা এসব মানতে পারবো না। আমাদের কাছে সম্মানটাই সব। তাই আমার ছেলেকে রেখে গেলাম। আপনারা কয়েক মাস ঘরজামাই করে রাখুন। তারপর সব ধামাচাপা পড়লে নাহয় আমরা এসে ওদের নিয়ে যাব।’
আলতাফ উদ্দিন এক কথাতেই রাজি হয়ে যান। তিনি নিজেও তো চাচ্ছিলেম না তার মেয়েকে এভাবে পাঠিয়ে দিতে। মেয়েটার উপর দিয়ে যা ঝড় বয়ে গেল এখন শামিমার একটু শান্তি আর সময় দরকার নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য। এই সময় কোন অচেনা পরিবেশে গেলে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারবে না। তার উপর লোকের মন্দ কথা তো আছেই।
তবে শাহানাজ পারভীন স্বামীর এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী। তার মতে বিয়ের পর মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠানোই উচিৎ ছিল। আলতাফ উদ্দিন অবশ্য স্ত্রীর কথায় কর্ণপাত করেন না। তিনি নিজের ইচ্ছামতো চলা মানুষ। শাহানাজ পারভীনও আর বেশি কিছু বলতে পারেন না।
শামিমা চুপচাপ বসেছিল। শামিমার দাদি আয়েশা বেগম এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘জানি তোর এহন খুব খারাপ লাগছে। মনে মনে হয়তো নিজের বাপের উপর রাগও হচ্ছে। কেন সে তোর উপর এমন একটা সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিল। কিন্তু সবুর কর দেখবি তুই একসময় ঠিক বুঝছি তোর বাপ কোন ভুল কাম করে নাই।’
শামিমা তার দাদির কোলে মাথা রেখে কেদে দেয়।
কাদতে কাদতেই বলে,
‘আমি কি দোষ করেছি দাদিমা? কেন আমায় এতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে। আজ আমার বোনই আমার শত্রুতে পরিণত হয়েছে, আমার যে আম্মু কোনদিন আমার উপর রাগ পর্যন্ত হয়নি আজ আমাকে দেখেই তার মুখ থেকে খারাপ শব্দ বের হয়ে আসছে। আমি যে আর নিতে পারছি না।’
আয়েশা বেগম শামিমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,
‘এমনে আর কাদবি না। চোখের পানি কি এত সস্তা? আল্লাহর উপর ভরসা রাখিস। মনে রাখিস আল্লাহ উত্তর পরিকল্পনাকারী। আর একটা কথা কখনো ধৈর্য হারাইবি না। আল্লাহ তার বান্দাদের এমন অনেক পরীক্ষা নেন।’
শামিমা প্রতিত্তোরে বলে,
‘জানি দাদিমা। আমি চেষ্টা করছি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার। আমি জানি আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। তার বান্দাদের তিনিই তো বিপদ থেকে রক্ষা করেন। আমি শুধু আল্লাহর কাছে এটুকুই চাইব আমাকে যেন তিনি আরো বেশি ধৈর্যশক্তি দেন। সামনে যে আমার আরো বড় লড়াই।’
‘কিসের লড়াইয়ের কথা বলছিস?’
নিজের মায়ের গলার স্বর শুনে শামিমা পিছনে ফিরে তাকায়। শাহানাজ পারভীন তাকে পাশ কা’টিয়ে সামনে এসে বলেন,
‘আম্মা আপনি আসেন। এই মেয়ের নাটক আর দেখতে হবে না। ২০ বছর ধরে নাটক তো কম দেখলেন না।’
শামিমা অস্ফুটস্বরে বলে,
‘আমাকে তুমি একটুও বিশ্বাস করোনা আম্মু? তোমার কি মনে হয় আমি এমন কোন কাজ করতে পারি যেটা অন্যায়?’
শাহানাজ পারভীন বাকা হেসে বলেন,
‘এতদিন বিশ্বাস করতাম না কিন্তু এখন করি। কেউ যদি আজ এসে আমায় বলে তুই খু’ন করেছিস আমি সেটাও বিশ্বাস করে নেব।’
‘আম্মু,,,,’
আয়েশা বেগম রাগ দেখিয়ে বলেন,
‘বৌমা মুখ সামলাইয়া কথা কও। আমার নাতনীরে আমি ভালো কইরাই চিনি। ওয় যা করছে তার পিছনে নিশ্চয়ই কোন উদ্দ্যশ্য আছে।’
শাহানাজ পারভীন ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,
‘আমি কিছু জানতে চাইনা এইসব ব্যাপারে। আমি আপনার খাবার তৈরি করে রেখেছি খেয়ে নিন।’
কথাটা বলে শাহানাজ পারভীন চলে যেতে নেয় তখন শামিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
‘আজ তুমি আমায় বিশ্বাস করছোনা তাইনা আম্মু? কিন্তু এমন একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন তুমি আজকের জন্য আফসোস করবে। তখন আমি হয়তো থাকবোনা কিন্তু এই স্মৃতিগুলো থাকবে।’
শাহানাজ পারভীন কিছু না বলে চলে যান।
তিনি যাওয়ার পর আয়েশা বেগম শামিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘মায়ের উপর রাগ কইরা থাকিস না। আমি ওরে চিনি আসলে তোরে খুব ভালোবাসে আর বিশ্বাস করে তো। এই বিশ্বাস হঠাৎ কইরা ভাইঙ্গা যাওয়াতে এমন করছে। যেদিন সব সত্যি জাইনতে পারবে সেদিন দেখবি তোকে আবার বুকে টাইনা নেবে।’
শামিমা মৃদু আসে। আয়েশা বেগমও চলে যান। শামিমা তখন একলা নিজের ঘরে বসে ছিল। বসে বসে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই ভাবছিল। জীবন সত্যিই বড় অদ্ভুত। কখন কি হয়ে আয় তা বোঝাই যায়না।
শামিমার ভাবনার মধ্যেই ললিত দরজার নক করে বলে,
‘আসব।’
শামিমা রক্তিম চোখে ললিতের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে,
‘আসুন। আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।’
ললিত ঘরে ঢুকতেই,,,,
চলবে কি?