#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Part_10
#Writer_NOVA
— আল্লাহ গো! জ্বলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ আমাকে বাঁচাও! আমাকে এসিড মারছে।
এক মুহুর্তের জন্য শ্রাবণ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। যখন তার হুশ ফিরলো দৌড়ে পাশের এক দোকান থেকে পানির কলস এনে মারিয়ার মুখের ওপর ঢেলে দিলো।মারিয়া দুই হাতে গলার কাছটা ধরে দাপাচ্ছে। শ্রাবণ দিশেহারা। রাস্তা থেকে নেমে সামনের ডোবা থেকে কলস ভর্তি পানি এনে আবারো মারিয়ার মুখে ঢালতে লাগলো। এতক্ষণে অনেক মানুষ জোরো হয়ে গেছে। পাশের দুটো দোকানের দোকানিরাও তাদের জগ ও ছোট কলস নিয়ে পানি ভর্তি করে মারিয়ার মুখে ঢালছে। শ্রাবণের থেকে বড় কলসটা নিয়ে একটা মধ্য বয়স্ক লোক বললো,
— বাজান তুমি ওর কাছে বহো। আমরা পানি আনতাছি। তুমি পাশে থাকলে ও একটু সাহস পাইবো।
শ্রাবণ ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আচ্ছা চাচা। জলদী পানি নিয়ে আসেন।
শ্রাবণ নিচে বসে মারিয়ার মাথাটা তার কোলে নিলো। মারিয়ার এক হাত চেপে ধরে তাতে চুমু খেয়ে বললো,
— কিচ্ছু হবে না তোমার। আমি তোমার কিছু হতে দিবো না। তোমার শ্রাবণ আছে তোমার সাথে। আমি এতোটা কেয়ারলেস কি করে হতে পারলাম? আমি থাকতেও তোমার এতবড় বিপদ হলো। তোমার কিছু হলে আমি নিজেকে মাফ করতে পারবো না।
শ্রাবণের চোখ দিয়ে পানি পরছে। মারিয়া শক্ত করে ওর হাত ধরে বারবার বলছে,
— আমার গলার দিকটা জ্বলে যাচ্ছে শ্রাবণ। আমি বোধহয় আর বাঁচবো না।
একের পর একজন দ্রুত পানি নিয়ে এসে মারিয়ার মুখ, গলার দিকে ঢালছে। এসিডের চরম শত্রু হলো পানি। পানির সংস্পর্শে এসিড তার ক্ষমতা হারায়।
মারিয়া একপাশ হয়ে থাকায় রক্ষা। উপুড় হয়ে বসে পা দেখার কারণে এসিড তার মুখে না পরে গলায় পরেছে।শ্রাবণ নীরবে কাঁদছে। তার সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। পানি ঢালা শেষ হতেই মধ্য বয়স্ক লোকটা আবারো বললো,
— বাজান এবার মাইয়াডারে হাসপাতালে নিয়া যাও।দেরী কইরো না।
শ্রাবণ তড়িঘড়ি করে নিজের শার্টটা খুলে মারিয়ার শরীরে জড়িয়ে দিলো। মারিয়ার পুরো শরীর ভিজে একাকার। তারপর কোলে তুলে নিয়ে এক রিকশা ডেকে তাতে উঠে বসলো। রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিয়ে বললো,
— জলদী সামনের হসপিটালে নিয়ে চলুন।
মারিয়াকে সাহস জুগানোর জন্য ওর মাথাটা নিজের বুকে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— তুমি কোন চিন্তা করো না মারিয়া। আমি তোমার কিছু হতে দিবো না।
মারিয়ার গলার জ্বালাটা অনেকটা কমেছে। তবুও খানিকক্ষণ পর পর চিনচিন করে উঠছে। সে শ্রাবণের বুকে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে রইলো।
ঘন্টাখানিক পর……
শ্রাবণ কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে মারিয়ার ট্রিটমেন্ট হচ্ছে। মারিয়ার বাবা-মাকে কল করে আসতে বলে দিয়েছে।মারিয়ার বাবা মহিউদ্দিন সাহেব ও মা আলেয়া বেগম খবর শুনে এক মিনিটও দেরী করেনি। দ্রুত চলে এসেছে। দৌড়ে কেবিনের সামনে এসে শ্রাবণকে দেখে মহিউদ্দিন সাহেব বললো,
— আমার মেয়ে কোথায়? ওর এই অবস্থা কি করে হলো? কে করেছে এমন?
আলেয়া বেগম শ্রাবণকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
— কথা বলো প্লিজ। ওর কি হয়েছে? আমার মেয়ে ভালো আছে তো। আমার মারিয়া কোথায়?
শ্রাবণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে তাকে অনুভূতি শূন্য একটা মানুষ মনে হচ্ছে। হাতের আঙুল দিয়ে কেবিনের দিকে তাক করে দেখিয়ে দিলো।আলেয়া বেগম ওকে ছেড়ে মহিউদ্দিন সাহেবের সাথে কেবিনে ঢুকলো। শ্রাবণ তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। তার সাদা পাতলা গেঞ্জি থেকে এখনো চুইয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পরছে। শ্রাবণ দুই হাতে মুখ ঢেকে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিচে বসে পরলো। তার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। শ্রাবণ নিজেকে অপরাধী ভাবছে। ও মারিয়ার সাথে থেকেও কি করে এরকম ঘটনা ঘটলো। তার জন্য সে নিজেকে বড় অপরাধী ধরে নিয়েছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে বেশ কিছু সময় রইলো। কান্না করতে না পারায় তার চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। কিছু সময় পর ডাক্তার, মহিউদ্দিন সাহেব বের হয়ে এলেন। আলেয়া বেগম মেয়ের শিউরে বসে ঠোঁট চেপে কাঁদছে। ডাক্তার বের হতেই শ্রাবণ উঠে দাড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
— মারিয়া কেমন আছে ডক্টর?
ডাক্তার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— চিন্তার কিছু নেই। সি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার।সাথে সাথে পানি ঢালায় ততটা ক্ষতি হয়নি। এখন ফুল রেস্ট, ঔষধ খেলে তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানান এসিড মুখে মারতে পারেনি। গলার দিকটা কিছুটা ঝলসে গেছে। নিয়মিত ঔষধ খেলে সেই ঘা সেরে উঠবে। তারপর ঝলসানো স্থানে ডাক্তারের পরামর্শে ঔষধ লাগালে দাগও কমে যাবে। তবে পুরোপুরি চলে যাবে কিনা তা বলতে পারছি না। সঠিক সময়ে আপনি তাকে হসপিটালে নিয়ে না আসলে সত্যি বড় ধরণের দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো। আপনি চাইলে পেশেন্টের সাথে দেখা করতে পারেন।
শ্রাবণ কিছুটা শান্ত হলো। মারিয়া ঠিক আছে এটাই তার কাছে বেশি। খুশিমনে বললো,
— জ্বি নিশ্চয়ই।
কথাটা বলে দেরী করলো না। দ্রুতপায়ে কেবিনে ঢুকে পরলো।মহিউদ্দিন সাহেব এতখন ধরে শ্রাবণকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছিলেন। তার যা বোঝার সে বুঝে ফেলছেন।ডাক্তারের মুখে সবই শুনেছেন। কিন্তু এখন সে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে চাইছে না। মেয়ে সুস্থ হওয়ার পর সব দেখবেন। তাই ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন।
☔☔☔
সিগারেটে বিশাল বড় করে একটা টান মেরে ধোঁয়া গুলো সামনের দিকে ছেড়ে দিলো হিমেল। মনটা তার বড্ড খুশি খুশি লাগছে। মারিয়ার মুখে এসিড মারার পর থেকে ভেতরে ভেতরে একটা পৈশাচিক আনন্দ খুজে পাচ্ছে। তখন পেছন থেকে মারিয়ার মুখে এসিড সেই মেরেছিলো। তারপর সেই বাইক নিয়ে ঢাকার এক ফুপুর বাসায় এসে গা ঢাকা দিয়েছে। হো হো করে হাসতে হাসতে তার সাথে থাকা বন্ধু জীবনকে বললো,
— শালী, বেশি বেড়ে গেছিলো। তাই কমিয়ে দিলাম। আমিও দেখবো ও এখন এই এসিডদগ্ধ মুখ নিয়ে বড় বড় ডায়লগ কি করে বলে। কতবড় সাহস! আমার সাথে পাঙ্গা নেয়। এবার বোঝ ঠেলা।
জীবন কিছুটা কুচোমুচো করে বললো,
— দোস্ত, এসব ঝামেলায় আমায় কেন ফাঁসালি বলতো? আমি তো শুধু বাইক চালিয়েছি। আর কিছু করিনি। কিন্তু ধরা পরলে তো কেউ এটা বিশ্বাস করবে না। বরং ডান্ডা মেরে হাজতে পুরবে।
হিমেল ওর দিকে তাকিয়ে আবারো হো হো করে হেসে বললো,
— ধূর, ছেমড়া এতো ভয় পাস কেন? কোন টেনশন করিস না। আমার মেম্বার বাপ আর ইলেকশনে দাঁড়ানো এমপি চাচা আছে তো। তাছাড়া থানার ওসি আমাদের দলের। ঐ মারিয়া আর মারিয়ার বাপ আমাদের কিছু করতে পারবো না।
— তবুও আমার ভয় করতাছে হিমেল।
— আরে চুপ কর তো। কিচ্ছু হইবো না। সব আমার বাপ হ্যান্ডেল কইরা নিবো। হারামজাদি, আমার বিয়া ভাঙছিলো। এখন ওরে বিয়া করবো কে তাও আমি দেখমু। বিয়াটা না ভাঙলে আমার সাথে সুখে-শান্তিতে ঘর করতো। তাতো ভালো লাগলো না।
হিমেল বেহুদা কারণেই হাসছে। কিন্তু সে জানে না মারিয়ার মুখের মধ্যে এসিড পরেনি। বরং তার গলায় পরেছে। জানতে পারলে হয়তো এতো খুশি থাকতো না। হিমেল হাসি থামিয়ে জীবনকে বললো,
— যা তো জীবন একটু মালপানি নিয়া আয়। অনেকদিন ধইরা কিছু খাওয়া হয় না। আজকের খুশিতে একটু না খাইলে চলেও না। ইচ্ছে মতো খাইয়া টাল হইয়া পইরা থাকমু।
মালপানি বলতে যে হিমেল কিসের কথা বলছে তা বুঝতে পেরে জীবন খুশি হয়ে গেলো। চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে উঠলো। হিমেল পাশ ঘেঁষে বসে বললো,
— আমারে খাওয়াবিনা?
— আরে শালা আমি কি একা একা খামু নাকি? একা খাওয়ায় কোন মজা নাই। দুজনেই একসাথে খামু। যা কথা না বইলা জলদী নিয়া আয়।
জীবনের মুখটা খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠলো। কতদিন পর সে ছাইপাঁশ গিলতে পারবে সে খুশিতে। খুশিতে অনেকটা বাকবাকুম অবস্থা। দেরী না করে সে ছুটলো ছাইপাঁশ আনতে।
☔☔☔
উত্তরের ঠান্ডা বাতাস বইছে। আকাশে পাঁজা কালো মেঘের আনাগোনা। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব মনে হচ্ছে। পুরনো বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিবু। একটা টিউশনি শেষ করে এখান দিয়ে ফিরছিলো। কি মনে করে এখানে দাঁড়ালো তা সে জানে না। ত্রিবুর মন কিছুতেই সায় দেয় না যে সে একজন অশরীরির সাথে কথা বলেছে। মনে হচ্ছে কোথাও তো একটা মিস্টেক রয়ে গেছে।পাশে থাকা বেঞ্চে বসে মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। জীবনটা এক দমকা হাওয়ার মতো।হুট করে এসে কোথা থেকে কোথায় চলে যায় তা কেউ বলতে পারে না। আজও নিঃশব্দে ত্রিবুর পাশে এসে দাঁড়ালো জামাল মিয়া। ত্রিবুকে এই অবেলায় এখানে দেখে সে কিছুটা বিস্মিত। ধীর পায়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি হয়েছে ত্রিবু?
ত্রিবু মাথা উঠিয়ে জামাল চাচার দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দিয়ে বললো,
— কিছু না চাচা।
— কিছু তো একটা হইছে তোমার। নয়তো এই অবেলায় তুমি পুরনো বাস স্টপেজে বইসা থাকতা না।
ত্রিবু আসল বিষয় লুকিয়ে মিনমিন সুরে বললো,
— এমনি ভালো লাগছিলো না,তাই বসলাম।
— বাড়ি চইলা যাও। আকাশের অবস্থা ভালা না। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবো।
ত্রিবু ধীরে মাথা উঠিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। ফকফকা আকাশি রঙের আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে। সাথে মেঘের গুরুম গুরুম আওয়াজও কানে ভেসে আসছে। ঠান্ডা বাতাসে হালকা ঠান্ডাও লাগছে। ত্রিবু নিচুস্বরে বললো,
— চাচা, আপনি বাসায় চলে যান। মনে হচ্ছে ঝুম বৃষ্টি নামবে। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি তো একবার শুরু হলে থামার আর নামই নেয় না।
— তুমি কি করবা? বাড়ি যাইবা না?
ত্রিবু উত্তর না দিয়ে বেঞ্চের পাশে থাকা এক গুল্মলতার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে রইলো। বাতাসে সেটা দুলে দুলে উঠছে। ত্রিবুর কাছে মনে হচ্ছে বৃষ্টি আসবে শুনে গুল্মলতাটাও ভীষণ খুশি। ত্রিবুর ইচ্ছে করছে এখানে রয়ে যেতে। আজও যে হঠাৎ বৃষ্টি। যদি হঠাৎ বৃষ্টিতে সে আসে। কিন্তু কি ভেবে নিজের মনকে শক্ত করে ফেললো। মনের ভেতর একরাশ অভিমান এসে জন্মালো। সে আজ এখানে থাকবে না। চলে যাবে সে৷ ছেলেটা বেচে আছে না মারা গেছে তাতে তার কিছু আসে-যায় না। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনটা দমে গেলো। যে তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখালো তার সাথে এমন করা ঠিক হবে না। তবে এটা সত্যি আজ সে এখানে থাকবে না। যদি ছেলেটা সত্যি মৃত হয় তাহলে সে তো স্ট্রোক করবে তাই।ভূত-প্রেত সে ভীষণ ভয় পায়। মাথা উঠিয়ে জামাল চাচাকে বললো,
— বাসায় চলে যান চাচা। আমিও চলে যাই। এই বৃষ্টিতে এখানে বসে থাকার কোন মানে হয় না।
জামাল চাচার উত্তরের অপেক্ষা না করে ত্রিবু বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। জামাল মিয়া এক নজর ত্রিবুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিজের বাসার কাচা মাটির রাস্তা নেমে গেলো।বাতাসের বেগটা বেড়ে গেছে। আকাশে থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে।ত্রিবু হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, “জীবন কি অদ্ভুত! যে অপরকে বাঁচতে শিখালো সে নাকি নিজেই মৃত৷” তবে ত্রিবুর মন বলছে কোথাও কোন কিন্তু নিশ্চয়ই আছে। পৃথিবীতে ভূত বলতে যখন কিছু নেই তাহলে ছেলেটা কে? তার রহস্য কি ত্রিবু বের করতে পারবে?
~~দুই চোখে অন্যের দোষ না দেখে, এক চোখ দিয়ে নিজের দোষ অপর চোখ দিয়ে অন্যের গুণ দেখুন।
#চলবে