হঠাৎ বৃষ্টিতে পর্ব-০৮ + বোনাস পর্ব

0
1138

#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Part_08
#Writer_NOVA

— আরে আপনি!

পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের সেই ছাতা ধরা ছেলেটা। ত্রিবু বেশ অবাক। এভাবে যে তার ধারণা সঠিক হয়ে যাবে তা সে ভাবতেই পারেনি। ছেলেটা একগালে রহস্যময় হাসি দিলো। তাতে ত্রিবুর মনে হলো ছেলেটা যেনো জানতো তাদের আবার হঠাৎ বৃষ্টিতে দেখা হবে। অবশ্য সেদিন তো ছেলেটা বলেছিলোই হঠাৎ বৃষ্টিতে আবার দেখা হবে। ত্রিবুকে আরেকদফা অবাক করে ছেলেটা বলে উঠলো,

— কেমন আছেন মিস ত্রিবু?

ত্রিবু চোখ দুটো রসগোল্লা করে ছেলেটার দিকে তাকালো। সে কি করে তার নাম জানলো? আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলো,

— আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে?

ছেলেটা আবারো রহস্যময় হাসি দিলো। ত্রিবুর এখন এই হাসির কারণ খুঁজতে খুঁজতে পাগল হওয়ার জোগাড়। সে কিছুতেই কোন হিসাব মিলাতে পারছে না। সে তো সেদিন ছেলেটাকে তার নাম বলেনি। তাহলে জানলো কি করে? ত্রিবু আরো কিছু ভাবার আগে ছেলেটা বলে উঠলো,

— বললেন না কেমন আছেন?

—জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

— আপনার জ্বর কি কমছে?

না,ত্রিবুর আজ অবাক হওয়ার দিন। একটার পর একটা আশ্চর্যজনক প্রশ্ন করে যাচ্ছে ছেলেটা। যা ছেলেটার জানার কথা নয়। ছেলেটা মুচকি হেসে বললো,

— ছোট মাথাটা এতো প্রেশার দিয়েন না। অসুস্থ শরীরে আরো অসুস্থ হয়ে যাবেন।

— আপনি যেরকম প্রশ্ন করছেন তাতে তো একের পর এক না চাইতেও অবাক হতে হচ্ছে।

— এতটা অবাকের কিছু হয়নি। সেদিন বৃষ্টিতে যেই পরিমাণে ভিজেছিলেন তাতে জ্বর আসাটাই স্বাভাবিক। তাই আমি জিজ্ঞেস করেছি আপনার জ্বর কমছে কিনা।

— ওহ আচ্ছা। কিন্তু আমার নাম জানলেন কি করে?

ছেলেটা একগালে হেসে একটা চোখ মেরে দুষ্টামির সুরে বললো,

— এটা সিক্রেট। বলা যাবে না।

ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি ও চোখ মারতে দেখে ত্রিবু ফিক করে হেসে উঠলো। হালকা আবছা আলোয় ত্রিবুর হাসির ঝংকার দূরে না গেলেও ছেলেটার কানে এসে বারি খেলো। এক ধ্যানে ত্রিবুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ত্রিবু হাসতে হাসতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ইতস্ততভাবে চুপ হয়ে গেলো। ছেলেটা কিরকম মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রিবু চোখ নামিয়ে নিলেও ছেলেটা অপলক চোখে তাকিয়ে নিচু স্বর করে বললো,

— আপনার হাসিটা মা শা আল্লাহ খুব সুন্দর।

ত্রিবু চমকে তাকালো। এই প্রথম কেউ তার প্রশংসা করলো। সবার কাছে তো অবহেলার পাত্রী হয়। চোখ দুটো তার ছলছল করে উঠলো। হিমেলের সাথে সাত মাস সম্পর্কেও সে কখনো ত্রিবুর কোন কিছুর প্রশংসা করেনি। ত্রিবুকে চুপ করে থাকতে দেখে ছেলেটা বললো,

— আমি সত্যি বলছি। আপনার হাসিটা খুব সুন্দর। চেহারাটা তো ভীষণ মায়াবী। আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা মায়াবতী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ত্রিবু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। ওর হাসি দেখে ছেলেটা জোর গলায় বললো,

— আমি জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। না করাটাই স্বাভাবিক।

— পাম দিচ্ছেন?

ত্রিবু চোখে চোখ রেখে কথাটা বললো। ছেলেটা মুচকি হাসলো। ত্রিবু একটা জিনিস খেয়াল করলো ছেলেটার
কথায় কথায় হাসার অভ্যাস।আসার পর থেকে হেসেই যাচ্ছে। হাসলে তাকে খারাপ লাগে না। বরং স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পরে। যা ত্রিবুর দেখতে বেশ লাগে। ত্রিবুকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা খাকরি দিয়ে বললো,

— জানেন মিস পৃথিবীতে অনেক প্রকার স্বর্ণ আছে। আঠারো ক্যারেট, বিশ ক্যারেট, বাইশ ক্যারেট, চব্বিশ ক্যারেট ইত্যাদি। দুবাই স্বর্ণ, সৌদি আরাবিয়ান, সিঙ্গাপুরের, বাংলাদেশের আরো বিভিন্ন দেশের। এই স্বর্ণ কিন্তু সবাই চিনতে পারে না।হয়তো চিনতে পারবে এটা স্বর্ণের বস্তু। কিন্তু কোন দেশের কোন ক্যারেটের স্বর্ণ তা একমাত্র স্বর্ণকার চিনে ভালো করে।এর মধ্যে চব্বিশ ক্যারেট হলো খাটি স্বর্ণ।যার খ্যাতি সারা বিশ্বজুড়ে রয়েছে। এগুলো কিন্তু অনেক দামী।

ত্রিবু কপাল কুঁচকে ছেলেটার দিকে তাকালো। এই ছেলে স্বর্ণের পেঁচাল শুরু করছে কেন? মনের মাঝে থাকা প্রশ্নটা মুখে করেই ফেললো,

— এসব কথা আমাকে শুনাচ্ছেন কেন?

ছেলেটা আবারো একি ভঙ্গিতে হাসলো। উফ, আবারো সেই হাসি! ছেলেটা কি বুঝতে পারছে না তার হাসিটা ত্রিবুকে ঘোরে ফেলে দিচ্ছে। ত্রিবু চোখ সরিয়ে নিলো। ছেলেটা শান্ত গলায় বললো,

— আপনি হলেন সেই চব্বিশ ক্যারেটের খাঁটি স্বর্ণ। আপনাকে সবাই চিনতে পারবে না। শুধুমাত্র স্বর্ণকার ছাড়া। নিজেকে তাই মূল্যহীন ভেবেন না। অবশ্য ঐ স্বর্ণকারটা আমাকেও বলতে পারেন। আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।

ত্রিবু বিস্মিত চোখে তার দিকে আবারো তাকালো। ছেলেটা বলছেটা কি? তার তো সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সে আবার এতো দামী কবে হলো? ত্রিবু কিছু বলার আগে ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো,

— তা দিনকাল কেমন যাচ্ছে মিস ত্রিবু?

— যাচ্ছে ঠেলে ধাক্কিয়ে কোনরকম।

— এর মধ্যে ঐ ছেলেটা কি আবারো কোন ঝামেলা করেছে?

— কোন ছেলে?

— ঐ যে যার সাথে আপনার সাত মাসের সম্পর্ক ছিলো।

ছেলেটার কথা শেষ হতেই পুরনো স্মৃতি আবারো হানা দিলো চোখের পাতায়। ভেতর থেকে হেঁচকি তুলে কান্না আসতে নিলে ঠোঁট কামড়ে সংবরণ করে নিলো। হঠাৎ ছেলেটার দৃষ্টি ত্রিবুর কপালে গেলো। সেখানে ক্রশ চিহ্নের মতো দুটো ছোট ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

— আপনার কপালে কি হয়েছে?

ত্রিবু চট জলদী কপালে হাত দিয়ে আমতাআমতা করে বললো,

— তেমন কিছু নয়। দরজার সাথে লেগে ফেটে গেছে।

ত্রিবু জানে সে মিথ্যে বলছে। তাই বারবার তার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠছিলো। চোখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকাতেই দেখলো ছেলেটা সন্দেহের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কথা যে সে বিশ্বাস করেনি তা দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছে। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছেলেটা বললো,

— আমি মিথ্যেটা শুনতে চায়নি। সত্যিটা বলুন।

ত্রিবু কিছুটা চমকে উঠলেও ছেলেটাকে বুঝতে দিলো না। মিথ্যে বলে লাভ হবে না বলে বড় করে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রথম থেকে সবটা বলে দিলো। হিমেলের কথা, তার ফুপুর বলা কথা, সাথে চুলের মুঠি ধরে থাপ্পড় দিয়ে যে দরজার সাথে লেগে কপাল ফেটে গেছে তাও বাদ রাখলো না। সব শুনে ছেলেটার চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠলো। রাগে তার কপালের রগ ফুলে উঠেছে। শক্ত গলায় বললো,

— আপনি কেন নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন না? এখন নিশ্চয়ই বলবেন ওরা আপনাদের গ্রাম থেকে বের করে দিবে তাই। আসলে আপনি চুপ করে থাকেন বলেই ওরা এমন করতে সাহস পায়। আপনি যদি প্রতিবাদী হোন তাহলে সেই সাহসটা পাবে না। দূর্বলদের ওপর সবলরা সবসময় অত্যাচার করে। আপনি নিজেকে তাদের কাছে দূর্বলভাবে প্রকাশ করছেন। যাতে তারা আপনার সাথে অত্যাচার করতে পারছে, আপনার ওপর দোষ চাপিয়ে দিতে পারছে। আর কত দূর্বল থাকবেন বলুন তো? এবার প্রতিবাদী হোন। নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। আপনি প্রতিবাদ করলে কেউ আপনার ক্ষতি করতেও দুইবার ভাববে।

ত্রিবু মুগ্ধ চোখে ছেলেটার দিকে তাকালো। আচ্ছা ছেলেটার মধ্যে কি জাদু আছে? প্রতিটা কথায় ত্রিবু মনের ভেতর জোর পায়, বেঁচে থাকার ইচ্ছে খুঁজে পায়, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারে। অন্য একটা ত্রিবুর অস্তিত্ব জানান দেয়। যে প্রতিবাদী, নিজেকে মূল্যবান, নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত করা ত্রিবু। ছেলেটা কিছু সময় থেমে আবারো বললো,

— হ্যাঁ, আপনি কালো। আল্লাহ আপনাকে কালো বানিয়েছে। এতে তো আপনার দোষ নেই। আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসে বলেই এই রং দিয়েছে। এই রং নিয়ে আপনি কেন হীনমন্যতায় ভুগবেন?আপনার কি মনে হয় না হীনমন্যতায় ভুগে আপনি আল্লাহর সৃষ্টিকে অপমান করছেন? আল্লাহর সৃষ্টিকে অপমান করার কোন অধিকার আমাদের নেই। তাই দয়া করে নিজের গায়ের রং নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগা বন্ধ করুন। বরংচ এটাকে পজেটিভ দিকে দেখুন। গায়ের রং নিয়ে কেউ কোন কথা বললে আপনি তা আমলে নিবেন না। নিজেকে আপনি ছোট করে দেখেন বলেই অন্যরা আপনাকে ছোট করার প্রন্থা পায়। আপনি যদি নিজেকে বড় করে দেখেন তাহলে কারোর সাধ্যি নেই আপনাকে ছোট করার। অন্যের কথাও তখন গায়ে লাগবে না। আরেকটা কথা, নিজেকে একটা শক্তিশালী রূপে আবিষ্কার করুন। প্রতিবাদী হোন। নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। এতে আপনার প্রতিপক্ষ ভড়কে যাবে। আপনাকে কাবু করতে পারবে না। বিপদকে মোকাবিলা করতে শিখুন মিস ত্রিবু। নিজেকে এমন স্থানে প্রতিষ্ঠিত করুন যাতে অন্যরা আপনাকে আদর্শ বানাতে পারে। আপনাকে দেখে কেউ তার গায়ের কালো রং নিয়ে হীনমন্যতায় না ভুগে।আপনাকে গুণ দিয়ে বিবেচনা করে। সমাজকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিন রূপে নয় গুণে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উপরের ধাপে উঠতে হয়।

ত্রিবু নিষ্পলকে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কই এমন করে তো সে কখনো ভাবেনি। আজ ছেলেটা ওকে নতুন করে ভাবাতে শিখালো। মনে মনে ত্রিবু শক্ত একটা পণ করলো। সেটা হলো চোখে আঙুল দিয়ে সে সমাজকে দেখিয়ে দিবে রূপে নয় গুণেই সব। ছেলেটা ত্রিবুকে বললো,

— অনেক কিছু বললাম। এগুলো নিয়ে একটু ভাববেন। আমার বিশ্বাস আপনি চেষ্টা করলে অবশ্যই নিজের যোগ্যতায় উপরে উঠতে পারবেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চলুন আপনাকে পৌঁছিয়ে দেই। এই সন্ধ্যায় আপনাকে একা ছাড়া আমার ঠিক হবে না।

ত্রিবু কোন কথা বললো না। সে ছেলেটার প্রতিটা কথা ভাবছে। আসলে কথাগুলো তাকে ভাবাচ্ছে। তার ভেতরের মরিচিকা পরা বিবেকটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বৃষ্টির বেগ কমে গেছে অনেক আগে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে হালকা ঠান্ডা বাতাস। দুজনে নিঃশব্দে বাড়ির পথ ধরলো। অন্ধকার হয়ে আসছে। আবছা আলোতে পথ চলতে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। বাড়ির কিছুটা সামনে এসে সেদিনের মতো ত্রিবু ছেলেটার দিকে ছাতাটা বাড়িয়ে দিলো।ছেলেটা কোন কথা না বলে ছাতাটা নিয়ে বললো,

— আসছি।

ত্রিবুকে কিছু বলতে দিলো না। সে চায় ত্রিবু তার কথাগুলো ভাবুক। ভেবে সিদ্ধান্ত নিক। যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাকে হেনেস্তা না করতে পারে। সে একাই নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে। ত্রিবু ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে চলে এলো। যখন ধ্যান ভাঙলো তার মনে হলো ভেতরের সত্ত্বাটাকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলেটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তখুনি সে চট জলদী পিছু ঘুরলো। আজও তাকে অবাক হতে হলো। কারণ আজও পিছনে কেউ নেই। এতো দ্রুত সে গেলো কি করে?

~~~মানুষ মাত্রই ভুল। তাই কারোর ভুল নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ না করে তার ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করুন।

#চলবে

#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Dhamaka_Part
#Writer_NOVA

— এই মারিয়া দাঁড়া।

পেছন থেকে কারো ডাক পেতেই দ্রুত পেছনে ঘুরলো মারিয়া। তার বেস্টফ্রেন্ড মুনকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। কতদিন পর দেখা। মুন দৌড়ে এসে মারিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পরলো। মারিয়াকে ছেড়ে অভিমানী ভঙ্গিতে বললো,

— তোর খবর কি বল তো?

মারিয়া দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,
— আর খবর!

— কেন কি হয়েছে?

দুজন কলেজের ভেতরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

— তোকে তো গতকাল কলে সব বললাম। আম্মু-আব্বু অনেক টেনশনে আছে। আম্মু তো আমাকে মামাবাড়ি পাঠানোর জন্য রিতীমত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।

— দেখ মারিয়া আমি একটা কথা বলি। কিছু মনে করিস না।

— এতো ভনিতা না করে বলে ফেল।

— তুই বরং আঙ্কেল-আন্টির কথা শুনে মাস খানিক ঢাকায় থেকে আয়। এতে তোর মঙ্গল।

মারিয়া হাঁটা থামিয়ে কপট রাগী গলায় বললো,
— তুইও শুরু করলি।

— রাগ করিস না। আমি আমার অপনিয়ন দিলাম।

— প্লিজ মুন থাম তুই। দয়া করে ফালতু বকবকানি থামা। আমার এসব আর ভালো লাগছে না। আমি মোটেও ভীতু নই। আমিও দেখতে চাই হিমেল কি করতে পারে। আমাকে চিনে না। ও যদি সেড় হয় আমিও সোয়া সেড়।

— জেদ করিস না। এতে হীতের বিপরীত হতে পারে। হিমেল কেমন ছেলে তা নিশ্চয়ই তোকে বলতে হবে না। যে ছেলে দিনে দুপুরে তোর বাবা-মায়ের সামনে তোর গলা টিপে ধরতে পারে সে খুনও করতে পারবে। তোকে এখন হেয়ালি করলে চলবে না। সাবধানে থাকতে হবে। সাবধানের মাইর নেই। ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ায় ও আরো বেশি রেগে আছে। রাগের বর্শবর্তী হয়ে যেকোনো কিছু করতে দ্বিধা করবে না।

— অনেক বলেছিস। এবার দ্রুত ক্লাশে চল।

— তুই বিষয়টাকে তুচ্ছ করে দেখে হেয়ালি করছিস মারিয়া। বিপদ কিন্তু বলে কয়ে আসে না। আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে তোর জন্য।

— কিন্তু আমার করছে না। ভবিষ্যতে কি হবে তার জন্য চিন্তা করে বর্তমান নষ্ট করার কোন মানে হয় না। অনেক কথা হয়েছে। এবার জলদী পা চালা।ক্লাশ করতে যেতে হবে।

— যা ভালো বুঝিস কর। তবে সাবধানে থাকিস।

— যথাআজ্ঞা মহারাণী।

দুই বান্ধবী আরো টুকটাক কথা বলতে বলতে ক্লাশের দিকে ছুটলো। আসলে সত্যিই মারিয়া বিষয়টাকে আমলে নিচ্ছে না। এতে তার বিপদ হবে না তো?

☔☔☔

অন্যদিকে……

হিমেল দুই দিন ধরে নিজেকে রুম বন্দী করে রেখেছে। প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি একটা বের হয় না। ছেলের হঠাৎ এরকম আচারণে তার বাবা-মা দুজনেই অবাক। প্রতিদিনের মতো আজও তার মা রুমকি বেগম দরজায় খাবার নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। তবু তার ছেলে রুম থেকে বেরিয়ে খাবার খেতে আসেনি।এক নাগাড়ে দরজায় করাঘাত করে সে হিমেলকে ডাকছে।

— হিমেল, এই হিমেল। সোনা বাবা আমার। দরজাটা খোল। আর কত নিজেকে এরকম ঘরবন্দী করে রাখবি। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।

হিমেলের কপাল কুঁচকে এলো বিরক্তিতে। সবেমাত্র একটা সিগারেট ধরিয়ে দুটো টান মেরেছে। এর মধ্যে এতো ডাকাডাকি তার সহ্য হচ্ছে না। বিরক্তিতে চেচিয়ে বললো,

— ডাকাডাকি করো না তো। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। কোন ডিস্টার্ব করবা না।

— সেকি কথা বাবা! খাবার খাবি না। খাবার না খেলে তো অসুস্থ হয়ে যাবি।

— উফ মা তুমি কি যাবা এখান থেকে। অসহ্যকর! কানের সামনে প্যান প্যান করতেই থাকে।

— আমি কিছু বললেই প্যান প্যান হয়ে যায়। যা আর কিচ্ছু বলবো না আমি। তোর যা খুশি তাই কর। আমার কথা তো শুনবি না। আসুক তোর বাপ আজ। তার কাছে সব বলবো আমি।

হিমেল কপাল ডলে নিজের রাগটা একটু দমন করে নিলো। তারপর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,

— তুমি কি দরজার সামনে থেকে সরবা? বেশি ডিস্টার্ব করলে বাড়ি থেকে কিন্তু বের হয়ে যাবো।

ছেলের বিরক্তি কন্ঠের হুমকি শুনে রুমকি বেগম কিছুটা দমে গেলো। ছেলেটার যা রাগ তাতে বাসা থেকে বের হয়েও যেতে পারে। তাই তিনি আর ডাকলেন না। ছোটবেলা থেকে শাসনের অভাবে ছেলেটা চরম বেয়াদব হয়ে গেছে। সবাই মাথায় তুলে নেচেছে। আদরের ছেলেকে শাসন করেনি। আর সবসময় বলেছে ছোট মানুষ এখুনি তো এমনটা করবে। যার দরুন আজ এই অবস্থা।

একটা বাচ্চার মানুষের মতো মানুষ হওয়ার শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। যদি পরিবার তাকে শিক্ষা দিতে না পারে তাহলে সে কি করে ভালো মানুষ হবে?বাচ্চাকে আদরের সময় আদর, শাসনের সময় শাসন করতে হয়। কোন কাজ অতিরিক্ত ভালো নয়। অতিরিক্ত আদরে যেমন সন্তান বিগড়ে যায়, তোমনি অতিরিক্ত শাসনেও সন্তান বিপথে চলে যায়। বাচ্চাকে ছোট থেকেই ঠিক ভুলের পার্থক্য শিখাতে হয়। উপযুক্ত মানুষ গড়ার হাতেখড়ি পরিবার থেকে দিতে হয়। ছোট বাচ্চারা সাদা কাগজের মতো হয়। তাদেরকে যেভাবে আঁকবেন সেভাবেই গড়ে উঠবে। এখন আপনার সন্তানকে আপনি ভালো পথে পরিচালনা করবেন নাকি খারাপ পথে তা আপনার ওপর নির্ভর করে।

☔☔☔

গত কয়েকদিন ধরে ত্রিবু পুরনো বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকে। যদি ছেলেটার দেখা পায়। যদিও ছেলেটাকে তার বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে। তবুও তাকে এক নজর দেখার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তাছাড়া ছেলেটাকে তো একটা ধন্যবাদ দিতেই হবে। তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখার আশা যে সে যুগিয়েছে। বাসে করেই কলেজ যায় সে। একটু আগেও একটা বাস চলে গেলো। কিন্তু ত্রিবু উঠলো না। হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে চমকে পেছনে ঘুরলো ত্রিবু। তাকিয়ে দেখে টিকিট কাউন্টারের জামাল চাচা। তিনি বিস্মিত ভঙ্গিতে বললো,

— তুমি প্রতিদিন কার অপেক্ষা করো ত্রিবু? আমি বেশ কয়েকদিন ধইরা খেয়াল করছি তুমি এখানে দাঁড়াইয়া কারো প্রতিক্ষায় প্রহর গুনো।

ত্রিবু মলিন হেসে বললো,
— একজন উত্তম ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের অপেক্ষা করি চাচা। সে আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। সব বাঁধা পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর রাস্তা দেখিয়েছে। তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার উদ্দেশ্য এখানে দাঁড়িয়ে থাকি। যদি এক পলক তার সাথে দেখা হয় তাহলে তাকে ধন্যবাদ জানাবো।

জামাল চাচা ত্রিবুর কোন কথা বুঝলো না। নিরস চোখে তাকিয়ে রইলো।তা বুঝতে পেরে ত্রিবু মুচকি হেসে তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। কুশলাদি জিজ্ঞেস করা শেষ হতেই সে বললো,

— চাচা, একটু পানি হবে? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।

— টিকিট কাউন্টারে লও(চলো)।

ত্রিবু, জামাল চাচার সাথে কাউন্টারে গেলো। ত্রিবুকে একটা টুলে বসতে দিয়ে জামাল মিয়া পানি আনতে গেলেন। ছোট একটা কাউন্টার। জানলার পাশে একটা পুরনো রংচটা টেবিল পাতা।সাথে বিবর্ণ চেয়ার।টেবিলের কোণার দিকে অনেকগুলো পত্রিকা জমে আছে। পাশে এক পাতা টিকিট। জামাল মিয়ার অবসর কাটে পত্রিকা পড়ে। কিছু সময় পর জামাল চাচা পানি নিয়ে এলেন। পানি এনে ত্রিবুর হাতে দিতেই ত্রিবু ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে জামাল চাচার হাতে দিয়ে বললো,

— ধন্যবাদ চাচা। আজ উঠি।

— নিশ্চয়ই।

ত্রিবু কিছুটা তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে টেবিলের পায়ার সাথে বারি খেলো। দুই হাতে টেবিলের কোণাটা আঁকড়ে ধরতে গেলে পত্রিকাগুলো সব নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে গেলো। জামাল চাচা দ্রুত এসে ত্রিবুকে উঠিয়ে কিছুটা শাসনের সুরে বললো,

— দেইখা চলবা না। পাইলা তো ব্যাথা।

— না চাচা ঠিক আছে।

ত্রিবু বেশি একটা ব্যাথা পায়নি। শুধু ডান পায়ের বুড়ো আঙুল কিছুটা জ্বালা করছে। দ্রুত বসে পত্রিকাগুলো উঠাতে উঠাতে বললো,

— সবগুলো এলোমেলো করে দিলাম চাচা। আমি সত্যি দুঃখীত।

— আরে ধূর মাইয়া। তুমি যে ব্যাথা পাও নাই তাই অনেক বেশি।

ত্রিবু মুগ্ধ নয়নে জামাল মিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো।তারপর পত্রিকাগুলো ভাজ করতে লাগলো। কিছু পত্রিকা মেলে পরে আছে।সেগুলো ভাজ করতে গিয়ে হঠাৎ একটা পত্রিকার কোণার দিকে চোখ যায়।দুই সপ্তাহ আগের পত্রিকা। সেখানে হাস্যউজ্জ্বল একটা ছেলের ছোট ছবি দিয়ে কিছু একটা লিখা।কিন্তু নিচের হেডলাইনের থেকে কোণার দিকটা তেছড়াভাবে ছেঁড়া। যার দরুন কি লেখা আছে তা পড়া সম্ভব নয়। ত্রিবু ভ্রু কুঁচকে ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকাতেই আৎকে উঠলো। আরে এটাই তো সেই মাথায় ছাতা ধরা ছেলেটা। যার কাছে সে ঋণী। ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য হন্যি হয়ে খুঁজছে। কিন্তু তার ছবি পেপারে ছাপিয়েছে কেন? ছবির নিচে থাকা লেখাটা না পড়তে পেরে ত্রিবু কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে জামাল চাচাকে বললো,

— চাচা, এই ছেলেটা….

পুরো কথা শেষ হওয়ার আগে জামাল চাচা চশমা মুছে পুনরায় চোখে দিয়ে বললো,

— কোন ছেলেটা?

— এই যে সাদা শার্ট পরিহিত ছেলেটা। ওর ছবি নিউজ পেপারে ছাপিয়েছে কেন?

— তুমি পড়ে দেখো।

— কিভাবে পড়বো? হেডলাইন থেকে তো নিচের অংশটা ছেঁড়া।

— দেখিতো কোন ছেলে?

— এই যে নিন।

জামাল মিয়া পত্রিকাটা হাতে নিয়ে দরজার সামনে এসে আলোতে মেলে ধরলেন।তিনি পত্রিকা পড়ার সময় ছোট থেকে ছোট বিষয়ও মনোযোগ সহকারে খুঁটেনাটে পড়েন। ছোটবেলায় সবসময় স্মৃতিশক্তির খেলায় ফার্স্ট হতেন। যার ফলে মধ্য বয়সে এসেও তার স্মৃতিশক্তি ভালো আছে। ছোটখাটো বিষয়ও স্পষ্ট মনে রাখতে পারেন। ছেলেটাকে ভালো করে দেখে বললো,

— ওহ এই ছেলের কথা বলছো।

ত্রিবু দ্রুত পায়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। তার বুকের ভেতরটা অজানা আশংকায় ঢিপঢিপ করছে। চাচার পাশে দাড়িয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,

— হ্যাঁ চাচা এই ছেলেই।

— এটা তো আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে। তুমি ওর ঘটনা জানো না?

ত্রিবু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
— কি ঘটনা চাচা?

— এই ছেলে তো গত প্রায় দেড় সপ্তাহ আগে বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেছে।

~~~যে আপনাকে খুব সহজে পেয়ে যাবে, সে কখনো আপনার মূল্য বুঝবে না 💔।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে