হঠাৎ বৃষ্টিতে পর্ব-০৭

0
1157

#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Part_07
#Writer_NOVA

— ঐ রবিন ক্যাচ ধর।উফ, শিট! যাঃ বেডা কি করলি এটা! সিম্পল ক্যাচটা মিস করে দিলি।এবার পাক্কা আউট হয়ে যেতো। তোদের হইছে কি আজ? একটা ক্যাচও ধরতে পারিস না!

আদনানের মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।ক্যাচটা মিস হওয়ায় সে রবিনের ওপর ঢেঢ় বিরক্ত। আজ ক্রিকেট খেলার মুডই নষ্ট করে দিচ্ছে ওরা। না ফিল্ডিং ভালো করছে না ব্যাটিং,বোলিং-এর কথা না হয় বাদই দিলাম।সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। রবিন মুখ কুচোমুচো করে বললো,

— সরি রে আদনান।

আদনান চেচিয়ে বললো,
— তোর সরির গুষ্টি কিলাই। একটাও ভালো মতো খেলতেছিস না। এই প্রিপারেসন নিয়া তোরা ম্যাচ জিতবি?আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি শূন্য রানে সব আউট হয়ে বসে থাকবি। মেজাজটাই খারাপ করে দিতেছিস। ঐ সজল তুই কি বল করাও ভুলে গেছিস। এক ওভারে চারটাই চাকা বল করলি। আর আকরাইম্মারে উইকেট কিপার কে দিছেরে? ও তো চুলের জ্বালায় চোখে দেখে না। বল ধরবো কি? উইকেট কিপারের ধ্যান থাকতে হয় সামনের দিকে। আর ওর ধ্যান থাকে চুলের দিকে। একটু পর পর চুল ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

সিদ্দিক এগিয়ে এসে আদনানকে কিছুটা থামানোর চেষ্টা করলো। ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

— আদনান শান্ত হো। চেচামেচি করলে তো কিছু হইবো না। ঠান্ডা মাথায় সব হ্যান্ডেল করতে হইবো।

— কি শান্ত হমু বল তো। গত দুই ঘন্টা ধরে ওরা যা খেলতাছে তাতে যে আমি মাঠ ছাইরা এখনো যাই নাই তা অনেক বেশি। মেজাজ গরম হয়ে গেছে আমার। আর তুই বলিস ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে। ম্যাচের আর মাত্র চারদিন আছে। এখন যদি এই অবস্থা হয় তাহলে কি হবে ভেবে দেখছিস?আমার ওপর দিয়ে কি ঝড় যাইতাছে তাতো তোরা জানিস। আমাদের পরিবার কি অবস্থায় দিন পার করছে তাও তোদের অজানা নয়৷ আম্মু অসুস্থ, আব্বু ডায়বেটিসের রোগী।তার মধ্যে আমাকে আব্বুর স্টেশোনারি দোকানে বসতে হচ্ছে।তাদেরকে সামলাতে হচ্ছে।নিজেকে শক্ত করতে হচ্ছে। মন-মানসিকতা আমার অনেক খারাপ। তবুও তোদের অনুরোধে আমি খেলতে রাজী হইছি। এখন যদি তোরা এই অবস্থা করিস তাহলে আমি যাবো কোথায়? ফিল্ডিংটা ভালো মতো করতেছিস না এট লাস্ট ব্যাটিংতো ভালো মতো করবি।সবকিছুর বাজে একটা অবস্থা। কিন্তু ওদের তাতে কোন মাথাব্যথা নেই। সব মাথাব্যাথা একা আমার।আমার তো মনে হচ্ছে ওদের থেকে হাইস্কুলের পোলাপান-গুলাও ভালো খেলে।

সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান কোমড়ে দুই হাত রেখে রাগে ফুঁসছে। চারদিন পর পাশের গ্রাম সূবর্ণপুরের ছেলেদের সাথে তাদের গ্রামের ছেলেদের একটা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছে। এর জন্য গত এক সপ্তাহ ধরে অনুশীলন করছে। কিন্তু পারফরম্যান্স ভালো নয়। এতে ভীষণ রুষ্ট আদনান। সবার থেকে খেলায় ভালো বলে তাকেই ক্যাপ্টেন বানানো হয়েছে। পাশাপাশি কোচের দায়িত্বটাও সে পালন করছে। ওকে সবাই কম-বেশি মানে।তাই ওর কথার ওপর কারো কথা বলার সাহস নেই। আকরাম ধীর কন্ঠে বললো,

— ভাই চুলগুলা অনেক জ্বালাইতেছিলো। তাই বারবার তা ঠিক করছিলাম।

আদনান ক্রুর দৃষ্টিতে আকরামের দিকে তাকাতেই আকরাম চোখ নামিয়ে নিলো। আদনান নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বললো,

— কালকের মধ্যে তোর এই বাবরি চুল কাটা দেখতে চাই। চুলে আর্মি কাট দিবি। নয়তো তুই খেলার থেকে বাদ। সজল, তোকে বোলিং আরো ভালো করতে হবে। সবগুলা চাকা বল করা যাবে না।

সজল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। আদনানের রাগটা একটু পরেছে। তাই দুই হাত মুঠ করে বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,

— যে যেখানে ছিলি সেখানে দাঁড়িয়ে যা। ওভার শেষ। এবার বল কে করবি?

সিদ্দিক হাত উঠিয়ে বললো,
— এই ওভারে আমি বল করি।

আদনান ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
— আচ্ছা যা। তবে রান বেশি দিস না।

— ওকে, নো টেনশন। আমি রান বেশি দিবো না।

আদনান সবাইকে থামিয়ে বললো,
— এক মিনিট! সবসময় মাথায় রাখবি বিপরীত টিমের সাথে খেলছিস। তাই ওদের সাথে খেললে যেরকম পারফরম্যান্স করতি সেরকম করবি। যাতে করে ঐখানে গিয়ে কোন সমস্যা না হয়।

সবাই একসাথে সমস্বরে চেচিয়ে বললো,
— ওকে ক্যাপ্টেন।

আদনান কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— হইছে যা। এবার ভালো মতো খেলিস। যদি এখনো আগের মতো হেলায় ফেলায় পারফর্ম খারাপ করিস তাহলে আমি সোজা বাসায় চলে যাবো। খেলার মাঠে আমাকে আর পাবি না।

☔☔☔

— তোমাদের বাপবেটির হইছে কি আমাকে একটু বলবা? কোন ভীমরতিতে ধরছে? আমার কোন কথা কানেই নিতাছো না। একটা অঘটন ঘটে গেলে তখন ভালো লাগবে মনে হয়। এর আগে তো আমার কথা শুনবা না। মেম্বার সাব যে কালকে এসে হুমকি-ধমকি দিয়ে গেলো তাতেও কি তোমাদের একটু ভয়ডর কিছু করে না? ঐ হিমেল তো অনয়াসে ছাড়া পেয়ে গেছে। এখন পদে পদে সুযোগ খুঁজবো আমাদের মারিয়ার ক্ষতি করতে। তাই আমি বলে কি ওকে ঢাকায় আমার ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেই। এখনকার অবস্থা স্বাভাবিক হলে তারপর ফিরিয়ে আনবোনি।

আলেয়া বেগম এক নাগাড়ে তার স্বামী মহিউদ্দিন ও মেয়ে মারিয়াকে কথাগুলো বললো। কিন্তু তার কথায় তার স্বামী,সন্তানের কোন ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। মারিয়া ও তার বাবা এক ধ্যানে সোফায় বসে টিভিতে একটা চাইনিজ মুভি দেখছে। আলেয়া বেগম রেগে টিভিটা বন্ধ করে সামনে এসে দাড়াঁলেন। তাতে বাপ, মেয়ে দুজনেই বিরক্তি নিয়ে আলেয়া বেগমের দিকে তাকালেন। মহিউদ্দিন সাহেব কপাল কুঁচকে বললো,

— আহ, আলেয়া রাত-বিরেতে কি শুরু করলে? মুভিটা একটু দেখতে দাও।

মারিয়াও তার বাবার সাথে যোগ দিয়ে বললো,
— আম্মু কি শুরু করলা! সরো সামনের থেকে।

আলেয়া বেগম রাগী গলায় বললো,
— আমার কথা কি তোমরা একটাও শুনছো? কতগুলা কথা বললাম আমি। একটা কথাও আমলে নিলা না। সেদিন দিনে-দুপুরে মারিয়াকে আমাদের সামনে গলা টিপে ধরেছে হিমেল। ওকে একা পেলে যে মেরে ফেলবে না তার গ্যারান্টি কি? হিমেলের বাবা আমাদের বাসায় এসে হুমকি দিয়ে যায় আমাদের দেখে নিবে। তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না আমাদের। তাই ভালোয় ভালোয় বলছি মারিয়াকে এখান থেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দাও। এখানকার পরিস্থিতি ভালো না। যেকোনো সময়ে মারিয়ার ওপর আক্রমণ হতে পারে। মারিয়ার আব্বু তুমি একটু আমার কথা শুনো।

আলেয়া বেগমের কথা শুনে মহিউদ্দিন সাহেব তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে মারিয়ার মায়ের ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। গতকাল সন্ধ্যার একটু পরে খালেক ব্যাপারি এসে নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে গেছে। মানহানির মামলাও নাকি করবে বলেছে। তারপর থেকে আলেয়া বেগমের মনে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সারাদিন ভয়ার্ত গলায় সম্ভব্য বিপদের কথাবার্তা বলে গেছে। মহিউদ্দিন সাহেব ততটা গুরত্ব না দিলেও তার মনে যে মেয়েকে নিয়ে ভয় নেই তা কিন্তু নয়। সে শুধু ভয়টা প্রকাশ করছে না। হলুদের দিন থেকে যে ঝামেলা শুরু হয়েছে তা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু মারিয়া এসবের ধার ধারে না। সে প্রচুর সাহসী মেয়ে। তার একটাই কথা এখান থেকে সে যাবে না। এই ঘটনার শেষ দেখেই ছাড়বে। সে যদি এখান থেকে চলে যায় তাহলে নিজের কাছে নিজে ভীতু নামক উপাধি পাবে। সে এখানে থেকে বাবার সহোযোগিতায় সব ঠিক করবে। হিমেল উল্টোপাল্টা কিছু করার আগেই এক্যাশন নিয়ে ফেলবে।

আলেয়া বেগম আবারো চেচিয়ে বললো,
— কি হলো কিছু বলছো না কেনো? একটা অঘটন ঘটলে কি তোমাদের টনক নড়বে?

মারিয়া এগিয়ে এসে তার মা কে সোফায় বসিয়ে দিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসলো।তারপর মায়ের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

— তুমি খামোখা টেনশন করছো আম্মু। তুমি যেমনটা ভাবছো সেরকম কিছুই হবে না। আর আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না। আমি যদি পালিয়ে যাই তাহলে ওরা ভাববে আমি ভীতু। কিন্তু তোমার মেয়ে তো ভীতু নয়। সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে জানে। তুমি আর বাবাই তো আমাকে শিখিয়েছো বিপদে ভয় না পেয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে তা মোকাবিলা করতে। তাহলে এখন মোকাবিলা না করে অন্য কোথাও যাবো কেন আমি? সব কুকুর কিন্তু কামড় দেয় না আম্মু। কিছু কুকুরের কাজই দূর থেকে ঘেউ ঘেউ করা। ঐ মেম্বার ও তার ছেলেও সে ঘেউঘেউ করা কুকুর। মুখে চটাস চটাস বলতেই পারবে। কিন্তু কাজের বেলায় ঠনঠনাঠন ঘন্টা।

আলেয়া বেগম রেগে তার হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মুখ ঝামটা মেরে বললো,

— তোদের বাপবেটির যা মন চায় তা কর। আমি আর কিচ্ছু বলবো না। কিন্তু কোন অঘটন ঘটলে দুজনের একজনকেও আমি ছেড়ে কথা বলবো না। কথাটা দুজনেই ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে রাখিস।

দ্রুত পায়ে রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন আলেয়া বেগম। দরজার শব্দে কিছুটা কেঁপে উঠলেন মহিউদ্দিন সাহেব। তিনি এখন গভীর চিন্তায় ডুব দিবেন। মেয়ের চিন্তা তার মাথায়ও ঘুরঘুর করছে। আর মারিয়া তার মায়ের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে উঠে গিয়ে টিভি ছেড়ে মুভি দেখায় মন দিলো। ভবিষ্যত নিয়ে সে কখনো চিন্তা করে না। তার ভাষ্যমতে ভবিষ্যতে তাই হবে মহান আল্লাহ তায়ালা যা ভেবে রাখবেন।

☔☔☔

দেখতে দেখতে কেটে গেলো দুই দিন। ত্রিবু নিজেকে এক প্রকার গুটিয়ে নিয়েছে। কলেজ থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে টিউশনি। এই অব্দি চালান। জ্বরটাও তার আগের থেকে অনেকটা ভালো। তাই কলেজে যাওয়া ও টিউশনি শুরু করে দিয়েছে। সাথে সেই ছাতার মালিককে খুজে বের করার দায়িত্ব তো আছেই। দুই দিন বিকেলে ছাতা দাতার খোঁজে বেড়িয়েছিলো। কিন্তু তার কোন হদিস পাইনি। কলেজ শেষ করে আজও পরিত্যক্ত বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে। যদি তার সন্ধান মিলে। লাল টুকটুকে ছাতাটার দিকে তাকালে ত্রিবু কিরকম জানি একটা ঘোরে চলে যায়। বড্ড বেশি আকর্ষণ করে।হঠাৎ গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ ভেসে আসছে। বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস। ত্রিবুর কানে একবার সেই শব্দ পৌঁছাতেই তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়েও বসে পরলো। তার মন বলছে ছেলেটা আজ আসবে। আজও যে হঠাৎ বৃষ্টি! একটু আগেও আকাশটা পরিষ্কার ছিলো। আর এখন কালো মেঘের মেলা। ত্রিবুর ধারণা সঠিক করে দিয়ে টিপ টিপ করে বৃষ্টি আরম্ভ হলো। ত্রিবু আনমনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আষাঢ় কবিতার দুই লাইন উচ্চারণ করলো।

— “নীল নবঘনে আষাঢ় গগণে তিল ঠাঁই আর নাহিরে,
ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।”

গাছের পাতায় বৃষ্টি পরে মৃদু শব্দের ঝংকার দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ কোন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। ত্রিবু ছাতা হাতে নিয়ে বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিলো। রাস্তায় কোন মানুষ নেই। মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়ি শো গতিতে তাকে ক্রস করে চলে যাচ্ছে।টিপ টিপ বৃষ্টি বেড়ে গিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হলো। বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাওয়ায় ত্রিবু দৌড়ে রাস্তার পাশের নতুন টিকিট কাউন্টারে সামনে আশ্রয় নিলো।চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। বৃষ্টির কারণে কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তখুনি একটা ছেলে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ত্রিবুর পাশে এসে দাঁড়ালো। অস্পষ্ট আলোতে ত্রিবু চমকে বলে উঠলো,

— আরে আপনি!

~~~ কারো উপকার করতে না পারলেও কখনো কারো অপকার করেন না🥰।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে