হঠাৎ বৃষ্টিতে পর্ব-০৬

0
1136

#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Part_06
#Writer_NOVA

— কার এতবড় সাহস? আমার পোলারে জেলের ভেতর ঢুকাইছে?কলিজা টান দিয়া বাইর কইরা ফালামু।গত এক রাত, এক দিন ধরে আমার পোলা জেলে।আর আজকে আমি জানি।কই থানার ওসি কই?

খালেক ব্যাপারি হুংকার দিতে দিতে থানার ভেতরে প্রবেশ করলেন। হিমেল গত এক দিন,এক রাত ধরে জেলের ভেতরে আছে এটা শুনে তার মাথা গরম হয়ে গেছে। তখন তার এক লোক কল করে জানিয়েছিলো হিমেল জেলে।ব্যাস সেটা শুনে ছুটে থানায় চলে এসেছে। চেয়ারম্যান আবুল হোসেন সাহেব বিরক্তিমাখা মুখে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ধেক রাস্তাও যেতে পারেনি। খালেক ব্যাপারির কল পেয়ে থানায় ছুটে এসেছে। সে এক কনস্টেবলকে বললো,

— আপনাদের ওসি কোথায়?

উত্তর দিকে কর্ণারের চেয়ার-টেবিলে বসে এক কনস্টেবল খাতায় কিছু একটা লিখছিলো। সে শান্তপর্ণে চোখ উঠিয়ে চেয়ারম্যানের দিকে তাকালো। তারপর মুখে কোন কথা না বলে আঙুল দিয়ে পূর্ব দিকে দেখিয়ে দিলেন। দ্রুত পায়ে খালেক ব্যাপারি, আবুল হোসেন সাহেব ও সাথের দুজন লোক পূর্ব দিকের কামরায় চলে গেলেন। ওসি রিপন সাহেব মাত্রই বাসার দিকে রওনা দিবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু তখুনি তার কামরায় চারজন লোকের প্রবেশ। চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে চিনতে তার বেগ পেতে হলো না। ভ্রু কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। খালেক ব্যাপারি রেগে বললেন,

— কোন অপরাধে আমার সোনার টুকরো ছেলেকে জেলে পুরেছেন? কি করেছে আমার ছেলে?

রিপন সাহেব সিট দেখিয়ে দিয়ে বললো,
— বসুন।

চেয়ারম্যান ও মেম্বার সাহেব দুজনেই বসলো। খালেক ব্যাপারির মুখটা রাগে লাল, নীল সিগন্যাল দিচ্ছে। তিনি আবারো চেচিয়ে বললো,

— কি হলো আমার কথার উত্তর দিন? হিমেল কি করেছে? কোন অপরাধের ভিত্তিতে ওকে আটক করেছেন?

রিপন সাহেব দুই হাত টেবিলের ওপর রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,

— আমি কি এখন আপনাকে কৈফিয়ত দিবো?আপনি ভুলে যাবেন না এটা একটা থানা। আর আপনি থানার ওসির সাথে কথা বলছেন।

খালেক ব্যাপারি রেগে টেবিলে জোরে একটা বারি দিয়ে বললো,

—আপনি জানেন আমি কার ভাই? সামনের ইলেকশনে আমার বড় ভাই রুহুল আমীন এমপি পদে দাঁড়াবে। তার সাথে বড় বড় রাজনৈতিক নেতার হাত আছে। একটা কল করলে আপনার ট্রান্সফার হতে মাত্র কয়েক ঘন্টা লাগবে।আপনি আবার বলছেন আমাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নন।

ব্যাপারির হুমকিতে কাজ হলো।ওসি সাহেব কিছুটা নড়েচড়ে বসলো। রুহুল আমিনের সাথে আসলেই অনেক বড় বড় নেতার উঠাবসা। তাকে ট্রান্সফার করতে একদিনের বেশি দুদিন লাগবে না। চাকরির শেষ সময়ে এসে ট্রান্সফার নিয়ে সে এতো ঝামেলা করতে চায় না। তাই কিছুটা নরম সুরে বললো,

— আপনার ছেলেকে শুধু শুধু এরেস্ট করা হয়নি। সে মহিউদ্দিন সাহেবের একমাত্র মেয়ে মারিয়াকে হ্যারেস করেছে। দিনে দুপুরে তাদের সামনে গিয়ে মারিয়াকে গলা টিপে ধরেছে। তাই মহিউদ্দিন সাহেব আমাদের কাছে কমপ্লেন করেছে। আমরা উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ও চাক্ষুস সাক্ষ্যীর বয়ানের ভিত্তিতে তাকে এরেস্ট করেছি।

হিমেল সেদিন ত্রিবুদের বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা মারিয়াদের বাসায় গিয়েছিল। সেখানে রাগের মাথায় মারিয়ার বাবা-মায়ের সামনেই মারিয়ার গলা টিপে ধরেছিলো। তখন দ্রুত নিজের মেয়েকে ছাড়িয়ে পুলিশকে বিষয়টা ইনফর্ম করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে হিমেলকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।

ওসির কথা শুনে খালেক ব্যাপারি হুংকার দিয়ে বললো,

— কি মহিউদ্দিনের এতবড় কলিজা! আমার ছেলেকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। আগে এদিকটা সামলাই। তারপর ওর খবর নিবো। ও আর ওর মেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে।

ওসি একগালে হেসে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
— তাও ভাগ্য ভালো আপনার ছেলের নামে মামলা করেনি। মামলা করলে ভেজাল হয়ে যেতো। কমপ্লেন করায় রক্ষা।

চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
— হিমেলকে বের করার ব্যবস্থা করুন।

ওসি সাহেব উসখুস করে বললেন,
— এমনি এমনি তো বের করতে পারি না। যদি কিছু…

ওসি সাহেব কিসের কথা বলছে তা বুঝতে পেরে খালেক ব্যাপারি বললো,

— খরচাপাতির কথা চিন্তা করবেন না। আগে আপনি আমার ছেলেকে বের করুন।

আবুল হোসেন সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন,
— কত লাগবে আপনার?

ওসি সাহেব বিজয়ী হাসি হেসে বললো,
— এই হাজার পাঁচেক হলেই চলবে।

খালেক সাহেব তার সাথে থাকা দুই চেলাপেলাদের থেকে একজনকে ডেকে বললেন,

— এই মিন্টু স্যাররে হাজার পাঁচেক টাকা দে তো।

মিন্টু নামক লোকটা ব্যাপারির আদেশ পেয়ে শার্টের পকেট থেকে দ্রুত টাকা বের করে ওসির হাতে দিলেন। ওসি সাহেব চিলের মতো ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে প্যান্টের পকেটে গুঁজে ফেললেন। কেউ দেখলে আবার ঝামেলায় পরতে হবে। টাকা রেখে খুশিমনে টেবিলে থাকা বেল চাপলেন। মিনিটের মধ্যে এক হাবিলাদর এসে স্যালুট করে বললো,

— ইয়েস স্যার!

— যাও গিয়ে উনার ছেলেকে নিয়ে এসো।

— ওকে স্যার।

হাবিলদার আদেশ পেয়ে ছুটলো চৌদ্দ শিকের কারাগারের দিকে।বেশ কিছু সময় পর হিমেলকে নিয়ে ফিরলো। এক দিনে তার চেহারার রং পাল্টে গেছে। মশার কামড়ে মুখের নানা জায়গা লাল হয়ে আছে।চেহারাটাও মলিন। খালেক ব্যাপারি দ্রুত চেয়ার থেকে উঠে ছেলের মুখ, চোখে হাত দিয়ে বললো,

— একদিনে কি চেহারা হয়ে গেছে আমার আদরের ছেলেটার। কি অবস্থা তোর!

হিমেল তার বাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুই হাত মুঠ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো,

— আমি কাউকে ছাড়বো না বাবা। ঐ মহিউদ্দিন সাহেব ও তার মেয়েকে যদি উচিত শিক্ষা না দেই তাহলে আমার নামও হিমেল নয়। মারিয়ার আমি এমন অবস্থা করবো যাতে কেউ আমার সাথে এসব করার আগে দুইবার ভেবে নেয়।

ব্যাপারি ছেলের হাত ধরে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্য বললো,

— সবকিছু হবে। যেমন তুই চাইবি তেমনি হবে। কিন্তু এখন নয়। চল বাসায় চল। তোর মা তোর চিন্তায় চিন্তায় নাওয়াখাওয়া ভুলে গেছে।

ওসি সাহেব এগিয়ে এসে খালেক ব্যাপারির সাথে হাত মেলাতে মেলাতে বললো,

— কোন সহযোগিতা লাগলে আমাকে বলবেন। আর কমপ্লেনের বিষয়টা নিয়ে ভাববেন না। আমরা তা দেখে নিবো।

“আসছি” বলে খালেক ব্যাপারি, আবুল হোসেন সাহেব, হিমেল ও সাথের লোকেরা বেরিয়ে গেলো। টেবিলে বসে থাকা সেই কনস্টেবলটা ঘৃণায় ওসি সাহেবের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। পুরো ঘটনাটা তার জানা আছে। ঘুষের বিনিময়ে ছেলেটা ছাড়া পেয়ে গেছে, এই আর নতুন কি!

থানা থেকে বেরিয়ে ব্যাপারি চেয়ারম্যান ও তার চেলাপেলা মিন্টু ও লোকমানকে বললো,

— চেয়ারম্যান সাব আপনি বাসায় চলে যান।এমনি আজকে আমারে অনেক সময় দিছেন। আর মিন্টু, লোকমান তোরাও হিমেলকে নিয়ে বাসায় চলে যা। আমি একটু আসছি।

হিমেল জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাবে বাবা?

ব্যাপারি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
— মহিউদ্দিনের সাথে আমার একটু বোঝাপড়া আছে।

☔☔☔

সন্ধ্যা থেকে ত্রিবুর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। ১০৫°-এর মতো জ্বর হবে। জোবেদা খাতুন বড় ট্রাংক থেকে লেপ বের করে ত্রিবুর গায়ে মেলে দিয়েছেন। তবুও তার নাতনি ঠকঠক করে কাঁপছে। দুদিন আগে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজেছে, দুদিন ধরে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে না,আজ দুপুরে কত কাহিনি ঘটলো,আবার আসলো জ্বর,মাথা ফেটে গেছে। সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। ত্রিবুর এই অবস্থা দেখে তার দাদী নিরবে কাঁদছে। মেয়েটা দুদণ্ডও ভালো থাকতে পারে না। একটার পর একটা লেগেই আছে। সে যদি পারতো তাহলে নাতনিকে নিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে বহু দূরে চলে যেতো। কিন্তু যাবেটা কোথায়? স্বামীর এই ভিটে-টুকুই তো শেষ সম্বল।আঁচলে চোখ মুছে ত্রিবুর শিউরের পাশে বসলো। কপালে হাত রেখে দেখলে জ্বরটা একটু কমেছে। একটু আগে গা পুড়ে যাচ্ছিলো। সে দ্রুত কলপাড় থেকে বালতি ভর্তি পানি এনে ত্রিবুর মাথায় ঢেলে তাপমাত্রা কমিয়েছে। ধীর কন্ঠে ত্রিবুকে ডাকলো।

— ত্রিবু, এই ত্রিবু।

— হু!

— উইঠা একটু কিছু খাইয়া লো।

— উহু।

— উহু কইলো হইবো না। দুই লোকমা হইলেও খাইতে হইবো। ভাত খাইয়া একটা নাপা খাইতে হইবো।

— না।

— কি না? না কইলে তো হইবো না। উঠ একটু।

— এখন খাবো না।

— কোন কথা নাই। আমি যা কইছি তাই। আর কোন কথা হুনমু(শুনবো) না। উঠ দেখি। আমি খাওয়ায় দেই।

তিনি উঠে গিয়ে টিনের পাটিশন দেওয়া আরেকপাশে চলে গেলেন। খানাডুলির পাশের ছোট মাচা থেকে প্লেট নিয়ে পাতিল থেকে ভাত বেড়ে নিলো। সেচি শাক দিয়ে শুঁটকির ঝোল ও ডাল রান্না করছেন।সেখান থেকে বেশিরভাগ অংশ প্লেটে নিলেন। এক মাগ পানি নিয়ে নতনীর পাশে এসে বসলেন।

— ত্রিবু উইঠা একটু খাইয়া নে।

ত্রিবু দূর্বল কন্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
— খাবো না, প্লিজ দাদী জোর করো না।

— জোর কইরো না কইলে তো হইবো না। খাইতে হইবো। না খাইলে গায়ে জোর পাবি কই থিকা।

না চাইতেও দাদীর জোড়াজুড়িতে ত্রিবুকে উঠতে হলো। কারণ ত্রিবু না খেলে তার দাদী খাবে না। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর নাক,মুখ কুঁচকে বললো,

— আর খাবো না দাদী। এবার তুমি খেয়ে নাও।

— কোন কথা কবি(বলবি) না। চুপচাপ পুরা প্লেট শেষ করবি। বিকেলে কাকের ঠোকর, বকের ঠোকেরের মতো অল্প একটু ভাত খাইছিস। সেগুলা কি এতখন পেটে থাকে? আরেকটু খাইয়া নে।

— সম্ভব না। মাথা ঘুরাইতাছে।

জোবেদা খাতুন আর জোর করলেন না। জোর করলে যদি আবার যতটুকু পেটে পরেছে তা বমি করে ফেলে দেয় তাই। মুখ ধুইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলেন। ত্রিবু লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। ভীষণ শীত করছে। মাথার কোণার দিকে ফেটে যাওয়ার স্থানে ব্যাথা করছে।সাথে শরীরও কাঁপছে। জোবেদা খাতুন আধখাওয়া প্লেট ঢেকে রেখে হাত ধুয়ে এলেন। ত্রিবুর মাথার পাশে বসে চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলেন। দূর্বল শরীর থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে ত্রিবু ঘুমিয়ে পরলো। জোবেদা খাতুন দরজা ভিরিয়ে কলপাড় থেকে ওযু করে এলেন। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। নাতনির জন্য নফল নামাজ পরে আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দোয়া চাইবেন। যাতে সে দ্রুত সুস্থ হয়ে যেতে পারে। ত্রিবু অসুস্থ হলে তিনি সারারাত নামাজ পরে আল্লাহর দরবারে ওর জন্য সুস্থতা কামনা করেন।

~~~পছন্দের বস্তুটা না পাওয়াই ভালো। তাতে তার কদর বোঝা যায়🌺।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে