হঠাৎ বৃষ্টিতে পর্ব-০৩

0
1150

#হঠাৎ_বৃষ্টিতে⛈️
#Part_03
#Writer_NOVA

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট একটা গ্রাম সূবর্ণপুর। নেই কোন ধর্ম ভেদাভেদ কিংবা সাম্প্রতিক দাঙ্গা। হিন্দু, মুসলিম মিলিয়ে গ্রামের লোকজন প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি হবে।এটাই ত্রিবুদের গ্রাম। গ্রামের উত্তর দিকে প্রধান সড়ক। সেই সড়কে বাস চলাচল করে। এছাড়া আনাচে কানাচে ছোট,বড় কাচা-পাকা রাস্তা তো আছেই। ঢাকা যেতে হলে ঐ প্রধান সড়ক দিয়ে যেতে হবে। সড়কের থেকে কয়েক মিনিট হাটলে খরস্রোতা নদী। নদীর ওপর বিশাল ব্রীজ। মূলত এই ব্রীজ দুইপারের প্রধান সড়ক সুংযুক্ত রাখতে বিশাল ভুমিকা পালন করছে।কালের বিবর্তনে নদী গর্ভ অনেকটা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। তবুও স্রোত কম নয়। লোকমুখে শোনা যায় আগে এখান দিয়ে লঞ্চ চলাচল করতো। কিন্তু এখন দুই চারটা জেলেদের ডিঙি নৌকা আর মাঝে মাঝে শো শো শব্দের ট্রলার ছাড়া কিছু দেখা যায় না। নদীর কিনার ঘেঁষে চর জেগে উঠেছে। সেই চরে কৃষকদের ধান বোনার দৃশ্য সত্যি মনোমুগ্ধকর।

ঘরের পাশের আমগাছ থেকে শালিকের চেচামেচি শুনা যাচ্ছে। দুটো শালিক কি নিয়ে জানি ঝগড়া শুরু করেছে,থামার নামই নেই । তার চেচামেচি কানে আসতেই ত্রিবু কাঁথাটা টেনে দিয়ে কানের মধ্যে বালিশ চাপা দিয়ে ধরলো। প্রধান সড়ক থেকে দশ বা পনের মিনিট হাঁটলে টিনের ঘেরা দেয়া ছোট একটা দোচালা ঘরের দেখা মিলবে। মাটির মেঝের ছোট টিনের ঘর ও পাটকাঠির তৈরি ছোট একটা রান্নাঘর। এটাই ত্রিবুদের বাড়ি। এখানে শুধু ত্রিবু ও তার দাদী থাকে। ত্রিবুর মা পালিয়ে যাওয়ার পর ত্রিবুর বাবা আবার বিয়ে করেন। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় থাকেন। মাঝে মাঝে মা ও মেয়েকে দেখতে আসেন।মাস শেষে যৎসামান্য টাকা পাঠান।তিনি মনে করেন এতেই তার দায়িত্ব শেষ। ত্রিবু কয়েকটা টিউশনি করে। সব মিলিয়ে টেনেটুনে দুজনের দিন ভালোই যায়।সকালের রান্নার জোগাড় করে ত্রিবুর দাদী জোবেদা খাতুন ঘরে প্রবেশ করলেন। নারিকেলের চিকন শলার তৈরি ঝাড়ু দিয়ে মাটির মেঝে ঝাড় দিতে দিতে নাতনিকে ডাকছেন তিনি।

— এই ত্রিবু কত পইরা পইরা ঘুমাবি? এবার এট্টু
(একটু) উঠ। সূর্য উইঠা গেছে। কিন্তু তুই এহনো উঠলি না। রান্ধন চড়াইতে হইবো। ঘরে কিচ্ছু নাই। তোর মফিজ চাচার মুদি দোকান থিকা দুইডা ডিম আইনা দে। আলু দিয়া ভুনা করমুনি। টেকা বাকি রাইখা আসিস। পরে দিয়া দিমু।

ত্রিবু ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দিলো,
— আচ্ছা।

ত্রিবু আচ্ছা বলে আবারো কাঁথা মুড়ি দিয়ে উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে পরলো।নাতনিকে উঠতে না দেখে জোবেদা খাতুন এগিয়ে এসে ত্রিবুর মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে বললো,

—এই ছেমরি কি কইতাছি হুনছোস? তোর কি কলেজ নাই আইজকা? এমন পইরা পইরা ঘুমাইতাছোস যে।

— দাদী বিরক্ত করো না। একটু ঘুমাতে দাও। রান্নার আগে তোমার ডিম পেলেই তো হলো।

— এই মাইয়া কয় কি? আমার ডিম পাবি কই? আমি কি উমা মুরগী যে ডিম পারমু? তোরে মুরগির ডিম আনতে কইছি।

— তোমার ডিম আর মুরগির ডিম একই।

— আবারো!

ত্রিবু এক লাফে উঠে বসলো। দাদীকে ঢেঢ় রাগানো হয়েছে। একটু কিছু বললে তিনি রেগে যায়। বেশি রাগালে রান্নাটা ত্রিবুকেই করতে হবে। ত্রিবু মুচকি হেসে দাদীকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— ও সতীন রাগো কেন? তুমি কি জানো রাগলে তোমার গাল দুটো লাল টমেটো হয়ে যায়?

ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট জােবেদা খাতুনের রাগ ভাঙানোর জন্য। উনি ফিক করে হেসে আঁচলে মুখ লুকালেন। ত্রিবুর দাদা বেঁচে থাকতে এভাবে রাগ ভাঙাতেন। তার নাতনিও সেরকম হয়েছে। মানুষটা গত হয়েছে আজ বারো বছর হলো। তবুও তার কথার অঙ্গিভঙ্গি,চেহারার গঠন সে ত্রিবুর সাথে মিল পায়। জোবেদা খাতুন কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

— হইছে হইছে আর পাম মারতে হইবো না। যা দৌড় দিয়া দুইডা ডিম লইয়া আয়। আমি গিয়া জ্বাল ঠেলা দিয়া আহি। মাটির চুলায় পাতার আগুন উপরে উইঠা গেলে সমস্যা।

— আচ্ছা সুন্দরী!

ত্রিবু তার দাদীকে ছেড়ে টেবিলের ওপর থাকা ব্রাশটা হাতে নিলো।গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পেস্টের টিউব থেকে ব্রাশে পেস্ট ভরিয়ে নিলো। আজ অন্যদিন থেকে বেশি উৎফুল্ল লাগছে তাকে। গতরাতে বাসায় ফিরে জব্বর এক ঘুম দিয়েছে। এক ঘুমে রাত পার।ফ্রেশ ঘুমের কারণে গতকাল রাতের সব স্মৃতি তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। গান থামিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে রওনা দিলো মফিজ চাচার মুদি দোকানের দিকে।

☔☔☔

পূর্ব দিগন্তে সূর্য তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে বহু আগে। ডিমের কুসুমের মতো লাল সূর্যটা ধীরে ধীরে পুরো ভুবন আলোকিত করছে। রাতে যেমন ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে থাকে তেমনি সকালে সূর্য তার কিরণে সারা পৃথিবী আলোকিত করে দেয়। সেই আলোতে অন্ধকার লেজ গুটিয়ে পালায়। পৃথিবী সাজে নতুন রূপে। গতরাতে যে ঝুম বৃষ্টি হয়েছিলো তা বোঝার উপায় নেই।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজ অনেকদিন পর সূর্যদোয় দেখলো মারিয়া। আরো একটি নতুন সকালের আগমন। নতুন সকাল, নতুন জীবন। চায়ের কাপটা পাশে রেখে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো সে।তখুনি মারিয়ার বাবা মহিউদ্দিন সাহেব দরজা খুলে মেয়ের কাছে অনুমতি চাইলো।

— আসবো মা?

— আরে বাবা এসো।

মারিয়া বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসলো।পাশের চেয়ারটা টেনে মহিউদ্দিন সাহেবকে বললো,

— বসো।

চেয়ারে বসে মহিউদ্দিন সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— মন খারাপ করিস না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোর জন্য ভালো কিছু রেখেছে। তুই যদি আমাকে সব খুলে না বলতি তাহলে গতকাল কতবড় ভুল হয়ে যেতো আমার। এটা ভেবেই আমি বারবার কেঁপে উঠছি।

— আহ,বাবা কি শুরু করলে! সকাল সকাল এসব কি খুব দরকার ছিলো?

— হ্যাঁ রে মা খুব দরকার। আমি নিজ হাতে তোকে অন্ধকার জীবনে ঠেলে দিতে চেয়েছি। আমি সত্যি অনুতপ্ত নিজের কাজে। আরো আগে তোর কথা শুনলে এমনটাও হতো না।

— বাবা, বাদ দাও এসব। যা হওয়ার তাতো হয়েছেই। বাবা,যৌতুক আমার পছন্দ নয়। এটা মেয়েদের মূল্যহীন করে দেয়। যখন ছেলেপক্ষ যৌতুক চাইলো তখুনি আমার সন্দেহ হয়েছে। আমি এতদিন উপযুক্ত প্রমাণ না পাওয়ায় চুপ ছিলাম। তাছাড়া ঐ হিমেলকে আমার মানুষ হিসেবে ভালো মনে হয়নি। তোমাকে বারবার বলেছিলাম যৌতুক দিয়ে আমাকে বিয়ে দিবে না। আমি কোন পণ্য নই। কিন্তু তুমি তো শুনলে না।

— আমায় মাফ করে দিস মা। সঠিক সময়ে তুই আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। নয়তো আমি যৌতুকের বিনিময়ে এক অমানুষের হাতে আমার কলিজার টুকরোকে তুলে দিতাম।

— যা হয়েছে অনেক ভালো হয়েছে। তুমি প্লিজ এসব নিয়ে কোন টেনশন করো না। আমি নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর বিয়ে করবো। এর আগে নয়। বর্তমান সমাজে মেয়েদের সফল হওয়া অনেক জরুরি।

— তোর যতদূর ইচ্ছে পড়িস। আমি মানা করবো না।

মারিয়া দুই হাতে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে চিৎকার করে বললো,

— Thank you Baba. You are my best father in the world.

☔☔☔

গতকালের বৃষ্টিতে কাঁচা রাস্তার মাঝে বেশ কয়েক গর্তে পানি জমে আছে। ত্রিবু এক হাতে ব্রাশ ধরে আরেক হাতে প্লাজু উঁচিয়ে হাঁটছে যাতে কাঁদা না লাগে। এক রাতে আশেপাশের ডোবাগুলোও পানিতে টইটুম্বুর। নতুন পানির আনন্দে দু-একটা ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। হালকা ভেজা মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তার কোণায় দুটো কেয়া ফুলের গাছ আছে। সেখানে কয়েকটা কেয়া ফুল ফুটেছে। ত্রিবু হাত বাড়িয়ে ফুল ছিঁড়তে গিয়েও ছিঁড়লো না। গাছের ফুল গাছেই সুন্দর। সবুজ ঘাসের ওপর চিকন এক বন্য ফুল গাছ। সাদা লাউফুলের মতো ফুলগুলো ঝুলছে। বৃষ্টিতে তাদের বেশ সতেজ লাগছে। আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এক সময় মফিজ চাচার দোকানের সামনে চলে এলো।

— চাচা দুইটা ডিম দিয়েন তো।

মফিজ চাচা ত্রিবুকে দেখে একগাল হেসে তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। এই লোকটা ত্রিবুকে ভীষণ পছন্দ করে। ত্রিবু মেয়েটাই এমন। খুব সহজে সবার সাথে মিশে যেতে পারে। খুব সহজে মিশে যেতে পারে বলেই তো আঘাতগুলোও খুব সহজে পায়।

— আরে ত্রিবু মা যে! কেমন আছো?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো চাচা। আপনি?

— আছি মা আল্লাহর রহমতে ভালোই।

কথা বলতে বলতে ডিমের গোল খাঁচা থেকে দুটো ডিম নিয়ে ছোট পলিথিনে গিঁট দিলেন মফিজ মিয়া। ত্রিবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

— এই নাও।

— খাতায় লিখে রাইখেন চাচা। টিউশনির টাকা পেলেই আপনার বকেয়া পরিশোধ করে দিবো।

— কোন সমস্যা নেই মা। তুমি টাকাপয়সা নিয়া চিন্তা কইরো না। তোমরা হইলা নিজেগো মানুষ। নিজেগো মানুষের লগে কি এতো হিসাব-নিকাশ চলে?

ত্রিবু মুগ্ধ নয়নে মফিজ মিয়ার দিকে তাকালো। ইস, মানুষগুলো কত সহজ-সরল! নেই কোন বিদ্বেষ, হিংসা। সহজসরল স্বীকারোক্তি। এই মানুষগুলোর জন্য কিছু তো তার করতেই হবে তার। নয়তো এদের ঋণ শোধ করবে কি করে? মফিজ মিয়া আবারো একটা হাসি দিয়ে বললো,

— আর কিছু লাগবো মা?

ত্রিবু কিছু সময় ভেবে বললো,
— আড়াইশ গ্রাম মসুর ডাল দিয়েন। আর নাপা ট্যাবলেট আছে চাচা?

— হো আছে।

— এক পাতা নাপা দিয়েন।

গ্রামের মুদি দোকানে নাপা ট্যাবলেটটা এভেলেভেল পাওয়া যায়। তাই এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়। ত্রিবুর শরীরটা কেমন জানি জ্বর জ্বর লাগছে। কালকে বাসায় এসে দ্রুত নাপা খেয়ে নিয়েছিলো। যার কারণে জ্বর বাবাজি হামলা করার সুযোগ পায়নি। তবে এখন আসবে আসবে ভাব। গলাটাও উসখুস করছে। কে জানে দেবে যাবে কিনা। মফিজ মিয়া আড়াইশ গ্রাম মসুর ডাল ও এক পাতা নাপা ট্যাবলেট ত্রিবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে সতর্কতা মিশ্রিত কন্ঠে বললো,

— খবর শুনছো নাকি ত্রিবু মা?

ত্রিবু ডিম, মসুর ডাল একটা বড় পলিব্যাগে ঢুকিয়ে ভালো করে গিঁট দিলো। তারপর চাচার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো,

— কি খবর চাচা?

— মেম্বারের পোলা হিমেলের বিয়া তো ভাইঙ্গা গেছে। ওর হবু বউ ভাইঙা দিছে।

খবরটা শুনে ত্রিবু চমকে উঠলো। একে একে গতরাতের বাজে স্মৃতিগুলো চোখের পাতায় ভেসে উঠলো। রাতের সেই ছেলেটার কথা মনে হতেই লাল ছাতার কথা মনে হলো। তবে তার ভীষণ ভয় করছে। হিমেল যদি তার বিয়ে ভাঙার দোষটা ত্রিবুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় তাহলে তো এই গ্রামে থাকা দুষ্কর হয়ে যাবে। এমনি ত্রিবুর পেছনে সব লেগে আছে। তার মায়ের কলঙ্কের দাগ তো তার গায়ে লেপ্টে দিয়েছে। তার মধ্যে এই ভেজাল হলে না জানি কত বাজে খেতাব পেতে হয়। ত্রিবু ভয়ার্ত চেহারা লুকিয়ে মফিজ চাচার থেকে বিদায় নেয়ার উদ্দেশ্য বললো,

— আজ আসি চাচা।

— আইচ্ছা। কোন কিছু লাগলে সোজা আমার দোকানে আইয়া পরবা। কোন সরম করবা না।

— জ্বি নিশ্চয়ই।

ত্রিবু সৌজন্যেতা মূলক হাসি দিয়ে দ্রুত বাড়ির পথ ধরলো। বাড়িতে প্রবেশ করার আগে পুকুর পার থেকে ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো। ঘরে এসে ডিম,ডাল,ব্রাশ টেবিলে রেখে বিছানায় বসতেই জোবেদা খাতুন ভয়ার্ত কন্ঠে ঘরে ঢুকে বললো,

— ত্রিবু মেম্বারের পোলা হিমেল আইছে। তোর লগে নাকি তার কথা আছে।

~~~খারাপ সময় একায় পার করতে হয়। তাই ভয় না পেয়ে ঠান্ডা মাথায় দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে তা মোকাবিলা করতে শিখুন। ইন শা আল্লাহ সফলতা আসবেই 💘।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে