আমার বড় ফুপাত বোন রুবী। খুবই অল্প বয়সে তার চাইতে দ্বিগুন বয়সের এক দ্বোজবরের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। শুধু তাই নয় আমার এই পুতুলের মত বোনটির একটি সাত বছর বয়সী সৎকন্যাও আছে। বিয়েতে আপত্তি দু একজনের থাকলেও বেশির ভাগ মুরব্বীর অপত্তি ছিল না। এমনকী আমার বোনেরও না।আমার দুলাভাই বিদ্বান এবং বিত্তশালী। মাথায় প্রকান্ড টাক।শোনা যায় আমার দুলাভাই তার শ্বশুরের সমবয়সী।
আমার এই বোনটা বরাবরই লোভী স্বভাবের। ভাল পোষাক ভাল খাবার বরাবরই পছন্দ করেন। প্রচুর মিথ্যা কথা বলেন কারনে অকারনে।
বিয়ের সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না।আমার বোনারেরা তো দুলাভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভীষন প্রাণবন্ত আমার এই বর্ষীয়ান দুলাভাইটি।তার আচার ব্যবহার দিয়ে সবারই মন জয় করে নিয়েছে।তারপর আবার বিরাট বিদ্বান।কোন দেশ থেকে যেন পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে এসেছে।আমাদের বাড়ির মানুষ তখনও ডাক্তার আর ডক্টরেট এর পার্থক্য বোঝেন না। তবে জামাই যে ডাক্তার না এই টুকু বোঝেন।
আমি বয়সে তার অনেক ছোট হবার পরও আমি আমার বোনকে খুবই অসম্মান করতাম।মুখের উপর কথা বলার জন্য তিনি আমায় কিছুটা ভয় করতেন। তার কিছুটা বেহিসাবী আচরনে আমি খুব কষ্ট পেতাম।
বাসি খাবার বলে যা তিনি ডাষ্টবিনে ফেলতেন, তা আমরা চোখেও দেখতাম না।
আমার দুলাভাই বিদ্বান মানুষ।বড় চকরী করেন। এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাও করেন।খুবই স্বচ্ছল তারা।
আমি তখন সবেমাত্র এইচএসসি শেষ করেছি।রুবী আপার একটি ছোট বোন আছে, ডলী। সে এসএস সি পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় বোনের বাসায়।
আমি আমার ফুপাতো বোনের বাসায় বেড়াতে এলাম। ডলি সংগ পাবো বলে।
আপার সৎ মেয়েটির নাম মুক্তি।যুক্তিসংগত ভাবে যতটুকু ভালবাসা বা যত্ন নেয়া উচিৎ সব কিছুই সুন্দর চলছে। সবাই তাকে সেইটুকু ভালবাসতো যেটুকু তার সবার কাছ থেকে তার পাওনা। আপাকে দেখি সন্ধ্য বেলায় ঘরের দরজা বন্ধ করে মেয়েকে দুই ঘন্টা পড়ান। তাকে মেয়েকে চোখে পড়ার মত কোন শাসন করতে দেখিনি। আদরও করতে দেখিনি।
আগেই বলেছি আমি রুবী আপাকে পছন্দ করতাম না।আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি খুবই লোভী একজন মহিলা।দুলাভাইয়ের টাকার জন্য তাকে বিয়ে করেছে। একথা আমি তাকে বলেছি।তিনিও তা স্বীকার করেছেন।যখন মুক্তির কথা বলেছি, তিনি জানিয়েছেন, মুক্তি তার কর্তব্য।
আমার চেয়ে বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও তার সাথে আমার বন্ধুত্বও ছিল। আপার ভেতর একটি সাদাসিধা হাসিখুশি সহজ সরল একটু গ্রাম্য একটা মেয়ে বাস করে।কখনোই কারো খারাপ চাইতে পারে না।
আমার বোনটি খুবই নামাজী এবং দানশীলা। । সদা হাস্যময়ী আমার বোনটিকে কিন্তু সবাই ভালবাসে। কিন্তু সবকিছু নিয়ে আমার সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়ে যেত।তাকে আমি অহরহ খোঁচাতাম লোভী বলে।তিনি হাসতেন।কখনো রাগ করতেন না।আমাকে সহ সবাইকেই তিনি তার মত করে ভালবাসতেন।
সেদিন আমরা দুই বোন, আমি আর ডলি মার্কেট থেকে দারুন দুইটা ড্রেস কিনে আনলাম।সে সময় আমরা উৎসব ছাড়া পোষাক পেতাম না। কেমন করে আমরা টাকা জমিয়েছিলাম সেটা আর আমার আজ মনে নাই। ড্রেস দুটি খুব সুন্দর ছিল, আজো ড্রেস দুটি আমার চোখে ভাসে।খুশিতে পাগোল হয়ে আপাকে দেখালাম। মুক্তিও দৌড়ে এলো।আপা তখন এক আশ্চর্য কান্ড করলেন। মুক্তিকে আসতে দেখে ঝট করে ড্রেসগুলি লুকিয়ে ফেললেন। মুক্তি আবার চলে গেল।ড্রেসগুলি মুক্তি দেখেনি। আপা ড্রেসগুলি নিয়ে গোপন কোন জায়গায় রেখে দিলেন।
আপার এই আচরণ দেখে রাগে আমার শরীর জ্বলতে লাগলো। আমার বোনটা এত নীচু! মুক্তি যদি ঐ জামার জন্য বায়না ধরে এ কারনে জামাগুলি মুক্তিকে দেখতেই দিল না! লুকিয়ে ফেললেন। না হয় মুক্তিকে একটা জামা কিনেই দিতেন! আর মুক্তি তো কখনোই বায়না করতো না।মুক্তি খুবই লক্ষী মেয়ে।
অনেক রাত। পাশে ডলি ঘুমাচ্ছ। আমার ঘুম আসছে না।টিভি দেখছিলাম বিছানায় বসে। সারাদিন আপার কাছ থেকে দূরে রইলাম মুড অফ করে।আপার ঐ জামা সংক্রান্ত ছোটলোকি বরদাস্ত করতে পারছিলাম না।
দরজায় শব্দ হল। আমি দরজা খুলতেই আপা ভেতরে এলেন।
আমার পাশে বসলেন। আমাদের জামার দাম জানতে চাইলেন। আমি দাম বললাম। তিনি আন্দাজ করে টাকা এনেছিলেন বেশি।টাকা আমার হাতে দিয়ে বল্লেন
ঃ শোন বোকা মেয়ে! তোরা নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়াবি, মুক্তির মনে কষ্ট লাগবে না? একদিনের তো ব্যাপার। কাল মুক্তির জন্য একটা কিনে এনে তিন খালা ভাগ্নী একই জামা পরলে কত সুন্দর লাগবে।
আমি হাঁ হয়ে গেলাম আপার কথা শুনে।আপা মনে করেছে আমরা জামা পরতে না পারার শোকে কাতর।আহারে! মেয়ে যেন মনে কষ্ট না পায় তার জন্য মেয়েকে জামাগুলি দেখতেও দেয়নি। আমি তো একটা ইমোশনাল ফুল।আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আপা আমার কান্নার কোন কারন না বুঝে মুখ চূন করে বসে রইলেন।
ঃ আপা, মাফ করে দাও।
এই হল আমার লোভী, হাস্যময়ী, মিথ্যেবাদী বোনটি।
এটা মনে কষ্ট পাওয়া দেখাটা আপার কর্তব্য ছিল না। কিন্তু সে মুক্তির মায়ের জায়গাটা দখল করেছিল মন থেকে, হৃদয় থেকে।
আরো পরের একটি ঘটনা।
মুক্তির ছোট ভাইয়ের বয়স তিন মাস।
আমি রাজশাহী থেকে সরাসরি আপার বাসায় উঠলাম পুটুস দেখার লোভে।ঘরে তিনজন। আপা মুক্তি আর আমি।আমি বাবুকে আদর করছি। কন্ঠে উচ্ছাস। এই প্রথম দেখছি আপার ছেলেকে। আপা কথা বলতে বলতে আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে কি যেন ইশারা করছে। বুঝলাম। তিনি তার কন্যাকে আদর করতে ইশারা করছেন।
আহা! আমার বোনটা শতায়ু হোক।
তারপর বহু বছর কেটে গেছে।আজ পর্য়ন্ত তার ছোট দুই ভাইয়েরও অজানা যে মুক্তি তাদের সৎ বোন। মুক্তির বাবাও নিশ্চয়ই সেই সত্যকে ভুলে গেছেন।আমার বোন ভীষন নামাজী। তার নামাজ খোদা কবুল করছেন কীনা জানি না।তবে সৎ কন্যাকে নিজের কন্যার চোখে যে নারী দেখতে পারে তার জন্য খোদা দোজখ হারাম করেছেন- এ আমার বিশ্বাস।আমার দেখা বিশাল হৃদয়ের নারী আমার রুবী আপা।
সবচাইতে আশ্চর্যকথা, মুক্তি দেখতে একেবারেই আপার মত।
বিশ্বাস করুন।
আমার চিগির কসম।