স্যার যখন স্বামী সিজন২
পার্ট_০৭
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস
এরপর ওদের দলের লিডার তমার হাত ধরতেই গেল আহাদ প্রায় চিল্লিয়ে উঠল।
“খবরদার আমার বউয়ের গায়ে হাত দিবে না।নাহলে তোদের অবস্থা খারাপ করে ফেলবো।”
আহাদকে এত মারার পরও যখন ও তমাকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো তখন ওদের পৈশাচিক হাসি যেন আগের থেকে আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেল।আর এদিকে তমা চোখ বন্ধ করে বারবার আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলো। আজকে ওর কারণে আহাদের কোন ক্ষতি হলে ও নিজেকে মাফ করতে পারবে না।
.
.
“এই এইদিকে কি হচ্ছে?”
চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনে তমা চোখ খুলে দেখে ২টা ছেলে আরেকটা মেয়ে ওদের দিকে দৌড়িয়ে আসছে।আহাদকে যে বখাটে ছেলেগুলো মারছিল তারা তাড়াতাড়ি ভয়ে দৌড় দিল।আর তমাকে ছেড়ে ওই বখাটে ছেলেদের লিডারটা পালিয়ে যেতে চাইলেই ওর দিকে দৌড়িয়ে আসা ছেলে ২টা লিডারকে আটকিয়ে ফেলে।
“রাত বিরাতে মেয়ে মানুষ দেখলেই কু* হয়ে যাস? আজকে দাঁড়া তর খবর নিচ্ছি।রাস্তার কু*কে মানুষ যেভাবে মারে আজকে তোরেও সেইরকম করে মারবো। ” এই কথা বলে সাহায্য করতে আসা ছেলে ২টার পাশে যে মেয়ে ছিল সে লিডারকে ইচ্ছামত মারতে লাগল।মেয়েটার সাথে থাকা ছেলে ২টাও মারে যোগ দিল।
আর এদিকে তমা তাড়াতাড়ি করে আহাদের কাছে গেল।ওরা আহাদকে কি মারটাই না মারলো!কপাল,মুখ,হাত পা থেকে অবিরত রক্ত পড়ছে।যে মেয়ের রক্ত দেখলেই মাথা ঘুরাই এখন সেই আহাদের শরীর থেকে রক্ত বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।এই মূহুর্তে রক্ত দেখে ওর খারাপ লাগলে চলবে না। আহাদের কাটা যে জায়গাগুলো থেকে রক্ত ঝড়ছে তাড়াতাড়ি করে সেই জায়গাগুলো তমা ওর ওড়না দিয়ে বেধে দেয়।অবশ্য নিজের হাত থেকে যে রক্ত পড়ছে সেদিকে ওর খেয়াল নেই।
.
.
“আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আপনারা এখানে আসতে একটু দেরি করলেই……..”
“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করেন।হয়ত আল্লাহ আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমাদেরকে পাঠিয়েছেন।”
তমা মেয়েটার পাশে থাকা ছেলে ২টার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে মেয়েটি বলে,, “আপু এরা আমার ভাই। ভাইদের সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে দোকানে গিয়েছিলাম।আপনাদের মতন আমরাও কোন খালি গাড়ি না পেয়ে এই রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু করি।আসার সময় দেখতে পাই একটা ছেলে আপনার হাত ধরে টানাটানা করছে। তাই তাড়াতাড়ি দৌঁড়ে চলে আসলাম।আপু আপনি ঠিক আছেন তো?”
“হ্যা আমি ঠিকাছি।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আর আপনার ভাইদের।”
“এতে আপু ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নাই।আরে উনার অবস্থাতো খুব খারাপ।মনে হচ্ছে মেডিকেলে নিয়ে যেতে হবে।”
.
.
আহাদ-“না আপু তেমন কিছু হয় নি।সামান্য ব্যথা পেয়েছি।এরজন্য মেডিকেলে যেতে হবে না।আজকে আপনারা আমার অনেক বড় উপকার করলেন সে জন্য আমি আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।”
মেয়েটা মুচকি হেসে বলল,,”ভাইয়া এভাবে বলবেন না।একে অন্যের বিপদে এগিয়ে না আসলে তাহলে আমাদের মনুষ্যত্ববোধটা আর কোথায় রইল বলুন?আচ্ছা এই অবস্থায় আপনারা বাসায় যেতে পারবেনতো?যদি বলেন তাহলে আমরা আপনাদের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি।”
আহাদ-“না, তা আর লাগবে না।এইতো আরেকটু হাঁটলে বাসায় পৌঁছে যাব। আপনাদেরও মনে হয় অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।তাই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান।”
“আচ্ছা তাহলে সাবধানে বাসায় যান।আচ্ছা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা প্রশ্ন করি উনি আপনার কি হন?”
আহাদ-“আমার স্ত্রী”
“ও আচ্ছা।ভালো থাকবেন।আসি তাহলে।”
.
.
“কি ব্যাপার এইভাবে তাকিয়ে আছ কেন?আমাকে হেল্প কর?”
“ও সরি…..”
উনাকে ধরে অনেক কষ্টে বাসায় আসলাম।বাসার গেইটের কাছে আসতে দেখি মামণি,আর উনার পরিবার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।আমাদেরকে দেখেই ওরা ভয়ে চিল্লিয়ে উঠল।
“তোদের শরীরে এত রক্ত কেন!? কি হয়েছে তোদের।”
“সব বলবো।আগে বাসায় চল।আমি তমাকে বাসায় দিয়ে আসছি।”
“লাগবে না,,, আমি একা যেতে পারব। আপনার অবস্থা খুব খারাপ।বাসায় যান।আমি ডাক্তার আংকেলকে কল করে আপনাদের বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
আমার কথাটা শুনে উনি রাগি দৃষ্টিতে এখন আমার দিকে তাকালেন। এত মার খাওয়ার পরও উনার রাগ কি করে আসে আমি সেটাই বুঝলাম না।আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে আসল।আর আমাদের পিছনে মামণি,উনার পরিবার দৌঁড়িয়ে আসল।এই অবস্থায় উনার রাগটা কেন উঠল তা আমি বুঝতে পারলাম না।শুধু আমি কেন বাড়ির কেউও তা বুঝতে পারল না।
উনি আমার রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।এদিকে সবাই ভয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। সবাই দরজা খুলার জন্য বারবার উনাকে ডাকছিলেন।উনি অনেক রাগ নিয়ে দরজা খুলে বললেন,,
“ভয় পাওয়ার দরকার নেই।তমাকে আমি কিছু করব না।শুধু ওর মাথার ব্রেনটা ওয়াশ করব আজকে।দয়া করে আমাকে আমার কাজটা করতে দাও।এখানে ভিড় না করে তোমরা বাসায় যাও আর আন্টি আমার উপর ভরসা রাখ। তোমার ছেলে যা করছে তোমার আর তোমার মেয়ের ভালোর জন্যই করছে এই বলে খুব জোরে দরজাটা আটকিয়ে দিল।
.
.
এমনিতে আজকে যা ঘটল, এরপর সাদা জামায় রক্ত লাগায় তমার মাথাটা ঘুরছে। এরউপর উনার এত রাগ দেখে তমার এখন জান যায় যায় অবস্থা?
“তমা,,দাঁড়িয়ে না থেকে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে আস?”
আহাদের এতটা শান্ত কণ্ঠ শুনে ওর হাত পা রীতিমতন কাঁপতে লাগল।এটা যে ঝড়ের আগের পূর্বাবাস ও তা ভালোভাবে বুঝতে পারছে।তাড়াতাড়ি করে ও ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসল।
আহাদ তমাকে বিছানায় বসার ইঙ্গিত করল।ও চুপচাপ আহাদের ইঙ্গিত পালন করে বিছানায় বসল।
আহাদ ওর হাতটা তমার দিকে এগিয়ে দিল।তমা বুঝতে পারল ওকে এখন কি করতে হবে।
“তমা!”
“জ্বী….. “কাঁপা গলায়।
“আজকে যে ছেলেটা তোমার হাত ধরে টানাটানি করছিল তোমার কি খুব ভালো লেগেছিল?”
“মানে,,আপনি পাগলের মতন কি বলছেন এসব?” আহাদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে তমা কথাটা বলে ওর হাতের কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করতে লাগল।
“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তোমার থেকে খুব ভালো লেগেছিল তাইতো ও যখন তোমার হাত ধরে টানাটানি করছিল তুমি কিছু করলে না?”
“আমি কি করতাম ওই মূহুর্তে। ওই শয়তানটার শক্তির সাথে পেরে উঠা আমার পক্ষে কিভাবে সম্ভব? ”
“তাই নাকি?অসম্ভবও তো কিছু ছিল না।তোমার বিপদে যে মেয়েটা তোমাকে সাহায্য করতে এসেছিল সে কিভাবে ওই বখাটে ছেলেটাকে মেরেছ দেখেছ একবারো?”
“…….”
“ওই মেয়েটা তোমার সমবয়সী। তোমার বিপদ দেখে ও কিভাবে এগিয়ে এসে ওই ছেলেটাকে মারল।ওর সাহস ছিল বলে কাজটা করতে পেরেছে। বিপদে পড়লে প্রথমে নিজেকে নিজে সাহায্য করতে হয়।একটা ছেলে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার হাত ধরে টানাটানি করবে আর তুমি কিছু না করে বেক্কলের মতন কান্নাকাটি করবে কেন? অন্যায় করছে ও আর কান্নাকাটি করবে তুমি!?ওই শয়তানটা যখনি তোমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছিল তখন ওর মেইন জায়গায় জোরে একটা লাথি মারতে পারলা না?এতটুকু কাজ তুমি নিজেকে সাহায্য করার জন্য করতে পারলা না।”
চুপচাপ বসে উনার কথা শুনছি আর উনার কাটা জায়গা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি ইতিমধ্যে। ভয়ে উনার চোখের দিকে তাকাতে পারছি না।বুঝতে পারলাম এইজন্য উনি এত রেগে ছিলেন।
আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লাম।
“আমি আসলে বুঝতে পারি নি তখন কি করতে হবে?নিজেকে তখন খুব অসহায় লাগছিল তাই কিছু ভাবতে না পেরে……….. “জোরে জোরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম।
এর কিছু মূহুর্তের পর উনি আমাকে টান দিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলেন।আমার দুই হাত উনার হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,,,
“এই সাহস নিয়ে তুমি তোমার মামণিকে ছেড়ে আমাকে ছেড়ে রাজশাহীতে গিয়ে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলে?এই সাহস নিয়ে!তুমি ৫ টা মাস মাস ওইখানে ছিল।তোমার মামণি,আমি, আমরা সবাই এই টেনশন করতাম তোমাকে নিয়ে। তুমি একা একলা একটা মেয়ে ওতদূর বান্ধবীর বাসায় থেকে কিভাবে পড়াশুনা করবে?কত রকমের বিপদ যে কোন সময় হয়ে যেতে পারে।তাই আমরা তোমাকে সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য নিষেধ করেছিলাম। এই আজকে এখানে যা কিছু হল না তা যদি ওইখানে হয়ে যেত তখন…..তখন কি করতে?কিভাবে নিজেকে তুমি বাঁচাতে।আজ আমি ছিলাম বলে হয়ত তোমাকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনটাকে তুচ্ছ করতে আমার হাত পা কাঁপে নি ওইখানে তোমার সাথে এমন কিছু হয়ে গেলে কে তোমাকে বাঁচাতে আসতো।
আজ আন্টির এই যে অসুস্থ অবস্থা দেখছ না সব তোমার কারণে হয়েছে।বেচারি অনেক টেনশনে থাকত তোমাকে নিয়ে।মায়ের মন বলে কথা….কত কিছুই না চিন্তা না করত আর তুমি…….”
“………”
“আজকের পর থেকে যদি তুমি আমার অনুমতি ব্যতিত কোন কাজ কর তাহলে তোমার কি অবস্থা করব আমি নিজেও জানি না।এখন থেকে আমি যা যা বলব, যা যা করতে বলব ঠিক তাই করবে।”
তমা মাথাটা নাড়িয়ে আহাদের কথায় সম্মতি জানালো।
“আর আজকের পর থেকে বাইরে গেলে বোরকা পড়ে যাবা, মুখে নেকাব বাঁধবা।”
তমা আবারো মাথাটা নাড়ালো।
এবার আহাদের হুশ হল।ও দেখল তমার চোখ থেকে পানি পড়ছে।তমারও যে হাত কেটেছে তা আহাদ এতক্ষণে খেয়াল করেনি।বুঝতে পারলো ওর কাটা জায়গায় আহাদ আরো জোরে চাপ দিয়ে ধরায় তমার ব্যথা করছে।
তমাকে ছেড়ে আহাদ তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ল।
“সরি,,, বুঝতে পারে নি এতটা ব্যথা পেয়েছ।আমি আন্টিকে ডেকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি।”
আবার ফিরে এসে আহাদ তমাকে জড়িয়ে ধরল।
আজকে যা হয়েছে সব ভুলে যাও। মনে কর ওইটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল।ওই বাজে স্মৃতি আর মনে করবে না।আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমাকে সবসময় পাবে। কখনো তোমাকে আমি একা ছাড়বো না।কিন্তু যদি কখনো আমি তোমার সঙ্গ দিতে না পারি তাহলে তুমি নিজেকে নিজে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবে।মরার আগ পর্যন্ত হার মানবে না।আর আল্লাহর কাছে এই দুয়া করি আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সবসময় তোমার হাত দুটি ধরে যাতে একসাথে চলতে পারি সেই তওফিক উনি আমাকে দান করুক।
……
এরপর তমার কপাল আর চোখ দুটোয় চুমো দিয়ে আহাদ চলে গেল।