স্যার যখন  স্বামী পার্ট_৬

0
5361

স্যার যখন  স্বামী
পার্ট_৬
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস

“মেঘ তুমি পাগল হয়ে গেছ,,তুমি নিজে কি বলছ সেটাই ভালোভাবে জানো না।তোমার সাথে কথা বললে এখন শুধু ঝগড়া হবেই।আজকের দিনে আমি এইসব করতে চাচ্ছি না।যাও চুপচাপ ঘুমাও গিয়ে।কালকে আমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে। ”
“কিন্তু…”(মিনমিনে সুরে)
“দেখ আমি খুব ক্লান্ত,, ঘুমাব।”
……
“কি ব্যাপার এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“বলছি আপনি কি খাটে ঘুমাবেন?”
“হ্যা, কেন?”
“না,, কিছু না ঠিক আছে তাহলে আমি খাটে আর আপনি সোফায় ঘুমান,, থুক্কু আমি সোফাতে আর আপনি খাটে ঘুমান।”
“কেন?সোফাতে কেন?”
“তো কোথায় ঘুমাব?”
“কেন খাটে।”
“আপনি না খাটে ঘুমাবেন তাহলে,,”
“তাহলে কি হয়ছে?আমরা দুইজনেই খাটে ঘুমাবো।আর কথা পেচায়ো না প্লিজ,, খাটে এসে ঘুমিয়ে যাও।”
(কি খারাপ কপাল তোর মেঘ,, শেষ পর্যন্ত তোকে এই রাক্ষসটার সাথে ঘুমাতে হবে)…..,,
“এখনো দাঁড়িয়ে আছে তুমি,,বুঝছি, তোমাকে এখন ভালোভাবে বলছি তাই কাজ হচ্ছে না।ওয়েট,,”
“আরে,,,,নামান,, নামান,,”
“চুপ “(ধমক দিয়ে)
অতঃপর আর কি চুপিই থাকলাম।আমাকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
“এবার ঘুম যাও,,, আর কোন কথা বলবা না।”
….
“কিছুক্ষণ পর মেঘ,,”
……
“কি ব্যাপার কথা বলছ না যে? দেখ আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না,,,তারপরও বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হচ্ছে,,এতদূরে গিয়ে ঘুমালে দেখা যাবে তুমি ঘুমের ঘুরে খাট থেকে পড়ে গেছ।তাই আরেকটু কাছে এসে ঘুমাও।”
“না,,আমি ঠিক আছি এইখানে।”
“না ঠিক নেই,,,যে মেয়ে ভার্সিটিতে হাঁটতে গিয়ে দিনে কমপক্ষে ১০ বার আছাড় খেয়ে পড়ে তাকে বিশ্বাস নেই।এখন তুমি খাট থেকে পড়ে গেলে ব্যথা পাবে,,তারপর তোমাকে নিয়ে আমার মেডিকেলে দৌড়াতে হবে।আমার কোন ছুটিও নেই। তাই আমি আজাইরা কাজে কোন রিস্ক নিতে চাই না। কাছে আসো।”
“আচ্ছা,,,”(কি আর করার উনার কাছে আসতে হল,,,নাহলে ধমক খাবো এখন)
“এটা কাছে আসা হল,,,এখনো রিস্ক আছে এইখান থেকেও পড়ে যেতে পারো।তোমাকে দিয়ে হবে না।এই বলে নিজে আমার কাছে এসে আমার মাথাটা তার বুকে রাখলেন।আর কথা বলবে না।ঘুমিয়ে পড়। ”
“আমিও আর কথা বাড়ালাম না,,জানি বলে লাভ নাই।তাই বাধ্য হয়েই স্যার যা বলল তাই মেনে নিলাম। শুধু একটাই চিন্তা আগেতো শুধু ক্লাসে বকা খেতাম আর এখন বাসা আর ক্লাস দুই জায়গায় বকা,,,,বকা আর বকা,,এইদিনও দেখা আমার বাকি ছিল “(ভিতরে ভিতরে কেঁদে)
.
.
পরেরদিন সকালে জানালা দিয়ে সূর্যের আলো আমার মুখে পড়ে আমার এতসুন্দর ঘুমটা নষ্ট করে দিল। আরে মা,,এত সকালে কেন জানালার পর্দাটা খুলছ।জানলায় পর্দা দিয়ে দাও।
“এখন সকাল ৮:০০টা বাজে মেঘ।উঠো তাড়াতাড়ি।”
“না,, আরেকটু ঘুমাবো,,যাও এখান থেকে।”
এরপরে আমার হাতের আঙ্গুলটা গরম কফিতে ঢুকিয়ে দিল।আর আমি চিল্লিয়ে উঠলাম মা পাগল হয়ে গেছ কি করছ?কথা বলতে বলতে দেখি এটা মা না স্যার। উনি খাটে বসে আছেন।
“এখানে স্যার কেমন করে এল? আপনি এখানে কি করে?”
“মানে,, কি বলছ,, আমার বেডরুম আমার বাসায় আমি থাকব নাতো কে থাকবে?”
“আপনার বাসা!!চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম,,হ্যা তো এটাতো আমার বেডরুম না। এখানের কোন কিছু চিনা মনে হচ্ছে না। এটা যদি স্যারের বাসা হয় তাহলে আমি এখানে কেন? এরপরেই মনে পড়ে গেল কালকে স্যারের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে যারকারণে আমি এইখানে।হঠাৎ করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়াগায় আসায় এরকম হয়েছে।আমার এই ধরণের ব্যবহারের জন্য খুব লজ্জাই পড়ে গেলাম। কি করব মাথায় আসছে না,,,”
“গুড মর্নিং,,মেঘ,,”
“গুড মর্নিং স্যার,,”
“দিলেতো সকালে মুডটা খারাপ করে,,দেখ আমি তোমার হাজবেন্ড হয়,,স্যার নয়,,প্লিজ এই স্যার,, স্যার কথাটা বলা বন্ধ কর,, বিরক্ত লাগে।আর আরেকটা কথা,মেঘ আগের মতন চললেতো আর হবে না। আজকে অনেক ঘুমিয়েছ কারণ কালকে তুমি অনেক ক্লান্ত ছিলে এইজন্য আমি তোমাকে এতক্ষণ ধরে ঘুম থেকে ডাকি নি।সকাল ৮:০০টা বাজে এক্ষণো তোমার ঘুম শেষ হয় নাই।আবার বলছ আরেকটু ঘুমাবো।এখন থেকে এত ঘুমানোর আরাম আমি হারাম করে দিব।কালকে সকাল সকাল ঘুম থেকে তোমাকে উঠতে হবে বুঝেছ।”
“হুম।”(মন খারাপ করে)
“টেবিল থেকে কফির কাপ তুলে আমাকে দিলেন,”
……..
“দেখ চুপ করে বসে থাকলে হবে না,,,আমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে,,, আমারতো আর ছুটি নেই।তাড়াতাড়ি চা টা শেষ করে ফ্রেস হয়ে খাওয়ার টেবিলে আস।একসাথে নাস্তা করব।”
“আচ্ছা।”
.
.
নাস্তার টেবিলে গিয়ে দেখি টেবিলে সুন্দর করে খাবার সাজানো হয়েছে। স্যার ছেলে হয়েই নাস্তা বানাতে পারে কিন্তু আমি!!?আমিতো কিছুই পারি না।বিয়ের আগে রান্নাঘরে আমি ভয়েও যেতাম না।একবার খুব শখ করে মাছ ভাজতে গিয়েছিলাম।মাছ ভাজতে গিয়ে তেলের ছিটা হাতে এসে পড়েছিল।এরপর থেকে ভয়েও রান্নাতো দূরের কথা আমাকে দিয়ে মা কোন রান্না করাতে পারেনি।খুব বেশি জোর করলে কান্নাকাটি করে ভরিয়ে দিতাম।এইসব কথা ভাবতে গিয়ে হাসি পাচ্ছে আবার মা বাবার কথাও খুব মনে পড়ছে।
“মেঘ বস,,”
“জ্বী,,”
“ওত দূরের চেয়ারে গিয়ে বসছ কেন?আমার পাশের চেয়ারটাতে বস।”
“না,,না,,”(মনে পড়ে গেল ধমকের কথা)
“না না মানে,,”
“আমি না না কই বলছি,, বলছি হ্যা হ্যা হ্যা,,,”
“আরেরে,, এত হ্যা হ্যা হ্যা করছ কেন বস,,”(ধমক দিয়ে)
“বসছি।”
“এই নাও,,গাজরের হালুয়া,,তোমার ফেভারিট খাবার,,”
“আপনি কেমন করে জানেন এটা আমার ফেভারিট খাবার,,,”
“কথা ঘুরিয়ে,,নাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
“আপনার না তাড়া আছে।আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে গেলে আপনার দেরি হয়ে যাবে।”
“তোমাকে ১-২ চামচ খাইয়ে দিলে কোন দেরি হবে না।নাও হা কর।”
(কালকে খাওয়া নিয়ে যে অবস্থা হল আবার ও যদি কিছু বলতে চাই তাহলে সাতসকালে আবারও বকা খাব।বকা খাওয়ার চেয়ে স্যারের হাত থেকে খেয়ে নিয় সেই ভালো।)
“আরে,,বাহ,,আজকে কিছু না বলে আমার হাত থেকে খাচ্ছ।ভেরি গুড গার্ল।আমার সাথে থাকতে থাকতে আরও good হয়ে যাবে (হেসে)।মেঘ বললে না তো কেমন হয়েছে আমার হাতের রান্না,,”
“হেসে,,,হুম ভালো।”
“শুধুই ভালো,,,”
(মনে মনে তো আর কি বলব,,ভালো হয়েছে তাই ভালো বলেছি।এর সাথে কি আরও কিছু কথা মিক্সড করতে হবে নাকি?) “ভাবনায় পড়ে গেলাম,,আর কি বলবো,,ভালো কথার সাথে আর কি কি প্রশংসনীয় কথা লাগাতে হবে,,”
“আচ্ছা থাক,,ভাবতে হবে না আর,,খাও,,,”
…….
“মেঘ এত ধীরে ধীরে খাচ্ছ কেন?তাড়াতাড়ি নাস্তা খাওয়া শেষ কর।”
…..(আরে,,,এত তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করার কি আছে,,আস্তে ধীরে শেষ করলে কি হয়,,আমার তো তাড়া নেই,,,তাড়া তো উনার।)
“ভাবা শেষ,,,”
“হ্যা,,(চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে),,,কিছু বলছেন,,,”
“কাকে কি বলি,,বলছি ভাবাচিন্তা শেষ হয়ে গেলে বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে আসেন দয়া করে।”
“না,, না,,, ভাবছি নাতো,,এই যে খাচ্ছি দেখেন,,দেখেন,,,”
“হুম দেখছি অনেক,,,আর দেখতে পারবো না এখন,,, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।মেঘ শুনো,,তুমিতো ঘরের কোন কাজ পারনা”
(এ্যা,,,ডাইরেক্টলি অপমান)…..
“দেখ,,, আমি আগে থেকে সেটা জানি,,,রান্না করতে পারো না,,, সেটা সমস্যা না,,তোমাকে রান্না শিখানোর মানুষ আজকে এসে যাবে,,,আর তোমার জন্য আজকে একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি সারপ্রাইজ?”
“সেটা সময় হলে দেখতে পারবে।”
….
“আর শুনো বাসায় একা থাকবে,, তাই বরিং ফিল হতে পারে,,তাই সময় কাটানোর জন্য আজকে ম্যাথ বইয়ের দ্বিতীয় চ্যাপ্টারের ম্যাথগুলো দেখে রাখবে।এটা সময় কাটানোর জন্য করলে করতে পার নাহলে নাই।কিন্তু আজকে বাসা এসেই যাতে দেখি দ্বিতীয় চ্যাপ্টারের ম্যাথগুলো তোমার শেষ।”
(এটা কেমন স্যাররে….একদিন যেতে না যেতে পড়া শুরু করে দিছে)…..
“এই যে ম্যাডাম পড়া পড়লে আজাইরা ভাবনা মাথায় আসবে না,,,সারাদিন শুধু ভাবনার তলেই থাকেন। আজকে পড়া যদি না পার তাহলে তোমার খবর আছে সেটা জেনে রাখ।আচ্ছা আসি,,তাহলে,,,ভাল থেকো,, আমার গালে দুই হাত দিয়ে উনি কথাটা বললেন।”
“জ্বী,,ঠিক আছে,,,”
“ও সরি একটা জিনিস করতে ভুলে গেছি,,,”
“কি জিনিস,,,,”
“আমার কপালে ভালবাসার পরশ দিয়ে বলল,,,এই জিনিসটা,,,আচ্ছা আসি তাহলে,,”
“হুম,,,”(ওনার এই ধরণের ব্যবহারে আমি একেবারে আক্কেলগুড়ুম। লোকটার মাথায় নিশ্চয় সমস্যা আছে,,,হবে বা না কেন সারাদিনই ম্যাথ নিয়ে থাকে। এই ধরণের ম্যাথ করা স্যারগুলো কখন যে কি করে বসে কিছুই বুঝা যায় না।)
.
.
পুরো বাড়িতে আমি একা একলা একটা মানুষ। ভালো লাগছে না।পড়াশুনা জিনিসটার প্রতি আমার ছোটকাল থেকে এলার্জি।আগেতো মা বাবা আমাকে ঠেলেঠুলে পড়িয়ে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।ভেবেছিলাম বিয়ে করে আর পড়াশুনা করব না,,এই বিরক্তিকর জিনিস থেকে রেহাই পাব। কিন্তু এখন যা দেখছি তাতে তো মনে হচ্ছে আমার পড়ালেখা জীবনেও শেষ হবে না। উনি যদি প্রতিদিন ম্যাথ করায় আর ম্যাথ করতে দেয় তাহলে আমি শেষ। এই ম্যাথ জিনিসটা আমার চিরকালের শত্রু।ভেবেছিলাম অন্য সাবজেক্ট নিয়ে পড়ব,,, কিন্তু কথায় আছে না ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন।আমার ফাটাপোড়া কপালে এই সাবজেক্ট এসে পড়েছে তাই বাধ্য হয়েই কোনরকম পড়তে হচ্ছে। এই ম্যাথ করতে করতে আমি শেষ হয়ে যাব আজকে থেকে। আল্লাহ আমাকে তুমি বাঁচায়ো। এখন এই ভয়ানক সাবজেক্ট পড়ার কথা ভেবে ভয় লাগছে।না,, এখন না,,,ম্যাথ বই পরে ধরব,,এখন আপাতত আমার লাগেজ থেকে কাপড়গুলো নামিয়ে গুছিয়ে রাখি।
লাকেজ থেকে কাপড়গুলো নামাতে গিয়ে হঠাৎ করে আমার লাকেজ থেকে সাগরের একটা ছবি পেলাম।বিয়ের আগের দিন আমি নিজেই এই ছবিটা সযত্নে লাকেজে রেখে দিয়েছিলাম।কিন্তু আজকে এই ছবিটা পেয়ে আমি কিছুক্ষণের জন্য আমার আর সাগরের সেই দিনগুলোর স্মৃতিতে ফিরে গেলাম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে