স্যার যখন স্বামী
পার্ট_৫
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস
অবশেষে কয়েকঘন্টার লং জার্নির পর স্যারের বাসায় আসলাম।ইতিমধ্যে বাসাটাও সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলা হয়েছে।আমি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি।স্যার আমার এই দৃষ্টির মানে বুঝলেন।তিনি নিজের থেকেই বলতে লাগলেন,আসলে এখানে আসার আগে পাশের বাসার প্রতিবেশীকে বলে রেখেছি যাতে তারা সুন্দর করে বাসাটাকে সাজিয়ে রাখে। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি এইসব করার মানেটা কি?সুন্দর করে বাসাটাকে সাজিয়ে উনি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছে আমাদের যে বিয়েটা হয়েছে সেটা স্বাভাবিক বিয়ে।আমি এই বিয়ে মানি না,শুধু নিজের আর পরিবারের মানসম্মান বাঁচানোর জন্য আমি উনাকে বিয়ে করেছি।এই বিষয় নিয়ে আজকেই উনাকে কিছু বলতেই হবে,,সম্পর্কটা বেশিদূর গড়াক তা আমি চাইনা। সাগরের কাছ থেকে যেভাবে আমি প্রতারিত হয়েছি আর কোন ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারব না।
“মেঘ কি ভাবছ? কতক্ষণ ধরে ডাকছি।”
“হ্যা…”
“বলছি রুমে যাবে চল।”
“হ্যা…,রুমে গিয়ে দেখি বিছানাটা সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানাটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে কেন?”
“দেখ আমি এইসবের কিছু জানি না।আমিতো শুধু বাসাটা ফুল দিয়ে সাজাতে বলেছি কিন্তু এরা এতকিছু করবে সেটা আমার জানা ছিল না। প্লিজ কিছু মনে কর না।আচ্ছা তুমি বরং ফ্রেস হয়ে এসো।সারাদিন তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে।”
“জ্বী…আচ্ছা,,”
“তুমি যাও আমি একটু পর আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আরে,,এইখানেইই আছি,,,ভয় পাওয়ার দরকার নেই।যাও,,”
.
.
উনার আলমারি খুলতে গিয়ে দেখি আলমারির অর্ধেক অংশ জুড়ে মেয়েদের কাপড় রাখা আছে। সেখানে শাড়ীসহ থ্রিপীস রাখা আছে।ওনিতো ব্যাচেলর থাকেন তাহলে ওনার আলমারিতে মেয়েদের কাপড় কেন?তারমানে ওনি কাউকে পছন্দ করতেন।তার জন্য আলমারি ভর্তি মেয়েদের কাপড় কিনে এনে তা সাজিয়েছেন।আমিই ওনার আর ওনার পছন্দ করা মেয়ের মাঝখানে এসে পড়েছি।আমার জন্যই ওনি সমস্যায় ফেসে গেলেন। নিজের থেকেই খারাপ লাগছে। আমার জন্য এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এখন আমিই এই সমস্যার সমাধান করে দিব। শাড়ী বাদ দিয়ে হাল্কা বেগুনী রঙের থ্রিপীচ পড়ে নিলাম। বাসার পাশে খুব সুন্দর একটা বারান্দা আছে।দেখলাম সেখানে অনেকগুলে টব ভর্তি ফুলের গাছ। এইগুলোতো সব আমার পছন্দের ফুলের গাছ। বারান্দার পাশে দোলনা ঝোলানো আছে। বাইরে থেকে খুব সুন্দর বাতাস বইছে। বারান্দা পাশে ফুলের টব,আর এই ঝোলানো দোলনা দেখে আমার সাগরের কথা আবার মনে পড়ে গেল।সাগরকেও আমি বলেছিলাম আমরা যে রুমে থাকবো সে রুমটার বারান্দাতে যেন আমার পছন্দের ফুলগুলো লাগানো হয়,আর সেখানে যাতে একটা দোলনা ঝোলানো থাকে যেন অবসর সময়ে আমরা সেই দোলনাতে বসে আমাদের সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো,জমে থাকা কথাগুলো একে অপরকে বলে সময় কাটাতে পারি। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
.
.
“এই যে মিস সরি মিসেস,,”
“হ্যা…”
“আচ্ছা মেঘ তোমার কি কোন রোগ আছে? ”
“নাতো…স্যার…কেন কি হয়েছে,,হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করলেন?”
“এই যে মেয়ে শোন একতো আমি এখন থেকে তোমার স্যার না,,তোমার হাজবেন্ড। তাই আমাকে আর কখনো স্যার বলে ডাকবে না। আর দ্বিতীয়ত তোমার বয়সতো এত বেশি না তাহলে কথা বলতে বলতে বা একলা থাকলে তুমি কিসব ফালতো কথা ভেবে কোথায় জানি হারিয়ে যাও,অনেকবার ডাকার পরও তোমার কোন হুশ থাকে না,,তাহলে এটাতো একটা রোগের মধ্যে পড়ে তাই নয় কি?”
….
“শোন মেঘ এইসব ফালতো চিন্তা ভাবা প্লিজ বাদ দিয়ে দাও।যেসব কথা ভাবলে তোমার কষ্ট হয় অযথা সেসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানেটা কি আমাকে সেটা বলতে পারো।এখন থেকে এইসব ফালতু কথা ভাববে না আর,সামনে তোমার অনেক রঙিন দিন আসবে,তাকে বরণ করে নিয়ে নিজের স্বপ্নগুলোকে পূরণ কর,,অতীতের খারাপ দিনগুলোর কথা ভুলে গিয়ে নিজেকে ভালবাস,,নিজের আপন মানুষ যারা তোমাকে ভালবাসে তাদের জন্য নিজেকে শক্ত কর,,তাদের ভালবাসাকে আপন করে নাও,দেখবে তোমার ভিতরে আর কোন কষ্ট বাসা বাঁধবে না,,তখন নিজেকে পরিপূর্ণ হবে।একটা খারাপ মানুষের জন্য জীবনটা কখনো থেমে থাকে না। জীবন ঠিকই তার গতিতে চলবে। আশা করি আজকের পর থেকে তুমি সাগরের কথা ভেবে আর আনমনা হবে না,অযথা নিজের চোখের জল ফেলবে না।যে তোমাকে বুঝে না শুধু শুধু তার জন্য নিজের চোখের জল ফেলার মানেটা কি?”
আমি কাদঁছি,,আশ্চর্য আর আমি সেটাই টের পেলামনা।গালে হাত দিয়ে দেখি আমার গাল বেয়ে চোখ থেকে নোনা জল পড়ছে আমার অজান্তে।
স্যার এবার আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার চোখের জল মুছে দিলেন। আজকের পর থেকে তোমার চোখ দিয়ে যাতে আর কোন অশ্রু পড়তে না দেখি আমি।এই চোখের জল দেখে আমার খুব কষ্ট হয়।এরপর তিনি আমার মাথাটা এনে তার বুকে রাখলেন।জানি না কেন ওনার বুকে মাথা রেখে কান্নার পরিমাণটা আগের থেকে আরও বেড়ে গেল।ওনি আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন।
“কিছুক্ষণ পর মেঘ,,,”
….
“এই মেঘ,,, ”
“হুম (ফুঁপিয়ে)”
“চল খাবার খাবে…অনেক আগে খাবার গরম করে রেখেছি,,,দেরি করলে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।চল,,”
“এখন কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা, এই প্রথম কোন পুরুষের এত কাছে এলাম।ওনার বুকে এই প্রথম মাথা রেখে কান্নাকাটি করার পর এখন খুব হালকা লাগছে।একটু আগে কোন শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না,,কিন্তু এখন আপনাআপনি আমার মনে শান্তি চলে এসেছে উনার বুকে মাথা রেখে। এই শান্তিটা এখন হারাতে চাচ্ছি না।”
“মেঘ প্লিজ,,চল নাহলে তোমার শরীর খারাপ করবে।”
….
“এরপর উনি উনার বুক থেকে আমার মাথাটা উঠিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিলেন।আর তাতে আমার হুশ এল।”
“আরে কি করছেন..”
“তুমি যে কি অলস মেয়ে,,, এতবার ডেকেই চলেছি অথচ তোমার কোন পাত্তা নেই।এইদিকে খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে কোলে নিলাম।চুপ করে থাক।”
“আরে,,নামান,,আমি হেঁটে যেতে পারবো”(চিল্লিয়ে)
“চিল্লিয়ে লাভ কোন লাভ হবে না,যা করছি করতে দাও,,,”
“কিন্তু….”
“বললাম না চুপ” (ধমক দিয়ে)
….
“এরপর উনি আমাকে বিছানায় বসিয়ে টেবিল থেকে খাবারের প্লেট তুলে নিলেন।মেঘ হা কর..আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।”
“দরকার নেই,আমি খেয়ে নিতে পারবো।”
“হ্যা আমি সেটা জানি,,তুমি নিজ হাতে খেতে পারবে,,,কিন্তু আজকে আমি তোমাকে খাইয়ে দিব। নাও হা কর।”
“বললাম তো এইসবের কিছু লাগবে না,,,”
“এত বকরবকর কর কেন বলত,,,হা করতে বলছি হা কর,,”(ধমক দিয়ে)
“ধমক খেয়ে বাধ্য হয়েই হা করলাম।নিজ হাতেই শেষ পর্যন্ত আমাকে খাইয়ে দিলেন। তাই বলে বকা দিয়ে,,খুব খারাপ উনি,,আবার কান্না পাচ্ছে,,স্যার বলে কিছু বলতে পারছি না,,সইতেও পারছি না,,”
“এখনতো ঠিকই খেলে মেঘ,আমার হাত দিয়ে,,কেন শুধুশুধু বকাটা খেলে,,আসলে তুমি যতক্ষণ না পর্যন্ত বকা খাও ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার শান্তি লাগে না,,বকা খাওয়ার পর ফটাফট কাজটা করে ফেল,,ভাল করে বললে জীবনেও সেটা করবা না।এখন থেকে আমার কথা না শুনলেই এরকম বকা খেতে হবে।
.
.
“ও…আল্লাহ উনি এমন কেন?(কেঁদে),,উনিতো ক্লাসে আমাকে প্রতিদিন পড়ার জন্য যেভাবে বকা দিতেন আজকে ও ঠিক সেইভাবে বকা দিচ্ছে উনার হাতে খাবার না খাওয়ার জন্য।ক্লাসে সবসময় সবার প্রথমে আমাকে দাঁড় করিয়ে পড়া প্রশ্ন করতেন আর না পারলে খুব বকা দিতেন।জানি না কেন আমাকে দিয়েই তিনি প্রশ্ন ধরার কাজটা শুরু করতেন।কেন অন্য স্টুডেন্টকে আগে প্রশ্ন করলে কি দুনিয়াটা উল্টে যেত,,আজকে আবারও ঠিক একিভাবে খাবার খাইয়ে দিতে গিয়ে বকা দিলেন,,মনে হয় যেন খাবার খাওয়াচ্ছেন না,, আমার ক্লাস নিচ্ছেন,,পড়া পাড়ছি না দেখে আমাকে বকা দিচ্ছে।”
“মেঘ,,, ও আল্লাহ এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব,,, কি ভাবছ?”
“হ্যা… হ্যা কিছু বলছেন,,,”
“না বাবু কিছু বলেনি,,,বলছি যে ভাবনার দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আস,,,আর লক্ষ্মী মেয়ের মতন ঘুমিয়ে যাও,,”
“বাবু,,,, আমি এখন ছোট নাই,,,আমি বড় হয়ে গেছি,,”(কেঁদে)
“আচ্ছা,,আচ্ছা তুমি বড় হয়ে গেছ প্লিজ এখন ঘুমিয়ে যাও,,”(আদুরে কণ্ঠে)
“হুম,,”
.
.
“উনি সবকিছু গুছিয়ে এলেন।রুমে এসে,,মেঘ এখনো ঘুমাও নি।”
“না।”
“কেন?”
“কিছু কথা ছিল,,”
“এখন কোন কথা না,,ঘুমিয়ে যাও।কালকে বলিও”
প্লিজ খুব সিরিয়াস কথা,,”
“বললাম না যা বলার কালকে বলবে,,,
(মন খারাপ করে),,আপনি খুব খারাপ স্যার,, আমাকে শুধু বকা দেন”(কেঁদে)
“এই কি স্যার..কখন থেকেই স্যার কথাটা বলা লাগিয়ে রাখছ হ্যা..আমাকে স্যার ডাকতে নিষেধ করছি না?হয় আমাকে তুমি বলে ডাকবা,,নাহলে আমার নাম ধরে।একটু আগে তোমাকে আমি কি বলছি,,বলছি না আর কাঁদবা না তাহলে আবার কাঁদছ কেন?”
…
“আচ্ছা বল কি বলবে?”(শান্ত হয়ে)
“আপনি আমাকে ডির্ভোস দিচ্ছেন কবে?”
“মানে? মেঘ তুমি ঠিক আছোতো”
“হ্যা আমি ঠিক আছি”
“আমার কাছে এসে,,আমার হাত শক্ত করে ধরে,,না তুমি ঠিক নেই।কিচ্ছু ঠিক নেই।ঠিক থাকলে এইসব কথা বলার মানেটা কি?ডির্ভোস দেওয়ার জন্য আমি তোমাকে বিয়ে করেছি?”(চিল্লিয়ে)
“স্যার,,”
“আবারও..স্যার”
“…মানে স্যার বলছি যে…”
“আমার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে,,”
“ওনি যেভাবে আমার হাত ধরে আছেন,,হাতে খুব ব্যাথা পাচ্ছিলাম,,আবারও আগের থেকে বেশি পানি চোখ দিয়ে নেমে পড়ছে।আমার চোখের পানি দেখে ওনার হুশ আসলো।হাত ছেড়ে দিলেন।”
“মেঘ ঘুমাও গিয়ে যাও,,
“না,,ঘুমাবো না,,আগে বলেন,ডির্ভোসটা কবে দিচ্ছেন?”
“মেঘ তুমি বারবার একি কথা কেন টেনে আনছো?”ডির্ভোসের কথা এখন কেন আসছে।”
“কারণ আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক ছিলনা,,তাছাড়া যেখানে ভালবাসা নেই,শুধুশুধু মিথ্যা ভালবাসার নাটক করে শুধু বিয়ের দোহাই দিয়ে সংসার করলে সে সংসার টিকে থাকতে পারে না।আমি সাগরকে বিশ্বাস করে ভালবেসে ঠকেছি আর দ্বিতীয়বার আমি নিজের সাথে এইভুল হতে দিবো না।”
“মেঘ,তুমি সাগরের সাথে আমার তুলনা করছ?”
“স্যার,আমি,”
“আবারও স্যার,”
“আসলে,,আমি কারও সাথে কারও তুলনা করছি না,আমি বলছি আর কাউকে আমি বিশ্বাস করতে আর ভালবাসতে পারবোনা,,আর আপনাকেতো নাই,,কারণ আমি আপনাকে স্যারের চোখে দেখি।তাছাড়া আমি জেনে গেছি,,”
….
“(স্যারের দিকে তাকিয়ে) আপনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন।আমার জন্য আপনি তাকে বিয়ে করতে পারেন নি।আমি আপনাদের দুজনের মাঝখানে এসে পড়েছি।”