স্যার যখন স্বামী
পার্ট_২৮
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস
এর কিছুদিন পর মেয়েটাকে দেখার জন্য ওদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ দেখলাম ওই মেয়েটা ওর বান্ধবীদের নিয়ে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।রহস্যটা কি দেখার জন্য আমি লুকিয়ে ওদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।ওর বান্ধবীরা জোরে জোরে চিল্লিয়ে বলছে এই আসছে আসছে মার মার।বলতে দেরি নেই সেই মেয়েটা খুব জোরে ইট দিয়ে সেই গাছে ঢিল মারে।এরপর তাড়াতাড়ি করে সব বান্ধবীরা মিলে দিলো দৌড়।আমি এদের দৌড়ানোর রহস্যটা তখনো বুঝলাম না।হঠাৎ দেখি একঝাক মৌমাছি বিদ্যুৎগতিতে আমার দিকে তেড়ে আসছে।আর এদিকে আমি রহস্য উদঘাটন করলাম যে সেই গাছে মৌমাছির মৌচাক ছিলো যা আমার মতন গর্দভের চোখে তা পড়ে নি।আর তখন পড়লেও আমার করার কিছু ছিল না ততক্ষণে মৌমাছি আমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল।রাগে যে আমার কি করতে ইচ্ছা করছিলো,তখন তা বলে বুঝাতে পারবো না।
.
.
এর কিছুক্ষণ পর ওই মেয়েটাকে অনেক কষ্টে খুঁজে পেলাম।ও তো আমাকে দেখে রীতিমতন চিল্লিয়ে উঠলো।আসলে মৌমাছির কামড় খেয়ে আমার চেহেরা তখন সেরকম দেখার মতন হয়েছিলো যেই দেখবে সেই ভয়ে দৌড় দিবে।
আমি কোন কথা না বলে মেয়েটার দুই গাল আর হাতে কামড় বসিয়ে দিলাম।মেয়েটাতো এবারও আগের মতন করে ভ্যা ভ্যা করে কান্না জুড়িয়ে দিলো।
“ভাইয়া আপনি আমাকে কামড় দিলেন কেন?”
“ন্যাকা মনে হয় যেন জানো না।আমার মুখের এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী। তাই হিসাব বরাবর করলাম।আজকে এই কান্ডটা কেন করলে?”
“ওই ছেলেটাকে ওইদিন শায়েস্তা করতে পারেনি।ও আজকে ক্লাসে আমাকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি করছে।আপনি আমাকে ধরে কালকে যে কথা শুনিয়েছেন ও সব শুনছে।এরপর ক্লাসের সবাইকে তা বলে বেড়িয়েছে।তাই আজকে ওর জন্য এত সুন্দর একটা প্ল্যান করলাম।আর আজকেও আপনি সেদিনের মতন আমার ফাঁদ দেওয়া গর্তে পা দিলেন।”
“কি!আজকেও ওই নির্দোষ ছেলের জন্য ফাঁদ পেতেছিলে?”
“কি নির্দোষ না ছাই।হুহ।ও আমার এত সুন্দর চুলের দুই বেনী নিয়ে সারাদিন টানাটানি করে,ফাজলামি করে,আমাকে বোকা বানাই,গণিতের জন্য স্যারের হাতে মার খাওয়াই আর ওরে আমি ছাইড়া দিমু।Never ওরে তো আমি পরে দেকখা নিমু।তার আগে আপনি কন তো আপনার কি অন্যের সব ব্যাপারে মাঝখান দিয়ে ঢুকখা যাওয়ার অভ্যাস আছে নি।আপনি আজকেও কেন ওই ছেলেটার মাঝখান দিয়ে ঢুকখা গেলেন।আর দেখেন আমার গাল আর হাতের অবস্থা কি করছেন।কামড় দিয়ে লাল বানিয়ে দিছেন।আপনি খুব খারাপ।খুব খারাপ।আপনারে আমি দেখখা নিমু”
“তো দেখো না কে নিষেধ করছে তোমাকে।তোমার সামনেই আছি। ভালো করে দেখো নাও।আর ভাষার কি ছিরি।শুদ্ধ করে কথা বলতে পারো না।কালকে তো কি সুন্দর করে কথা বলছ।”
“এএএ….আমার প্ল্যানের ১২ টা বাজাইয়া,আমারে কামড় দিয়া আবার কন শুদ্ধ করে কথা কইতে।কইতাম না।আপ্নারে আমি দেখখাই নিমু।”
“তো দেখো না।প্লিজ দেখো দেখো।”
“হুহ।”(মুখ ভেংচিয়ে) দৌড় দিয়ে চলে গেল। পাগলি একটা।
ইতিমধ্যে আমি মেয়েটাকে নিজের অজান্তে ভালবেসে ফেলেছি।আসলে মা যা বা যাকে পছন্দ করে আমিও তাকে পছন্দ করি।মায়ের মুখে মেয়েটার প্রশংসা শুনেই মেয়েটার প্রতি আমার প্রথমে ভাললাগা কাজ করে।এরপর ওকে দেখে,ওর এই ছেলেমানুষিগুলো দেখে আস্তে আস্তে এই পিচ্চিকে আমি ভালবেসে ফেলি।অবশ্য ওর এই ছেলেমানুষীর জন্য আমাকেও অনেক পস্তাতে হয়।তারপরও ওকে আমি ভালবাসি।ওর ভালো-মন্দ সবকিছুকে আমি ভালবাসি।(মুচকি হেসে)
.
.
এরপরের ঘটনায় আসি,
ভাবলাম ছিঁচকাঁদুনী মেয়েটাকে একটু দেখে আসি।বিকালে ও বান্ধবী আর বাচ্চাদের সাথে মাঠে ক্রিকেট খেলছিল।দূর থেকে ওর ব্যাট করা দেখছিলাম।ভালোই ব্যাটিং করে।ভালো ব্যাটিং করে বলে এত জোরে ছক্কা মারার কি দরকার ছিল।ওর এই এত জোরে ছক্কা মারার কারণে বলটা একেবারে আমার মুখে এসে পড়ল।বল আর কাউকে দেখলো না, দেখেশুনে একেবারে আমার কাছে এসে আমার এই অতিসুন্দর মুখখানার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল।আমার সুন্দর চেহেরায় কারোর হয়ত বদনজর পড়ছে এই জন্য বারবার আমার মুখের উপরই শুধু অত্যাচার হচ্ছিল।এবার আর রাগ কন্ট্রোল হল না।মেয়েটার হাত ধরে জোর করে ওকে টেনে নিয়ে পুকুর পাড়ে নিয়ে আসলাম।
.
.
“এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি?এত জোরে ছক্কা মেরে দেখো আমার মুখের অবস্থা কি করছ?ফাজিল মেয়ে।”
“ওমা এতে আমার দোষটা কোথায়?(অবাক হয়ে)বল ছুটে আপনার মুখে পড়লে আমি কি করতে পারি?”
“বেয়াদব মেয়ে।বড়দের মুখে মুখে তর্ক কর।এভাবে ছক্কা মারলে মানুুষের মুখে বল এসে পড়তে পারে সেই বুদ্ধিটুকুও নাই।চোখ কোথায় নিয়ে রাখ?সামনে যে মানুষ আছে তা কি দেখো না।বুঝেশুনে ব্যাট করা উচিত।আর এই মেয়ে সারাদিন টইটই করে যে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াও দেখো তো মুখের অবস্থা কি হয়েছে।এইরকম পেত্নী,পাগলির মতন সারাদিন না ঘুরে ভালোকরে সেজেগুজে চলতে তো পারো।এইরকম পাগলির মতন থাকলে এই বদঅভ্যাস কোনদিনও পরিবর্তন হবে না।পরে বড় হলে কেউ তোমাকে ভয়েও বিয়ে করবে না।”
“কিহ আমি পেত্নী,পাগলি।”
“হুম তাইতো বললাম। কেন কানে কম শুনো নাকি।”
“হুম আমি কানে কম শুনি।আমি কম শুনলে কি হয়ছে কিন্তু আশেপাশের মানুষতো বেশি শুনবে।”
“মানে।”
“বুঝাচ্ছি।এই পাগল,পাগল।আল্লাহ বাঁচাও আমাকে।আমাকে এই পাগল হাত ধরে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।সবাই দেখে যাও। কে কোথায় আছো তাড়াতাড়ি লাঠি নিয়ে আসো।”
.
.
ওর এই কথা শুনে আমি তো পুরা তাজ্জব। এত তাড়াতাড়ি এই ঘটনা ঘটেছে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।মেয়েটা আমাকে পাগল বলে ডাকল।তাও আবার জোরে জোরে চিল্লিয়ে বলছে আমি নাকি ওকে ধরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম এলাকার ছেলেমেয়ে বড়রা সবাই এই মেয়ের চিৎকার শুনে লাঠি নিয়ে হাজির।মেয়েটাকে আর শায়েস্তা করতে পারলাম না।একে শায়েস্তা করতে গিয়ে এখন নিজের জান যায় যায় অবস্থা।তাড়াতাড়ি করে ওকে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলাম।আল্লাহ সেবারের যাত্রায় বাঁচিয়েছিলো নাহলে গ্রামবাসীর লাঠির বাড়ি সেদিন আমার গায়ে পড়লে আমি নিশ্চিত এক্কেবারে পটল তুলতাম।
.
.
এতকিছুর পরও কেন জানি ওকে ভাল লাগত।ভালবাসতে ইচ্ছে করত।কিন্তু এই মেয়ে তো অনেক পিচ্চি।এই ভালবাসা অনুভব করার অনুভূতি এখনো ওকে স্পর্শ করে নি।তাই ওকে আমার ভালবাসার কথা না জানানোই ভালো। মেয়েটা আরেকটু বড় আর বোঝদার হোক আর আমিও ততদিনে ভালো একটা চাকরি যোগার করি।দেখতে দেখতে সময় পাড় হয়ে যাবে।আর এরপরেই ওকে আমি আমার মনের কথাটা জানিয়ে দিবো। ও আমার মায়ের জন্য যা করেছে, যেভাবে আমার মনকে ছুঁয়েছে সেভাবে আমার এই মনটাকে কেউ ভালবাসার রং এ কেউ রাঙ্গাতে পারবে না।তাই এই পিচ্চির জন্য নিজের অনুভূতিটুকু লুকিয়ে রাখতে হবে।আর ওকে একটু মানুষ করতে হবে তাহলেই হবে।ইশ এই মেয়েটাকে যদি নিজে পড়াতে পাড়তাম তাহলে পড়াশুনায় ও আর অমনোযোগী হতে পারতো না,যদি ওকে নিজের কাছে রেখে দিতাম তাহলে আমার মার আর ধমকে একদম মানুষ হয়ে যেত।আমার এই স্বপ্ন কি পূরণ হতে পারেনা?যদি পূরণ হত ওকে আমি আমার নিজের মতন করে গড়ে নিতাম।
মেয়েটাকে শুধু সকালে দেখে মনটা ভরে না,তাই তার বাড়ির দিকে আবার রওনা দিলাম।আর সেদিনি কলার খোসার সাথে পা পিছলিয়ে আমি পড়ে গেলাম।
.
.
“আরে মেঘ কয় যাও এই বলে ওর হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে আনলাম।”
“আমি তোমার গল্প শুনবো না।”
“তাই বলে চুপি চুপি আমাকে একা ফেলে চলে যাবে।আমি এখন গল্প করার মুডে আছি। চলে গেলে কেমনে হবে।এই বলে ওকে আমার কাছে টেনে এনে বসালাম।”
“হ্যা কি জানি বলছিলাম, ও মনে পড়েছে এরপর শুনো,”
এরপরে ওকে আমি এই কান্ডের জন্য কান ধরে উঠ বস করিয়েছি।বেচারির মুখের অবস্থা দেখার মতন ছিলো।
এরপরের দিন বিকালে মেয়েটা যে আমাদের বাসায় এসেছিলো সেটা আমি জানতাম না।বিকালে পুকুরে গোসল করছিলাম।মেয়েটা হঠাৎ করে আমার সামনে হাজির হয়ে ফিক করে হেসে দিল।সে হাসি দেখেই আমি ফিদা।আর এই সুযোগে ফাজিল মেয়েটা আমার কাপড় চোপড় নিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে চলে আসছে।ভাবলাম আমি এর প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বো।
.
.
কিন্তু সেই প্রতিশোধ আর নেওয়া হল না।পর দিন সকালে ও আমাদের বাসায় আসলো না।ব্যাপারটা কেমন জানি লাগলো।মার কাছে জিজ্ঞাস করতেও লজ্জা লাগছিলো।তাই মাকে কিছু বললাম না।কিন্তু দুপুর পর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না।ওর কথা বলা,দুষ্টুমি খুব মিস করছিলাম।আর থাকতে না পেরে ওর বাড়ির দিকে রওনা দেয়।ওকে দেখলাম না।ওর বাসায় গিয়ে দেখি ওদের ঘর তালামারা।এটা দেখে মনে হচ্ছিল আমি আর নেই।আমার মূল্যবান জিনিস আমার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম ওরা ঢাকায় চলে গেছে।এত কষ্ট হচ্ছিল আমার বলে বুঝাতে পারবো না।একটাবারও কি আমাকে বলে যেতে পারতো না।কিন্তু পরে মনে হল ও তো আমাকে চিনেই না।শুধু আমার মাকে চিনে।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।বাসায় এসে দেখি আমার মা টা আর আগের মতন তেমন প্রাণবন্ত নেই।আগে যে হাসিটা মুখে লেগে থাকত সেই হাসিটা আর নেই।হয়ত উনার গল্প করার সখী এখন উনার কাছে নেই তাই।আমার পক্ষেও আর বাসায় থাকা সম্ভব হলো না।এখানে থাকলে ওর দুষ্টুমির স্মৃতিগুলো ভেবে আরও কষ্ট পাবো।তাই ঢাকায় চলে আসলাম।আর আমার সেই ভালবাসার মানুষটাকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
.
.
এরপর প্রায় ৫টা বছর কেটে গেল।এই ৫ বছরে আমি অনেকের সাথে মিশিছি। পড়ালেখার জন্য ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও আমার ফ্রেন্ড ছিল।এদের মধ্যে অনেকের কাছে প্রপোজালও পেয়েছিলাম।ভেবেছিলাম এদের মধ্যে যে কারোর প্রপোজাল একসেপ্ট করে আমি নতুন করে লাইফটাকে সাজাবো।ওর চিন্তা করে আর নিজেকে কষ্ট দিবো না।ওর সাথে আমার একদিন দেখা হবে সে আত্মবিশ্বাস আমার মনে ছিল কিন্ত সেই ৫ বছরে ওকে না পেয়ে আমার ভিতরে যে একাকীত্ব ঘিরে ধরল তা খুব কষ্টকর ছিল।কিন্ত ফ্রেন্ডলি অবস্থায় এদের কারো মাঝে আমি ওকে অনুভব করে নি।কিছু একটা ওদের মাঝে ছিল না যার জন্য আমার মন ব্যাকুল ছিল।পড়ে বুঝলাম এই ভাবে হবে না মন থেকে একবার যাকে ভালবাসা হয় তাকে ছাড়া অন্য কারোর কাছে ভালবাসার মানুষের সেই তীব্র অনুভূতি খুঁজে নেওয়া চরম বোকামি।৫বছর ধরে যেহেতু ওর জন্য অপেক্ষা করেছি আল্লাহ চাইলে সারাজীবনও ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারবো।শুধু নিজের ইমোশন,আবেগটা কন্ট্রোলে রাখতে হবে।নাহলে এই অপেক্ষা করার বাধ ভেঙ্গে যাব