স্যার যখন স্বামী
পার্ট_২৫
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস
কাজি যখন বিয়েতে আমার নাম নিলো তখন মনে হল এই বুঝি সব গেল।কিন্তু না তেমন কিছু হয়নি।তারমানে উনি সব সামলে নিয়েছেন আগে থেকে।যাক বাঁচা গেল।অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেল উনার সাথে।অনেক খুশি লাগছে।যাকে চেয়েছি তাকেই সারাজীবনের জন্য আপন করে নিলাম।
“এইযে এইবার বড় করে রাখা ঘোমটা খুলতে পারেন।”
আরে এটাতো তাসপিয়ার গলা।
“তু….তু…..তুই……”
“হ্যা আমি।”
“আরে এখানে তো সবাইকে দেখছি।আমার মা বাবা, আমার ডিপার্টমেন্টের ক্লাসমেটরা সবাই এখানে।প্রিয়া ম্যাডামও এসেছেন।উনাকে দেখেতো আমার চোখ দুটি ছানাপোড়া হওয়ার মত কারণ ওনি বউয়ের বেশে নয় মেহমান হিসেবে এসেছেন।কিন্তু উনার চোখে কোন রাগ নেই।বিয়ের কনেতো উনার হওয়ার কথা ছিলো উনার জায়গা বদলে আমি বিয়ে করেছি।কিন্ত উনি আমাকে দেখে রাগলেন না উল্টো মুচকি মুচকি হাসছেন।যেন কিছুই হয়নি মনে হল তন্ময় স্যারের সাথেই আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো।কি হচ্ছে এইসব।”
.
.
“কিরে কেমন দিলাম।”
“মানে…….”
“গাধী এখনো বুঝিস নি,,”
“সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।কি হচ্ছে এইসব।
মা,বাবাতো দেখি শাশুড়িমার সাথে কথায় ব্যস্ত।ওরা এখানে কিভাবে?”
“তাসপিয়া তুমি যাও,মেঘের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”(প্রিয়া)
“কি হচ্ছে এগুলো।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“আমি বলছি।আমি তন্ময়ের ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ড সেটাতো এতক্ষণে ওর কাছ থেকে শুনে নিয়েছে।আমি ওকে আগে অনেক পছন্দ করতাম।পছন্দ থেকে ভালবাসা।আর এরপরেই ওকে প্রপোজ করে বসি।কিন্তু ও তা রিজেক্ট করে দেয়।এর কারণ জানতে চাইলে ও প্রায়ি বলত ও অন্য আরেকটা মেয়েকে ভালবাসে।তাই অন্য কাউকে ভালবাসা ওর পক্ষে সম্ভব না।আমি অনেকবার ওর কাছ থেকে সেই মেয়েটার নাম জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওর কাছ থেকে কোনদিন সেই মেয়েটার নাম জানতে পারেনি।এর কিছুদিন পরেই জানতে পারি তন্ময়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড আমাকে ভালবাসে।একবার একজনকে ভালবেসে ঢের শিক্ষা হয়েছে তাই এই ভালবাসায় আর মন দেয়নি।এরপরেই তন্ময় ঢাকা ভার্সিটিতে শিক্ষকতা পদে ঢুকে আর এরপর আমি।একি ডিপার্টমেন্টে আমরা জয়েন্ট করি।পুরানো ফ্রেন্ডকে খুঁজে পেয়ে ভালোইই কাটত দিন।এরপর ওর থেকে আমি শুনতে পারি আমার সেই ফ্রেন্ড আমাকে এখনও ভালবাসে।ও আচ্ছা ওর নামটাতো তোমাকে বলিনি।ওর নাম রাফি।এরপর প্রায়ি তন্ময় আমাকে বিভিন্ন বাহানায় ঘুরতে নিয়ে যেত আর সেখানে রাফি এসে উপস্থিত হত।বুঝতাম ওর আসল উদ্দেশ্য রাফির সাথে আমাকে দেখা করানো। এরপর বিভিন্নভাবে রাফির সাথে আমার প্রায় দেখা হত তন্ময়ের মাধ্যমে।রাফির সাথে মিশতে মিশতে বুঝতাম ও আমাকে আসলেই ভালবাসে।এর মধ্যে আমিও ওকে একটু একটু ভালবেসে ফেলেছি।ভার্সিটিতে রাফিকে নিয়ে আমরা কথা বলতাম।রাফির কি পছন্দ না পছন্দ ওর সম্পর্কে সব খোঁজখবর আমি তন্ময়ের থেকে নিতাম।আর এইজন্যই তন্ময়ের সাথে আমার কথাবার্তাটা বেশি হত।এর মাঝে যে তন্ময় তোমাকে বিয়ে করেছে সেটা আমাকে জানায়নি।এর কিছুদিন পর আমার একটা জরুরি কাজ থাকে।কোন রিক্সাও খুঁজে পাচ্ছিলাম।তাই সেদিন তন্ময়ের গাড়িতে লিফট নিই আমি।এরপর রাফির সাথে আমার সামান্য একটা বিষয় নিয়ে খুব ঝগড়া হয়।অবশ্য এতে আমারও কিছু দোষ ছিল।রাফি আমার উপর অনেক রাগ করার কারণে কয়েকদিন ধরে আমার সাথে দেখা বা কথা বলে নি।এ কয়েকটা দিন যে আমার কিভাবে কেটেছে তা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবোনা।কিভাবে ওর রাগ ভাঙ্গাবো তা বুঝতে পারছিলাম না।তাই তন্ময়ের কাছে যাই। ও আমার মনটা ভালো করার জন্য আমাকে পার্কে নিয়ে যায়।কিন্তু মনটা ভালো ছিলো না তাই অনবরত কান্না করেই যাচ্ছিলাম। তাই আমার হাত ধরে ও আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে কিছুই হবে না সব ঠিক হয়ে যাবে।সেদিন যে সাগর আমাদের পিছু নিয়েছিল তা আমরা জানতাম না।এ সামান্য ঘটনার ছবি তুলে সাগর তোমাকে সেই ছবি পাঠিয়ে তোমাকে উল্টাপাল্টা কথা বুঝিয়ে তোমার মনে আমাদের সম্পর্কে খারাপ কথা ঢুকিয়েছে।আর সেই ছবি দেখে তুমি তা বিশ্বাস করে নিলে তন্ময় আর আমার মধ্যে কিছু চলছে।আর সেদিন রেস্টুরেন্টের সেই ঘটনা দেখে বুঝলাম তোমরা দুইজন স্বামী-স্ত্রী।আর তন্ময়ের সেই পছন্দের মেয়েটাই তুমি।তুমি কোন কিছু ভালোভাবে না জেনেশুনে যে পদক্ষেপ নিয়েছ তার জন্য তন্ময়কে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে।তন্ময় তোমার সাজানো নাটকটা পরে বুঝতে পেরে তোমাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলো।কিন্তু তোমার অতিরিক্ত জিদ আর ওকে কষ্ট দেওয়ার কারণে সেও মনে মনে ঠিক করে তোমাকেও এর থেকেও বেশি কষ্ট দিবে।তাই ও আর আমি মিলে মিথ্যা নাটক করে তোমাকে ইমোশনালভাবে কষ্ট দেওয়ার প্ল্যান করি।আর এরপরের কথাতো তুমিই জানো। ”
“I am extremely sorry না জানি আপনার সম্পর্কে কি না কি ভেবেছি আমি।প্লিজ ম্যাডাম পারলে আমাকে মাফ করে দিবেন।”
“না না Its ok. তোমার জায়গায় আমি থাকলে আমি নিজেও অনেক খারাপ কিছু ভাবতাম।যাই হোক তোমার বিবাহিত জীবন সুখের হোক সেই দুয়া করি আমি।God bless u.”
.
.
এরপর একে একে সবার থেকে জানতে পারলাম আজকে তন্ময়ের সাথে যে আমার বিয়ে সেটা আমি বাদে বাকি সবাই জানে।মা বাবা,আমার শাশুড়ি মাও জানে।এই কাজটা উনি মোটেও ঠিক করেননি।আমি আমার এই ভুলের জন্য কতনা কষ্ট পেয়েছি এরপর এই বিয়ে নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারিনি অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো।কিন্তু উনি……। আমাকেই যদি বিয়ে করবেন তাহলে কেন এই মিথ্যা অভিনয় করলেন।মানছি আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য উনি এইসব করেছেন তাই বলে এত্ত কষ্ট দিবেন তা ভাবতে পারে নি।
উনার সাথে বিয়ে হওয়াতে মনে মনে খুশি হলেও এখন খুব রাগ হচ্ছে।আজ রাতে উনাকে মজা দেখাবো।
.
.
“সাব্বির দাঁড়াও।”
“স্যার, আপনার বিবাহিত জীবন সুখের হোক।”
“ধন্যবাদ।আর সেইদিনের সেই সাহায্যের জন্যও তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।তুমি যদি সেদিন পেনড্রাইভটা না পাঠাতে তাহলে ওকে আমার লাইফ থেকে হারিয়ে ফেলতাম।Many many thanks.”
“স্যার কিসের পেনড্রাইভ!আমি কোন….”
“Oh plz, সাব্বির মিথ্যা বলা লাগবে না।আমি সব জানি।”
……
“ভাবছো কিভাবে জেনে গেলাম।তাহলে শুনো পেনড্রাইভের সাথে একটা চিঠিও দিয়েছিলে তুমি।তোমার লেখার সাইজ দেখে বুঝে গেছি এই চিঠির মালিক কে?এত সুন্দর লেখা তুমি ছাড়া আর কে লিখবে?হ্যান্ডরাইটিং দেখেই বুঝি গেছি এই কারবার কে করেছে?”
“বুঝে গেলেন তাহলে।অনেক চেষ্টা করেছিলাম লিখা সুন্দর করার জন্য কিন্তু কিছুতেই হয় না।কয়েকটা ফ্রেন্ডকেও বলছিলাম সুন্দর করে চিঠিটা লিখে দিতে।কিন্তু আমার সব ফ্রেন্ডেরই হাতের লিখা একি রকম মানে বাজে…।ওদেরও ইগো বলে একটা কথা আছে।তাই নিজেদের এই সুন্দর হাতের লিখা দিয়ে চিঠি লিখতে অপারগতা জানাই।তাছাড়া আমার হাতে সময়ও বেশি ছিলো না তাই নিজের হাতে লিখা চিঠি আর পেনড্রাইভটা লোক দিয়ে সকালে আপনার বাসায় পাঠিয়ে দিই।”
“হুম বুঝলাম।আচ্ছা একটা কথা বলোতো তুমি এইসব কেন করতে গেলে?সত্য কথায় বলবে এই আশাই রাখছি।”
“স্যার কথাটা শুনতে আপনার থেকে খারাপ লাগলেও বলছি একসময় আমি মেঘকে অনেক ভালবাসতাম।প্রায় ২মাসের মতন ও ক্লাসে আসে নি।এই নিয়ে আমার মনে কি পরিমাণ অশান্তি হচ্ছিল আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না।বিশ্বাস করুন আমি তখন জানতাম না যে এর মধ্যে ওর বিয়েও হয়ে গেছে।এরকিছুদিন পর মেঘ আর তাসপিয়ার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়।একদিন মেঘ আমাকে পার্কে এনে জানায় তাসপিয়া নাকি আমাকে ভালবাসে।এই কথা শুনে আমি আর নিজের ভালবাসার কথা ওকে জানাতে পারেনি। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি আপনার সাথে মেঘের কোন সম্পর্ক আছে।পরে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি আপনারা দুইজন স্বামী -স্ত্রী। মেঘ সুখে থাকুক সেটাই সবসময় চেয়ে এসেছি।তাই নিজের ভালবাসার কথা নিজের মনে চেপে রেখেছি।তাসপিয়ার কথাটাও ভেবে দেখলাম।ও আসলেই একটা ভালো মেয়ে।ওর সাথে মিশে বুঝলাম আমি লাইফ পার্টনার হিসেবে যেমন মেয়ে চাই তাসপিয়াও ঠিক তেমন মেয়ে।পরে ওকে আমি ভালবাসতে শুরু করি।মেঘের কারণেই আমি তাসপিয়াকে আমার লাইফে পেয়েছি।এইজন্য আমি সারাজীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। কিছুদিন পর আমি মেঘের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ করি।বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঠিক নেই।মনের মধ্যে সন্দেহ তৈরী হল।একদিন ওকে আর তাসপিয়াকে আমি লুকিয়ে কথা বলতে দেখি।মেঘ সেদিন খুব কান্না করছিলো।আমার সন্দেহ তখন আরো গাঢ় হয়।তাই তখনি ঠিক করলাম আমাকে কিছু একটা করতে হবে।পরে আমি ওদের কথোপকথন ভিডিও করি। এরপর মেঘের পিছু নেই।সেখানে ওকে আমি একজনের সাথে কথা বলতে দেখি।তারও ভিডিও করলাম।এরপরের দিন সকালে আমি সেই ভিডিওর পেনড্রাইভ আর চিঠি আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম।”
“মেঘের বন্ধু হিসেবে যা করলে তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।”
“বন্ধু হিসেবে এইটা আমার কর্তব্য ছিল।”(মুচকি হেসে)
.
.
অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। আর উনার আসার নাম নাই।রাগ ক্রমশই বাড়ছে।
“উহুম উহুম”
“আপনি,,এত দেরি করে আসছেন কেন?জানেন কতক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
“আচ্ছা তাই নাকি?তা ম্যাডাম আপনার বুঝি তশ সইছিলো না কখন আপনার কাছে আসবো কখন আপনাকে আদর…..”
“ওয়েট ওয়েট,, আপনিতো দেখি অনেক ফাস্ট।এইসব ফালতো চিন্তা মাথায়ও আনবেন না।আর বলুনতো এইসব নাটকের মানে কি?আমাকেই যদি বিয়ে করবেন তাহলে এতদিন ধরে আমাকে এত কষ্ট দিলেন কেন?জানেন কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিলো আমার।”
“জানিতো।আর জেনেশুনেই আমি তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছি।আমাকে যে এত কষ্ট দিলে তার বেলায়।”
“আমি আমার ভুলের জন্য আপনাকে সরি বলছি।কিন্তু আপনিও এইরকম কাজ করে ঠিক করেননি। আমাকেও সরি বলুন।”