স্যার যখন স্বামী
পার্ট_১৫
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস
ক্লাস শেষ করে একমুহূর্তও এদিক ওদিক না তাকিয়ে হাঁটা দিলাম।
“মেঘ গাড়িতে উঠ”
….
“কথা কানে যাচ্ছে না”
….
“মেঘ শেষবারের মতন বলছি গাড়িতে উঠ।নাহলে কিন্তু এই পাব্লিক প্লেসে তোমাকে কোলে করে গাড়িতে উঠাবো”
বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠলাম।নাহলে আজকে ক্লাসে যে অপমান করল তাতে গাড়িতে উঠার কোন ইচ্ছায় নেই।একটাও কথা বলেনি উনার সাথে।রাগ কি উনার একার আছে আমার নেই।
বাসায় এসে অনেক্ষণ কাঁদলাম।কেঁদে মনটা হালকা করলাম।আজকে সামান্য একটা সংজ্ঞা পারেনি বলে এত অপমান।আজকে থেকে ভালো করে ম্যাথ করবো।আগেও উনি এমন করত কিন্তু আমার গায়ে উনার এই কড়া কথাগুলো ততটা লাগতোনা।কিন্তু এখনতো আমি উনার স্ত্রী হই।আপন মানুষকে ক্লাসের সবার সামনে এত অপমান।এইবার ম্যাথে ভালো রেজাল্ট করে উনাকে দেখিয়ে দিবো। কারোর সাহায্য আমার দরকার নেই হুম।আমি একাই একশ।
.
.
রাতে রাগ করে খায়নি।আর উনিও খাবারের প্লেট নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন অনেক্ষণ ধরে।আগে না খেলে জোর করে খাইয়ে দিতেন কিন্তু আজকে তেমন কিছু করছেন না।হয়ত বুঝেছেন উনারও কোথাও না কোথাও ভুল ছিল।
অনেক্ষণ খাবারের প্লেট নিয়ে ঘুরাঘুরির পর আমার সামনে আসলেন।
“মেঘ খেয়ে নাও”
“আমি খাবো না”
“আমার কথায় রাগ করেছ”
“না,আমি কারোর কথায় রাগ করিনা।আমি একমাত্র আমার আপন মানুষগুলোর উপর রাগ করি”
“তার মানে আমি তোমার আপন কেউ না?”
“হ্যা”
“বললেই হলো,তুমি আমার কেউ না হুম।এত টাকা দেনমোহর দিয়ে তোমাকে বিয়ে করছি এই ফালতু কথা শুনার জন্য।আচ্ছা আর রাগ করে থাকা লাগবেনা।আমি খাইয়ে দিচ্ছি”
“না”
“খাবারের উপর রাগ করে লাভ নেই।উল্টো নিজেরেই ক্ষতি হয়।আর তোমাকে কি আমি ইচ্ছা করে বকা দিয়েছি।ক্লাসে আমাকে স্যার বলছ কেন?আর বললাম না ক্লাস থেকে পড়া নিয়ে নিতে। পড়া নাও নি কেন?”
“আপনাকে ক্লাসে স্যার বলে ডাকবো নাতো কি বলে ডাকব।আর ওইদিন আমি ১ম ক্লাস ভালোভাবে না করে চলে আসছি।আপনাকে ওইদিন এই কথা বলে চলে আসতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আপনাকে ব্যস্ত দেখলাম(হুহ প্রিয়া ম্যাডামের সাথে কথা বলছিলো তাই রাগে কিছু না বলে চলে আসছি এই কথাটা আর বলিনি)।আমার কাছে কোন মোবাইলও নেই যে এই কথাটা আপনাকে জানাবো।কিন্তু আপনি আমার কোন কথা না শুনে ওইদিন কত কথা শুনালেন আর আজকে কত্তগুলো বকা দিলেন”
.
.
“ও এই ব্যাপার।ওই সময় অনেক রাগ উঠে গিয়েছিল তাই এত বকা দিয়েছি।কিন্তু তোমারও দোষ আছে”
“আবারও আমার দোষ ধরে”
“আমার রাগ ঠাণ্ডা হওয়ার পর আমাকে এই কথাগুলো কেন বলোনি।ওইদিন যদি আমাকে এই কথাগুলো বলে ফেলতে তাহলে আজকে এতকিছু হত না।নাও এখন খেয়ে নাও।এখন খেলে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিবো”
“সত্যি”
“হুম”
“খেলাম এবার আমার সারপ্রাইজটা দেন”
“চোখ অফ করো।এই নাও তোমার সারপ্রাইজ”
“লাভ লকেট”
“হুম অনেক আগে এনেছিলাম কিন্তু তোমাকে দিতে পারেনি।আজকে দিলাম।এখানে তোমার আর আমার ছবি আছে।যখনি মন খারাপ থাকবে এই লকেট খুলে আমাদের ছবি দেখে নিতে পারবে।তোমার পছন্দ হয়েছে”
“হুম খুব খুব পছন্দ হয়েছে”
.
.
বউ দেখি তোমার গালটা,খুব লেগেছে না!এই বলে আমার ডান গালটা ছুঁয়ে দিলেন।
আসলে ওইদিন উনার রাগ এতই ছিল যে রাগের বশে খুব জোরে ডানগালে থাপ্পড়টা মেরেছিলেন।আয়নাতে গিয়ে দেখি পুরো পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে।হ্যা ব্যথাতো গালে বেশি পেয়েছিলাম কিন্তু তার চেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছিলাম উনার সেদিনের কড়া কথায়।উনার বকাতে আমি অভ্যস্ত কিন্তু এইরকম কড়া বকা আর রাগ সেদিন প্রথম দেখলাম।খুব কষ্টও পেয়েছিলাম উনার কথায়।সকালে থাপ্পড় মারা গালটা চুল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম যাতে আঙ্গুলের ছাপগুলো উনার নজরে না পড়ে।
উনি আমার আরও কাছে এসে আমার সে গালে অজস্র চুমো দিলেন।জানি না এটা কি এমন মলম ছিল মূহুর্তের মধ্যে আমার সব কষ্ট,ব্যথা দূর হয়ে গেল।তারপর ড্রয়ার থেকে একটা মলম এনে আমার গালে লাগিয়ে দিলেন।
.
.
সকালে উনার সাথে ভার্সিটিতে গেলাম।ক্লাসে গিয়ে শুনি তন্ময় স্যার আমাদের ক্লাস আর নিচ্ছেন না।আমাদের ডিপার্টমেন্টে অন্য ক্লাসে ক্লাস করাবেন কিন্তু আমাদের ক্লাস নিবেন না।উনার বদলে আরেকজন টিচার আমাদের ম্যাথ ক্লাস নিবেন।মেয়েরাতো সবাই হতাশ,আর আমাদের ক্লাসে আরেকটা ঢঙী আছে এতো না পারে পুরা কেঁদে দিতে।মেয়েরা সবাই বলাবলি করছে স্যার এমনটা কেন করলেন।আমারও একি প্রশ্ন উনি এই কাজটা কেন করলেন?আমার জন্য কি উনি এই ব্যবস্থা নিয়েছেন।যদি এরকম হয় তাহলে তা নিজের থেকেও খারাপ লাগবে।
.
.
“কিরে তাসপিয়া তোর মন কোনদিকে?এত উদাসীন লাগছে কেন?”
“আমি মনে হয় পড়ে গেছি”
“কি?মানে”(অবাক হয়ে)
“আমি মনে হয় প্রেমে পড়ে গেছি”
“কি তুই!তা সে ভাগ্যবান ছেলেটা কে?”
“(লজ্জিত হয়ে)আমাদের ক্লাসের ছেলে”
“নাম কি?”
“সাব্বির”
“কি তুই সাব্বিরের প্রেমে?কখন,কেমন করে হল?”
“তোর বিয়ের জন্য যখন থেকে তুই ক্লাসে আসা অফ করে দিয়েছিস এর কয়েকদিন পর ও নিজেই আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে আসে।ও তোর সম্পর্কে আমাকে অনেককিছু জিজ্ঞাস করত।তুই আসিস না কেন,কোন সমস্যা হয়েছে কিনা।আমাকে তুই তোর বিয়ে হওয়ার কথাটা ক্লাসের কাউকে জানাতে নিষেধ করেছিলি তাই ওকে সত্যি কথাটা বলেনি।বলেছি কয়েকদিনের মধ্যে তুই চলে আসবি।ওর সাথে আস্তে আস্তে মিশতে মিশতে ওকে আমার ভালো লেগে যায়।আর এরপর মায়া।আর এই মায়া থেকেই ধীরে ধীরে ওর জন্য আমার ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে”
“কি বললি?মায়া!মায়া থেকে ভালবাসা জন্মায়”
“হুম গাধী।কেন তুই সাগর ভাইয়াকে যখন ভালবাসতি তখন তোর উনার সবকিছুর প্রতি মায়া জন্মায়নি”
“না ওর প্রতিতো আমার কখনো মায়া জন্মায়নি।শুধু ক্ষণিকের মায়া কাজ করেছিলো ওর প্রতি।ওকে ভালবাসি এই কথাটা শুধু আমার মুখের কথায় সীমাবদ্ধ ছিলো।”ভালবাসি”শুধু মুখের এই কথাটা একে অপরকে বলতাম।স্যারের জন্য আমার যে মায়া জন্মেছে তার থেকে সাগরের প্রতি আমার এই মায়া অনেক দুর্বল।তাইতো সাগরকে এত সহজে ভুলতে পেরেছি।সাগরকে ভালবাসি এই কথাটা মুখ দিয়ে বলতে বলতে তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।কিন্তু ওকে যে ভালবাসতাম সেই ভালবাসার অনুভূতিটা ততটা অনুভব করতাম না।ক্ষণিকের যে মায়া ছিল সেটাও আস্তে আস্তে লোপ পেয়েছে।এখন সাগর নামটা আমার কাছে অপরিচিত লাগে।এই নামের মানুষকে কোন একসময় মুখে বলা “ভালবাসি”কথাটা বলে ভালবেসেছিলাম তা এখন আর মনে পড়ে না।ওর জন্য এখন আমার মনে কোন অনুভূতিই কাজ করে না।কিন্তু উনার জন্য,উনার জন্য খুব প্রখাঢ় এক অনুভূতি আমার মনে কাজ করে।উনার কথা,উনার স্পর্শ,উনার সবকিছুতে মায়া কাজ করে।তারমানে আমি উনাকে…।
না চাইতেও ওনাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি।মনকে কত বুঝালাম আর কাউকে ভালবাসবো না কিন্তু এই মন কোন কথা শুনলোনা।না না করা সত্ত্বেও এই মন ঠিকই আমার অজান্তে একজনকে ভালবেসে ফেলেছে।শেষ পর্যন্ত উনার প্রেমে পড়ে গেলাম।
.
.
ক্লাস শেষে,ভার্সিটি গেইটে,
“কি ব্যাপার অনেক্ষণ ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।কোথায় ছিলে এতক্ষণ ধরে?”
“তাসপিয়ার সাথে ছিলাম”
“ও, আচ্ছা,কি ব্যাপার মেঘ আমার দিকে ওমন করে কি দেখছ!”
“কিছু না”
উনার মুখ দেখে বুঝার চেষ্টা করছি আমি উনার প্রতি যা অনুভব করি উনিও কি আমাকে ঠিক একিভাবে অনুভব করেন।
“আচ্ছা আপনি নাকি আমাদের ক্লাস আর নিচ্ছেন না?”
“হ্যা”
“কারণটা কি জানতে পারি?”
“সত্য বলবো নাকি মিথ্যা”
“অবশ্যই সত্যিটাই বলবেন”
সাথে সাথে উনি জোরে গাড়ির ব্রেক কষলেন
“মেঘ তুমি কি আসলেই বুঝনা নাকি বুঝতে চাওনা”
“মা মা..মানে”
অনেকক্ষণ ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন।কি মায়া এই চোখে।বেশিক্ষণ উনার চোখে তাকিয়ে থাকলে উনি আবার খারাপ মনে করবেন তাই তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম।
মেঘ তোমার জন্য এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।আর তোমাদের ক্লাস নিবো না।কারণ তোমাকে কোন কিছু জিজ্ঞাস করার জন্য দাঁড় করালে তুমি স্যার নামে আমাকে সম্বোধন কর।আর এই জিনিসটা আমার খুব খারাপ লাগে।আগে বাসায় ডাকতে। তোমাকে অনেক বুঝানোর পর তুমি আর আমাকে স্যার বলো না।বাসায় আপনি করে ডাক।কিন্তু ভার্সিটিতে এসে যদি তোমাদের ক্লাস নিতে গিয়ে আমাকে তোমার কাছ থেকে আবার স্যার ডাক শুনতে হয় সেটা আমার নিজের থেকেই খারাপ লাগবে।তোমার থেকে যখন স্যার ডাকটা শুনি তখন মনে হয় আমি তোমার আপন কেউ না।
.
.
দেখো ইচ্ছে করলে আমি বিয়ের পর তোমার উপর আমার অধিকারটা দেখাতে পারতাম।পারতাম নয় কি?ইচ্ছা করলে নিজের অধিকারটা আদায় করে নিতে পারতাম।কিন্তু আমি তা করেনি।কেন করনি জানো?কারণ আমি সবসময়ই চাইতাম আমার স্ত্রী আমাকে আগে মন থেকে ভালবাসোক।আমার কাছে তোমার মনটাই সবচেয়ে মূল্যবান।জোর করে একটা নারীর শরীর পাওয়া গেলেও মনটা পাওয়া যায় না।শরীরের চাহিদা,সুখতো স্বল্পকালীন।সময়ের সাথে সাথে তা নিস্তেজ হয়ে যায়।কিন্তু মনের সম্পর্ক এর সুখের চাহিদা দিনকি দিন বাড়তে থাকে।যদি মনের কোন টান না থাকে,আত্মার কোন সম্পর্ক আমার জীবনসঙ্গীর সাথে তৈরী করতে না পারলাম তাহলে সত্যিই আমার পুরোজীবনটাই বৃথা।এখনকার জন্য,বুড়ো বয়সের জন্য সবসময়ের জন্য আমি একটা নির্ভরশীল হাত চাই যে হাতকে কেন্দ্র করে আমরা একে অপরের জন্য স্বপ্ন দেখব,একজন আরেকজনের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসব।সোনালী দিনগুলো একসাথে দেখার জন্য একে অপরের সাথে থাকব।বিপদের দিনে একে অপরের ছাউনি হিসেবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো।একে অপরকে সাহস যুগাবো।একাকীত্ব দিনগুলো দূর করার জন্য,মনের কথাগুলো কাউকে বলার জন্য,আমার প্রিয়জন,ভালবাসার মানুষের সঙ্গ প্রয়োজন।আর এইসবের জন্য মনের সম্পর্কটা অনেক জোরালো হওয়া লাগে।সুন্দরভাবে সারাটাজীবন যদি এইভাবে কাটাতে চাই এক্ষেত্রে যদি আত্মার আর মনের সম্পর্কটা মূলকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়,একে অবলম্বন করে আমাদের বাকিটা পথ বাঁচতে হয় তাহলে শুধু শরীরের চাহিদাটা কি করে বড় হয়?আমি চাইবো তুমি আমাকে মন থেকে মেনে নিয়ে আমাকে ভালবাসো।শুধু এই দিনটার জন্য আমি এতটা বছর অপেক্ষা করে আছি।আমাকে মন থেকে মানতে হলে আমার নাম ধরে না ডাক অন্তত আমাকে তুমি বলে ডাক।দেখবে আস্তে আস্তে আমাকে তোমার নিজের একটাই অংশই মনে হবে।এই কাজটা করতে পারলে ভাববো তুমি আমাকে পুরোপুরি মেনে নিতে না পারলেও কিছুটা হলেও মেনে নিয়েছ।